জাগরণের কবি-বিদ্রোহের কবি নজরুল ইসলাম

Comments

সন্দীপ দে 

“গাহি সাম্যের গান—-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম ক্রীশ্চান !
গাহি সাম্যের গান !”……

ওপরের এই পঙ্ ক্তি ক’টি যেমন কবিকে মানবপ্রেমিক হিসেবে প্রতিভাত করে, তেমনি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে যে চিরন্তন সাম্যের বন্ধন তারই জয়গানে তাঁকে উতল হতে দেখা যায়। তিনি অখণ্ড বাংলার প্রাণের কবি কাজি নজরুল ইসলাম। তিনি একদিকে মানবপ্রেমিক, আবার অন্যদিকে অবশ্যই  বিদ্রোহের কবি।  তাঁর  এই বিদ্রোহী-সত্তা সুস্পষ্টভাবে বাঙ্ময় হয়েছে তাঁরই রচিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। নিবন্ধে সে প্রসঙ্গ উল্লেখ থাকছে নির্দিষ্ট অনুচ্ছেদে।

আরও পড়ুন

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম

আজ সাম্প্রদায়িক হিংসা-জর্জর ও নানা সংকটে দীর্ণ ভারতে, এমনকী গোটা উপ মহাদেশে বিদ্বেষ, সন্ত্রাস, শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার, নিষ্পেষণ, ঘৃণা ও সংঘাতে মানবতা ক্ষতবিক্ষত-বিধ্বস্ত।  অন্ধকারের অশুভ শক্তি নগ্ন উল্লাসে বিক্ষত করছে মানবিক মূল্যবোধ, লাঞ্ছিত করছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারকে, আক্রান্ত হচ্ছে  পরমত সহিষ্ণুতার চিরকালীন আদর্শ। বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির বর্ণময় মালাটিকে ছিন্নভিন্ন করার নানা অপচেষ্টা চলছে। এই চরম বিপর্যয়কর মুহূর্তে আমাদের স্মরণ করতে হয় বিদ্রোহী কবির সেই অনবদ্য সৃষ্টি, যা শুভবোধসম্পন্ন সমস্ত মানবপ্রেমিককে যেন তীব্র কশাঘাত করে—

“অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানেনা সন্তরণ,
কাণ্ডারী ! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি -পণ !
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী ! বলো, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!”
                                 (‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’)

কবির এই সৃষ্টির মধ্য দিয়ে  আজকের এই অবক্ষয়ী দিনেও তাঁর প্রাসঙ্গিকতা বিপুল সমারোহে  উদ্ভাসিত হয়। তিনি অন্ধকার থেকে আলোর অভিমুখে সমগ্র দেশকে পৌঁছে দিতে তাঁর সমস্ত প্রতিভাকে নিয়োজিত করেছিলেন। দুঃখ, যন্ত্রণা, দারিদ্র্য, লাঞ্ছনা,শোষণ, বঞ্চনা ও অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন জাগরণের কবি, জীবনপ্রভাতের কবি। আজকের দিনে সেই কবির  সামগ্রিক সৃষ্টি সচেতন মানুষদের যূথবদ্ধ করে সমস্ত অন্যায়-অপহ্নবের বিরুদ্ধে আসন্ন লড়াই-সংগ্রামে ব্রতী হতে প্রাণিত করে।

Nazrul_Pramila02

স্ত্রী প্রমীলা দেবী তথা আশালতা সেনগুপ্তার সঙ্গে কবি নজরুল

স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য – বিস্ময়কর প্রতিভা

বাংলার সাহিত্য- সংস্কৃতির ভুবনে কাজি নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬ )  এক অনন্য স্বাতন্ত্র্য ও বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন। সম্ভবত তিনিই প্রথম উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত বিরাজিত সাহিত্যজগতে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা একজন মৃত্তিকা সংলগ্ন পুরুষ— যিনি কোনো সংশয় বা আড়াল না রেখে বাংলার সাহিত্য জগতের সমকালীন  প্রচলিত মূল্যবোধকে পালটে দিয়ে সরাসরি মুক্তকণ্ঠে সাধারণ মানুষের দুঃখ বেদনা, জীবন যন্ত্রণা, তাদের সামাজিক নিগ্রহ ও বঞ্চনার জীবনকথা সোচ্চারে তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে মূর্ত করেছেন। তাই স্বভাবতই তাঁর বিস্তৃত ঘটনাবহুল বর্ণময় জীবন মসৃণ ছিল না। তাঁকে সইতে হয়েছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, দুর্বিষহ বিপত্তি। আমরা কখনোই বিস্মৃত হতে পারিনা যে, দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য,শ্রমিক-কৃষকরাজ কায়েমের জন্য, মানুষকে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এদেশের বুকে আন্দোলন-সংগ্রামের প্রবহমানতায় কবি নজরুল ইসলাম ছিলেন অন্যতম প্রেরণার উৎস। একইভাবে ওপার বাংলায় মহান মুক্তিযুদ্ধ সহ পরবর্তী সমস্ত প্রগতিকামী লড়াইয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুল হয়ে উঠেছেন প্রেরণার কাণ্ডারি। বাংলাদেশে নজরুল ‘জাতীয় কবি’র মর্যাদায় গভীর শ্রদ্ধায় অধিষ্ঠিত। দুই বাংলা জুড়েই মানুষের হৃদয়ে-চেতনায় অনুরণিত হয় — ‘সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনাতে নজরুল।কবি নজরুল ইসলামকে নিয়ে দুই বাংলার মানুষের হৃদয়ে উত্তাল আবেগ-উচ্ছ্বাস লক্ষ করে মনস্বী লেখক অন্নদাশংকর রায় যথার্থই লিখেছিলেন:

