ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী: ৩টি দশক যিনি জেলেই কাটান

Comments

‘পৃথিবীতে সম্ভবত আমিই রাজনৈতিক আন্দোলন করিবার কারণে সর্বাধিক সময় জেলখানায় অতিবাহিত করিয়াছি। মাঝখানে দু-এক মাস বিরতি ছাড়া আমি টানা ৩০ বছর জেলখানায় কাটাইয়াছি।’ … ‘আমি ১৯০৮ সন হইতে ১৯৪৬ সন পর্যন্ত ৩০ বৎসর কারাগারে কাটাইয়াছি, ৪/৫ বৎসর অজ্ঞাতবাসে কাটাইয়াছি। …জেলখানার পেনাল কোডে যেসকল শাস্তির কথা লেখা আছে এবং যেসব শাস্তির কথা লেখা নাই তাহার প্রায় সব সাজাই ভোগ করিয়াছি।’

জীবনের তিনদশকের বেশী সময় জেলে কাটানো ময়মনসিংহের ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘জেলে তিরিশ বছর ও পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ তাঁর স্মৃতিকথায় এভাবেই নিজের সে সময়কে ব্যক্ত করেছেন।

ব্রিটিশ শাসনের শৃংখল থেকে দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে যিনি সারা জীবন বিপ্লবী কর্মযজ্ঞে নিয়েজিত ছিলেন, যিনি অনুশীলন দলের সঙ্গে যুক্ত হন শৈশবে, যিনি ক্ষমতালাভ বা ব্যক্তিস্বার্থের ধ্যান-ধারণার উর্ধে ছিলেন, যিনি আদর্শিক রাজনীতির বাস্তবায়নে লড়াকু প্রতীক, তিনি ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী। জন্মেছিলেন ১৮৮৯ সালের মে মাসে। ময়মনসিংহ জেলার কাপাসাটিয়ার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁর বাবার নাম দূর্গাচরণ চক্রবর্তী। তিনি ছিলেন স্বাধীনতাকামী একজন মানুষ। উদারমনা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চা ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তিনিই ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীকে স্বদেশী রাজনীতির সাথে যুক্ত করে দেন। ছেলে যেন বিদেশী পোশাক বর্জন করে তাই তিনি  ১৯০৫ সালে ত্রৈলোক্যনাথকে দেশী সাদা মোটা কাপড় কিনে পাঠান সংগে একটি আশির্বাদ পত্র। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর ছেলে মনে-প্রাণে দেশ প্রেমিক হোক, স্বদেশী হোক। দেশের সেবা করার জন্য বাবার পরম স্নেহের সেই আশির্বাদ মাথা পেতে নিয়েছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ।

ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। এরপর প্রাথমিক পড়াশুনা শেষে ১৯০৩ সালে তাঁকে মালদাহ জেলার সানসাটের পুখুরিয়া মাইনর স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী খুব ভাল ছাত্র ছিলেন। শিক্ষকরা তাঁকে নিয়ে গর্ব করতেন। এই মাইনর স্কুল থেকে ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর বৃত্তি দেওয়ার কথা ছিল। তিনি বৃত্তি পাবেন শিক্ষকরাও আশাবাদী। কিন্তু পারিবারিক কারণে তাঁকে ওই স্কুল ছেড়ে চলে আসতে হল। ওই স্কুলে পড়াশুনার সময় তিনি ‘অনুশীলন’ সমিতির সংস্পর্শে আসেন। এরপর তিনি ময়মনসিংহ জিলা হাইস্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি একবছর পড়েন। সেখানেও তিনি ভাল ছাত্র হিসেবে শিক্ষকদের নজরে পড়েন। ১৯০৬ সালে তিনি ‘অনুশীলন’ সমিতির সাথে সরাসরি যুক্ত হন। বিপ্লবী দলে যুক্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে দলের কার্যক্রম এগিয়ে নেন।

Trailokyanath Chakraborty02

এরপর তিনি সাটিরপাড়া হাইস্কুলে ভর্তি হন। এখানে তিনি পড়াশুনায় মনোযোগ দেয়ার জন্য স্কুলের ছাত্রাবাসে উঠেন। এই স্কুলের শিক্ষকরাও আশা করেন তিনি বৃত্তি পাবেন এবং সে জন্য শিক্ষকরা তাঁকে প্রতিদিন ৩ ঘন্টা পড়াশুনা করতে বলেন। কিন্তু তিনি সারাক্ষণ যুক্ত থাকতেন সশস্ত্র বিপ্লববাদী দলের কাজে। পাঠ্যবই না পড়লেও তিনি রাজনীতি বিষয়ে পড়াশুনা করতেন সবসময়। বিপ্লববাদী দলের ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠা করে সহপাঠীদের নিয়ে নিয়মিত শরীর চর্চা ও দেশের স্বাধীনতার জন্য পাঠচক্র করতেন। নিজ জেলায় ক্ষুদে বিপ্লবী ঘাঁটি তৈরি করেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষার ২ মাস আগে ১৯০৮ সালে তিনি বিপ্লবী দলের কাজে নারায়নগঞ্জে আসেন। এসময় ব্রিটিশ পুলিশ বিপ্লবাত্মক কাজের জন্য তাঁকে গ্রেফতার করে ৬ মাসের জেল দেয়। আর নারায়নণগঞ্জে সেই গ্রেফতারই তাঁর প্রথাগত শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। শুরু হয় এক নতুন জীবন। মুক্তি পেয়ে ১৯০৯ সালে তিনি ঢাকায় আসেন।

ঢাকায় আসার পর তাঁকে অন্যতম আসামী হিসেবে টাকা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। শুরু হয় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী অভিযান। পুলিশ হন্যে হয়ে তাঁর সন্ধান শুরু করে। ঢাকার বিপ্লবীদের পরামর্শে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। আত্মগোপন অবস্থায় তিনি আগরতলার উদয়পুর পাহাড় অঞ্চলে যান। সেখানে তিনি বিপ্লববাদী দলের একটি শাখা স্থাপন করেন। দুই বছরের মধ্যে তিনি উদয়পুর পাহাড় অঞ্চলে বিপ্লবীদের একটি বিশাল ঘাঁটি তৈরি করেন। এই অঞ্চলের বিপ্লবী দলের তিনি ছিলেন সম্পাদক। শরীর চর্চা, ব্যায়াম, লাঠি খেলা, ছোড়া খেলা, কুস্তি ইত্যাদির আড়ালে ভারতমাতাকে ব্রিটিশসাম্রাজ্যের হাত থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক শিক্ষা, বিপ্লবী তত্বের প্রচার ও বিপ্লবী কর্মী তৈরী করাই ছিল তাঁর কাজ।

১৯১২ সালে ওখান থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় তাঁর বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। প্রমাণের অভাবে বৃটিশ পুলিশ এই হত্যা মামলা থেকে তাঁকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য হয়। তিনি স্থান পরিবর্তন করে চলে যান মালদহ। সেখানে তিনি দলের একটি শক্তিশালী শাখা গঠন করার পর ১৯১৩-১৯১৪ সালে রাজশাহী ও কুমিল্লায় গুপ্ত বিপ্লবী দলের ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই গুপ্ত সমিতি বা বিপ্লবী দল প্রতিষ্ঠা করতে তাঁকে দলের সিনিয়ররা সহযোগিতা করতেন।

১৯১৪ সালে ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীকে আবারও ব্রিটিশ পুলিশ গ্র্রেফতার করে। গ্র্রেফতারের পর এসময় তাঁকে বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করা হয়। এই মামলার মাধ্যমে তাঁকে দশ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে আন্দামানে প্রেরণ করা হয়। শুরু হল মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ। উল্লেখ্য, আন্দামান সেলুলার জেল ছিল ব্রিটিশ শাসকদের সম্ভবত সবচেয়ে প্রিয় জেল আর এখানে পাঠানো আসামিদের জন্যে সবচেয়ে ভয়ংকর জেল। এক কথায় বলা যায়, মৃত্যু ফাঁদ।

১৯২৪ সালে আন্দামান সেলুলার জেল থেকে মুক্তি পান ত্রৈলোক্যনাথ। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের পরামর্শে তিনি দক্ষিণ কলকাতার জাতীয় স্কুলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই জাতীয় স্কুলের শিক্ষার্থীদেরকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতেন তিনি। একই সাথে বিপ্লবী দলের নেতা ও সংগঠক হিসেবে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই ১৯২৭ সালে তাঁকে আবারও ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেফতার করে। এ সময় তাঁকে ব্রহ্মদেশের (বর্মা বা বর্তমানের মায়ানমার) মন্দালয় জেলে পাঠানো হয়। এখানে তিনি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, পৃথি শিং, পুলিন বাবু, এম.পি নারায়ণ মেনন, গুরুমূখ শিং, পন্ডিত পরমানন্দ, মোস্তফা আমেদসহ আরো অনেক সহযোদ্ধার সাথে কারাবাস করেন। ১৯২৮ সালে তাঁকে ভারতে এনে নোয়াখালি জেলার হাতিয়া দ্বীপে নজরবন্দী করে রাখা হয়। ওই বছর মুক্তি পেয়ে তিনি উত্তর ভারতে যান এবং হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আর্মিতে যোগ দেন। এরপর ভারতীয় বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বিপ্লবী দল তাঁকে ব্রহ্মদেশে পাঠায়। বিপ্লবী ভাবধারায় বিশ্বাসী ত্রৈলোক্যনাথ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসেও যুক্ত ছিলেন।

Trailokyanath Chakraborty03

১৯২৯ সালে তিনি লাহোর কংগ্রেসে যোগদান করেন। এসময় তিনি ভারতের সর্বত্র অবাধে ঘুরে বেড়িয়ে বিপ্লবী সশস্ত্র দলকে সংগঠিত করার জন্য কংগ্রেসের রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করেন। রাজশাহীতে অবস্থানকালে ১৯৩০ সালে তাঁকে আবারও ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেফতার করে। এসময় তাঁকে একটানা ৮ বছর কারাবাস করতে হয়। এবার তাঁকে বিভিন্ন জেল ঘুরিয়ে শেষ পর্যন্ত আরেক কুখ্যাত জেল বকসা বন্দিশালায় রাখা হয়। ভুটান সীমান্তে সিঞ্চুলা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে স্থাপিত এ বন্দিশালায় বছরের পর বছর রাজবন্দিদের কয়েদ রেখে অত্যাচারে তাঁদের জর্জরিত করে ফেলা হত। সে অত্যাচারের কাহিনী রবীন্দ্রনাথসহ অসংখ্য সাহিত্যিক তাদের রচনায় স্থান দিয়েছেন। এ জেলদুর্গে বন্দি থেকেছেন দেশমাতৃকার মুক্তি মন্ত্রে নিবেদিত অসংখ্য বিপ্লবী। বকসা জেলদুর্গটি ছিল গভীর অরণ্যবেষ্টিত। জনবিরল দুর্গম পাহাড়ি বকসা দুর্গের সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল অনেক উঁচু করে। দুর্গের ভেতরে ছিল কয়েক দফায় কাঁটাতারের বেড়া। রাজবন্দিদের উপর ছিল নিপীড়নের চাবুক।

১৯৩৮ সালে তিনি মুক্তি লাভ করেন। ওই বছর তিনি সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে রামগড় কংগ্রেসের কাজে যুক্ত হন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তিনি ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘটানোর চেষ্টা করেন। ১৯৪২ সালে তিনি ‘ভারত-ছাড়’ আন্দোলনে যোগ দিয়ে গ্রেফতার হন। ১৯৪৬ সালে মুক্তি পেয়ে নোয়াখালীতে সংগঠন গড়ার চেষ্টা করেন।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তিনি নিজ ভূখন্ড পূর্ব পাকিস্তানেই থেকে যান। স্বাধীনতার পর তিনি ঢাকার রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারী ও শারিরীকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর তিনি রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। তদুপরি সামরিক জান্তা তাঁর নির্বাচন বাতিল করে এবং তাঁর রাজনৈতিক এমনকি সামাজিক কার্যকলাপেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এরপর ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী নিজ গ্রাম ময়মনসিংহের কাপাসাটিয়ায় চলে যান এবং সেখানে বসবাস করতে শুরু করেন।

১৯৭০ সালে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যান। ভারত সরকার তাকে সম্মাননা দেবার জন্যে দিল্লী নিয়ে যান। চিরকুমার ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী দিল্লীতেই ১৯৭০ সালের ৯ আগষ্ট মৃত্যুবরণ করেন।

মা, মাটি, মানুষের জন্য আজীবন দুঃসহ অত্যাচার সহ্য করেওনিজের কাজের মূল্যায়নে তিনি ছিলেন অকপট তাই তিনি বলেছেন, “আমার স্বপ্ন সফল হয় নাই, আমি সফলকাম বিপ্লবী নই। আমার ব্যর্থতার কারণ, আমার দুর্বলতা নয়। আমি কখনও ভীরু ছিলাম না- আমার জীবনে কখনও দুর্বলতা দেখাই নাই। আমি আমার চরিত্র নির্মল ও পবিত্র রাখতে সক্ষম হইয়াছি। অর্থলোভ আমার ছিল না। এক সময় হাজার টাকা আমার কাছে আসিয়াছে, কিন্তু সে টাকা নিজের ভোগ-বিলাসের জন্য ব্যয় করি নাই।—– মৃত্যুভয় আমার ছিল না, যে কোনো বিপদজনক কাজে হাত দিতে আমি পশ্চাৎপদ হই নাই। আমার স্বাস্থ্য ভাল ছিল, আমি কখনও অলস ছিলাম না, কঠিন পরিশ্রমের কাজে কখনও ভীত হই নাই, যখন যে কাজ করিয়াছি, আন্তরিকতার সাথে করিয়াছি। আমার ব্যর্থতার কারণ পারিপার্শ্বিক অবস্থা, আমার ব্যর্থতার কারণ একজন দক্ষ ও সফলকাম বিপ্লবীর যতটা ধীশক্তি ও জন- গণ-মন অধিনায়কতার যে ব্যক্তিত্ব থাকা আবশ্যক তাহার অভাব”।

সূত্র: gunijan.org.bd
সম্পাদনা: বাঙালীয়ানা

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.