পথ চলাচল
এমনই দেখেছি আমি
জলা ক্ষেতে উড়ে গেছে
পরিযায়ী দল
অনেক অনেক নিচে
আগুন আগুন রঙা
পড়ে আছে নক্ষত্রের ফুল,
এমনই দেখেছি আমি
কমলির রাঙা গাই যেন
ছুটে গেছে দিগন্তের দিকে
এমনই উদ্বাস্তু দিনে
সার বেঁধে হেঁটে গেছে দিগ্ বালকেরা।
এমন দীঘল বন ক্ষেতে
গভীর গভীর চাঁদ নেমে আসে ঠিক সন্ধ্যায়
এখানেই কারা যেন স্মৃতি শিলালিপি
রেখে গেছে নদী পাড় বেয়ে
ফেলে যাওয়া জ্যোৎস্নার ধূ ধূ বালুচর
সেখানে তখন শুধু দিগহাস গড়াগড়ি খায়
সমান্তরাল পৃথী জেগে ওঠে
মরুজ্যোৎস্নায়।
এমনই জীবন পার হয়ে
ক্লান্ত চোখ চিনে নেয়
পথ চলাচল।

মেরুদেশে যে কথা হয়নি বলা…
উত্তরের সেইসব আলাস্কা অরণ্য পথে
কুঁচি কুঁচি বরফের স্বাদ,
ক্যারিব্যু হরিণেরা যূথবদ্ধ হেঁটে যায়
অথচ এখানে আজ হলুদ দ্রাক্ষা ক্ষেতে
মিশে আছে পরাগরেণু,
বলা হয়নি যে কথা
এখানের শহরেও, গুঁড়ো গুঁড়ো মেঘে
মাঝে মাঝে নেমে আসে আস্ত বিকেল–
ট্রাফিক সিগন্যালে অনিবার্য সংকেত
চলে যাওয়া খুব সোজা নয়
একথা জেনেও
কিছু লোক হেঁটে গেছে
ধীর পায়ে, কালিন্দীর তীরে
উত্তর মেরুর দেশে বরফের চাঁই
ভাঙছে ভাঙছে
প্রত্যন্ত ঘুমের মাঝে
জাগছে হৃদয়।।

নির্বাক হরিণীর মতো অক্ষরেরা আসে
ঝ’রে যাওয়া বিবর্ণ পাতার গায়ে
জমা হয় যন্ত্রণা নামের ভালোবাসা
সোনালী শিশির হয়ে যে ফুল ফুটেছে আজ
পদচিহ্ন তার
রেখে যেতে যেতে কেউ,
থমকে দাঁড়ায় এসে–
ননীবালা মাটির দাওয়ায়
অলস রোদের মতো
লিখে রাখে
দিনযাপনের কথা,
সন্ধ্যা নামে
গাঁয়ে প্রান্তরে –
অক্ষর সাজাই।
যারা সব হেঁটে গেছে
এইসব পার হ’য়ে
মুহূর্তের সাথে এসে
ভেসে যায়,
গভীর অসুখ থেকে
আবার দাঁড়াই–
মাঝগাঙে বন্ধ খেয়া
পাটাতনে ঝুলে আছে
ছিন্ন সময়।
এসব গল্প সারা হলে
আঁচলে কুড়িয়ে নিয়ে
রুপালি আগুন ঝরা শীত
শঙ্খিনী নদী জেগে ওঠে,
নির্বাক হরিণীর মতো অক্ষরেরা আসে
মাঝরাতে, হৃদয় গভীরে।

ছেঁড়া পৃষ্ঠা
৩ নং বাসস্ট্যান্ডের গায়ে মরা রোদ-
সামনের মাঠজুড়ে
অজস্র নীলকণ্ঠের ডানা অলৌকিক,
টের পাইনি অযাচিত
ট্রাম-রাস্তাটা কখন নদী হয়ে গেল।
সেই রাতে পাতার গভীরে,
শুভ্র করতল, নীল জ্যোৎস্নায় খেলা করে
ভোরের পুটুসফুল ন’টা বারোটা
উদাসী সে ঘুঘুচর
খোলা পৃষ্ঠা।
ফিরে দেখো –
অনাদায়ী ভুর্জপত্র এক
বিষাদ কারুলিপি
গচ্ছিত রাখা আছে
সমুদ্রগর্ভে
বীথিদের জলবারান্দায়
আজও যেন উড়ে যায়
ছেঁড়া পাতা, তীর্যক মেঘে
তরলিত জ্যোৎস্নায় ডুবো তারা যতো
অজস্র নক্ষত্রফুল জেগে জেগে
ফুটে আছে
লুব্ধকের গায়ে
খোদিত সে ইতিহাস
নিরাকার মন–
সুকঠিন আর্দ্রতায়-
শীতার্ত প্রদাহ যেন
বিষাদ মেঘের রাতে অস্ফুট জড়িয়ে ধরে।

জীবন
বহুদিন আগে এক পূর্ণ স্রোতস্বিনী বালিকা
ইউক্যালিপটাস তলায় দাঁড়িয়ে বলেছিল,
একদিন আমি ঠিক শুভ্রশ্বেতা জ্যোৎস্না হবই
দেখে নিও–
তারপর বহুজল কলকল বয়ে গেছে
এইসব কালিন্দীর দুপাড় বেয়ে
অনেক অনেক রাত বুড়ি-বাসন্তী খেলা মেতে
ছুঁয়ে গেছে অরণ্য প্রাচীর
ধবলী গাভীর মতো স্তব্ধ আকাশ
চেয়ে চেয়ে চলে গেছে গাঙের ওপারে
ইছামতি খাবি খাওয়া রাঙা মাছ
মিশে গেছে ধূধূ বালু ধূসর বলয়ে
তবুও শ্যাওলা ধরা ভোরের পাঁচিলে
শিস দেয় দুর্গা টুনটুনি,
এখানে এখন আজ শঙ্খিনী সন্ধ্যার দল
ধীর পায়ে নেমে যায় কালিন্দীর জলে।
ইউক্যালিপটাস তলা
সংলাপে মাতে
কোন আঁধারের সান্দ্র বাতাসে।

লেখক:
জয়শ্রী গাঙ্গুলি, কবি এবং গল্পকার