দুনিয়া কাঁপানো বিপ্লবে সমগ্র বিশ্বব্যবস্থাকে বদলে দিয়েছিল রাশিয়া। কেবল রাশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকেনি এ বিপ্লব, ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বময়। মানুষের চিন্তা, মনন, দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এক অভাবনীয় মানবিকতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছিল রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব।
১৭৮৯ সালের স্বাধীনতা, সাম্য, মৈত্রী প্রতিষ্ঠার ফরাসি বিপ্লব প্রকৃতই ছিল বুর্জোয়া ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিপ্লব। প্রচলিত সামন্তবাদী ব্যবস্থা বিলোপ ঘটিয়ে বুর্জোয়া ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ফরাসি বিপ্লব মেহনতিদের মুক্তি দিতে পারেনি। বিপরীতে বুর্জোয়া শাসন-শোষণের নতুন এই ব্যবস্থার জাঁতাকলে শিকার হয়েছিল শ্রমজীবী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ।
১৮৭১ সালে প্যারি কমিউনের বিপ্লব শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষাকে প্রজ্বলিত করলেও; সেটা স্থায়ী হতে পারেনি বুর্জোয়াদের আঘাতে-আগ্রাসনে। ১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ থেকে ২৮ মে পর্যন্ত স্থায়ী ছিল প্যারি কমিউনের সাফল্য। ১৮৭১ সালের ২৮ মে শ্রমজীবীদের ক্ষমতা হারানোর মধ্যদিয়ে পতন ঘটে প্যারি কমিউনের। প্যারি কমিউনের বিজয় স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ৭২ দিন।
অক্টোবর বিপ্লব অতীত ব্যর্থতার গ্লানি পেরিয়ে অসামান্য বিজয়ের সাফল্য লাভ করেছিল। মানবমুক্তিতে বিপ্লবের বিকল্প কিছু নেই। তাই বিপ্লব যেমন প্রাসঙ্গিক–তেমনি অনিবার্যও। কার্ল মার্কস, এঙ্গেলসের তত্ত্ব তত্ত্বরূপেই থেকে যেতো, যদি সেই তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ না ঘটতো। বলশেভিক বিপ্লবের বিজয়ে বিশ্বে মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বপ্রথম আবির্ভাব ঘটেছিল সোভিয়েত রাশিয়ায়। তবে এই বিপ্লব হঠাৎ করেই ঘটেনি। দীর্ঘ পথপরিক্রমায়, ত্যাগ-আত্মত্যাগে অক্টোবর বিপ্লব বিশ্বসভ্যতার নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। রাশিয়ার বিপ্লব ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া মহাদেশগুলোতেও।
নিপীড়ক জার শাসনামল শেকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলেছিল যে অক্টোবর বিপ্লব তার প্রাণশক্তি, রূপকার, নেতা ছিলেন ভ্লাদিমির ইলিচ উইলিয়ানভ। লেনিন তাঁর ছদ্মনাম। লেনিন নামেই তিনি হয়েছিলেন বিশ্বখ্যাত।
বাংলার কবিকিশোর সুকান্ত ভট্টাচার্য তার লেনিন কবিতায় যথার্থই বর্ণনা করেছেন অক্টোবর বিপ্লবে লেনিনের প্রাসঙ্গিকতা।
লেনিন ভেঙেছে রুশে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,
অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন প্রথম প্রতিবাদ।
আজকেও রুশিয়ার গ্রামে ও নগরে
হাজার লেনিন যুদ্ধ করে,
মুক্তির সীমান্ত ঘিরে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে।
বিদ্যুৎ-ইশারা চোখে, আজকেও অযুত লেনিন
ক্রমশ সংক্ষিপ্ত করে বিশ্বব্যাপী প্রতীক্ষিত দিন,-
বিপর্যস্ত ধনতন্ত্র, কণ্ঠরুদ্ধ, বুকে আর্তনাদ;
– আসে শত্রুজয়ের সংবাদ।সযত্ন মুখোশধারী ধনিকেরও বন্ধ আস্ফালন,
কাঁপে হৃৎযন্ত্র তার, চোখে মুখে চিহ্নিত মরণ।
বিপ্লব হয়েছে শুরু, পদানত জনতার ব্যগ্র গাত্রোত্থানে,
দেশে দেশে বিস্ফোরণ অতর্কিতে অগ্ন্যুৎপাত হানে।
দিকে দিকে কোণে কোণে লেনিনের পদধ্বনি
আজো যায় শোনা,
দলিত হাজার কণ্ঠে বিপ্লবের আজো সম্বর্ধনা।
পৃথিবীর প্রতি ঘরে ঘরে,
লেনিন সমৃদ্ধ হয় সম্ভাবিত উর্বর জঠরে।
আশ্চর্য উদ্দাম বেগে বিপ্লবের প্রত্যেক আকাশে
লেনিনের সূর্যদীপ্তি রক্তের তরঙ্গে ভেসে আসে;
ইতালী, জার্মান, জাপ, ইংলন্ড, আমেরিকা, চীন,
যেখানে মুক্তির যুদ্ধ সেখানেই কমরেড লেনিন।
অন্ধকার ভারতবর্ষ: বুভুক্ষায় পথে মৃতদেহ-
অনৈক্যের চোরাবালি; পরস্পর অযথা সন্দেহ;
দরজায় চিহ্নিত নিত্য শত্রুর উদ্ধত পদাঘাত,
অদৃষ্ট ভর্তসনা-ক্লান্ত কাটে দিন, বিমর্ষ রাত
বিদেশী শৃঙ্খলে পিষ্ট, শ্বাস তার ক্রমাগত ক্ষীণ-
এখানেও আয়োজন পূর্ণ করে নিঃশব্দে লেনিন।লেনিন ভেঙেছে বিশ্বে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,
অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন জানায় প্রতিবাদ।
মৃত্যুর সমুদ্র শেষ; পালে লাগে উদ্দাম বাতাস
মুক্তির শ্যামল তীর চোখে পড়ে, আন্দোলিত ঘাস।
লেনিন ভুমিষ্ঠ রক্তে, ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ,
বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই লেনিন।।(সুকান্ত ভট্টাচার্য / লেনিন)
ভলগা নদীর তীরবর্তী সিমবির্স্ক শহরে ১৮৭০ সালের ২২ এপ্রিল লেনিন সম্ভ্রান্ত ও অবস্থাপন্ন এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রাপ্ত এবং সরকারি স্কুলের পরিদর্শক। কর্মজীবনে তাঁর পিতা প্রশাসনের উচ্চপদ মর্যাদায়ও অসীন হয়েছিলেন। লেনিনের মাতা ছিলেন বিত্তবান এক জার্মান ডাক্তারের মেয়ে। অর্থাৎ লেনিন একটি সুবিধাভোগী শ্রেণির প্রতিনিধি হয়েও বঞ্চিত-নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সম্পূর্ণ শ্রেণিচ্যুত হয়ে।

১৮৮৭ সালে ১৭ বছরের লেনিন
জার শাসনের বিশাল রাশিয়া ছিল সমগ্র বিশ্বের ছয় ভাগের এক ভাগ ভূখণ্ডের জার সাম্রাজ্যের অধীন। একদিকে জার স্বৈরতন্ত্র, সামন্তবাদী শোষণ অপরদিকে শিল্প সাহিত্যের খ্যাতিমান লেভ তলস্তয়, দস্তয়ভস্কির দেশ রাশিয়া। ইউরোপের আধুনিক সংস্কৃতির অন্যতম সঙ্গীতজ্ঞ চাইকোভস্কিও রাশিয়ান। জার সম্রাটের নিষ্ঠুর শাসনে অতিষ্ঠ তরুণদের মধ্যে বিপ্লবাকাক্সক্ষার সৃষ্টি হয়। ১৮৬০ সালে দাস প্রথা কাগজে-কলমে রদ হলেও, বাস্তবে সামন্ত শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট ছিল রাশিয়ার সমষ্টিগত সাধারণ মানুষ। তরুণদের মধ্যে জার শাসন অবসানে সশস্ত্র পন্থা অবলম্বনের সূত্রপাত ঘটে। ১৩ মার্চ ১৮৬০ সালে তরুণ বিপ্লবীদের বোমায় জার আলেকজান্ডার-২ নিজ রাজধানী সেন্ট পিটার্সবুর্গের শ্বেত প্রাসাদে নিহত হয়। লেনিনের পিতা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৮৮৬ সালে আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন।
১৮৮৭ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পূর্ব মুহূর্তে লেনিনের জীবনে ঘটে এক সকরুণ ঘটনা। সেই ঘটনাই লেনিনকে পুরোমাত্রায় পাল্টে দেয়। পাল্টে দেয় তাঁর চিন্তা, চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি। জার সম্রাট আলেকজান্ডারের হত্যার অভিযোগে লেনিনের বড় ভাই আলেকজান্ডার উইলিয়ানভ গ্রেফতার হন। সেন্ট পিটার্সবুর্গের বোমা হামলায় অংশগ্রহণকারী বিপ্লবীদের সঙ্গে লেনিনের বড় ভাই আলেকজান্ডার যুক্ত ছিলেন। বিচারে নিজেকে নির্দোষ ঘোষণা এবং ক্ষমা ভিক্ষা অস্বীকার করে আদালতে লেনিন ভ্রাতা আলেকজান্ডার বলেন, ‘আমি মনে করি দেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন শুধু সম্ভব তাই নয়, এটা অনিবার্য। বিপ্লবের কারণে আমি মৃত্যুবরণে ভীত নই।’ ২০ মার্চ তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। বড় ভাইয়ের এই আত্মদানই লেনিনকে বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে ঐ বছর ভর্তি হন লেনিন। এবং বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। পরবর্তীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন শাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সময় লেনিন কার্ল মার্কসের অর্থনীতি, দর্শন, রাজনৈতিক মতাদর্শ একাগ্রচিত্তে পাঠ করেন। রাশিয়ান ভাষায় প্লেখানভের লেখা বইয়ের মাধ্যমে তরুণ বিপ্লবীরা মার্কসীয় দর্শন ও মতবাদের সাথে পরিচিত হন। লেনিন নিজেও প্লেখানভের বই এবং তাঁর অনুদিত মার্কসের বই পাঠ করে মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়ে ওঠেন। প্লেখানভের সঙ্গে লেনিনের মতবিরোধের পরও লেনিন প্লেখানভের অবদানকে আজীবন স্বীকৃতি দিয়েছেন। পার্টির তরুণদের উদ্দেশ্যে লেনিন বলেছেন, ‘তরুণ পার্টি সদস্যদের উপকারে আমাকে এইকথা যোগ করতেই হবে যে, তোমরা কেউ প্লেখানভের দার্শনিক রচনাসমূহ পাঠ, পাঠ করতে আমি বোঝাতে চাই অনুশীলন না করে ধীমান কমিউনিস্ট হয়ে ওঠার আশা কোরো না। কারণ মার্কসবাদের ওপর এর চেয়ে প্রকৃষ্ট বিশ্বের আর কোথাও কিছু লেখা হয় নি।’ [লেনিন ১৯২১ গ, পৃ ৯৪] রাশিয়ায় বিপ্লবী তরুণেরা প্লেখানভ পাঠ করেই মার্কসবাদের শিক্ষা গ্রহণ করে সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি গঠন করেছিল। একথা লেনিন নিজেও স্বীকার করেছেন। ১৮৯১ সালে আইন শাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন লেনিন।
১৮৯৩ সালে সেন্ট পিটার্সবুর্গে লেনিন বিভিন্ন মার্কসবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৮৯৫ সালে লীগ অব স্ট্রাগল গঠন করে বিপ্লবকে সংহত করতে চেষ্টা করেন। ঐ উদ্দেশে বিদেশ যেতে চাইলেও সরকারি অনুমতি পাচ্ছিলেন না। তবে হঠাৎ করেই সে সুযোগ আসে। প্লেখানভের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে জেনেভাতে। মত প্রচারে ‘রাবোদনিক’ পত্রিকা প্রকাশের আলোচনা হয়। লাফার্গ, লিবনেখট্ প্রমুখ মার্কসবাদীদের সঙ্গে লেনিনের পরিচয় ঘটে। লেনিন দেশে ফিরে এলে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। ১৮৯৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৮৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একটানা কারাবাসের পর লেনিনকে তিন বছরের জন্য সাইবেরিয়াতে নির্বাসনে পাঠানো হয়। নির্বাসনে থাকা সময়ে লেনিন ‘‘The Development of Capitalism in Russia” এবং “The Tasks of the Russian Social Democats” বই দুটি রচনা করে নারদনিক মতবাদ ও সোস্যাল ডেমোক্র্যাট পার্টির মধ্যকার অর্থনীতিবাদকে প্রত্যাখ্যানে যথাযথ ভূমিকা পালন করেন।

১৯২০ সালের ৫ মে মস্কোর সভেরদলভ স্কয়ারে এক সভায় বক্তব্য রাখছেন লেনিন।
১৯০০ সালে নির্বাসন থেকে সেন্ট পিটার্সবুর্গে ফিরে এসে ‘ইস্ক্রা’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯০৩ সালের পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে পার্টির মধ্যকার বলশেভিক ও মেনশেভিক ধারার সৃষ্টি হয়। ব্রাসেলসে শুরু হলেও সরকারি নিষেধাজ্ঞায় পরে দ্বিতীয় কংগ্রেস লন্ডনে স্থানান্তরিত হয়েছিল। ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে রুশ-জাপান যুদ্ধ শুরু হয়। লেনিনের বিখ্যাত বই “ওয়ান স্টেপ ফরোয়ার্ড, টু স্টেপ ব্যাক” প্রকাশিত হয়। বাকুতে তেল-খনির শ্রমিক ধর্মঘটে মালিক পক্ষের দাবি মেনে নেয়া হয়। সেন্ট পিটার্সবুর্গের সর্ববৃহৎ কারখানা পুটিলভে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে বৃহৎ শ্রমিক আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং সেটা দ্রুত দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ৯ জানুয়ারি ১৯০৫ বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা জারের শ্বেতপ্রাসাদ অভিযানকালে নিরস্ত্র শ্রমিকদের ওপর গুলি চালায় জারের সশস্ত্র বাহিনী। এতে শতাধিক শ্রমিক নিহত এবং অগণিত শ্রমিক আহত হয়। ইতিহাসে এই দিনটি ‘রক্তাক্ত কালো রবিবার’ নামে অভিহিত। সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। চর্তুদিকে শ্রমিক ধর্মঘট বিস্তার লাভ করে। জুন মাসে পটেমকিন যুদ্ধজাহাজ জার সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং শ্রমিকদের পক্ষ গ্রহণ করে। ১৯০৫ সালে বিপ্লবের এই সূচনা বাস্তবে জয়ী হতে পারেনি।
লেনিন গণতান্ত্রিক বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণির ভূমিকা সম্পর্কে মার্কসীয় ব্যাখ্যা উত্থাপন করেন, ‘Two Tactics of Social Democracy in the Democratic Revolution’ বইতে। পার্টির তৃতীয় কংগ্রেস লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয়। লেনিনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পার্টিতে গৃহিত হয়। নভেম্বরে লেনিন দেশে ফিরে আসেন। ডিসেম্বরে ফিনল্যান্ডে বলশেভিক কনফারেন্সে লেনিনের সাথে সর্বপ্রথম স্ট্যালিনের সাক্ষাৎ হয়। পার্টির পঞ্চম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় লন্ডনে ১৯০৭ সালে। জার সম্রাটের পুলিশের হাতে গ্রেফতার এড়িয়ে গোপনে সুইজাল্যান্ডে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১৯০৮ সালে সুইজাল্যান্ড থেকে প্যারিস চলে আসেন। বিজ্ঞানী মাখের দর্শনে প্রভাবিত কতিপয় বলশেভিক ও মেনশেভিক বুদ্ধিজীবী কার্ল মার্কসের মতবাদের ওপর অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। এই ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে লেনিন অনেক ক’টি নোট লিখে প্রচার করেন এবং এই বিভ্রান্তকারীদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘Materialism and Empirio-Criticism : Critical Comments on a Reactionary Philosoply’ ।
প্রাগে অনুষ্ঠিত পার্টির ষষ্ঠ কনফারেন্সে ১৯১২ সালে মেনশেভিকদের বহিষ্কার করে পার্টির নতুন নামকরণ করা হয়, ‘রাশিয়ান সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি (বলশেভিক)।’ এ বছরই লেনিন অস্ট্রিয়ার অধীন পোল্যান্ডের ক্রাকাওতে চলে যান। সেখানেও তাঁর পক্ষে থাকা সম্ভব হয়নি। ঠিকানা বদল করে পোরোনিন নামক পোলিশ গ্রামে আশ্রয় নেন। প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হয় ১৯১৪ সালের আগস্টে। লেনিন তখন আশ্রয় নেন সুইজারল্যান্ডে। এই যুদ্ধে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে শ্রমিক-মেহনতি শ্রেণির ভূমিকা নিয়ে অপরাপর দেশের কমিউনিস্টদের সঙ্গে লেনিনের মতবিরোধ প্রবল হয়ে পড়ে। স্বাদেশিকতার নামে সাম্রাজ্যবাদীদের এই যুদ্ধে এক দেশের শ্রমিক অপর দেশের শ্রমিকের ওপর গুলি চালাবে- লেনিন ছিলেন আত্মঘাতি এই প্রবণতার প্রবল বিরোধী। সকল দেশের শ্রমিক শ্রেণির মানুষের প্রতি তাঁর ছিল অভিন্ন নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি। লেনিনকে বলশেভিক এবং অন্যরা ‘অতিমানব’ জ্ঞান করলেও লেনিন কখনো এসকল ব্যক্তি স্তুতিকে সমর্থন করেননি। তাঁর প্রকৃত পরিচয় একজন মতাদর্শিক রাজনৈতিক প্রতিভাসম্পন্ন বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ। যিনি সমাজ ও সময়কে বাস্তবতার নিরিখে বুঝতে পারতেন।
অসাধারণ বাগ্মী ও তীক্ষ্ণধারার বিচক্ষণ বক্তা। যুক্তিবাদী লেনিন আবেগ, উচ্ছ্বাস, উত্তেজনার বিপরীতে ছিলেন ধীরস্থির, সহিষ্ণু প্রকৃতিক এক সংগ্রামী মানুষ। আদর্শিক রাজনৈতিক প্রশ্নে তিনি অনমনীয়, আপোসহীন, অবিচল এবং কৌশলী এক সংগ্রামী জননেতা। অসাধারণ তাঁর ব্যক্তিত্বপ্রভাব, বুদ্ধিমত্তা ও কর্মশক্তি। এক সাংবাদিক বলেছেন, ‘শাণিত, ক্ষুরধার তাঁর বুদ্ধি, আশ্চর্য প্রখর তাঁর মন।’ ৮ মার্চ ১৯১৭ সেন্ট পিটার্সবুর্গ শহরে চরম শ্রমিক বিদ্রোহ শুরু হয়। জার নিকোলাস–২ সিংহাসন চ্যুত হয় এবং প্রভিশনাল সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। লেনিন এপ্রিল মাসে জার্মানি থেকে রাশিয়ায় প্রত্যাবর্তন করেন। সেন্ট পিটার্সবুর্গে বিখ্যাত এপ্রিল থিসিস ঘোষণা করেন। যার মর্মকথা, কোনো রকম বিলম্ব না করে অনতিবিলম্বে বুর্জোয়াশ্রেণির প্রভিশনাল সরকার উৎখাত করে বিপ্লব সংঘটিত করা। শ্রমিক-কৃষক এবং সৈনিকগণ সম্মিলিত ভাবে সোভিয়েতগুলোর রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করতে হবে। প্রভিশনাল সরকার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সোভিয়েতগুলোকে ভেঙে বলশেভিকদের নিশ্চিহ্ন করতে। লেনিন আত্মগোপনে চলে যান।
জুলাইর ২৪ তারিখে কেরেনেস্কি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়। নতুন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৭ নভেম্বর ১৯১৭ বলশেভিকরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে, লেনিনের নেতৃত্বে। সম্পন্ন হয় অক্টোবর বিপ্লব। ডিসেম্বরে রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের বুর্জোয়াদের গঠিত হোয়াইট গার্ড ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশ বিপ্লব পরাস্ত করতে নিজেদের সৈন্য প্রেরণ করে গৃহযুদ্ধের সূচনা করে। তবে এতে তাদের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভ সম্ভব হয়নি। অক্টোবর বিপ্লব বিজয়ের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে যায়।
১৯১৮ সালে জার্মানির সঙ্গে ব্রেস্ট-লিটভস্ক চুক্তিতে সোভিয়েত সরকার এবং জার্মানির যুদ্ধ স্থগিত হয়। ৩০ আগস্ট একটি শ্রমিক সমাবেশে বক্তৃতা শেষে গাড়িতে ওঠার মুহূর্তে আততায়ী এক নারীর গুলিবর্ষণে লেনিন মারাত্মক আহত হন। লেনিন গার্ড রেজিমেন্ট নিয়ে চলাচল করতেন না। তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী একমাত্র গাড়িচালক। যিনি দ্রুত লেনিনকে নিয়ে বাসায় আসেন। বাসায়ই চলে তাঁর চিকিৎসা। লেনিনের দেহে দু’টি গুলি অনেকদিন পর্যন্ত ছিল। শেষে এই গুলির বিষক্রিয়ায় মাথাব্যথার যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। তাঁর কণ্ঠাস্থিতে থাকা একটি গুলি বের করা হয়। গুলিবিদ্ধ লেনিন তারপরও তীব্র মানসিক শক্তিতে নতুন রাষ্ট্রের সমস্ত কিছু সামাল দিয়েছেন। পরপর তিনবার পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেন। শরীর অসাড় হয়ে যায়।
২১ জানুয়ারি ১৯২৪ মহান এই বিপ্লবীর জীবনাবসান ঘটে। ইতিহাসের কিংবদন্তি মহানায়ক বিপ্লবী লেনিন নতুন রাষ্ট্র গঠনের কাজে যথেষ্ট সময় পাননি। বিপ্লবের মাত্র ক’বছর পরেই তাঁর মৃত্যু হয়।
ব্যক্তিগত জীবনে শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে বিপ্লবী আদর্শ প্রচারের অন্যতম কর্মী-সংগঠক নাদেজদা ক্রুপস্কায়াকে লেনিন বিয়ে করেছিলেন। বিপ্লব পরবর্তী লেনিনের বেঁচে থাকা সোভিয়েত রাষ্ট্রের জন্য ছিল অপরিহার্য। লেনিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেও গঠন প্রক্রিয়ায় নগণ্য সময় যুক্ত থাকতে পেরেছেন। এটি সোভিয়েত রাষ্ট্রের জন্য কেবল নয় বিশ্বের অগণিত নিপীড়িত-মেহনতি মানুষের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যও ছিল চরম আঘাততুল্য।
বাঙালীয়ানা/এসএল