“ভুল হয়ে গেছে
বিলকুল
আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নিকো
নজরুল।

শৈশবের বিচিত্র অভিজ্ঞতা

নজরুল ইসলাম অলীক কল্পনা-বিলাসী, নিভৃত গৃহকোণের বাসিন্দা, জীবন ও সমাজ বিমুখ সাহিত্য রচয়িতা ছিলেন না কোনোদিন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি বাংলার সাহিত্যাকাশে ‘ধূমকেতু’র মতোই যেমন উদয় হয়েছিলেন, তেমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার আগেই কণ্ঠরুদ্ধ (১৯৪২) হয়ে সাহিত্যাকাশ থেকে মিলিয়ে গিয়ে সংবিৎহারা অবস্থায় ছিলেন জীবনের অন্তিমকাল পর্যন্ত। মাত্র ২২/২৩ বছরের সাহিত্য জীবনে কবিতা, গান, প্রবন্ধ সহ অসামান্য সব সৃষ্টির মাধ্যমে, সেইসঙ্গে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে  জনমানসকে যেভাবে আলোড়িত করেছেন,তার নজির মেলা ভার। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার (বর্তমানে পশ্চিম বর্ধমান) জামুরিয়া থানার অন্তর্গত প্রত্যন্ত গ্রাম চুরুলিয়ায়  ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (বাংলা ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬) নজরুল ইসলামের জন্ম। রানিগঞ্জের কয়লাখনির শ্রমজীবী এলাকার নিকটবর্তী লালমাটি, তপ্ত আবহাওয়া, দারিদ্র্য-অনুন্নত চুরুলিয়ায় একটি অসচ্ছল মুসলমান পরিবারে আরও অন্যান্য শিশুর মতোই বেড়ে উঠেছিলেন নজরুল।

আরও পড়ুন

রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক এবং তার পরে

বিশেষভাবে উল্লেখ্য, নজরুলের যখন মাত্র ন-বছর তখন পিতা কাজি ফকির আহমেদের মৃত্যু হয়। তাঁর দুই স্ত্রীর একজন জাহেদা খাতুন,অপরজনের নাম জানা যায়না। দুই স্ত্রীর মোট সাত পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কাজি সাহেবজান। তার পর চার পুত্রের অকাল মৃত্যুর পর নজরুলের জন্ম।  তাই সম্ভবত তাঁর ডাক নাম ছিল দুখু মিয়াঁ। মার স্নেহস্পর্শ নজরুলের বেশিদিন জোটেনি। পিতার মৃত্যুর সময় নজরুল সবে গ্রামের মক্তবের পাঠ শেষ করেছেন। পড়াশোনায় মেধা ছিল,কিন্তু প্রাথমিক স্তর পেরিয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য আর্থিক সামর্থ্য  ছিলনা। তাই দুখু মিয়াঁকে উপার্জনের তাগিদে ওই মক্তবেই প্রায় সমবয়সিদের পাঠের তালিম দেবার দায়িত্ব নিতে হয় দশ বছর বয়সে। ১৯১১ সালে তিনি বর্ধমান জেলার মাথরুন গ্রামে নবীনচন্দ্র বিদ্যালয়ে ভরতি হন। তখন ওই স্কুলে  প্রধান শিক্ষক ছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। জানা যায়, কাছাকাছি সময়ে অন্ডালে এক রেলওয়ে গার্ডের পাল্লায় পড়ে খানসামাগিরিও করেছেন নজরুল । তারপর  সংসারে নিদারুণ অর্থকষ্টের জন্য  গৃহত্যাগ করেন নজরুল। যোগ দেন গ্রামীণ লোকশিল্প লেটো গানের দলে। তিনি আসানসোলে মাসিক একটাকা বেতনে রুটির দোকানে কাজ করেছেন। সেখানে পুলিশ কর্তার বাড়িতে গৃহ সহায়কের কাজ করেছেন। সেই পুলিশ কর্তা স্নেহপরবশ হয়ে নজরুলকে  নিয়ে গিয়ে তাঁদের ময়মনসিংহ জেলার দরিরামপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভরতি করে দেন(১৯১৪)। সেখানে বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করা সত্ত্বেও এক বছর পর নজরুল ফিরে আসেন বর্ধমানে এবং ভরতি হন শিয়ারশোল রাজস্কুলে। একই সময়ে রানিগঞ্জ হাইস্কুলের ছাত্র, পরবর্তীকালে যিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সেই শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গভীর সখ্য তৈরি হয় তাঁর। ‘কেউ ভোলেনা কেউ ভোলে’ র ভূমিকায় শৈলজানন্দ বন্ধু নজরুল সম্পর্কে লিখেছেন:

“আমার সৌভাগ্য, আমি অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে পেয়েছিলাম এমন একটি মানুষকে ঠিক যে সকল মানুষ সচরাচর চোখে পড়ে না। অনেকের চেয়ে স্বতন্ত্র। অজস্র প্রাণপ্রাচুর্য, অবিশ্বাস্য রকমের হৃদয়ের উদারতা, বিদ্বেষকালিমামুক্ত অপাপবিদ্ধ একটি পবিত্র মন। তার নিরাসক্ত সন্ন্যাসীর মতো একটি আপনভোলা প্রকৃতি।”

আরও পড়ুন

বাকরুদ্ধ নজরুল আর বাকস্বাধীনতা

আবার আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন:

“একই দেশে আমাদের বাড়ি, একই জল-হাওয়ায় আমরা মানুষ হয়েছি,নজরুল আমার সহপাঠী  বাল্যবন্ধু। আমরা যখন পরস্পরকে ভালোবেসেছিলাম,অনেক বন্ধুর মাঝখান থেকে আমরা যখন একে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম,তখন আমরা বাংলার কাব্যজগৎ বা সাহিত্যজগতের কেউ নই।” ( টুকরো কথা,পৃষ্ঠা -২২)

মননে বিপ্লবী চেতনার উদ্ভাস

১৯১৫ সাল থেকে ১৯১৭ সাল শিয়ারশোল রাজস্কুলে পড়াশোনা করেন নজরুল। তখন তিনি ক্লাস টেনের ছাত্র। স্কুলের প্রি-টেস্ট পরীক্ষা দিয়েছিলেন। পরিচিত সকলের আশা, মেধাবী ছাত্র নজরুল ম্যাট্রিকে ভালো ফল করে বৃত্তি পাবেন, কিন্তু হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি ৪৯ নম্বর বেঙ্গলি রেজিমেন্টে যোগ দেন। চলে যান করাচির সেনা নিবাসে। বহির্মুখী স্বভাবের নজরুল ছিলেন সকলের প্রিয়।  এখানে গানে, কবিতায়, গল্প, রসিকতায়, উচ্চকিত হাসিতে সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। এখানে তিনি হাবিলদার পদে উন্নীত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন রসদ ভাণ্ডারের দায়িত্বে। মাঝে মাঝে নৌশেরায় ট্রেনিং-এ যাওয়া ও করাচি শহরে কেনাকাটা করতে যাওয়া ছাড়া কোয়ার্টারে সীমাবদ্ধ জীবন ছিল তাঁর। এই সেনা নিবাসে তাঁর পড়াশোনা, লেখালেখি, নানা বাদ্যযন্ত্র শেখা, ছাউনির এক পাঞ্জাবি মৌলবির কাছে আরবি-ফারসির তালিম নেওয়া, স্বরলিপি দেখে রবীন্দ্রসংগীত শেখা, বিপ্লবী পত্র-পত্রিকা গোপনে পড়া, বেশকিছু বাংলা পত্রপত্রিকার চাঁদা দিয়ে গ্রাহক হয়ে নিয়ম করে আনানো ও পড়া — এই ছিল তাঁর নিবিড়-নিচ্ছিদ্র দিনলিপি। নজরুলের সাহিত্য চিন্তা, সমাজভাবনা ও আন্তর্জাতিক চেতনার আলোকে মুক্তিসংগ্রামী কবি হয়ে ওঠার প্রস্তুতিপর্ব রচিত হয়েছিল এখানেই। মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭ সালের  রুশ বিপ্লবে লাল ফৌজের বিজয় বার্তা শুনে উচ্ছ্বসিত নজরুল এখানেই এক সন্ধ্যায় সঙ্গী বন্ধুদের  নিয়ে আলোচনা, প্রবন্ধ পাঠ ও গানের মধ্য দিয়ে আনন্দ উদ্ যাপন করেছিলেন। আর এটাও সহজেই অনুমান করা যায়, হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষ-কলুষ ঘোচাবার দৃঢ় মনোভূমি তাঁর গড়ে উঠেছিল করাচির এই সেনা নিবাসেই।  এখানে বসেই কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ ও গল্প-কবিতা পাঠানোর সূত্রপাত। ১৯১৯ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় নজরুলের লেখা প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ প্রকাশিত হয়। এই সূত্রেই তাঁর সঙ্গে সংযোগ তৈরি হয় ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ,  তৎকালীন ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার’ সহ সম্পাদক মুজফ্ফর আহ্ মদের সঙ্গে। যা  শৈশব-কৈশোর থেকে যৌবনের সন্ধিক্ষণে এই সামগ্রিক জীবনপ্রবাহ নজরুলের কবিত্বশক্তি, সাহিত্যসৃজন, সংগীতপ্রতিভা থেকে শুরু করে তাঁর রাজনৈতিক ও বিপ্লবী চেতনা গড়তে সাহায্য করে। বিশেষকরে মুজফ্ফর আহ্ মদের সান্নিধ্য এবং শিয়ারশোল রাজ স্কুলে বিপ্লবী যুগান্তর দলের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক নিবারণচন্দ্র ঘটকের প্রভাব  নজরুলকে সংগ্রামী চেতনায় ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হবার ক্ষেত্রে অনেকটাই সহায়ক হয়েছিল। এ ঘটনার সাক্ষ্য মেলে মুজফ্ফর আহ্ মদের লেখায়। তিনি তাঁর রচিত ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’য় লিখেছেন:

শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলের আরও একটি কথা এখানে বলে রাখি। শ্রী নিবারণচন্দ্র ঘটক ওই স্কুলের নজরুলের একজন শিক্ষক ছিলেন। তাঁর বাড়িও ছিল শিয়ারশোলেই। তিনি সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের পশ্চিম বঙ্গীয় দলের, অর্থাৎ যুগান্তর দলের সহিত সংযুক্ত ছিলেন। পল্টন হতে ফেরার পরে নজরুল নিজেই আমার নিকটে স্বীকার করেছিল যে সে শ্রী ঘটকের দ্বারা তাঁর মতবাদের দিকে আকর্ষিত হয়েছিলেন।” (পৃষ্ঠা-১৩)

আরও পড়ুন

নজরুল ইসলাম: বাঙালির কবি

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন নজরুলের বেঙ্গলি রেজিমেন্টে যোগদান নিছক কোনো তাৎক্ষণিক ভাবনা বা কৌতূহল নিবৃত্তির বিষয় ছিলনা। এ প্রসঙ্গে মুজফ্ফর আহ্ মদ লিখেছেন:

“বেঙ্গলী ডবল কোম্পানীতে যোগদান করার যে-ডাক নজরুল ইসলামের কানে পৌঁছেছিল সেটা ছিল তার নিকটে দেশপ্রেমের আহ্বান। তা না হ’লে মেট্রিকুলেশন ক্লাসের প্রথম ছাত্র সে,সকলে মনে করেছে পরীক্ষা দিয়ে সে জলপানি পাবে,— সে কি কারণে সব ছেড়ে দিয়ে ফৌজে চলে গেল? ফৌজ হতে তরুণ সৈনিকেরা প্রায়ই উদ্দাম স্বভাব নিয়ে ফিরে আসে, কিন্তু নজরুল ইসলাম ফিরেছিল দেশপ্রেমে ভরপুর হয়ে।…..

আমি নজরুল ইসলামের নিকটে জানতে চাইলাম সে রাজনীতিতে যোগ দেবে কিনা। জওয়াবে নজরুল বললেন, ‘তাই যদি না দেব তবে ফৌজে গিয়েছিলেম কিসের জন্যে?’  (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৩০)

Nazrul_Friends02_Edited01

শিকারীদলের সঙ্গে কবি। অধ্যাপক সুদীন চট্টোপাধ্যায়ের সূত্রমতে ছবিটি সম্ভবতঃ ১৯২১ বিহারের চুনারুতে তোলা।

‘বিদ্রোহী’ কবিতা: কবির অসামান্য সৃষ্টি  

নজরুলের কাব্যপ্রতিভা ও সৃষ্টির ভুবন প্রসঙ্গে একটি কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তিনি যদি শুধুমাত্র ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখার পর কাব্যজগৎ থেকে অবসর নিতেন, তবুও তিনি কবি খ্যাতির সুউচ্চ আসনে বিরাজ করতে পারতেন। একটি কবিতার মাধ্যমে যে সমস্ত কবি বিখ্যাত ও চিহ্নিত হয়েছেন,তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য কাজি নজরুল ইসলাম। তাঁর ‘বিদ্রোহী’  কবিতা প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে যে আলোড়ন ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছিল এবং  কবি হিসেবে তিনি অভিনন্দিত হয়েছিলেন, সেইসঙ্গে এই কবিতাকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, তা সম্ভবত কোনো কবির ক্ষেত্রে হয়নি। এছাড়া আরেকটি বিষয়ও উল্লেখনীয়, বিদ্রোহী কবিতা জনমানসে এতটাই আলোড়ন তুলেছিল যে, বিমুগ্ধ পাঠকেরা কবির নামের আগে তাঁরই রচিত কবিতার নাম সংযোজন করে তাঁকে মহিমান্বিত করেছিলেন। তিনি দেশে-দুই বাংলায়, বিশ্বের আঙিনায় নতুন করে পরিচিতি লাভ করেন ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে। এছাড়া এই কবিতা নিয়ে স্মারক ডাকটিকিটও প্রকাশিত হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি বিরল দৃষ্টান্ত। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। সেই অনুযায়ী ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ অতিক্রান্ত হয়েছে।

আরও পড়ুন

অসাম্প্রদায়িকতা ও নজরুল

বিদ্রোহী কবিতা যখন লিখেছিলেন কবি তখন তিনি থাকতেন কলকাতায় ৩/৪ সি, তালতলা লেনের বাড়িতে মুজফ্ফর আহ্ মদের সঙ্গে। এই কবিতা সৃষ্টির ঘটনা সম্পর্কে মুজফ্ফর আহ্ মদ তাঁর বইয়ে লিখেছেন:

তখন নজরুল  আর আমি  নীচের তলার পুব দিকের, অর্থাৎ বাড়ীর নীচেকার দক্ষিণ  পূর্ব কোণের ঘরটি  নিয়ে থাকি। এই ঘরেই কাজী  নজরুল ইসলাম  তার ‘বিদ্রোহী ‘কবিতাটি লিখেছিল। সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রির কোন সময়ে তা আমি জানিনে। রাত দশটার পরে  আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলেম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি এমন  সময়  নজরুল বললো,সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে আমায় পড়ে শোনাল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।”  (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১২২)

‘বিদ্রোহী’-তে বাংলা শব্দের সঙ্গে আরবি, ফারসিসহ হিন্দু কাব্য, পৌরাণিক উপকথা থেকে চমকপ্রদ শব্দ চয়ন, বিচিত্র ধ্বনি, উদ্দাম ছন্দ,দৃপ্ত ভাব, সুরের ঝংকারের সমন্বয়ে ও দুরন্ত বিপ্লবী প্রাণের আহ্বানে যে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হলো তাতে বাংলার মানুষ এই কবিতার মাধ্যমে বাঁধ ভাঙা যৌবনের স্পর্ধিত উচ্চারণ প্রতিধ্বনিত হতে শুনলেন——

” বল বীর—-
বল উন্নত মম শির,
শির ‘নেহারি’ আমারি,নত-শির ওই  শিখর হিমাদ্রির !
বল বীর—-
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
খোদার আসন  ‘আরশ’  ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রির!”

ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তীব্র মাত্রা যেন সংযোজিত হয়েছিল এই কবিতায়। শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শুরুতে রচিত এই কবিতা যেন হয়ে উঠেছিল যৌবনের প্রতীক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাতীয় জীবনে একদিকে যেমন নৈরাশ্য দেখা দিয়েছিল, অন্যদিকে ১৯১৫ সালে বালেশ্বরের বুড়ি বালামের তীরে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে আহত হয়ে বিপ্লবী বাঘাযতীনের শহিদের মৃত্যবরণ ও ভারতব্যাপী বিপ্লব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় বেদনা তৈরি করেছিল । এই সময়কালে ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নতুন আশার সঞ্চার করেছিল। সেই সঙ্গে শোষিত-নিপীড়িত মানুষের মাথা তুলে দাঁড়াবার দুর্জয় সাহস ও  পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার প্রেরণা জুগিয়েছিল। পাশাপাশি নিরন্তর শ্রেণি সংগ্রামের বার্তা ঘোষিত হয়েছিল। এই সামগ্রিক পটভূমিতে ভারতবর্ষ সহ পরাধীন দেশগুলির  মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীনতার এক নতুন ব্যঞ্জনা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল বিদ্রোহী —–

আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন -রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে  রণিবে না—-
বিদ্রোহী  রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত৷।

‘বিদ্রোহী’ কবিতায় পুরাতনকে ভেঙে নতুনের আহ্বান, ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নতুন সৃষ্টির পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কারমুক্ত চেতনা এবং  নির্ভীক বিদ্রোহী- বিপ্লবী প্রাণের চিরন্তন ঘোষণা যেন বাঙ্ময় হয়েছে—-

আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান-বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন।
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন।
আমি চির-বিদ্রোহী বীর —-
আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির।

আরও পড়ুন

বঙ্গীয় মুসলিম সম্মেলনে নজরুলের ঐতিহাসিক ভাষণ

‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রথম ছাপা হয়েছিল ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি ‘বিজলী’ পত্রিকায়। সেদিন বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও পত্রিকাটির এত চাহিদা হয়েছিল যে সেই সপ্তাহে ‘বিজলী’ দু’বার ছাপতে হয়েছিল। পরে ‘মোসলেম ভারত’, ‘প্রবাসী’, ‘সাধনা’, ‘দৈনিক বসুমতী’ ও ‘ধূমকেতু’-সহ অন্যান্য পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছিল। ওই সময়ে এমন একটি কবিতা এতগুলো পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়াও একটি বিশেষ ঘটনা। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নজরুলের কণ্ঠে ‘বিদ্রোহী’ আবৃত্তি শুনে তাঁকে আলিঙ্গন করেছিলেন। কবি ও লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন,“রবীন্দ্রনাথের কাব্য প্রতিভার তখন মধ্যাহ্ন দীপ্তি। দেশের যুবজনের মনে তাঁর আসনও পাকা। তারই মাঝে হঠাৎ আর একটা তীব্র প্রবল তুফানের ঝাপটা কাব্যের রূপ নিয়ে তরুণ মনকে উদ্বেল করে তুলেছিল—

আমি ঝঞ্ঝা আমি ঘূর্ণি
আমি পথ সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি“…

কবিতার ছন্দে ও ভাষায় একী উত্তাল তরঙ্গ। কার কণ্ঠে ধ্বনিত এ প্রচণ্ড কল্লোল, কিশোর জগতে একটা সাড়া পড়ে গিয়েছিল, জেগে উঠেছিল একটা রোমাঞ্চিত শিহরণ।”

সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু লিখলেন, ” বিদ্রোহী পড়লুম ছাপার অক্ষরে মাসিক পত্রে — মনে হলো এমন কখনো পড়িনি। অসহযোগ অগ্নিদীক্ষার পরে  সমস্ত মনপ্রাণ যা কামনা করেছিল এ যেন তাই। দেশব্যাপী উদ্দীপনার এই যেন বাণী।”

আবার সাহিত্যিক অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সম্পর্কে তাঁর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেছেন, ” এ কে নতুন কবি? নির্জীব দেশে এ কার বীর্যবাণী? শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, সমগ্র দেশ  নাড়া দিয়ে জেগে উঠল এমনটি কোনদিন শুনিনি, ভাবতেও পারিনি।….আলস্যে আচ্ছন্ন দেশ আরামের বিছানা ছেড়ে হঠাৎ উন্দণ্ড মেরুদণ্ডে উঠে দাঁড়াল।”

এই প্রশংসা, উচ্ছ্বাসের মধ্যে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে ঘিরে কবি মোহিতলাল মজুমদার, সজনিকান্ত দাস প্রমুখের কদর্য সমালোচনা, কুৎসা, ব্যঙ্গ কবিতা রচনা এবং কবি গোলাম মোস্তাফা, আবদুল হাকিম, গোলাম হোসেনদের তীব্র মৌলবাদী আক্রমণ শুরু হয়েছিল। বাংলা কাব্যে বিদ্রোহের ঝংকার ও প্রাণের কল্লোল তাঁদের সহ্য হয়নি।  মোহিতলাল প্রচার করলেন এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নাকি তাঁর কাব্য প্রবন্ধ ‘আমি’ থেকে ভাব চুরি করে লেখা। তিনি অহেতুক শোরগোল তোলার চেষ্টা করলেও সুবিধা করতে পারেননি। এসব সত্ত্বেও তখন বিপুল অংশের তরুণ যুবশক্তি, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রত বিপ্লববাদীরা এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্যে পেয়েছিলেন অফুরান প্রাণশক্তি, সংগ্রামের প্রেরণা। যে কবিতা আজও সজীব, চিরস্মরণীয় ও লড়াইয়ে উদ্দীপিত করছে ।

ধূমকেতু ‘ পত্রিকা প্রকাশ

নজরুলের সাহিত্য,  সাংবাদিক ও রাজনৈতিক জীবনে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশ। এই পত্রিকার আবির্ভাবের ঘটনাও অত্যন্ত নাটকীয়। পূর্ব পরিচিত জনৈক হাফিজ মসুদ আহ্ মদ একবার মুজফ্ফর আহ্ মদকে বলেন, তিনি একটি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা বার করতে চান এবং তাঁকে এই পত্রিকার দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। পত্রিকা প্রকাশে টাকার সংস্থান কীভাবে হবে জানতে চাইলে মসুদ সাহেব  আড়াইশ’ টাকা সংগ্রহের কথা বলেন। শুনে  মুজফ্ফর আহ্ মদ তৎক্ষণাৎ সেই প্রস্তাব নাকচ করে তাঁকে জানান, মাত্র আড়াইশ’ টাকা হাতে নিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করতে যাওয়া হঠকারিতা হবে। এরপর তিনি একই প্রস্তাব নিয়ে নজরুলের কাছে যান। নজরুল তখন ছিলেন ‘সেবক’ পত্রিকায়। কিন্তু সেখানে তিনি মনের দিক থেকে মোটেও খুশি ছিলেন না,তাই সঙ্গে সঙ্গেই মসুদ সাহেবের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। নজরুল স্থির করলেন এই পত্রিকা সপ্তাহে দু’বার প্রকাশিত হবে এবং তিনিই নাম দিলেন ‘ধূমকেতু’।

‘ধূমকেতু’র জন্য নজরুল রবীন্দ্রনাথের কাছে বাণী প্রার্থনা করলে কবি পত্রিকার দিক চিহ্নিত করে লিখলেন—-

কাজী নজরুল ইস্ লাম কল্যাণীয়েষু

“আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু /আঁধারে বাধ্ অগ্নিসেতু, /দুর্দ্দিনের এই দুর্গশিরে /উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন ! /অলক্ষণের তিলক রেখা /রাতের ভালে হোকনা লেখা, /জাগিয়ে দে রে চমক মেরে ‘/আছে যারা অর্দ্ধচেতন।”

এছাড়াও ‘ধূমকেতু’ কে স্বাগত জানিয়ে বাণী দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিত, কবিশেখর কালিদাস রায়, বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ প্রমুখ।

১৯২২ সালের ১২ আগস্ট ‘ধূমকেতু’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়।

‘ধূমকেতু’র প্রথম সংখ্যায় নজরুল তাঁর বিদ্রোহী সত্তাকে উচ্চকিত করে লিখলেন:

“আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল-ধূমকেতু”…..

আর সম্পাদকীয়তে লিখলেন:

” ‘মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে’, ‘জয় প্রলয়ঙ্কর ‘ বলে ‘ধূমকেতু ‘ কে রথ করে আমার আজ নতুন পথে যাত্রা শুরু হল। আমার কর্ণধার আমি। আমায় পথ দেখাবে আমার সত্য। আমার যাত্রা শুরুর আগে আমি সালাম জানাচ্ছি —নমস্কার  করছি আমার সত্যকে।…. দেশের যারা শত্রু, দেশের যা কিছু মিথ্যা, ভণ্ডামি মেকি তা সব দূর করতে ধূমকেতু হবে আগুনের সম্মার্জনী।…. ধূমকেতু কোনো সাম্প্রদায়িক কাগজ নয়।মানুষ- ধর্মই সবচেয়ে বড়ো ধর্ম। হিন্দু-মুসলমানের মিলনের অন্তরায় বা ফাঁকি কোনখানে তা দেখিয়ে দিয়ে এর গলদ দূর করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য।”….

এভাবে ‘ধূমকেতু’-তে একের পর এক লেখায় নজরুল জনমানসকে উদ্বেলিত করেছিলেন,এমনকী সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের প্রাণেও দোলা দিয়েছিলেন। উর্দু কবি ও স্বাধীনতা সংগ্রামী হসরত মোহানী ১৯২১ এর ডিসেম্বরে কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করে রাজদ্রোহের মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। তা সত্ত্বেও কবি নজরুল ইসলাম ১৯২২ সালের ১৩ অক্টোবর  ধূমকেতু-র পাতায় দৃঢতার সঙ্গেই ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলেন। তিনি লিখলেন—-

“ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ  দায়িত্ব, সম্পূর্ণ  স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে। তাতে  কোনো বিদেশীর মোড়লি করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না।”

সেই সময় ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা কলকাতা মহানগরীকে যেন নাড়িয়ে দিয়েছিল। পত্রিকা বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গে সংগ্রহের জন্য রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। স্বাভাবিক কারণেই ধূমকেতু পত্রিকার উপর শাসকবর্গের তীক্ষ্ণ নজর পড়লো। এরমধ্যে ধূমকেতুর অক্টোবর সংখ্যায় নজরুলের লেখা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ এবং লীলা মিত্রের ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ৎ’ রচনা দুটি ব্রিটিশ সরকারকে প্রচণ্ড রুষ্ট করে তোলে। পত্রিকা অফিসে পুলিশ চড়াও হয়ে ছাপানো সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করে এবং নজরুলের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বের হয়। নজরুল আত্মগোপনে যাবার কিছুদিন পর ১৯২২-এর ২৩ নভেম্বর  কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার হন। তাঁকে নিয়ে আসা হয় কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে। রাজদ্রোহের অপরাধে তাঁর সশ্রম কারাদণ্ড হলো। উল্লেখ্য, এই মামালায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে নজরুল “রাজবন্দীর জবানবন্দি”  বলে একটি বিবৃতি আদালতে পেশ করেছিলেন। এই জবানবন্দি বিচারের উপর কোনো প্রভাব ফেলতে না পারলেও স্বদেশ প্রেমের অপরাধে বিচারের নামে প্রহসনকে নজরুল নিজের যুক্তির সাহায্যে ছিন্নভিন্ন  করে দিয়েছিলেন । তারপর কবিকে আলিপুর জেল হয়ে নিয়ে যাওয়া হয় হুগলি জেলে। এখানে নানান অব্যবস্থা ও বিচারাধীন বন্দিদের প্রতি জেল কতৃপক্ষের অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে নজরুল রাজনৈতিক সহ বন্দিদের নিয়ে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। এভাবে দীর্ঘদিন অনশন চলার পর উদ্ বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ শিলং থেকে হুগলি জেলে নজরুলের উদ্দেশে টেলিগ্রাম করেন– “অনশন ত্যাগ করো। আমাদের সাহিত্য তোমায় দাবি করে (Give up hunger strike, our literature claims you)।” জেল কর্তৃপক্ষ সেই টেলিগ্রামটি ইচ্ছাকৃতভাবেই নজরুলের হাতে পৌঁছে দেয়নি। অনশনের ৩৯ দিন পর কুমিল্লা থেকে বিরজাসুন্দরী দেবী এসে কবির অনশন ভাঙান। ১৯২৪-এর জানুয়ারির মাঝামাঝি কারাজীবন থেকে মুক্তি পান কবি নজরুল।

নজরুল ইসলাম  সম্পাদিত ১৯২২-এর ১৩ নভেম্বর সংখ্যাটি ছিল ‘ধূমকেতু’র শেষ সংখ্যা। এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ‘ধূমকেতু’র স্বল্পায়ু উপস্থিতি বিদ্রোহের বার্তায়, অগ্নিবীণার ঝংকারে,স্বাধীনতার প্রলয়মন্ত্র উচ্চারণে বাংলার জনমানসকে সুতীব্রভাবে আন্দোলিত ও উদ্দীপ্ত করতে সক্ষম হয়েছিল।

কাব্যে ঝংকৃত শ্রেণি সংগ্রাম ও সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী বাণী

বাংলা কাব্যে শ্রেণি সংগ্রামের চেতনা প্রকাশে, শোষক আর শোষিতকে পরস্পর বিরোধী এবং সংগ্রামরত দুই শ্রেণি হিসেবে তুলে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নজরুল ইসলাম একজন অগ্রগণ্য কবি। তিনি লিখেছেন:

আজ জাগ্ রে কৃষাণ, সব ত গেছে,কিসের বা আর ভয়,
এই ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয়।
 ঐ বিশ্বজয়ী দস্যুরাজার হয়-কে করব নয়,
ওরে দেখ্ বে এবার সভ্যজগৎ চাষার কত বল।
                                               (‘কৃষাণের গান’)

তিনি অত্যাচারী শোষকের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের রুখে দাঁড়িয়ে লড়াইয়ে শামিল হবার আহ্বান জানাচ্ছেন—

মোদের যা ছিল সব দিইছি ফুঁকে,
এইবার শেষ কপাল ঠুকে
পড়ব রুখে অত্যাচারীর বুকে রে !
আবার নতুন করে মল্লভূমে গর্জাবে  ভাই দল-মাদল।
ধ র্ হাতুড়ি, তোল্ কাঁধে শাবল।”
                     ( ‘শ্রমিকের গান‘)

ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্য নজরুলকে নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল,সর্বহারার শৃঙ্খলমোচনের সংগ্রামে ব্রতী হতে প্রাণিত করেছিল। তিনি নভেম্বর বিপ্লবকে স্বাগত জানিয়ে ‘প্রয়োল্লাস’ কবিতায় আহ্বান জানিয়েছেন:

“তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে
কাল– বোশেখীর ঝড়!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!”

কবি নজরুল মুজফ্ ফর আহ্ মদের অনুরোধে ‘ইন্টারন্যাশনাল’ গানটির অনুবাদ করেন। যে গানে শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিকতা মূর্ত হয়েছে, প্রকাশ পেয়েছে সারা দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণির সংঘবদ্ধতা। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় এই গানটি অনূদিত হয়েছে,গাওয়া হয় একই সুরে। নজরুল এর নাম দিয়েছেন ‘অন্তর-ন্যাশনাল সঙ্গীত’। তাঁর অনুবাদ —
 
“জাগো—
জাগো অনশন-বন্দী, উঠরে যত
জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত। “……
 
এই অনুবাদ সম্পর্কে মুজফ্ ফর আহ্ মদ লিখেছেন,“বাঙলা ভাষায় সর্বোৎকৃষ্ট অনুবাদতো বটেই,আমার বিশ্বাস ভারতীয় ভাষাগুলিতে যতসব অনুবাদ হয়েছে সে-সবেরও সেরা।” 
(প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৯৮)

নজরুল ইসলাম অস্পৃশ্যতা, ভেদাভেদ ও সাম্প্রদায়িকতার কেবল বিরোধিতাই করেন নি,এসবের বিরুদ্ধে কাব্যে-সাহিত্যে ধিক্কার ধ্বনিত করেছেন এবং প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রামেও অবতীর্ণ হয়েছিলেন। জাতের নামে বিদ্বেষ, ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেই কবিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তিনি ‘জাতের বজ্জাতি’ কবিতায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উচ্চারণ করেছেন:

“জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত- জালিয়াৎ খেল্ছে জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া।
হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি, ভাব্ লি এতেই জাতির জান,
তাই ত বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে একশ’ – খান !
এখন দেখিস্ ভারত– জোড়া
‘চে আছিস বাসি মড়া,
মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া। “

তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে লেখা ‘হিন্দু – মুসলমান ‘ শিরোনামে এক প্রবন্ধে লিখেছেন:

“একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল আমার,হিন্দু মুসলমান সমস্যা নিয়ে। গুরুদেব বললেন, দেখ,যে ন্যাজ বাইরের তাকে কাটা যায়,কিন্তু ভেতরের ন্যাজকে কাট্ বে কে?

হিন্দু মুসলমানের কথা  মনে উ ঠ্লে আমার বারে বারে ঐ গুরুদেবের কথা মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে আমার এ প্রশ্নও উদয় হয় মনে যে,  এ ন্যাজ গজাল কি করে? ঐ সঙ্গে এটাও মনে হয়, ন্যাজ যাদেরই গজায়— তা ভিতরেই হোক আর বাইরেই হোক— তারাই হয়ে ওঠে পশু।” (‘রুদ্র মঙ্গল’)

তিনি ‘মন্দির ও মসজিদ’  শিরোনামে আরেকটি প্রবন্ধে তীব্র শ্লেষ-বিদ্রূপে সাম্প্রদায়িক হিংসা-হানাহানির করুণ পরিণতির কথা তুলে ধরে লিখেছেন :

‘মারো শালা যবনদের’। ‘মারো শালা কাফেরদের’।

আবার হিন্দু-মুসলমানী কাণ্ড বাধিয়া গিয়াছে। প্রথমে কথা কাটাকাটি,তারপর মাথা-ফাটাফাটি আরম্ভ হইয়া গেল। আল্লার এবং মা কালীর ‘প্রেষ্টিজ’ রক্ষার জন্য যাহারা এতক্ষণ মাতাল হইয়া চীৎকার করিতে ছিল,তাহারাই যখন মার খাইয়া পড়িয়া যাইতে লাগিল– দেখিলাম,তখন আর তাহারা আল্লামিঞা বা কালী ঠাকুরাণীর নাম লইতেছে না। হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি পড়িয়া থাকিয়া এক ভাষায় আর্তনাদ করিতেছে ‘ বাবা গো মা গো ‘।– মাতৃ পরিত্যক্ত  দু’টি বিভিন্ন ধর্মের শিশু যেমন করিয়া একস্বরে কাঁদিয়া তাহাদের মাকে ডাকে।

দেখিলাম, হত আহতদের ক্রন্দনে মসজিদ টলিল না,মন্দিরের পাষাণ দেবতা সাড়া দিল না। শুধু নির্ব্বোধ মানুষের রক্তে তাহাদের বেদী চির কলঙ্কিত হইয়া রহিল।(প্রাগুক্ত)

নজরুল ইসলামের জীবনদর্শন ও জীবন যাপনের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিলনা। লক্ষণীয় দিক হলো, কবি নজরুল প্রমীলা সেনগুপ্তকে বিয়ের সময় তাঁকে ধর্মান্তরিত করেন নি বা মুসলিম প্রথা অনুসরণ করেন নি । তিনি আন্তরিকভাবেই নানা জাতি-ধর্মের মিলনের প্রত্যাশী ছিলেন। ১৯২৯ সালে অ্যালবার্ট হলে (বর্তমানে কফি হাউস) তাঁর এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের অভিভাষণে তিনি অকপটে বলেছিলেন:

“কেউ বলেন আমার বাণী যবন,কেউ বলেন কাফের। আমি বলি দুটোর কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু- মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডস্যাক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।”

কবির এই সম্প্রীতি ও মিলনের  আন্তরিক আকাঙ্ক্ষাই মূর্ত হয়েছে তাঁর ‘ সাম্যবাদী ‘ কবিতায়। তিনি লিখেছেন:

গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্”

এমন অসংখ্য রচনা ছড়িয়ে আছে তাঁর সৃষ্টি সম্ভারে–যা চিরন্তন মানবপ্রেম, সম্প্রীতির আলোকশিখা হয়ে আমাদের প্রদীপ্ত করছে।

আজকে উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনা, তীব্র জাতিবিদ্বেষ-কলুষিত ও সংকট-জর্জরিত সময়ে নজরুল ইসলামের মতো একজন বিদ্রোহ-বিপ্লবের চেতনায় দীপ্ত  কবির “হায়দরি হাঁক”- এর প্রয়োজনীয়তা প্রতি মুহূর্তে  অনুভূত হচ্ছে। তেমনি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে তাঁর অনুপম সৃষ্টির সেই কালজয়ী সম্প্রীতির বাণী:

“মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম
হিন্দু মুসলমান
মুসলিম তার নয়ন-মণি
হিন্দু তাহার প্রাণ।”

তথ্যসূত্র:

* সঞ্চিতা — কাজী নজরুল ইসলাম– ডি এম লাইব্রেরি,কলকাতা -৬।
* রুদ্রমঙ্গল — কাজী নজরুল ইসলাম  — গ্রন্থলোক,কলকাতা।
* কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি কথা— মুজফ্ফর আহ্ মদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, কলকাতা।
* জনগণের কবি কাজী নজরুল ইসলাম — কল্পতরু সেনগুপ্ত, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা-১৩।
* নজরুল জীবনী— অরুণ কুমার বসু, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা-২০।

প্রোফাইল চিত্র: শিল্পী বিপদ ভঞ্জন সেন কর্মকার

লেখক:
Sandeep Dey
সন্দীপ দে, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

*প্রকাশিত লেখার মতামত ও বানানরীতি লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই প্রকাশিত এ লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট