আলিঙ্গন
মৃত্যুকে বারবার উঁকি দিতে দেখেছি শিয়রে
ভয় আর নেই এখন
যে কোনো সময় সহজ মন্ত্রে
অস্তিত্ব পরিণত হবে আত্মায়।
পিছুটানগুলো ক্রমশ ছিঁড়ে ফেলছি
সতর্ক সজাগ অবহেলায়…
জলজ ব্যথায় ভাসতে চাই না
হৃদয়ভেদী চিৎকার চাই না
বিদায়ের বিষণ্ণ ক্ষণে।
অলস এক শেষযাত্রার প্রতীক্ষা আমার
এতবার মৃত্যুকে কাছে দেখে
সহাস্যে আলিঙ্গনের এটুকু প্রস্তুতি
নেওয়াই তো উচিত!
২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

নিয়তির খেলা
হন্তারক সময় কেড়ে নিয়েছে
আমার শৈশব আর কৈশোরকে
তারুণ্য ছিনিয়ে নিয়েছে আত্মার স্বজন
দুর্বিষহ ব্যথা আর দায়িত্বের বোঝা নিয়ে
অজান্তে এসে গেছে প্রৌঢ়ত্ব
শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ভাঙনের গান।
এখনো সময় পাগলা ঘোড়া হয়ে
পালিয়ে যায় হাতের মুঠো থেকে।
ধাবমানকালের বোবা বলি হয়ে অনুভব করি
করতল থেকে গলে পড়ে যায় দম্ভের নুড়ি
বলিরেখার আঁকিবুঁকি সদম্ভে কারুকাজ করে
ক্লিষ্ট দেহের দৃশ্যমান অংশে।
অথর্ব মন মেনে নেয়, মানিয়ে নেয় সব
ধীরে ধীরে অন্ধ আর বধির হয়
শোক-তাপ অপরিবাহী হয়ে ওঠে
ছাই ফেলার কুলো হতে পারলেও হয় খুশি।
নইলে অগতির গতি খোঁজে গ্রাস আর বাসের সংস্থান।
সময়ের সাথে ক্রমবর্ধমান অসহায়তা
ব্যঙ্গ করে যৌবন
ভুলে যায় অনিবার্য নিয়তি… হিসেব দিতে হয় প্রতিটি আচরণের।
২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

কবিতার জয়গান
নিস্তরঙ্গ জীবন স্বপ্নহীন, ছন্দহীন
কেটে যাচ্ছিল অর্থহীন বিনা অর্জনে।
হঠাৎ শামুক খোলসে আড়মোড়া ভেঙে
ব্যস্ত হতে চাই নিজের খেয়ালে।
উড়তে চাই আপন ইচ্ছের বর্ণিল ঘুড়িতে।
বুঁদ হই বই ও মুখবইয়ের সর্বগ্রাসী ভুবনে।
ডুবে যাই কবিতায়, ভাসি কবিতায়
হৃদয় উজার করে লিখে যাই অব্যক্ত কথকতা যত।
উপমার আড়ালে খুঁজি সৃষ্টির সুখ,
আত্মার প্রশান্তি মেলে,
ঝাপসা হয় স্বরচিত দুঃখ।
ঘোরলাগা উপলব্ধি…
কবিতা প্রথম প্রেমের মতো…
মগ্ন মুগ্ধতা তাতে।
কবির মনে সন্তরণ করা অনুভবের নির্যাসে
কবিতা হয়ে ওঠে সন্তান।
ছন্দের ফ্রেমে মূর্ত হয় একেকটা বোধ
পাওয়া না পাওয়ার পদাবলি।
যদি তা না করা যায়
হয়ে ওঠে কষ্টকর…
প্রসববেদনার মতোই।
এরপর মায়ের মমতায় কবিতার গায়ে ওঠে
অলংকারের আভরণ।
কবিতা হয় প্রেমিকার মতো
দুর্বোধ্য আর আবেদনময়ী।
কবির ঋদ্ধ মননে, সুপ্ত চেতনায়
চাষ হয় শব্দের
ক্রমাগত নিড়ানি, বাছাই, মাড়াইয়ের পর
রোপিত হয় ভালোবাসার বীজ।
কবির মতো কবিতাও প্রতিনিয়ত ভাঙে,
হয় আরো পরিশুদ্ধ, হতে চায় হৃদয়ভেদী।
ভাষাকে করতে থাকে পরিশীলিত,
মনকে কালিমা থেকে দূরে,
কখনো-বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে হাতিয়ার।
কবিতা ভালোবাসতে শেখায় নিজেকে,
আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা প্রতিটা জীবনকে।
তাই কবিতার সমৃদ্ধি চাই,
চাই কিছু কবিতা প্রিয় মন।
কবি শুধু কবিতা নিয়েই বাঁচুক আমরণ।

বেদনার জলছাপ
জলের জলছাপ আঁকি যখন-তখন
বিষণ্ণ বিকেল, রাতজাগা প্রভাতে
পুরোনো পালক ভারী হয়ে
চেপে বসে চেতনায়
মেঘ জমে বুকে
জলের কল্লোল চোখের কার্নিশে।
পালানো যায় না অন্তর্গত হাহাকার থেকে
ছুঁড়ে ফেলা যায় না তুচ্ছ চিহ্নও
পুড়ে ফেলা যায় না
মুক্তোর মতো চিঠির হরফগুলো।
অবিনাশী স্মৃতির বিনাশও জানি না।
জমাট রক্তের মতোই অমোচনীয় সে দাগ!
কষ্টের রং প্রতিফলিত হয় না মুখে
এ এক দারুণ প্রাপ্তি!
নইলে মনকাড়া স্থায়ী মুখোশের সন্ধানে
সময় যেতো প্রায় সবার।
আজ সচেতন হাসির বিজ্ঞাপনে
বিবর্ণ মনের প্রলেপ দেয়া যায়
শোভন কৃত্রিমতায়।
১৭ আগস্ট, ২০২২

শূন্য ও শূন্যতা
যোগ বিয়োগ আর ভাগের ভারে
ক্লান্ত যাপিত জীবন।
প্রতিদিনের দরদামের দাড়িপাল্লায়
শক্ত বন্ধনীতে পড়ে থাকে টুকরো শখ
যা আর মুক্তির উপায় জানে না।
ভাগফলে সন্তানের আহার্য হলেই খুশি
স্যান্ডেলটা ভাগশেষে
আগামী কোনো এক মাসে।
মধ্যস্বত্তভোগীর বৃত্তে
দমবন্ধ হয়ে চাপা পড়ে মধ্যবিত্ত।
ঋণ শতগুণ হয়ে পিছিয়ে দেয়
পাটিগণিতের হালখাতা।
জমা খরচের সম্পাদ্যে প্রচুর কাটাছেঁড়া-
মেলে না দুদিক।
ভুলের বর্গ হয়
হতাশাও সমানুপাতিক বাড়ে।
আয়নায় প্রতিবিম্ব দেখে না
ভয় হয়…
সেখানে শূন্য আর শূন্যতা
যেন ব্যঙ্গ করে তাকিয়ে আছে।
৩০ আগস্ট, ২০২২

ইচ্ছেরা ডানা মেলুক
ইচ্ছে করে এক বুক অভিমান হতে
সহস্র অনুযোগে হব বঙ্কিম ভ্রুকুটি।
প্রতীক্ষায় চুপ রইবে পায়ের নূপুর
দেহাতীত বাসনা ছোঁবে লাল সিঁথি-পাটি।
ইচ্ছে করে ছুঁয়ে দেবো ভোরের শিশির
যুথবদ্ধ করতলে শিউলির হাসি
দিগভ্রান্ত উষ্ণতার আলোয়ান গায়ে
বুকের জমিনে জলছাপ রাশি রাশি।
ইচ্ছে করে তিলতিল জমানো ইচ্ছেরা
সাকার হোক না কোনো সাধনার বরে
সুখের পাখিরা সব ডানা ঝাপটাক
চোখে মুখে, হৃদে দেহে বিবশ আদরে।
২৪ আগস্ট, ২০২২

একা চলাই নিয়তি
হোয়াংহোর দুঃখ কতটা জানা হয়নি কোনোদিন।
নিজস্ব ব্যথার কালকেউটে বয়ে যাই
যুগ থেকে যুগান্তর।
রোদ, ঝড়, বৃষ্টিতে ঠুনকো অস্তিত্বের
ম্রিয়মাণ দেয়াললিখন হয়ে
বেঁচে থাকি একাকী…
প্রতিক্ষণ মন ক্ষয়ে যায়
বয়সের টেরাকোটা আঁচড় দেয়
জরাক্রান্ত কুণ্ঠিত শরীরে।
ক্রমশ নিষ্প্রভ চোখে
জনারণ্যের উষ্ণতা আলো দেয় না
বহতা সন্ধ্যা নদীর মতো বলে
সসংকোচে চলি চেনা পথের সরলতায়।
আবেগের অর্গল অহরহ খুলে যায়
নিউরনের কোষে কোষে জাগায় বিভ্রম।
শূন্যে লিখি রেড স্কোয়ারের মতো
ক্ষরণের রঞ্জিত রূপায়ণ।
তাই সহস্রের ভিড়েও থাকি মৌনী মৃন্ময়ী
ধূসর মেঘে আঁকি ব্যথার জলছাপ।
চোখের আয়নায় হাওড়ের জলরাশি বয়ে যায়
উদ্দেশ্যহীন, শব্দহীন
বিবশ বোধের ব্যর্থতায়।
নিয়তির দাস-পুতুল হয়ে বেঁচে থাকি
নির্বাণের উদগ্র আকাঙ্ক্ষায়।
একটা জীবন…একা…কিছু অর্থহীন আঁকিবুঁকি।

লেখক:
জেরিন মোসফেকা রহমান, কবি, চিত্রগ্রাহক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক