জিন গবেষক সভান্তে পেবো দিকদিশারি বাতিঘর

Comments
।। ফারদিন ফেরদৌস ।।

ইদানিং মুসলিম বিশ্ব প্রাকৃতিক নির্বাচনের জনক ইংলিশ জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদকে বাতিল বলে গণ্য করবার প্রয়াস পাচ্ছে। এমনকি কিছু দেশে বিজ্ঞানের পাঠ্যসূচি থেকে তা উঠিয়ে দেয়ার দাবিও তোলা হচ্ছে। ঠিক এই সময়টায় সুইডিশ বিজ্ঞানী ড. সভান্তে পেবো মানবপ্রজাতির বিবর্তন নিয়ে অভাবনীয় ধারণা উপস্থাপন করলেল। তিনি প্রমাণ করলেন আধুনিক মানুষের পূর্বসূরী হচ্ছে নিয়ান্ডারথাল মানুষ। সেই নিয়ান্ডারথাল মানুষের জিন বিন্যাসের ‘অসম্ভব’ কাজের জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেলেন মিস্টার পেবো!

নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর সভান্তে পেবোর স্টাফদের উদযাপন নেটদুনিয়ায় এরইমধ্যে ভাইরাল হয়ে গেছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে ওই বিজ্ঞানীর স্টাফরা জলে ছুঁড়ে ফেলে চুবিয়ে দিচ্ছে তাঁকে। অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয় সাফল্যের উদযাপন বুঝি এমনটাই হওয়া উচিত।

বিজ্ঞানীদের মতে, আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষরা যখন আফ্রিকা ছাড়তে শুরু করে, তখন ইউরেশিয়া অঞ্চলের নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে তাদের আন্ত-প্রজনন ঘটে।

বহুমাত্রিক ও ব্যাপক গবেষণায় এটাই প্রমাণ হচ্ছে যে, মানুষের প্রজাতিগুলোর মধ্যে বর্তমান মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি সময়ের প্রজাতি হচ্ছে নিয়ান্ডারথাল। আজ থেকে প্রায় ৩০ বা ৪০ হাজার বছর আগে এ পৃথিবী থেকে তারা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও বর্তমান সময়ে এসে তাদের অসংখ্য ফসিল (জীবাশ্ম) উদ্ধার করা গেছে আফ্রিকা ও ইউরোপে।

জেনেটিক গবেষণা প্রমাণ করেছে, নিয়ান্ডারথাল ও আধুনিক মানুষ উভয়েই একই সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে। আমাদের ডিএনএ’র কিছু অংশ আমাদের পূর্বপুরুষদের থেকে নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে ভাগ করে পেয়েছি আমরা আধুনিক মানুষেরা।

১৮৫৬ সালের আগেই নিয়ান্ডারথালদের বেশ কয়েকটি ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছিলো, তবুও ১৮৫৬ সালে জার্মানির নিয়ান্ডারথাল উপত্যকা থেকে পাওয়া ফসিলটিই ছিলো নিয়ান্ডারথালদের আদর্শ নমুনা বা ফসিল। ওই উপত্যকার নামটিই তাই এই প্রজাতির স্মারকচিহ্ন হয়ে যায়। অনুপুঙ্খ জেনোম সিকোয়েন্সিং এর মাধ্যমে প্রাগৈতিহাসিক নিয়ান্ডারথাল গবেষণার জটিল কাজকে আধুনিক মানুষের সাথে একসূত্রে গেঁথে দিয়ে এবারে নোবেল প্রাইজ পেলেন সভান্তে পেবো।

নিয়ান্ডারথাল যুগের মানুষের বিলুপ্তির হাজার হাজার বছর পর তার ডিএনএর গঠন নকশা নতুন করে তৈরি করতে গিয়ে তিনি কী কঠিন সমস্যায় পড়েছিলেন, গণমাধ্যমকে তিনি তা সবিস্তারে জানিয়েছেন।

পেবো বলেন, কল্পনা করুন, একটি ডিকশনারির সবগুলো পাতা একটি কাগজের শ্রেডারে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং আপনাকে নতুন করে ডিকশনারিটি তৈরি করতে হবে।

এবার কল্পনা করুন, ঐ ডিকশনারি থেকে কাগজের হাজার হাজার টুকরো অন্য বইয়ের কাগজের হাজার হাজার সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।

এবার সেই কাগজের টুকরোর পাহাড়ের ওপর ঢেলে দিন এক কাপ কফি।

ফলাফল: একটি বিশাল কাগজের বল যাতে মিশ্রিত রয়েছে লক্ষ লক্ষ অক্ষর, অনেক ছাপা কাগজের ছোট ছোট অংশ, যার মানে বোঝা যায় না, এবং যেগুলো আলাদা করে পড়লে রীতিমতো বিভ্রান্ত হতে হয়।

এখন, সেই ডিকশনারিটিকে আপনি কি আবার নতুন করে তৈরি করতে পারবেন?

সময়ের সাথে সাথে এই প্রাক-হোমো স্যাপিয়েন্স যুগের মানুষের সম্ভাব্য অবশেষের ক্ষয়, শত শত বছর ধরে ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের সাথে বসবাস, এবং আধুনিক মানুষের সাথে মিথস্ক্রিয়ার ফলে নিয়ান্ডারথাল মানুষের ডিএনএকে আবার এক জায়গায় জড়ো করার কাজটি হয়ে উঠেছিল প্রায় অসম্ভব।

বিবিসি বাংলা জানাচ্ছে, উনিশশো নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে জার্মানির লাইপজিগের ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট ফর ইভোল্যুশনারি অ্যানেথ্রোপলজি বিভাগ ড. পেবোকে চাকরি দেয়।

তিনি নিয়ান্ডারথালদের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ নিয়ে কাজ করে আসছিলেন এবং এই ইন্সটিটিউট তাঁকে বিশাল এক গুণগত অগ্রগতির সুযোগ তৈরি করে দেয়। সেটা হলো ডিএনএ নিউক্লিয়াসের গঠন সম্পর্কে গবেষণা করা।

চিকিৎসার জন্য নোবেল পুরস্কার প্রদানের দায়িত্বে থাকা করোলিনস্কা ইন্সটিটিউট এক বিবৃতিতে বলেছে, “নতুন ইন্সটিটিউটে, ড. পেবো এবং তাঁর দল পুরাতন হাড় থেকে ডিএনএ-কে আলাদা করা এবং সেগুলো বিশ্লেষণ করার পদ্ধতিগুলিকে ক্রমাগত উন্নত করেছেন। গবেষণা দলটি নতুন প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়েছে যা জিন বিন্যাসকে খুব সুদক্ষ করে তুলেছে।”

নিয়ান্ডারথাল জিন বিন্যাসের এই গবেষণার জন্য প্রায় ৪০,০০০ বছর আগের নিয়ান্ডারথাল হাড়ের নমুনা ব্যবহার করা হয়। এই হাড়গুলোতে ডিএনএ-এর কোডগুলি ভালভাবে সংরক্ষিত ছিল। এবং এর পেছনে একটি কারণ ছিল, তা হল এই হোমিনিডদের মধ্যে নরমাংস খাওয়ার প্রথা।

অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া নিয়ান্ডারথাল মানুষের ডিএনএ রহস্য উন্মোচন এবং বর্তমানের আধুনিক মানুষের থেকে নিয়ান্ডারথাল মানুষের জিন বিন্যাস কতখানি আলাদা তা ব্যাখ্যা করা। তিনি হয়তো তখন ভেবে দেখেননি, কিন্তু তাঁর হাত ধরেই বিজ্ঞানে চালু হয়েছিল নতুন একটি শাখা: প্যালিওজেনোমিক্স।

ড. পেবো বিবিসিকে বলেছেন, “আমরা যখন নমুনাগুলি বিশ্লেষণ করেছি তখন লক্ষ্য করেছি যে প্রায়ই আমরা এমন হাড়ের টুকরোগুলিতে বেশি সাফল্য পেয়েছি যেগুলিতে কাটা দাগ ছিল কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে যে হাড়গুলিকে ভাঙা হয়েছিল। জীবাশ্মবিদদের মতে, এর থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে এই মানুষগুলিকে খেয়ে ফেলা হয়েছিল!

“আপনি যদি হাড়ের এই সামান্য টুকরোগুলো থেকে মাংসকে আলাদা করে খেয়ে ফেলেন এবং হাড়গুলো গুহার কোণে ফেলে দেন, তাহলে সেখানে তারা দ্রুত শুকিয়ে যাবে এবং হাড়গুলোর মধ্যে মাইক্রোবিয়াল তৎপরতা কম হবে। এবং এগুলো অনেক দ্রুত শুকিয়ে যাবে।

“আমাদের নিয়ান্ডারথাল প্রকল্পের সাফল্যের জন্য ধন্যবাদ জানাতে হয় এসব নরখাদকদের,” বিবিসিকে এমনটাই বলছিলেন এই বিজ্ঞানী।

এই কাজে ড. পেবো আধুনিক ডিএনএ সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করেন এবং উঁচু মানের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য এমন পরীক্ষাগার তৈরি করেন যেটি নমুনাগুলিতে দূষণ রোধ করতে পারে।

এরপর তিনি লক্ষ লক্ষ ডিএনএ খণ্ড বিশ্লেষণ করেন এবং পরিসংখ্যানগত কৌশল ব্যবহার করে দূষণ সৃষ্টিকারী আধুনিক জিন থেকে সেগুলোকে আলাদা করেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, “এই গবেষণার মাধ্যমে তিনি শুধুমাত্র নিয়ান্ডারথালের ডিএনএ-র বিন্যাসই আবিষ্কার করেননি। তিনি একই সঙ্গে এর জিনোম এবং আধুনিক মানুষের মধ্যে সংযোগও খুঁজে পেয়েছেন।

এই আবিষ্কার প্রমাণ করে যে হোমো স্যাপিয়েন্সের সাথে নিয়ান্ডারথালদের যৌন সম্পর্ক ছিল এবং নিয়ান্ডারথালদের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি ঘটেছিল।

একই সঙ্গে গবেষকরা হোমিনিডের আরেকটি প্রজাতি আবিষ্কার করেছিলেন যা মূলত এশিয়ায় বাস করত। এর নাম ডেনিসোভান।

আর পর পর এসব আবিষ্কারের স্বীকৃতি হিসেবেই এই সুইডিশ গবেষককে বিশ্বের সবচেয়ে অসামান্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়।”

Homo Sapiense  তথা আধুনিক মানুষের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া (extinct) পূর্বসূরী দুটি গোষ্ঠী’র (নিয়ান্ডারথাল ও ডেনিসোভান) জেনোম সিকোয়েন্সের ‘অসম্ভব’কে ‘বাস্তব’ করে দেখিয়েছেন ড. পেবো।

এই আবিষ্কারের মাধ্যমে জানা গেল আধুনিক মানুষের জীনের ১-২%  নিয়ান্ডারথাল ও ১-৬%  ডেনিসোভান থেকে  এসেছে। ফলে আধুনিক মানুষের রোগাক্রান্ত হওয়া বা নিরাময় লাভ করবার ক্ষেত্রে এই জেনোম সিকোয়েন্সিং তাদের ইমিউন সিস্টেমকে কিভাবে প্রভাবিত করে তা জানা সহজতর হবে। এতে নিঃসন্দেহে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান রোগতত্ত্ব গবেষণায় আরও বেশখানি এগিয়ে যাবে।

ড. পেবো’র এই আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে ডারউইনের Evolution তথা বিবর্তনবাদ তত্ত্বটি আরও পোক্ত হলো। আমাদের পূর্বপুরুষেরা নরখাদক ছিল এটা এখন দিবালোকের মতো প্রমাণিত সত্য। আরো সত্য হলো পুরাণ বর্ণিত এডাম ও ইভই আমাদের প্রথম পূর্বপুরুষ বা পূর্বনারী নন। কেবলমাত্র ঐশী জ্যোতিকে পথপ্রদর্শক মানা বিজ্ঞানবিমুখ যারা বিবর্তন থিওরিকে উড়িয়ে দিতে চান তারা আরেকবার নড়েচড়ে বসতে পারেন।

ড. সভান্তে পেবোর এই যুগান্তকারী গবেষণা বিজ্ঞানের সকল সুবিধাভোগী বিজ্ঞানবিমুখ মানুষদেরকে সামান্যতম বিজ্ঞানমনস্ক করলেও বিশ্বমানুষ তথা মানবতা উপকৃত হবে!

হার্দিক অভিবাদন মিস্টার সভান্তে পেবো।

মানব গবেষণায় আপনি দিকদিশারি বাতিঘর হয়ে থাকুন।

৫ অক্টোবর ২০২২

Fardin Ferdous
ফারদিন ফেরদৌস, সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন

*প্রকাশিত এ লেখার মতামত ও বানানরীতি লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই এখানে প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট