দৃঢ়তা, বীরত্বের প্রতীক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান বীরশ্রেষ্ঠ

Comments

১৯৭১ সালের ৩১ জানুয়ারী দু’মাসের ছুটিতে এসেছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান। ছুটিতে ঢাকায় মতিউর দেশে বড় ধরনের কোনো ওলট-পালট ঘটতে চলেছে কি না তার অপেক্ষা করতে থাকেন। মার্চের ১ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে ঢাকাসহ সারা দেশে যে প্রবল বিক্ষোভ শুরু হয়, তা লক্ষ করে মতিউরের মনে হয়, এই অবস্থায় তাঁর পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না।

Matiur Rahman01

বৈমানিকের পোশাকে মতিউর রহমান

৭ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের বিশাল জনসভায় যোগ দেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে এবং জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে তাঁর মনে হয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে আর অখণ্ডরূপে টিকে থাকা সম্ভব হবে না, বাংলাদেশ স্বাধীন হতে চলেছে।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে জনসাধারণের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেন। যতই দিন যায়, ততই তাঁর এই ধারণা প্রবল হতে থাকে যে বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। একই সঙ্গে তাঁর মনে এই আশঙ্কাও জাগে যে বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রাম নস্যাৎ করতে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে; যা কিছুই ঘটুক না কেন, তা যে অত্যন্ত গুরুতর কিছু হবে, সেটি তিনি বুঝতে পারছিলেন মতিউর।

অসহযোগ আন্দোলনের একটা বড় সময় তিনি ঢাকায় অবস্থানরত বাঙালী বিমানবাহিনীর অফিসারদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করেন বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খোন্দকার উইং কমান্ডার এম কে বাশার, স্কোয়াড্রন লিডার এম সদরুদ্দীন, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম হামিদুল্লাহসহ বিমানবাহিনীর আরও কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী সঙ্গে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, বিমানবাহিনীর ১৮ জন বাঙালী অফিসার এবং প্রায় ৫০ জন টেকনিশিয়ান ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করবেন।

২৫ মার্চ সকালে তিনি নরসিংদীর রায়পুরায় দাদা বাড়িতে বেড়াতে যান। কিন্তু সেদিনই মধ্যরাতে ঢাকায় শুরু হলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস গণহত্যাযজ্ঞ। তিনি দাদার গ্রামে আটকা পড়লেন। কিন্তু তিনি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলেন না। তিনি দাদার গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোর তরুণ-যুবকদের সংগঠিত করে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলেন। গ্রামের তরুণ-যুবকদের প্রতিদিন নিয়মিত শরীরচর্চা করাতেন, অস্ত্র চালনা, পরিখা খনন ইত্যাদি শেখাতেন। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি তিনি করতেন, তা হলো যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করা, সাহস জোগানো।

Matiur Rahman04

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান

শহীদজননী জাহানারা ইমাম মতিউর রহমান সম্পর্কে লিখেছেন, ‘দশ-এগারো বছর বয়স থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে বাস করা সত্ত্বেও ওই অঞ্চলের প্রতি মতির কোনো রকম আকর্ষণ বা মমতা জন্মায়নি। দুই দেশের জলবায়ু, ভাষা, জীবনযাপন প্রণালি, মানসিকতা ইত্যাদি সবকিছুর মধ্যেই আকাশ-পাতাল তফাত, সেটা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতেন। কিংবা বলা যায়, তাঁর মতো এমন করে অন্য অনেকে হয়তো উপলব্ধি করতেন না। সুযোগ ও প্ররোচনা থাকা সত্ত্বেও তিনি অবাঙালী মেয়ে বিয়ে করেননি, তাঁর বন্ধুরাও যাতে না করেন, সেদিকে মতির খেয়াল ছিল। তাঁর সন্তানেরা যাতে বাংলায় সহজে কথা বলতে শেখে, তার জন্য তিনি বাসায় উর্দুভাষী লোক পর্যন্ত রাখতেন না। অনেক খরচ ও হাঙ্গামা করে দেশ থেকে বাঙালী কাজের লোক নিয়ে যেতেন।’

১৯৩৯ সাল। সারা পৃথিবী জুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল। ইংরেজদের অধীনে এই ভারত উপমহাদেশের ঢাকা নামের ভূখন্ডের মানুষগুলোও তখন যুদ্ধের আতঙ্কে আতঙ্কিত। এমনি যুদ্ধের মাঝে ১৯৪১ সালে ঢাকা শহরের আগা সাদেক রোডের ১০৯ নম্বর বাড়িতে জন্ম নেন মতিউর রহমান। তারিখ ২৯ অক্টোবর, বুধবার, মধ্যরাত্রি। মা সৈয়দা মোবারুকুন্নেসা। বাবা মৌলবি আব্দুস সামাদ। তিনি পেশায় ছিলেন ঢাকা কালেক্টর অফিসের সুপার। নরসিংদী জেলার রায়পুর থানার রামনগর গ্রামে ছিল তাঁদের পৈত্রিক নিবাস। নয় ছেলে দুই মেয়ের পরিবারে জন্ম নেয়া মতিউর ছিলেন অষ্টম। ছেলেবেলা থেকেই তিনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, দুরন্ত, ডানপিটে। ১৯৫২ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর মাঝে ছিল প্রতিভার দ্যুতি।

বাংলা ভাষাকে তথা বাঙালীর মুখের ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যাঁরা বুকের রক্ত ঢেলে ঢাকার পিচঢালা রাজপথ রাঙিয়েছিলেন, তাঁদের গৌরবময় ইতিহাস ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী। ব্রিটিশদের কবল থেকে বেরিয়ে আমাদের স্বাধীনতার দিকে এগোবার প্রথম সোপান ছিল এটি। বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে উত্তাল সেই দিনগুলোতে মতিউরের বয়স মাত্র এগারো বছর। সে সময়েই ভাষার জন্য এ আন্দোলন দাগ কাটে তাঁর মনে। নিজের ভাষা নয় এবং চাপিয়ে দেয়া ভাষা হওয়ায় মতিউর এসময়ে তাঁর পাঠের অন্তর্গত উর্দু পড়তে চাইতেন না। সরাসরি বলতেন, ‘উর্দু কেন পড়ব? আমাদের ভাষা তো বাংলা।’

Matiur Rahman03

শিক্ষার্থে পাকিস্তান যাবার দিন সকালে পরিবারের সাথে সর্বডানে (টাই পরিহিত) মতিউর রহমান

মতিউরের বাবা মৌলবি আব্দুস সামাদ ছিলেন ছেলের উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে সচেতন। তিনি তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানের সারগোদা পি. এ. এফ স্কুলে ভর্তি করাতে চাইলেন। পশ্চিম পাকিস্তানীদের বৈষম্যের কারণে বাঙালীদের সেনা, নৌ বা বিমান বাহিনীতে ভর্তি হওয়া ছিল খুবই কঠিন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বাছাই করা স্কুলের বাছাই করা ছাত্রদের মাঝে পরীক্ষা হলো ইংরেজি মাধ্যমে। ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করে মেধাবী মতিউর ১৯৫৬ সালে সারগোদা পি. এ. এফ একাডেমি স্কুলে ভর্তি হন। দিনটি ছিল ৫ই এপ্রিল। মতিউর থাকতে শুরু করলেন টেমপেস্ট হলে। নতুন জায়গায়, অচেনা পরিবেশে পাকিস্তানী সহপাঠীদের অসহযোগিতার মাঝে মতিউরের সময় কাটতে লাগল। তিনি কখনোই উর্দু ব্যবহার করতেন না। ডাইনিং হলে খাবার খাওয়া নিয়েও অনেক ব্যঙ্গ বিদ্রূপ সহ্য করতে হতো তাঁকে। কিন্তু তিনি তাঁর মেধা দিয়ে, সীমাহীন সহ্যশক্তি আর প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা দিয়ে সকল প্রতিকূলতা জয় করার চেষ্টা করেন। প্রথম পরীক্ষাতেই সবার জবাব দিয়ে দিলেন তিনি। খেলাধুলায় প্রথম স্থান অধিকার করলেন। ফুটবল, হকি, বাস্কেটবল ও সাঁতারে সবাইকে অবাক করে দিলেন তাঁর ক্রীড়ানৈপুণ্যে।

১৯৬০ সালের মে মাসে মতিউর কৃতিত্বের সাথে ১ম বিভাগে মেট্রিক পাস করলেন ডিস্টিংশনসহ। এরপর দিলেন ISSB exam. এরপর ১৯৬১ সালের আগস্টের ১৫ তারিখে তিনি রিসালপুরে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর একাডেমিতে ফ্লাইট ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন জিডি পাইলট কোর্সে। পাকিস্তানীরা সবসময়ই তাঁকে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছে। বিমান নিয়ে পাকিস্তানী পাইলটের সাথে ডগ ফাইট করতে গিয়ে সাজাও ভোগ করেছেন মতিউর। কিন্তু তবুও মতিউর ছিলেন একজন চৌকস ক্যাডেট। তাঁর একাগ্রতা, ইচ্ছা আর মেধার কাছে প্রতিহত হলো সকল বিপত্তি। এগিয়ে গেলেন তিনি।

১৯৬৭ সালে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হয়ে পদোন্নতি হয় মতিউর রহমানের। ১৯৬৮ সালের ১৯ এপ্রিল বিয়ে করেন এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে মিলি খানকে। বিয়ের কয়েকদিন পরেই মতিউর চলে যান পাকিস্তানের চাকলালা বিমান ঘাঁটিতে। ১৯৬৯ সালের ২৩ এপ্রিল জন্ম হয় এ দম্পতির প্রথম কন্যা মাহিনের। পরের বছর ১৪ ডিসেম্বর জন্ম হয় দ্বিতীয় সস্তান তুহিনের।

Matiur Rahman02

সন্তান ও স্ত্রীর সাথে মতিউর রহমান

১৯৭১ সালের শুরুতে সারাদেশ যখন উত্তাল, ছুটিতে সপরিবারে ঢাকা এসে দাদা বাড়ী রায়পুরের রামনগর গ্রামে আটকে পড়া মতিউর অসীম ঝুঁকি ও সাহসিকতার সাথে ভৈরবে যে ট্রেনিং ক্যাম্প শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানী বিমান বাহিনী ‘সেভর জেড’ বিমান থেকে তাঁর গড়ে তোলা সেই ট্রেনিং ক্যাম্প ও প্রতিরোধ বাহিনীর ঘাঁটির উপর বোমাবর্ষণ করে। মতিউর রহমান পূর্বেই এটি আশঙ্কা করেছিলেন। তাই আক্রমণের পূর্বেই ঘাঁটি পরিবর্তনের কারণে ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পান তিনি ও তাঁর বাহিনী। বিমান আক্রমণ শেষে মতিউর সবার উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘বিমান থেকে ভৈরবে বোমাবর্ষণ হয়েছে। পাইলটদের মাঝে এমনও হতে পারে কেউ আমার ছাত্র। আমারই ছাত্র আজ আমার মাথায় বোমা ফেলছে। আমার দেশকে রক্তাক্ত করছে।’ মতিউর মাটি হাতে নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার নিজের মাটির মর্যাদা আমি রাখবোই। আমি পাইলট। আমার চাই যুদ্ধবিমান। একটা বিমান পেলে তাদের দেখিয়ে দিতাম। কারণ বিমান প্রতিহত করতে চাই বিমান বা বিমান বিধ্বংসী কামান।’

এরপর মতিউর ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল ঢাকা আসেন। পরিবারের মুরুব্বীদের চাপে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ৯ মে সপরিবারে করাচি ফিরে যান। যদিও দুই মাসের ছুটিতে এসে চারমাস পেরিয়ে গেছে ততদিনে। করাচি পৌঁছে মতিউর লক্ষ্য করেন বাঙালী অফিসারদের সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। তাঁকেও তাঁর নিজের দায়িত্ব না দিয়ে দেয়া হলো ফ্লাইট সেফটি অফিসারের দায়িত্ব। মতিউরের চিন্তা তখন কেবল একটি বিমানের। তিনি পরিকল্পনা শুরু করেন। সহকর্মীদের সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করছেন আর খুঁজছেন সুযোগ। পি. আই. এ-এর একটি বিমান হাইজ্যাকের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর বাঙালী অফিসারদের উপর কড়া নজর রাখা শুরু হয়। বাঙালী পাইলটদের আকাশে উড্ডয়নের অনুমতি বাতিল করা হয়। মতিউর তখন করাচির মশরুর বিমান ঘাঁটির বেস ফ্লাইট সেফটি অফিসার। এর আগে মতিউর ছিলেন ফ্লাইট ইন্সট্রাকটর। ছাত্রদের বিমান চালনার প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি।

২০ আগস্ট শুক্রবার রাশেদ মিনহাজ নামে তাঁর এক অধস্তন অফিসার একটি প্রশিক্ষণ বিমান নিয়ে ওড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। একটি টি-৩৩ বিমান সে জন্য প্রস্তুত ছিল। মতিউর সেটা ছিনতাই করার সিদ্ধান্ত নেন। ওই সময় কন্ট্রোল টাওয়ারে দায়িত্বরত ছিলেন ফরিদউজ্জামান নামের একজন বাঙালী অফিসার এবং একজন পাকিস্তানি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। রাশেদ মিনহাজ কন্ট্রোল টাওয়ারের ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পর বিমানটি নিয়ে ২৭ নম্বর রানওয়েতে ঢোকার জন্য ৪ নম্বর ট্যাক্সি ট্র্যাক দিয়ে এগিয়ে যান। মতিউর তখন তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি চালিয়ে দ্রুত সেখানে চলে যান এবং রাশেদ মিনহাজকে থামার সংকেত দেন। মতিউর ছিলেন ফ্লাইট সেফটি অফিসার; কন্ট্রোল টাওয়ারের ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পরও ফ্লাইট সেফটি অফিসার বিমান থামানোর সংকেত দিলে সেই নির্দেশ পালন করাই নিয়ম। রাশেদ মিনহাজ ট্যাক্সি ট্র্যাকের মাঝখানে বিমানটি দাঁড় করিয়ে বিমানের ক্যানোপি তুলে মতিউরকে জিজ্ঞাসা করেন, কী হয়েছে? তখন মতিউর লাফ দিয়ে বিমানটির ককপিটে উঠে পড়েন।

১৯৬৩ সালে পাইলট অফিসার মতিউর রহমান সামনের সারিতে ডানদিক থেকে দ্বিতীয়

তারপরের ঘটনার বিবরণ সম্পর্কে বিভিন্ন ভাষ্য পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেন, মতিউর রাশেদ মিনহাজকে চেতনানাশক দিয়ে সংজ্ঞাহীন করে বিমানটি চালিয়ে ভারত সীমান্তের দিকে উড়ে যেতে থাকেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর রাশেদ মিনহাজ সংজ্ঞা ফিরে পান এবং দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। ফলে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে দুজনই মারা যান। অন্য একটি ভাষ্যে বলা হয়, দুজনের মধ্যে শুরু থেকেই ধস্তাধস্তি চলে এবং বিমানটি একাত-ওকাত হয়ে আকাশের দিকে উঠে যেতে থাকে। কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে বিমানটির পাখা দুটি অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে দেখে রাশেদ মিনহাজকে জিজ্ঞাসা করা হয়, কোনো সমস্যা হয়েছে কি না। কিন্তু রাশেদ মিনহাজের কাছ থেকে কোনো উত্তর আসে না। বিমানটি খুব নিচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল, সম্ভবত রাডারে ধরা পড়েনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটি কন্ট্রোল টাওয়ারের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। কন্ট্রোল টাওয়ার তখন বেস কমান্ডারকে বিষয়টি জানায়। তারা আশঙ্কা করে, বিমানটি ছিনতাই হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে দুটি এফ-৮৬ জঙ্গি বিমান সেই টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমানের খোঁজে আকাশে উড়ে যায়। কিন্তু সেটির কোনো হদিস তারা পায়নি।

বিকেলের দিকে খবর আসে, ভারত সীমান্তের কাছে তালাহার নামের একটি জায়গায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে বিমানের দুজন আরোহীই মারা গেছেন। রাশেদ মিনহাজের দেহ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এবং মতিউর রহমানের দেহ অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। মতিউর রহমানকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর গোরস্তানে কবর দেওয়া হয়, তবে অফিসারদের কাতারে নয়, সৈনিকদের কাতারে। তাঁর কবরে লেখা হয় গাদ্দার বা বিশ্বাসঘাতক।

তাঁর স্ত্রী মিলি রহমানকে একটা বাড়িতে অন্তরীণ করা হয়, দিনের পর দিন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অবশেষে ১৯৭১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তাঁকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

দীর্ঘ ৩৫ বছর পর ২০০৬ সালের ২৫ জুন তাঁর দেহাবশেষ বাংলাদেশে আনা হয়। ২৬ জুন মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। দীর্ঘ ৩৫ বছর অবহেলায় থাকলেও মতিউর ফিরে আসেন তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন দেশে। ঠাঁই পান এদেশের মাটিতে।

তথ্য সূত্র:
১) প্রথম আলো
২) গুণীজন

সম্পাদনা: বাঙালীয়ানা/এসএল

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.