জ্যোতি বসু:  লড়াই-আন্দোলনে প্রেরণার বাতিঘর

Comments

“জীবন দেবার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে প্রতিটি মুহূর্তে। কিন্তু মৃত্যু যখন আমাদের ডাক দেবে, তখন যেন জীবনের বৃথা অপচয়ের জন্য অনুতাপ না করতে হয়। যেন বলতে পারি, পৃথিবীর মহত্তম সংগ্রাম ‘মানব মুক্তি’-র জন্য আমরা জীবন দিয়ে গেলাম।”…

১৯৭০ সালের ৩১ মার্চ ভোরবেলা তাঁকে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল পাটনা রেল স্টেশনে। আততায়ীর গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় তিনি বেঁচে যান। কিন্তু পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা সিপিআই (এম) কর্মী কমরেড আলি ইমাম গুলিতে প্রাণ হারান। এই ঘটনার প্রতিবাদে ১ এপ্রিল কলকাতার শহিদ মিনার ময়দানে সুবিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় উপস্থিত থেকে তিনি নিজেই আগের দিনের ভয়ঙ্কর ঘটনার পরিপ্রক্ষিতে তাঁর বক্তৃতায় আবেগমথিত কণ্ঠে উপরোক্ত কথাক’টি উচ্চারণ করেন। বিভিন্ন সভা সমিতিতে, নানা উপলক্ষে তিনি বলতেন: “আমরা কমিউনিস্টরা বলি যে, আমরা শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত মানুষের জন্য যেন কাজ করে যেতে পারি, মানুষের মুক্তির জন্য যেন কাজ করে যেতে পারি। সেই বিশ্বাস, সেই ভরসা আমার আছে এবং  আমার শরীরে যতটুকু কুলোয় তাই নিয়ে মানুষের জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করে যাব”…..

তিনি পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারত, এমনকী এই উপ মহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন ও গণ আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা কমরেড জ্যোতি বসু (৮ জুলাই, ১৯১৪–১৭ জানুয়ারি, ২০১০)।

Jyoti Basu01

আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতীক

জ্যোতি বসু নামটি উচ্চারণ করলে অবচেতন মনেই যেন পশ্চিমবঙ্গ, গণআন্দোলন, কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রসঙ্গ আন্দোলিত হয়ে ওঠে। তাঁর ছবির কথা ভাবলে আমাদের মানসপটে আঁকা হয়ে যায় রক্ত পতাকা উদ্ভাসিত ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের জন কল্লোল; শহরের রাজপথে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের দৃপ্ত মিছিল, গ্রামের বিস্তীর্ণ সবুজের সমারোহে খেতের আলপথ ধরে লালপতাকা উঁচিয়ে কৃষকের দিগন্ত বিস্তৃত সারি অথবা কলে-কারখানায় শোষণ আর শাসনের ভ্রূকুটিকে হার মানিয়ে মেশিন আর সাইরেনের শব্দ ছাপিয়ে অধিকার আদায়ের দাবিতে বুকে ক্ষোভের আগুন জ্বেলে শ্রমজীবীদের দুরন্ত স্লোগান। তাঁর কণ্ঠস্বরে যেন প্রতিধ্বনিত হয় মানুষেরই জীবন জয়ের বার্তা, দরিদ্র-প্রান্তিক অসহায় মানুষের মধ্যে যেন স্পন্দিত হয় গভীর আস্থা ও বেঁচে থাকার চিরন্তন আশ্বাস।

কমিউনিস্ট হয়ে ওঠার প্রস্তুতি

উত্তাল চল্লিশের দশক — আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদের দানবীয় ঔদ্ধত্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ্রাসী উন্মত্ততা,জাতীয় প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন, ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তরের বীভৎসতা এবং ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা ইত্যাদির অভিঘাতে এক অস্থির সময়ে রাজনীতির আঙিনায় অভিষেক হয় জ্যোতি বসুর। অবশ্য তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক জীবন নির্মাণের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা নিশ্চিত হয়েছিল তিরিশের দশকে লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে যাবার সুবাদে। সেখানে তিনি সহপাঠী-বন্ধু ভূপেশ গুপ্ত, স্নেহাংশু আচার্যসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে মেতে ওঠেন লন্ডন মজলিস নিয়ে। তিনিই হন তার প্রথম সম্পাদক। লন্ডন মজলিশের অন্যতম একটি কাজ ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ লন্ডনে এলে তাঁদের সংবর্ধনা জানানো। তখন সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতসহ অনেককেই সংবর্ধিত করা হয়েছিল। তার আগে কৃষ্ণ মেননের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া লিগের সভায় গিয়ে দেশের স্বাধীনতার সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার  প্রয়াসের সূচনা। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাঁরা সাক্ষাৎ করেন ব্রিটেন কমিউনিস্ট পার্টির  হ্যারি পলিট, রজনী পাম দত্ত, বেন ব্রাডলে প্রমুখ বিখ্যাত নেতাদের সঙ্গে। সংযোগ গড়ে ওঠে পুনর্গঠিত ব্রিটেনের ভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে। সব মিলিয়ে এক নতুন চিন্তার জগতে, এক নতুন রাজনৈতিক আবহে তিনি জড়িয়ে পড়লেন। তিনি সেই সময়কালের কথা ও তারই আবেশে  নিজের অনুভবের কথা ব্যক্ত করে লিখেছেন:

“লন্ডন, কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ছাত্ররা কমিউনিস্ট গ্রুপ গড়ে তুললেন। ব্রিটিশ পার্টি নেতারা আমাদের জানালেন প্রকাশ্য সভা না করতে। কেননা ভারতে ইংরেজ রাজশক্তি তখন কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করেছে। আমরা মার্কসবাদী পাঠচক্রে যেতে শুরু করলাম। আমাদের পড়াতেন হ্যারি পলিট, রজনী পাম দত্ত, ক্লিমেন্স দত্ত এবং ব্র্যাডলের  মতো নেতারা। গোটা বিশ্ব তখন তপ্ত থেকে তপ্ততর। স্পেনে শুরু হয়েছে গৃহযুদ্ধ। ফ্রাংকোর স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রীদের সংগ্রাম নজর কাড়ছে সমস্ত প্রগতিশীল মানুষের। ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে স্বাধীন চিন্তার এই যুদ্ধে শামিল হতে গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক ব্রিগেড। র‍্যালফ ফকস্, ক্রিস্টোফার কডওয়েলের মতো বিখ্যাত কমিউনিস্ট  বুদ্ধিজীবীরা স্পেনে যেতে শুরু করেছেন। আর্নস্ট হেমিংওয়ের উপন্যাস ‘ফর হুম দি বেল টোলস’ এই সংগ্রাম নিয়েই লেখা। আমি ভিতরে ভিতরে প্রবল  আলোড়িত। মার্কসবাদী  সাহিত্য পাঠ আর সমসাময়িক ঘটনা প্রবাহ আমাকে দ্রুত রাজনীতির মূল প্রবাহে টেনে নিচ্ছে।” (“যত দূর মনে পড়ে”, পৃষ্ঠা ৮)।

Jyoti Basu02

এই পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং  মনের মধ্যে আলোড়িত চিন্তার প্রবাহ জ্যোতি বসুদের চালিত করে এক দৃঢ় সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে। তাঁরা কয়েকজন স্থির করলেন ভারতে ফিরে গিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে কাজ করবেন।

স্বদেশে – কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রবাহে

১৯৪০-এ জ্যোতি বসু, ভূপেশ গুপ্তরা দেশে ফিরে এসে কমিউনিস্ট আন্দোলনের স্রোতধারায় নিজেদের মেলে ধরলেন, যেন বহতা নদীর উতল স্রোত সুবিশাল সমুদ্রের মোহনায় গিয়ে পড়ল। লড়াই -আন্দোলনের প্রবহমানতায়  রাজনীতির আঁকাবাঁকা দুর্গম পথে নির্ভীক অভিযাত্রী হিসেবে জ্যোতি বসুর যাত্রা শুরু হলো। তখন সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ছিল আত্মগোপনকারী পার্টি কর্মী ও নেতাদের আশ্রয়ের স্থান ঠিক করা, পার্টির গোপন বৈঠকের জায়গা ঠিক করা এবং বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা ইত্যাদি। এছাড়াও তখন তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল পার্টির জন্য চাঁদা সংগ্রহ করা। তখন গোপন পার্টির নির্দেশে জ্যোতি বসু পার্টি ক্লাস নিয়েছেন এবং বিভিন্ন সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দিয়েছেন।

এই সময়কালের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো, ১৯৪১ সালের জুন মাসে হিটলারের নাৎসি বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। এই আক্রমণের ফলে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে এক গুণগত পরিবর্তন আসে। যুদ্ধের চরিত্রে পরিবর্তন আসে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনযুদ্ধে পরিণত হয়। এর কিছুদিনের মধ্যেই (৭ ডিসেম্বর, ১৯৪১) আমেরিকার পার্লহারবারে বোমা ফেলে জাপান। ১৯৪২ সালে শুরু হয় ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন। সেই সময় কমিউনিস্ট পার্টির সামনে এক ভয়ঙ্কর প্রতিকূল পরিস্থিতি। পার্টির উপর নেমে এসেছে নানা দমন-পীড়ন, আক্রান্ত পার্টি কর্মীরা। এই প্রতিকূলতার মধ্যেও পার্টি কর্মীরা গ্রামে, গঞ্জে শহরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পার্টির নীতি-আদর্শের কথা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।

এই পরই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে বাংলা। ১৯৪৩ সালের এই ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী মন্বন্তরের মোকাবিলায় পার্টির উদ্যোগে জনরক্ষা কমিটি গড়ে তোলা হয় এবং ত্রাণের কাজ সংগঠিত হয়। এ ছাড়াও পার্টির উদ্যোগেই তৈরি হয়েছিল ‘বেঙ্গল মেডিক্যাল রিলিফ কো-অর্ডিনেশন কমিটি’।

তখন শুধুমাত্র রাজনীতির অঙ্গনেই নয়, প্রগতি সংস্কৃতি আন্দোলনের গতিধারায় সংযুক্ত হয় ছাত্র-যুবদের একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ইয়ুথ কালচারেল ইনস্টিটিউট’ সংক্ষেপে ওয়াই সি আই। সোভিয়েত আক্রান্ত হবার পর ‘সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’ ইত্যাদি। এই সমস্ত সংগঠনের বহুধা-বিস্তৃত কর্মকাণ্ডের সঙ্গেই জড়িয়ে ছিলেন জ্যোতি বসু।

ইতিমধ্যে (১৯৪৩ সালে) বোম্বাই শহরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার আগে এই বছরেই কলকাতায় ভারত সভা হলে হয়েছে পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সম্মেলন।

নানা ঘটনায় আলোড়িত সেই সময়কালের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো, ঢাকায় ফ্যাসিস্ট শক্তির সমর্থকদের দ্বারা নৃশংসভাবে খুন হন উদীয়মান লেখক ও কমিউনিস্ট কর্মী সোমেন চন্দ। এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন জ্যোতি বসু। ১৯৪২ এর ৮ মার্চ ‘সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’র আহ্বানে ঢাকার সূত্রাপুরে এক ফ্যাসিস্ট বিরোধী সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। এই সম্মেলনে অংশ নিতে কলকাতা থেকে ঢাকা গিয়েছিলেন স্নেহাংশুকান্ত আচার্য, বঙ্কিম মুখার্জি এবং জ্যোতি বসু। রেল কর্মীদের একটি মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে সেই সম্মেলনে আসার পথে ফ্যাসিবাদের একদল উন্মত্ত সমর্থকের আক্রমণে খুন হন বছর বাইশের তরুণ সম্ভবনাময় লেখক সোমেন চন্দ। এই মিছিলেই অন্যান্যদের সঙ্গে ছিলেন জ্যোতি বসু।

১৯৪৪ সাল থেকে জ্যোতি বসু পার্টির নির্দেশে  শ্রমিক সংগঠনে কাজ  শুরু করেন। প্রথমে বন্দর ও ডক শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে ও পরে বি এন রেলওয়ে শ্রমিকদের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ার কাজে যুক্ত হন।

Jyoti Basu_Castro

ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সাথে।

সংসদীয় রাজনীতির আঙিনায়

শ্রমিক সংগঠনে নেতৃত্ব দেবার পাশাপাশি  সংসদীয় রাজনীতির পরিবৃত্তে জ্যোতি বসুর দীর্ঘ অভিযাত্রা শুরু হয়। তিনি ১৯৪৬ সালে  রেলওয়ে কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে কংগ্রেসের হুমায়ুন কবীরকে পরাজিত করে বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইন সভায় নির্বাচিত হন। ওই সময় আরও দু’জন কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁরা হলেন দার্জিলিং কেন্দ্রে রতনলাল ব্রাহ্মণ এবং দিনাজপুর কেন্দ্রে রূপনারায়ণ রায় । ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯ — দু’দফায় যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময়কাল বাদ দিলে (দু’বারই ছিলেন উপ মুখ্যমন্ত্রী) ১৯৪৬ থেকে ১৯৭২ — জ্যোতি বসুই ছিলেন আইন সভায় অন্যতম বিরোধী কণ্ঠস্বর। এই ‘৪৬ সালেই ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা গোটা দেশে কলঙ্ক চিহ্ন এঁকে দেয়। এই বছরের ১৬ আগস্ট এই দাঙ্গা শুরু হয়। ওই দিন মুসলিম লিগ সারা দেশে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ (Direct Action Day) পালনের ডাক দেয়। পার্টির উদ্যোগে এই ভয়াবহ দাঙ্গা নিরসনে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জ্যোতি বসুও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ‘৪৬-এর এই দাঙ্গায় কলকাতায় ২০ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এই দাঙ্গার ভয়াবহতার মধ্যেও মানুষের মধ্যে যে চিরন্তন সম্পর্ক ও  সহমর্মিতার দিক উদ্ভাসিত হয়েছিল, তার উল্লেখ করে জ্যোতি বসু লিখেছেন:

“ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের প্ররোচনায় দুই সম্প্রদায়ের (হিন্দু ও মুসলমান) উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা দাঙ্গা বাধানোর জন্য দিনের পর দিন প্রস্তুতি চালিয়েছিল, জনসাধারণের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়েছিল। নিঃসন্দেহে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি জনসাধারণের একটা অংশের মধ্যে উন্মত্ততা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিল। ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার এই একটা দিক। 

কিন্তু সেই সঙ্গে আরেকটা দিকের কথা ভুললে চলবে না। হিন্দু অধ্যুষিত অনেক এলাকায় এমন সব ব্যক্তিরা ছিলেন, যাঁরা ঐ উন্মত্ততার মধ্যেও নিজেদের জীবন বিপন্ন করে মুসলিমদের আশ্রয় দিয়েছেন। আবার অনেক মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাতেও এমন সব ব্যক্তিরা ছিলেন, যাঁরা অনুরূপভাবেই বহু হিন্দু পরিবারকে রক্ষা করেছেন এবং এলাকা থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন।” (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা: ৩৪)

এই সময় বঙ্গীয় আইন সভায় কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে জ্যোতি বসু তাঁর বক্তব্যে  ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে আক্রমণ কেন্দ্রীভূত করে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক  সম্প্রীতির ওপর জোর দিয়েছিলেন।

এর পর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলনসহ দুর্বার কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক-কর্মচারী আন্দোলন, উদ্বাস্তুদের আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন ইত্যাদি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বহুমুখী গতিধারার সঙ্গে জ্যোতি বসুর জীবনপথও একাত্ম হয়ে যায়। সত্তরের নৈরাজ্য-সন্ত্রাসের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন থেকে আলোয় উত্তরণের সংগ্রামে তিনি ছিলেন অন্যতম আলোর দিশারি। বাংলার এই সামগ্রিক লড়াই-আন্দোলনের দুর্বার গতিধারাই জ্যোতি বসুকে কমিউনিস্ট নেতা-জননেতা রূপে নির্মাণ করেছে, তিনি প্রকৃত অর্থেই যেন হয়ে উঠেছিলেন বাংলার গরিব-শ্রমজীবী-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত জনঅংশের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। এই দীর্ঘ লড়াই-আন্দোলনের পথ বেয়েই ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে অন্ধকারের দুঃশাসনকাল পেরিয়ে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা হয় বামফ্রন্ট সরকার। তারপর ক্রমান্বয়ে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনিই ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে যে নজির আজও নেই।

Jyoti Basu_Mandela

নেলসন ম্যান্ডেলার সাথে।

সাফল্যের নানা দিক

জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকারের জনমুখী কর্মকাণ্ডে অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে রাজ্যে। গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, দলমত নির্বিশেষে বন্দিদের মুক্তি, সরকারি কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার প্রদান, ছাঁটাই কর্মীদের পুনর্বহাল, শিক্ষার প্রসার ও শিক্ষায় গণতন্ত্রীকরণ, শিক্ষকদের উপযুক্ত মর্যাদা দান ইত্যাদি সিদ্ধান্ত উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।

এছাড়া ভূমি সংস্কার ও ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে ভূমিহীনদের জমি বণ্টন, বর্গাদারদের অধিকার সুরক্ষা, মহিলাদের জন্য যৌথ পাট্টা, গ্রামীণ মানুষের আর্থিক উন্নয়ন,পঞ্চায়েতের মাধ্যমে মানুষের রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতায়ন, ১৮ বছরের ভোটাধিকার, পঞ্চায়েত-পৌর সভায় নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন এবং যাবতীয় উন্নয়নমূলক কাজে মানুষকে যুক্ত করা, বিরোধীদের মতমতকে মর্যাদা দেওয়া ইত্যাদির মধ্যদিয়ে গণতন্ত্রের বিকাশ, পঞ্চায়েত-পৌরসভায় মহিলাদের আসন সংরক্ষণ, তপশিলি-আদিবাসী-সংখ্যালঘুসহ অনগ্রসর শ্রেণির কল্যাণে প্রভূত উদ্যোগ গোটা দেশে নজির সৃষ্টি করেছে।

জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে পঞ্চায়েতের সাফল্য শুধু দেশে নয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও প্রশংসিত হয়েছে। এই সময়েই কৃষিতে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে রাজ্যে, খাদ্যশস্য উৎপাদনে উদ্বৃত্ত রাজ্যে পরিণত হয়েছে, ক্ষুদ্র শিল্পে, মৎস্য উৎপাদনে, বন সৃজনে দেশের শীর্ষস্থান অধিকার করেছে পশ্চিমবঙ্গ। এরই পাশাপাশি হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যাল, বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, তথ্য প্রযুক্তি শিল্পসহ অসংখ্য শিল্প গড়ে উঠেছে রাজ্যে। কৃষির সাফল্যকে অটুট রেখে শিল্প সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এই সমস্ত কিছুর মূল অভিমুখ ছিল বিকল্প পথে কর্মসংস্থান ও রাজ্যের সার্বিক উন্নয়ন।

জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যে সাম্প্রদায়িক মেলবন্ধন ও বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি রক্ষার ক্ষেত্রেও অনন্য নজির রেখেছে। এ সমস্ত দিক ছাড়াও ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় জ্যোতি বসুর দৃঢ় ও নীতিনিষ্ঠ ভূমিকা দেশে, এমনকী বহির্বিশ্বেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লিতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে ঐতিহাসিক জলবণ্টন চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল তার অন্যতম রূপকার ছিলেন জ্যোতি বসু। এছাড়াও আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, এই বছরেই (১৯৯৬) একাদশ লোকসভা নির্বাচনের পর বামপন্থী ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তির সমন্বয়ে গঠিত ১৩ দলের ‘সংযুক্ত মোর্চা’র তরফে জ্যোতি বসুকে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু পার্টির (সিপিআই-এম) সিদ্ধান্তে তিনি সেই পদ গ্রহণে অসম্মতি জানিয়েছিলেন। বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতালিপ্সা ও পদ আঁকড়ে রাখার কুৎসিত পরিবেশের মধ্যে তাঁর এই অবস্থান নিঃসন্দেহে ছিল এক বিরল দৃষ্টান্ত। এমন অসংখ্য নজিরসৃষ্টিকারী সাফল্যের  প্রধান রূপকার হওয়া সত্ত্বেও জ্যোতি বসুর কণ্ঠে কখনো শোনা যায়নি যে ‘আমি করেছি’র মতো আত্মঅহংকার বা আত্মপ্রচার। তাঁর প্রতিটি বক্তৃতায়, লেখায়, এমনকী ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় সবসময়ই প্রাধান্য পেয়েছে অপরূপ শব্দবন্ধ ‘আমরা’। তিনি লিখেছেন:

“এ রাজ্যে যখন বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা হয় তখনই আমরা ঘোষণা করেছিলাম, আমাদের সরকার শুধু মহাকরণ থেকে চলবে না, প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি শহরে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। সেই মতো আমরা পঞ্চায়েত রাজ প্রতিষ্ঠা করেছি, অসংখ্য পৌরসভা গঠন করেছি এবং এগুলির হাতে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দিয়েছি। …..রাজ্যের সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যে থেকেও আমরা মানুষকে যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তা সব সময়ই বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছি। আমরা মানুষকে কখনো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেইনি।” (দেশহিতৈষী, শারদ সংখ্যা, ২০০৯)।

জ্যোতি বসু ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সুদীর্ঘ গণআন্দোলনের নেতা, রেকর্ড সময়ের (১৯৭৭-২০০০) মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর ভাবনায় যেমন ছিল এ রাজ্য, তেমনি তাঁর মধ্যে বিরাজ করত দেশের ভাবনা। তাই তাঁর কথায়, বক্তৃতায়, লেখায় বারে বারেই উঠে এসেছে এমনই কিছু কথা–আজকে পশ্চিমবঙ্গের যে সাফল্য, যে অগ্রগতি তা শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, গোটা দেশের। আমরা শুধু পশ্চিমবঙ্গের জন্য লড়াই করিনা, আমাদের লড়াই সমগ্র দেশের জন্য।”

একান্ত সান্নিধ্যে

এমনই এক বিশিষ্ট জননেতা, দেশে-বিদেশে সমাদৃত কিংবদন্তিতুল্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়ে এই লেখক নিজেকে ধন্য মনে করছে। বিভিন্ন সময়ে তাঁর কাছে যাবার সূত্রে তাঁর সময়জ্ঞান ও নিয়মানুবর্তিতা যেমন  বিশেষভাবে নজরে এসেছে, তেমনি এটাও উপলব্ধিতে এসেছে যে,  একজন নবীন নিচুতলার কর্মীর সাথেও তিনি সব সময়েই যথাযথ গুরুত্ব ও অভিনিবেশের সঙ্গেই আলোচনায় মগ্ন হন। আবার অবলীলায় প্রশংসাও করেন। কোনো সময়েই তাঁর মধ্যে এতটুকু বিরক্তি বা উপেক্ষার মনোভাব দেখা যায়নি। নানা উপলক্ষে একান্ত আলাপচারিতারমধ্য দিয়ে এই অনুভবও হয়েছে যে, কেন তিনি একজন ব্যতিক্রমী অনন্য মানুষ।

Jyoti Basu03

লেখকের সাথে।

তাঁর আপাতগম্ভীর ভাবমূর্তির আড়ালে একটা স্নেহপ্রবণ, সংবেদনশীল মনও বিরাজ করত। মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে অব্যাহতি নেবার পর তাঁর তৎকালীন আবাসস্থলে (ইন্দিরা ভবন) একজন অস্থায়ী চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাকে স্থায়ী পদে নিয়োগ করার জন্য জ্যোতি বসুর যে উদ্বেগ এবং আন্তরিক তৎপরতা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ এই লেখকের হয়েছে, তা অপার বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। সেই সঙ্গে এটাও নজরে এসেছে যে,তাঁর যে ভাবনা, যে উপলব্ধি তা সরাসরি প্রকাশ করাই তাঁর স্বভাব। এমন অনেক প্রসঙ্গই তিনি একান্ত আলাপচারিতায় এনেছেন, যেগুলির অনেক কিছুই হয়ত এই লেখককে বলার কোনো কারণ ছিল না।

জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রাজ্যের উন্নয়ন ও অগ্রগতির সাফল্য  রচনার পাশাপাশি নীতি-আদর্শের সঙ্গে সাযূজ্য রেখে জীবনকে চালিত করেছেন। তিনি সময়ের আহ্বানে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরির জন্য স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমানে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার কুৎসিত রাজনীতির আবহে এটাও এক আলোকিত দৃষ্টান্ত।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায়

সাম্প্রদায়িকতা, বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে জ্যোতি বসুর নির্ভীক, দৃঢ় ভূমিকা ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ প্রত্যক্ষ করেছেন রাজ্য তথা দেশের মানুষ। তাই তো ১৯৯২ সালে উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদীদের হাতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর দিল্লিসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হিংসার আগুন জ্বললেও পশ্চিমবঙ্গে তার কোনো আঁচ পড়তে পারেনি। বরং ভিন রাজ্যের আতঙ্কিত, আক্রান্ত মানুষ অনেকেই তখন পরিত্রাণ পেতে ‘জ্যোতি বসুর মুলুকে’ আশ্রয় খুঁজে ছিলেন। তিনি ঐতিহাসিক ‘বাবরি মসজিদ’ ধ্বংস ও দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানোর জন্য বিজেপি-কে প্রকাশ্যে সোচ্চারে ‘অসভ্য বর্বর’ বলে অভিহিত করেছেন। এজন্য প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন অটল বিহারী বাজপেয়ী কলকাতায় এসে রাজভবনে জ্যোতি বসুকে একবার সরাসরি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনি আমাদের দলকে অসভ্য বর্বর বলেন কেন ?” সপাট উত্তরে দৃঢ়তার সঙ্গেই জ্যোতি বসু বিজেপি’র দ্বারা দেশের সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক স্মারক বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও দেশজুড়ে এই দলের সাম্প্রদায়িক হিংসাত্মক কার্যকলাপের উল্লেখ করে বলেছিলেন, আপনিই বলে দিন এসব কার্যকলাপের জন্য আপনাদের দলকে অসভ্য-বর্বর ছাড়া আর কী বলে সম্বোধন করব?” বলাই বাহুল্য, বাজপেয়ীর আর উত্তর দেবার কিছু ছিল না। এই ঘটনার কথা জ্যোতি বসু নিজেই জানিয়েছেন পরবর্তী বিভিন্ন সভা-সমাবেশে।

জ্যোতি বসু  মনেপ্রাণে যা বিশ্বাস করতেন, সেটাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর কথায়, বক্তৃতায় বা লেখায় প্রকাশ করতেন। তিনি সব সময় চাইতেন অতীতের দীর্ঘ লড়াই-আন্দোলনের ইতিহাস নবীন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে। বামপন্থীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহলের যে নিরন্তর কুৎসা, অপপ্রচার তার বিরুদ্ধে ও তরুণদের বিভ্রান্ত করার অপকৌশলকে রুখতে এবং ভবিষ্যৎ অগ্রগতির স্বার্থে এটা জরুরি বলেই তিনি মনে করতেন। তিনি প্রায় প্রতিটি সভা-সমাবেশে এবিষয়টি উল্লেখ করতেন, যা একবার একটি প্রবন্ধের জন্য অনুলিখনের সময় এই লেখককেও বলেছিলেন:

“অনেক লড়াই, সংগ্রাম, আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমাদের রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আমাদের উপর অকথ্য নির্যাতন হয়েছে, আমাদের উপর লাঠি চলেছে, গুলি চলেছে। বিনা বিচারে আমাদের আটক করা হয়েছে। জেলের ভিতরেও আমাদের উপর গুলি চালানো হয়েছে। হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আমাদের পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। তবুও আমরা শ্রমিক, কৃষক, বাস্তুহারা, মধ্যবিত্ত, শিক্ষক, কর্মচারী, ছাত্র, যুব, মহিলা সবার স্বার্থেই লড়াই করে গেছি। কিন্তু কখনোই শাসকশ্রেণির কাছে আত্মসমর্পণ করিনি।”

সুবিস্তীর্ণ  সংগ্রামী অভিযাত্রায় জ্যোতি বসুর উপলব্ধিতে ছিল ‘সভ্যতার সংকট’-এ বিধৃত রবীন্দ্রনাথের সেই চিরন্তন বাণী–মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব  তাঁর বক্তব্যেও বার বার মানুষের সাথে সংলগ্ন থাকার কথাই উচ্চারিত হয়েছে। তাই তিনি লড়াই-সংগ্রামের অবিরত ধারার মধ্য দিয়েই অগণিত মানুষের জীবন সংগ্রামের বিশ্বস্ত সাথি,প্রিয় নেতার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন। তাঁর দৃঢ় কণ্ঠে বারে বারেই উচ্চারিত হয়েছে—-

মানুষের স্বার্থ ছাড়া কমিউনিস্টদের আর কোনো স্বার্থ নেই মানুষ যেমন ভুল করে, আবার মানুষই ইতিহাস রচনা করে। তাই মানুষের কাছেই আমাদের বারে বারে যেতে হবে।”

প্রেরণার বাতিঘর

আজ পশ্চিমবঙ্গে এক চরম দক্ষিণপন্থী একনায়কতন্ত্রী শাসনে  গণতন্ত্র, মানুষের অর্জিত অধিকার, শান্তি-সম্প্রীতির ঐতিহ্য ও সর্বোপরি রাজ্যের সম্মান ভূলুণ্ঠিত হতে বসেছে । অন্যদিকে দেশের শাসনভার উগ্র সাম্প্রদায়িক হিংসাশ্রয়ী শক্তির কবলে পড়ে গরিব শ্রমজীবী নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রা বিধ্বস্ত-বিপন্ন। দেশের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ, সংবিধান, আইন ব্যবস্থা, সংহতি-সম্প্রীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস ও সংস্কৃতির উপর নেমে এসেছে ভয়ংকর আঘাত। এছাড়া চিরন্তন মানবিক সম্পর্ক-মূল্যবোধকে নস্যাৎ করার প্রক্রিয়া চলছে, বিজ্ঞান-যুক্তিবাদ ও প্রগতি চিন্তার পথে পুরাণ উপকথা,অন্ধ কুসংস্কার ও উগ্র ধর্মীয় বিভেদের বিষ ছড়িয়ে দেশকে অন্ধকারে গহ্বরে নিয়ে যাবার ধ্বংসাত্মক অপচেষ্টা চলছে। সাম্রাজ্যবাদের জঘন্য চক্রান্তে  হিংসা-সন্ত্রাসে মৃত্যুর বিভীষিকা মাঝেমাঝেই এই উপ মহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তকে অস্থির ও বিপন্ন করে তুলছে। এসবের  বিরুদ্ধে একযোগে লড়াইয়ে জনমানুষের সঙ্গে সুনিবিড় সখ্য গড়ে তোলা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার ও দাবি আদায়ের সংগ্রামের পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তনের নতুন দিশায় দুর্নিবার লড়াইয়ের প্রবাহে অগ্রসর হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। এই আলোক অভিযানে কমরেড জ্যোতি বসুর সুদীর্ঘ সংগ্রামী জীবন প্রেরণার বাতিঘর হয়ে ভাস্বর থাকবে।

প্রাসঙ্গিক তথ্য:

* ‘যত দূর মনে পড়ে’- জ্যোতি বসু, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড , কলকাতা-৭৩।
* ‘জ্যোতি বসুর নির্বাচিত রচনা সংগ্রহ’, প্রথম খণ্ড, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা-৭৩।
*‘নন্দন’, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সংখ্যা, ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিট, কলকাতা-১৬।
* ‘দূরের মানুষ কাছের মানুষ জ্যোতি বসু’, সন্দীপ দে, সৃষ্টির একুশ শতক, উৎসব সংখ্যা ২০২০, ১৫ শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলকাতা-৭৩।

লেখক:
Sandeep Dey
সন্দীপ দে, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

*প্রকাশিত লেখার মতামত ও বানানরীতি লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই প্রকাশিত এ লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক

ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার কবিতা

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট