ফ্রিডম পার্টির ক্যাডার থেকে যুবলীগ নেতা বনে যাওয়া যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় শত কোটি টাকা জমা রয়েছে বলেও জানা গেছে। পুলিশের পর দ্বিতীয় দফায় দশ দিনের রিমান্ডে নিয়ে খালেদকে জিজ্ঞাসাবাদকারী র্যাব কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
র্যাব-৩ এর উপ-অধিনায়ক এবং মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফায়জুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, খালেদকে দ্বিতীয় দফা রিমান্ডে এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বিস্তারিত জানানো হবে।
আশির দশকের শেষদিকে ফ্রিডম পার্টির সক্রিয় কর্মী ছিলেন খালেদ। ধানমন্ডির ৩২ নম্বারের বাড়িতে হামলাকারী ফ্রিডম মানিক ও ফ্রিডম রাসুর হাত ধরে তার রাজনৈতিক পথচলা শুরু। শাহজাহানপুরে বেড়ে ওঠা খালেদ একসময় বিএনপি নেতা মীর্জা আব্বাসের ভাই মীর্জা খোকনের ঘনিষ্ঠ ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শুরু করে যুবলীগের রাজনীতি। ধীরে ধীরে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আসীন হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট ও দুবাইয়ে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের যুব সংগঠনের রাজনীতি শুরু করে খালেদ। প্রথমদিকে সম্রাটের অধীন হয়ে কাজ করলেও সম্প্রতি নিজেই ক্যাডার বাহিনী নিয়ে চলাফেরা করত।

যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ওরফে ক্যাসিনো খালেদ
জিজ্ঞাসাবাদের সময় খালেদ জানায়, এরপরই শুরু হয় তার চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি। আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়েও কাজ করে খালেদ। বৈধ-অবৈধ অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করত সবসময়। ক্যাসিনো, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আয় করে। এসব অর্থ যুবলীগের শীর্ষনেতা থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের অনেক সিনিয়র নেতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভাগ দিত।
তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা ছিল রাজধানীর মতিঝিল, শাহজাহানপুর, রামপুরা, সবুজবাগ, খিলগাঁও ও মুগদা। এসব এলাকায় থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, রেল ভবন, ক্রীড়া পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, যুব ভবন, কৃষি ভবন, ওয়াসার ফকিরাপুল জোনসহ বেশিরভাগ সংস্থার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করত সে। কমলাপুর এলাকায় ‘ভূঁইয়া অ্যান্ড ভূঁইয়া’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে তার।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ জানিয়েছে, মতিঝিলের ফকিরেরপুল ইয়ংমেন্স ক্লাব থেকে তার মাসিক আয় ছিল ৪০ লাখ টাকা। মুক্তিযোদ্ধা চিত্তবিনোদন ক্লাব থেকে মাসিক আয় ছিল তিন লাখ টাকা। শাহজাহানপুর রেলওয়ে গেট সংলগ্ন মাছের বাজার থেকে মাসিক আয় ছিল ৬০ হাজার টাকা। শাহজাহানপুর এলাকার লেগুনা থেকে মাসিক আয় ৩০ হাজার টাকা। বিভিন্ন ফুটপাত থেকে মাসিক আয় ছিল ২০ হাজার টাকা।
অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রেখেছে বলে জানায় খালেদ। এরমধ্যে মালয়েশিয়ার আরএইবি ব্যাংকে ৬৮ লাখ টাকা জমা রয়েছে। সিঙ্গাপুরের ইউওবি ব্যাংকে দেড় কোটি টাকা, ব্যাংক অব ব্যাংককে এক লাখ বার্থ, বাংলাদেশের স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকে ৬ থেকে সাড়ে ৬ কোটি টাকা, ব্র্যাক ব্যাংকে আড়াই কোটি টাকা, এনসিসি ব্যাংকে নিজের নামে ১৯ কোটি টাকার এফডিআর, ব্র্যাক ব্যাংকে স্ত্রী সুরাইয়া আক্তারের নামে ৫০ লাখ টাকা, এনসিসি ও ব্র্যাক ব্যাংকে অর্পণ প্রোপার্টিজের নামে ১৫ লাখ টাকা করে ৩০ লাখ টাকা গচ্ছিত রয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, ২০১৫ সালে খালেদ সুমন নামে একজনের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন শীর্ষ নেতাকে ৬০ লাখ টাকা দেয় খালেদ। আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতাকে পূর্বাচলের একটি প্রজেক্টের জন্য ৫ কোটি টাকা দেয়। যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের শীর্ষ একজন নেতাকে সম্প্রতি ৫০ লাখ টাকা ও আরেকজন পলাতক নেতাকে ৪০ লাখ টাকা দেয় খালেদ। এছাড়া, আওয়ামী লীগের দু’জন মধ্যসারির নেতাকে দুই কোটি টাকা, যুবলীগের এক শীর্ষনেতাকে দুই দফায় ২০ লাখ টাকা এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মতিঝিল বিভাগের একজন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ও ডিবির একজন অতিরিক্ত উপ-কমিশনারকে নিয়মিত টাকা দিত যুবলীগের এই নেতা।.
তদন্ত কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, যুবলীগ নেতা খালেদের ক্যাডারবাহিনীর মধ্যে ঘনিষ্ঠদের নাম জানিয়েছে সে। এরমধ্যে গোরানের কাউন্সিলর আনিস ও তার সহযোগী পিচ্চি রুবেল, ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর একেএম মমিনুল হক সাঈদ, তার সহযোগী হাসান উদ্দিন, আরামবাগ ক্লাবের প্রহরী জামাল ও কাজি সুমন তার অন্যতম সহযোগী ছিল। জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ জানিয়েছেন, গোরানের রাউফুল আলম শুভ (বহিষ্কৃত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক)-এর কাছে ৪/৫টি বিদেশি পিস্তল রয়েছে। এছাড়া ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রিজভী, মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের এনামুল হক আরমান ওরফে ক্যাসিনো আরমান, রানা মোল্লা, কাইল্লা আমিনুল, অঙ্কর, উজ্জল মোর্শেদ, ক্যাসিনো বকুল, ল্যাংড়া জাকির ও ড্রাইভার জিসান তার অন্যতম সহযোগী।
র্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ অনেক তথ্য দিলেও অনেক কিছু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছে। খালেদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে তার ক্যাডার বাহিনীর সদস্য ও সহযোগীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
উল্লেখ্য, ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করে র্যাব। ওই দিনই গুলশানের বাসা থেকে খালেদকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, অস্ত্র আইন, অবৈধভাবে জুয়ার আসর বসানোর অভিযোগে গুলশান ও মতিঝিল থানায় চারটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেফতারের পর প্রথমে গুলশান থানা পুলিশ ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ দুই মামলায় ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরবর্তী সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মামলাটির তদন্ত স্থানান্তর করা হয় র্যাবের কাছে।
বাঙালীয়ানা/এসএল