দ্বিজাতিতত্ত্ব: নানা ভ্রান্তি ও তার প্রচার – পর্ব ১ । রাহমান চৌধুরী

Comments
দ্বিজাতিতত্ত্ব ভারত ভাগের ক্ষেত্রে একটি প্রধান আলোচনার বিষয়। জিন্নাহকে এই দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্ভাবক বলা হয়। বহু বহু বছর ধরে এই কথা ইতিহাসে বলা হয়েছে জিন্নাহ দ্বিজাতিতত্ত্বের না‌মে ভারত ভাগ করেছেন। ইতিহাস লেখকদের অনেকে কংগ্রেসের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে ভারত ভাগের সকল দায় জিন্নাহর কাঁধে চাপিয়েছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস গ্রন্থে বর্তমানেও তাই রয়েছে। পরবর্তীতে বহু ইতিহাসবিদ সত্যানুন্ধান না করে পূর্বের ইতিহাসকে মান্য করে, বার বার পুরানো কথাই বলে গেছেন। জিন্নাহ সেখানে ভারত ভাগের হোতা আর গান্ধী হলেন গণসংগ্রামী। কংগ্রেসের গণসংগ্রামের ভিতর দিয়ে ভারত স্বাধীন হয়েছে। কংগ্রেস হলো ধর্মনিরপেক্ষ দল। জিন্নাহ সেখানে একজন কট্টোর মুসলিম নেতা। জিন্নাহ যে জীবনের প্রথম পনেরো বছর কংগ্রেসের রাজনীতিতে সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সে কথাটাও তাদের অনেকের ইতিহাসে উল্লিখিত নয়। জিন্নাহ যতদিন কংগ্রেসে ছিলেন, সেটা ধর্মনিরপেক্ষ দলই ছিল। কংগ্রেস গান্ধীর দখলে যাবার পর সেটা আর ধর্মনিরপেক্ষ ছিল না। কংগ্রেসের তখনকার প্রধানব্যক্তিত্ব গান্ধীর লক্ষ্য ছিল রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা, গো-রক্ষা আর চতুবর্ণ বা বর্ণবাদ টিকিয়ে রাখা। ফলে মুসলিম অধ্যুষিত ভারতে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখে একজন আর যাই হোক ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারেন না। কংগ্রেসের সভায় গান্ধী এসব বলতেন, কংগ্রেস তা নিয়ে আপত্তি তোলেনি। স্বভাবতই কংগ্রেস গান্ধীর সময়কালে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে কথা না বলে ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে নিজেকে দাবি করতে পারে কি?
কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক চিন্তার পরিচয় পাওয়া যাবে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনকে ঘিরে ভিন্ন দুটি ঘটনায়। কংগ্রেস নেতা নরিমানের ভাগ্যে কী ঘটেছিল? পরবর্তীকালে আবুল কালাম আজাদ তাঁর ‘ভারত স্বাধীন হল’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন, বোম্বাইয়ে নরিমান ছিলেন স্থানীয় কংগ্রেসের নেতা। প্রাদেশিক সরকার গঠনের প্রশ্নে পদমর্যাদা এবং দলীয় কাজের ভিত্তিতে নরিমানকেই নেতৃত্বদানের আহ্বান জানানো হবে এই ছিল সাধারণের প্রত্যাশা। নরিমানকে নেতৃত্বে দিতে বলার মানে এই ছিল যে, যোগ্যতার জোরে একজন পার্শী মুখ্যমন্ত্রী হবেন যেখানে কংগ্রেসের প্রাদেশিক পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য হিন্দু। সরদার প্যাটেল আর তাঁর সহযোগীবৃন্দ কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারছিলেন না। সেই কারণে নরিমানকে বাদ দিয়ে বোম্বাই প্রাদেশিক নেতা বি জি খেরকে দৃশ্যপটে আনা হলো এবং বোম্বাই প্রাদেশিক পরিষদের নেতা হিসেবে তাঁকে নির্বাচিত করা হলো। কংগ্রেসের সভাপতি জওহরলাল বা গান্ধী কেউ এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেননি। নরিমান এইরকম সিদ্ধান্তে দুঃখে ভেঙে পড়লেন এবং কংগ্রেস ছেড়ে দেয়ার কারণে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটলো।
বিহারেও ঘটেছিল অনুরূপ ঘটনা। নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে সৈয়দ মাহমুদ ছিলেন প্রদেশের প্রধানতম নেতা। তিনি সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটিরও তিনজনের একজন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং সে কারণে প্রদেশের বাইরে ও ভিতরে উভয় স্থানে তাঁর প্রভাব ছিল। কংগ্রেস যখন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলো তখন এটা ধরেই নেয়া হয়েছিল যে মাহমুদ নেতা নির্বাচিত হবেন এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের অধীনে বিহারের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হবেন। কিন্তু তাঁর পরিবর্তে মুখ্যমন্ত্রীর মনোনয়ন পেলেন কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য কৃষ্ণ সিংহ ও অনুগ্রহ নারায়ণ সিংহ। তাঁদের ডেকে পাঠানো হলো বিহারে। বোম্বাইয়ে সর্দার প্যাটেল যে ভূমিকা পালন করেছিলেন বিহারে সেই একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন রাজেন্দ্রপ্রসাদ। ভারত স্বাধীন হলো গ্রন্থে আজাদ স্বীকার করছেন, ‘কংগ্রেস তার প্রতিশ্রুত আদর্শ পুরোপুরি মেনে চলতে পারেনি। অনুতাপের সাথে স্বীকার করতে হবে যে, কংগ্রেসের জাতীয়তাবোধ তখনো সাম্প্রদায়িক বিবেচনার উর্ধ্বে উঠে সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘুত্বের পরিবর্তে মেধার ভিত্তিত্বে নেতা নির্বাচন করার পর্যায়ে যেতে পারেনি।’ সংরক্ষিত আসনের প্রশ্নে গান্ধী বহুদিন পূর্বে যে মেধাকে অগ্রাধিকার দেবার কথা বলেছিলেন, তিনি এক্ষেত্রে নীরব রইলেন। মেধার পরিবর্তে গুরুত্ব পেল সাম্প্রদায়িক মনোভাব।
যশোবন্ত সিংহ লিখেছেন, কংগ্রেস ১৯৩৭ সালে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গিয়েছিল। নিজের সাফল্য সম্পর্কে আগে নিশ্চিত ছিল না বলেই মুসলিম লীগের সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাতে গিয়েছিল। যখন ক্ষমতা পেল ‘সংখ্যায় ছোট, সুতরাং অপ্রাসঙ্গিক’ সহযোগীকে ক্ষমতার ভাগ দেওয়া দরকার থাকলো না। এটা একেবারেই বিশুদ্ধ সংখ্যাগুরুবাদ। তিনি আরো বলেন, যার বাস্তব পরিণাম হয়েছিল ভয়ংকর। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতা’-র সঙ্গে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে মেলানো যায় না। কংগ্রেসের চরিত্রধর্মে তারই প্রকাশ ঘটেছিল। গান্ধী আশ্রমের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিচিত্র নারায়ণ শর্মা যিনি কংগ্রেস সরকারের প্রাদেশিক মন্ত্রী ছিলেন, উনিশশো চুরাশি সালের চোদ্দই জুলাই গান্ধীবাদী শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা এক চিঠিতে বলেন, ‘নির্বাচনে কংগ্রেস প্রবল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। আর কংগ্রেসের স্বার্থপরায়ণতা বৃদ্ধি পেল। জওহরলাল সেই প্রবাহে ভেসে গেলেন। বলা যায় কংগ্রেসের “অহং”-এর সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল তাঁর ভিতরেই। এই কারণে সে সময়ে মুসলমানদের উপেক্ষা করা হয়েছিল। আর তার দুষ্পরিণাম হলো প্রবল। পাকিস্তানের জন্মের মূলে এই কারণ। দীর্ঘদিন যাবৎ আমার এই অভিমত পাকিস্তান সৃষ্টির মূল দায়িত্ব আমাদের, হিন্দু সম্প্রদায়ের। কংগ্রেসেরও।’
সুনীতি কুমার ঘোষ জানাচ্ছেন, জিন্নাহ সাঁইত্রিশ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে সরকারের যোগ দিয়ে সেই সাম্প্রদায়িক পরিমণ্ডলটাকে ভাঙতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, যদি কংগ্রেস-মুসলিম যৌথভাবে সরকার গঠন করে তাহলে সকলে বুঝবে ভারতের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক প্রবণতাটা প্রধান সঙ্কট নয়। তাতে করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সদ্ভাব গড়ে উঠবার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগের নেতৃত্ব তাই কংগ্রেসের দিকে আন্তরিকতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। যশোবন্ত সিংহ লিখেছেন, ১৯৩৭ সালের নির্বাচন এবং কংগ্রেসের নির্বাচন পরবর্তী আচরণ প্রথমবার মুসলিমদের বিস্মিত এবং স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। তাঁরা বুঝতে পারলেন, বর্ণ হিন্দুরা নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ কিন্তু মুসলমানরা দুর্বল, বিভক্ত এবং বিচ্ছিন্ন। জওহরলাল বা গান্ধী বা কংগ্রেস যতোই নীতিগত যুক্তি খাড়া করুক না কেন, মুসলিম লীগের সঙ্গে জোটে না যাওয়ার যে সিদ্ধান্ত তাঁরা নিয়েছিলেন, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য তার পরিণাম হলো ভয়াবহ। মুসলমানরা নিজেরা এইবার মিলিতভাবে ভিন্ন পথে হাঁটতে শুরু করলেন। জিন্নাহ কংগ্রেসের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু কংগ্রেস নিজেই তা হতে দিল না। মুসলমানদেরকে আলাদা করে দিয়েছিল।

দ্বিজাতিতত্ত্ব: নানা ভ্রান্তি ও তার প্রচার – পর্ব ২
পড়ুন এখানে

মুসলমানদেরকে আলাদা করার ব্যাপারটা বহু আগেই ঘটেছিল। খিলাফতের পক্ষ নিয়ে গান্ধীর কংগ্রেসের রাজনীতিতে ধর্ম টেনে আনার ফলে জিন্নাহ কংগ্রেস থেকে যখন বের হয়ে আসেন, তারপর থেকে কংগ্রেসের রাজনীতিই পাল্টে গেল। কংগ্রেসের প্রধান ব্যক্তিত্বদের অনেক তখন হিন্দু মহাসভার সদস্য। গান্ধী যাদের সঙ্গে মিলে গোরক্ষা পর্ষদ গঠন করেছিলেন। জিন্নাহ ১৯২০ সালে কংগ্রেস ছাড়তে বাধ্য হন। মুসলিম লীগেও থাকবার ইচ্ছা ছিল না। মুসলিম লীগের এবং কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষদের নিয়ে ন্যাশনালিস্ট বা ইন্ডেপেন্ডেন্স নামে একটি দল গঠনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। জিন্নাহ সর্বদা বিশ্বাস করতেন, ভারত থেকে ইংরেজকে তাড়াতে হলে হিন্দু-মুসলমানদের একসঙ্গে লড়তে হবে। কিন্তু গান্ধীসহ কংগ্রেসের তখনকার নেতারা মনে করতেন, সংখ্যাগুরু হিন্দুদের ভারতের এক চতুর্থাংশ মুসলমানদের সমর্থন না হলেও চলবে। ফলে জিন্নাহ যখন মুসলিম লীগের প্রধান হিসেবে বারবার কংগ্রেসের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে চেয়েছেন, হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের কথা বলেছেন কংগ্রেস এবং হিন্দু মহসভা সেটাকে গুরুত্বই দেয়নি। গান্ধীবাদী শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, যশোবন্ত সিংহ, মৃণালকান্তি চট্টোপাধ্যায়, শ্যামাপ্রসাদ বসু, সুনীতি কুমার ঘোষ, বিমলানন্দ শাসমল, সিদ্ধার্থ গুহ রায় প্রমুখ স্পষ্টভাবে তা লিখে রেখে গেছেন। কংগ্রেসের বহু নেতার জীবনীতেও তার কমবেশি উল্লেখ রয়েছে।
বর্তমান সময়ে যাঁরা দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবর্তক হিসেবে জিন্নাহর নাম বলেন এবং তার সঙ্গে ভারত ভাগের সম্পর্ক খোঁজেন বা জিন্নাহকে তার জন্য খলনায়ক বানাতে চান; ভারত ভাগের ইতিহাস নিয়ে তাদের পড়াশুনা সম্পর্কে মনে প্রশ্ন জাগে। জিন্নাহ দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা প্রথম বলেননি। দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা প্রথম শোনা যায় সাভারকারের মুখে। ১৯২৩ সালে সাভারকার ‘হিন্দুত্ব’ গ্রন্থে দাবি করেছিলেন ‘হিন্দুরা এক পৃথক জাতি’। পরের বছর ১৯২৪ সালের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত হিন্দু মহাসভার নেতা লালা লাজপত রায় “ইরাবতী থেকে ব্রহ্মপুত্র” নামে ধারাবাহিকভাবে ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকায় তেরোটি প্রবন্ধ লেখেন, সেখানে তিনি হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে ভারত ভাগের কথা উচ্চারণ করেন। তিনি সেখানে হিন্দু ভারত মুসলিম ভারত কথাটি প্রথম উচ্চারণ করেন। হিন্দুদের স্বার্থরক্ষার জন্য দরকার বোধে বাংলা এবং পাঞ্জাব ভাগ করার কথা তি‌নি লিখেছিলেন। ১৯২৫ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতায় অখিল ভারত হিন্দু মহাসভার পরবর্তী অধিবেশনে বলা হয়, ‘বলপ্রয়োগ করে যেসব হিন্দুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা দেওয়া হয়েছে, তাদের আবার হিন্দুধর্মের ছত্রছায়ায় ফিরিয়ে আনতে হবে; হিন্দি ভাষা জনপ্রিয় করতে হবে এবং হিন্দু উৎসব অনুষ্ঠানের প্রসার ঘটাতে হবে। সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দেয়া কারা শুরু করলো প্রথমে? কতোটা উগ্র ছিল সেই বক্তব্য? ভারতের সকল মুসলমানকে আবার হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে এ ধরনের কথা কি উস্কানিমূলক ছিল না? এই রকম বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কি হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা লাগার সম্ভাবনা তৈরি করা হয়নি? হিন্দুরা কোনো সম্প্রদায় নয়, হিন্দুরা একটা জাতি, হিন্দু মহাসভা বারবার সেই কথাই বলছিল। কংগ্রেস তখন কী ভূমিকা রেখেছিল সাম্প্রদায়িক এসব বক্তব্যের বিরুদ্ধে? বরং যাঁরা এসব বলছিলেন, তাঁরা ছিলেন অনেকেই কংগ্রেসের নেতা।
মুসলিম লীগ গঠনের প্রায় ছয় মাস আগেই ১৯০৬ সালের জুলাই মাসে হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্বভারতীয় সংগঠন শ্রীভারত ধর্মমণ্ডল প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই বছরেই পাঞ্জাবে অনুরূপ অপর একটি সংগঠন ‘হিন্দু সহায়ক সভা’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হিন্দু-পন্থী নীতি চালুু করার আহ্বান জানানো হলো। ১৯০৭ সালে পাঞ্জাবে ‘হিন্দুসভা’ গঠন করা হয়। হিন্দুসভার পাঞ্জাবে অনুষ্ঠিত প্রথম সম্মেলনে বলা হয় যে সামাজিক জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সমগ্র হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বার্থ অবিচলভাবে এবং সতর্কতার সঙ্গে রক্ষা করাই নতুন সংগঠনের লক্ষ্য। মুসলিম লীগ মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের কথা বলেছিল, হিন্দুসভাও হিন্দুদের স্বার্থরক্ষার কথাই বলেছে। কিন্তু হিন্দুসভা যখন পাঞ্জাবের সংখ্যালঘু হিন্দুদের স্বার্থরক্ষার শ্লোগান দেয়, সেটা সাম্প্রদায়িক চিন্তা হিসেবে বিবেচিত হয়নি। যখন ভারতবর্ষে মুসলিম লীগ সংখ্যালঘু মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার দাবি জানায় তখন সেটাকে বলা হয় সাম্প্রদায়িক দাবি। মুসলিম লীগ তখন হয়ে দাঁড়ায় সাম্প্রদায়িক দল। রুশ দেশের দুজন গবেষক দেখাচ্ছেন, লাহোরের ‘প্রতাপ’ পত্রিকায় হিন্দু মহাসভার নেতা লালা হরদয়ালের একটি প্রবন্ধে ভয়াবহ উগ্র আত্মম্ভরিতার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। তিনি ঘোষণা করেন যে, ‘হিন্দুস্থানের এবং পাঞ্জাবের হিন্দু জাতির ভবিষ্যত চারটি স্তম্ভের উপর উপর নির্ভরশীল। হিন্দু সংগঠন, হিন্দু রাজ, হিন্দুস্থানের মুসলমানদের হিন্দুধর্মে দীক্ষা প্রদান এবং আফগানিস্তান ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলি জয় করে সেইসব দেশের মানুষকে হিন্দুধর্মে দীক্ষা দান। না হলে হিন্দুরা সবসময় বিপদের মধ্যে থাকবে এবং হিন্দু জাতির অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে।’
মুসলিম লীগ তখন পর্যন্ত কখনো বলেনি, মুসলিমরা আলাদা জাতি। মুসলিম লীগ ইসলাম প্রচারের সংগঠন ছিল না। ছিল সংখ্যালঘু মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের প্রতিষ্ঠান। জিন্নাহ তখন মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু তিনি হিন্দুসভার উস্কানিকে প্রশ্রয় না দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে মিলন ঘটাতে ব্যস্ত, তিনি তখনো চাইছেন কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ এক সঙ্গে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিক। হিন্দুরা যখন হিন্দুদের স্বার্থরক্ষার কথা বলছে, কিংবা মুসলমানদের হিন্দু বানিয়ে ফেলতে চাইছে, এমনকি আফগানিস্তান পর্যন্ত দখল করতে চাইছে সেখানকার মুসলমানদের হিন্দুধর্মে দীক্ষা দেবার জন্য, সেটা কংগ্রেসের দৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িক ঘটনা নয়। হিন্দুরা যখন নিজেদের হিন্দু জাতি বলছে, তখন কি মুসলমানদের ভিন্ন জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো না? দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণা তাহলে কাদের সৃষ্টি? যশোবন্ত সিংহসহ কয়েকজনের বক্তব্য প্রমাণ করেছে জিন্নাহ সাইত্রিশ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের সঙ্গে মিলেমিশে রাজনীতি করতে চেয়েছেন। কিন্তু কংগ্রেস সেটাকে বাতিল করে দিয়েছে। বহু উদাহরণ, দলিলপত্র আর তথ্য রয়েছে তার পক্ষে।
জিন্নাহ দ্বিজাতিতত্ত্বের আমদানী করেননি। ভারতবর্ষে দ্বিজাতিতত্ত্ব আমদানী করেছে হিন্দু মহাসভার সদস্যরা আর করেছে বাংলার বর্ণহিন্দু জমিদার আর সুবিধাভোগী শিক্ষিত সমাজ। রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিত্ব পর্যন্ত শেষ বয়সে না বুঝে জড়িয়ে গিয়েছিলেন এই রকম দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রচারে। ‘বাঙলা ভাগ হলো’ গ্রন্থে জয়া চ্যাটার্জী সেই তথ্য দিচ্ছেন চমৎকারভাবে। চল্লিশ সাল তখনো বহুদূরে। হতাশ জিন্নাহ হিন্দু-মুসলমান ঐক্য না ঘটাতে পেরে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের ব্যর্থতার পর আর দেশে ফিরবেন না ভাবছেন। সাম্প্রদায়িক সমাধানের সূত্র খুঁজে বের করার জন্য উনিশশো বত্রিশ সালের আগস্ট মাসে মদনমোহন মালব্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় এলাহাবাদের ঐক্য সম্মেলন। এতে হিন্দু ছাড়া শিখ প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেছিলেন আর ছিলেন মুসলিম লীগ পন্থী এবং জাতীয়তাবাদী মুসলমানরা। সর্বাগ্রে আলোচনা হলো কেন্দ্রীয় সরকারে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে। মুসলমানদের দাবি ছিল এক তৃতীয়াংশ, হিন্দু প্রতিনিধিরা পঁচিশ ভাগ দিয়ে আরম্ভ করেন এবং শতকরা বত্রিশ ভাগ পর্যন্ত মেনে নেবার জন্য পাঁচদিন সময় নষ্ট করেন। পরদিন সতেরোই আগস্ট লন্ডন থেকে জানা গেল, বাঁটোয়ারার দ্বারা মুসলমানদের কেন্দ্রীয় পরিষদে এক তৃতীয়াংশ আসন দেয়ার কথা চূড়ান্ত করেছে ব্রিটিশ সরকার।
যখন এইরকম এক পরিস্থিতি চলছিল, বাংলায় দেখা গেল নতুন ধরনের আর এক সঙ্কট। বাংলায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও, দীর্ঘদিন ভোটার হিসেবে হিন্দুদের সংখ্যা ছিল বেশি। স্বভাবতই হিন্দুরা সকল ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। জমিদার বেশির ভাগ হিন্দুরাই ছিলেন, এমনকি বিভিন্ন পেশায় এবং সরকারি বেসরকারি চাকরিতে বর্ণহিন্দুরাই তখনো এগিয়ে। সরকারি প্রশাসনে তাঁদেরই প্রাধান্য ছিল, তাঁরা এগিয়ে ছিলেন কাউন্সিল সদস্য হিসেবে, পৌরসভার বিভিন্ন পদ আর চাকরিতে। বিশেষ করে প্রভাবশালী হিন্দুরা বাংলার স্থানীয় স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রাধান্য বিস্তার করে ছিলেন। নতুন বাঁটোয়ারায় জনসংখ্যা অনুযায়ী আসন সংরক্ষণ করা হলে, স্বভাবতই মুসলমানদের আসন বেড়ে যাবে। বর্ণহিন্দুরা এই ঘটনায় নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি হারাবার ভয়ে ভীত হয়ে পড়েন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অধিকারকে তাঁরা মেনে নিতে চাননি। জয়া চ্যাটার্জী লিখেছেন, কিন্তু যে কারণে তাঁরা ঐ রোয়েদাদকে প্রত্যাখান করেন এবং যে ভাষায় করেন তা আরো বিস্ময়কর।
জয়া চ্যাটার্জী কেন এইরকম বিস্ময় প্রকাশ করছেন? কারণ ব্রিটিশ নীতির বিরুদ্ধে তাঁরা সমালোচনা করেননি। ইউরোপীয় এবং ইঙ্গ-ভারতীয়দের যে আইনসভায় বহুগুণ অতিরিক্ত আসন দেওয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধেও তাঁদের বিক্ষোভ করতে দেখা যায়নি। ব্রিটিশদের দায়ী না করে তাঁরা মনে করতে লাগলেন এটা মুসলমানদের প্রতারণা বা চালাকি, যার দ্বারা মুসলমানরা হিন্দুদেরকে নিজেদের অধীনতার জালে আটকাতে চাইছে। এরকম ধারণার ফলে ভদ্রলোক হিন্দুরা নিজেদের জন্য সংখ্যালঘুদের অধিকার দাবি করতে উৎসাহী হন এবং তাঁরা সংখ্যালঘু হিসেবে নিজেদের দাবি উত্থাপন করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে কলকাতা টাউন হলের আলোচনায় তাঁরা বলেন, হিন্দু ও মুসলমানের পৃথক সংস্কৃতি। হিন্দু মুসলমানের শিক্ষা, ব্যক্তিগত আইন এবং অনুরূপ বিষয়ের প্রেক্ষিতে হিন্দুদেরকে পৃথক জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। হিন্দুদেরকে বাংলার কিছু বর্ণহিন্দুরাই মুসলমানদের থেকে পৃথক জাতি হিসেবে স্বীকার করে নেয়।
ব্যাপারটির সেখানেই শেষ নয়। হিন্দু ভদ্রলোকরা আর যা বললেন, তা আরো ভয়াবহ এবং সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট ছিল। বাঁটোয়ারাকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে উল্লেখ করে বলা হলো, বাঙালী হিন্দু প্রতিভার বিকাশ এবং বাংলার নতুন সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিনির্মাণ হলো ব্রিটিশ ভারতের এক সুবিদিত বিস্ময়কর ঘটনা। আর ব্রিটিশ শাসনেই বাঙালী হিন্দু সভ্যতার বিকাশ সম্ভব হয়েছে। মুসলমানদের এখন ক্ষমতায় বসানোর অর্থ হলো বাংলাকে পলাশী-পূর্ব অন্ধকারে নিয়ে যাওয়া। যার ফলে সতেরোশ’ সাতান্ন সাল থেকে বাংলায় ব্রিটিশরা যা করেছে তা অস্বীকার করা হবে এবং ‘ব্রিটেন ও বাংলার বিশ্বাসঘাতকতা’ শিরোনামে বাংলার ইতিহাসে নতুন একটা অধ্যায় লিখতে হবে। হিন্দু ভদ্রলোকদের এই ধরনের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, বাঙালী মুসলমানদের চেয়ে তাদের কাছে প্রিয় এবং আস্থাভাজন হলো ইংরেজ শাসকরা। আর সংখ্যাগুরু মুসলমানরা কখনোই ক্ষমতায় চলে আসুক তা তাঁরা চাইছেন না। মুসলমানদের ক্ষমতায় আসা মানেই তাদের বিচারে অন্ধকার যুগে ফিরে যাওয়া। দ্বিজাতিতত্ত্বের জন্য যাঁরা জিন্নাহকে দায়ী করেন, তাঁদের কাছে প্রশ্ন রাখা যেতে পারে দ্বিজাতিতত্ত্বের আমদানী কাদের দ্বারা হয়েছিল? কারা হিন্দুদের একটি আলাদা জাতি বলে মুসলমানদের সেখান থেকে বিভক্ত করে দিয়েছিলেন? মুসলমান আর হিন্দুরা এক জাতি নয়, কথাটা বারবার কাদের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল?
মুসলমানদের প্রতি কতিপয় বর্ণহিন্দুদের সামান্যতম সম্মানবোধ ছিল না। নিজেদের আত্মম্ভরিতা নিয়ে তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন। এই সকল বর্ণহিন্দুদের সম্মান না ছিল মুসলমানদের প্রতি, না নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রতি। বর্ণহিন্দুরা যেমন মুসলমানদের শত্রু ছিলেন, তেমনি শত্রু ছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দুদের। বরং নিম্নবর্ণের হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ছিল প্রীতির সম্পর্ক। নিম্নবর্ণের হিন্দু-মুসলমানরা বর্ণহিন্দুদের মতো সাম্প্রদায়িক মানসিকতার ছিলেন না। বর্ণহিন্দুরা কতোটা সাম্প্রদায়িক আর অহঙ্কারি ছিলেন তার প্রমাণ গভর্নর জেটল্যাণ্ডকে লেখা তাঁদের স্মারকলিপি। সেখানে তাঁরা লিখেছিলেন, ‘বাংলার হিন্দুরা সংখ্যায় কম হলেও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সামগ্রিকভাবে তাঁরা শ্রেষ্ঠ।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রফুল্লকুমার রায়, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ স্বাক্ষরিত ভিন্ন একটি ঘোষণায় তাঁরা বলেছিলেন যে, ‘শিক্ষাগত যোগ্যতা আর রাজনৈতিক উপযুক্ততায় হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব, নাগরিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির উন্নয়নে তাঁদের অবদান এবং রাজ্যের প্রশাসনের প্রতিটি শাখায় অতীতে তাঁদের সেবার খতিয়ান এতো সুবিদিত যে, তা পুনরুক্তি করার প্রয়োজন নেই। শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সমগ্র ভারতে হিন্দু বাঙালীদের সাফল্য সবার চেয়ে বেশি; অথচ বাংলার মুসলমান সম্প্রদায় এমন কোনো ব্যক্তিকে সৃষ্টি করতে পারেনি যে ঐসব ক্ষেত্রে সর্বভারতীয় প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে।
জিন্নাহ কিন্তু হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ব্যাপারে তখনো আশা ছাড়তে পারছেন না। জিন্নাহ এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, সামগ্রিক ভারতের বিকাশ এবং উন্নয়ন আর ইংরেজদের পরাজিত করতে হলে হিন্দু-মুসলমানদের এক পতাকার নীচে আসতে হবে। জিন্নাহর ব্যক্তিগত বন্ধু ও তদানীন্তন কংগ্রেস নেতা দেওয়ান চমনলাল এবং অপর একজন কংগ্রেস নেতা রায়জাদা হংসরাজ ১৯৩৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর গান্ধীকে এক পত্রে লেখেন যে, জিন্নাহ সাম্প্রদায়িক সমস্যা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সম্বন্ধে কেবল আলোচনা করতেই প্রস্তুত নন, তিনি একটা বোঝাপড়াতেও উপনীত হতে ইচ্ছুক। পত্রের অনুলিপি কংগ্রেস সভাপতি জওহরলালকে আটাশে সেপ্টেম্বর পাঠিয়ে তিনি গান্ধীকে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অনুরোধ জানান। চমনলালের পত্রে অসন্তুষ্ট হয়ে জওহরলার ত্রিশে সেপ্টেম্বর গান্ধীকে লেখেন যে, ‘এই সময়ে আপনার ও জিন্নাহর মধ্যে একটি সাক্ষাৎকার কেবল নিরর্থকই হবে না, ক্ষতিকারকও হতে পারে। গান্ধী অক্টোবরে প্রথম দিকে বল্লভভাইকে লিখিত এক পত্রে জানান, ‘বর্তমানে জিন্নাহর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকারের কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। জওহরলাল এটা চায় না।’
জিন্নাহ স্পষ্ট বুঝলেন, কংগ্রেস ক্ষমতা লাভ করার পর নিজেদের আত্মঅহমিকার কারণে মুসলিম লীগকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলতে চায় না। সূক্ষ্মভাবে ভারতের রাজনীতি থেকে মুসলিম লীগকে বাতিল করে দিতে চায়। তিনি তখন সাম্প্রদায়িক বিভেদ বাড়ার লক্ষণগুলি দেখতে পাচ্ছিলেন। শরৎ বসু লিখেছিলেন, যদি ১৯৩৭ সালে গান্ধী সম্মিলিত মন্ত্রীসভা গঠনে রাজি হতেন তাহলে জিন্নাহ এবং তাঁর সমর্থকরা সন্তুষ্ট হতেন এবং হিন্দু-মুসলিম মতপার্থক্য অনেক কমে যেতো। সর্বেপল্লী গোপাল লিখেছিলেন, সাঁইত্রিশ সালের নির্বাচনের আগে কংগ্রেস ও লীগ যে নির্বাচনী ইস্তেহার দিয়েছিল সেখানে লীগের সঙ্গে কংগ্রেসের মূলত কোনো পার্থক্য ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও কংগ্রেস সরকার গঠনে মুসলিম লীগকে সঙ্গে নিতে চায়নি। মুসলমানদের কংগ্রেস সরকারে নেয়া দূরের কথা, গান্ধী এবং কংগ্রেসের আরো অনেক নেতা মুসলমানদের ব্যাপকভাবে কংগ্রেসে ঢোকা পছন্দ করেননি। ১৯৩৭ সালের ছাব্বিশ থেকে উনত্রিশে এপ্রিল কংগ্রেস নির্বাহী পর্ষদের সভায় গান্ধী বলেছিলেন, শ্রেণী সংগ্রাম হিংসার আবহাওয়া সৃষ্টি করে। তিনি প্রসঙ্গক্রমে সেখানে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য সম্পর্কে আরো বলেছিলেন যে, তিনি ব্যাপকভাবে মুসলমানদের কংগ্রেসের সদস্য করার পক্ষপাতী নন যখন দুটো সম্প্রদায় পরস্পরকে বিশ্বাস করে না। গান্ধীর এ বক্তব্য কী প্রমাণ করে না, তিনি কগ্রেসকে হিন্দুদের দল হিসেবেই সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন? কংগ্রেস আসলে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ভারতের মুসলমান আর মুসলিম লীগকে সম্পূর্ণ বাতিল করে দিতে চেয়েছিল। কংগ্রেসের বিভিন্ন আচরণে শিক্ষিত মুসলিমরা বহুদিন পর যেন সেই সত্যিটা দেখতে পেল।
হিন্দু নেতারা ইতিপূর্বে জিন্নাহকে বারবার অপমান করলেও, জিন্নাহ মুসলমানদের কখনো হিন্দুদের থেকে সরিয়ে আনতে চাননি। কংগ্রেস না চাইলেও ব্রিটিশ সরকার জিন্নাহর সঙ্গে বহু বিষয়ে আপোস করতে চাইলো। ব্রিটিশ সরকার জিন্নাহর বহু দাবি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল। জিন্নাহ ইচ্ছা করলে তখন ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আপোস করে ক্ষমতার ভাগ নিতে পারতেন। জিন্নাহ তখন ব্রিটিশ সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন না বা নীতিগত জায়গা থেকে সরে দাঁড়ালেন না। বরং তখন পর্যন্ত তিনি চাইছেন কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়া করে ভারতের জন্য স্বাধীনতা অর্জন। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের আগে তিনি চাইলেন মুসলমানসহ সকল সংখ্যালঘুর স্বার্থ সংরক্ষণ করার সাংবিধানিক অধিকার। গান্ধী এবং কংগ্রেস বুঝতে পারলেন, জিন্নাহর সঙ্গে আলোচনায় না বসলে হবে না। কিন্তু আলোচনায় বসলেন ঠিকই, কিন্তু জিন্নাহর দাবি মেনে নিতে পারলেন না। জিন্নাহর জনপ্রিয়তা তখন মুসলিম জনমানসে বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। বাংলা এবং পাঞ্জাবে জিন্নাহ তেমন জনপ্রিয় ছিলেন না। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর পর কংগ্রেসের দুঃশাসনে তিনি দ্রুত সেখানে সর্বজন প্রিয় নেতা হয়ে উঠলেন। ফলে ১৯৩৮ সালের মধ্যে সারাদেশে মুসলিম লীগের একশো সত্তরটি নতুন শাখা স্থাপিত হয়। উত্তর প্রদেশে নব্বইটি এবং পাঞ্জাবে নতুন করে চল্লিশটি শাখা গঠিত হলো। ১৯২৭ সালে মুসলিম লীগের সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র তেরশো। কিন্তু দশ বছরের মাথায় শুধুমাত্র উত্তর প্রদেশেই এই সময়ে এক লক্ষ মানুষকে নতুন করে লীগের সদস্য করা হয়। মৃণালকান্তি চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, যদি নির্বাচনের পর জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগকে গুরুত্ব দেওয়া হতো তাহলে হিন্দু মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংহতি সুদৃঢ় হতো এবং তাতে পরিণামে দেশভাগের দুর্ভাগ্য এড়ানো যেতো।
জিন্নাহ নিজে তখন তাঁর হিন্দু-মুসলমান মিলনের সমুদয় ব্যর্থতার জন্য কংগ্রেসের অনড় মানসিকতাকে দায়ী করলেন। হিন্দু মহাসভার ১৯৩৬ সালের এক বিবৃতিতে বলা হয়, হিন্দুদের মনে রাখা উচিৎ যে হিন্দুস্থান একমাত্র হিন্দুদের নিজস্ব বাসভূমি এবং তাদের জীবনের লক্ষ্য হলো আর্য সংস্কৃতি এবং হিন্দু ধর্মের বিকাশ সাধন। ভারত একমাত্র হিন্দুদেরই দেশ এবং হিন্দু সংস্কৃতির বাহক। হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকার ১৯৩৭ সালের ত্রিশে ডিসেম্বর হিন্দু মহাসভার সভাপতির অভিভাষণে বলেছিলেন, ‘প্রধানত দুটি জাতি ভারতবর্ষে, হিন্দু এবং মুসলিম।’ তিনি পুনরায় ১৯৩৮ সালে বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষে, আমাদের হিন্দুস্থানে হিন্দুরাই হলো প্রধান জাতি আর মুসলমানরা সংখ্যালঘু একটি গোষ্ঠী।’ জিন্নাহ তখন পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরে ছিলেন। তাঁর মনে বিশ্বাস ছিল, কংগ্রেস আর গান্ধী মিলে এর একটা সুরাহা করবেন। ফলে তিনি হিন্দু মহাসভার উস্কানিকে তখন এড়িয়ে গিয়েছিলেন। সাভারকার সাঁইত্রিশ সালে আবার হিন্দু জাতীয়তাবাদের তত্ত্বকে এক সম্পূর্ণ ও সর্বব্যাপী রূপ প্রদান করেন। তিনি ভারতে হিন্দুজাতির অস্তিত্ব বিষয়ক তত্ত্বের মূল বক্তব্য প্রকাশ করেন। তিনি বললেন, সেই তত্ত্বের বনিয়াদ হলো পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত চারটি বিশ্বাস: হিন্দু, হিন্দুধর্ম, হিন্দুত্ব এবং হিন্দুরাজ।
সাভারকারের মতে হিন্দুস্তানে উদ্ভুত যে কোনো ধর্মের মানুষই হিন্দু। যেমন হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন। কিন্তু মুসলমান আর খ্রিষ্টানরা নয়। সেই সঙ্গে তিনি দাবি তোলেন যে হিন্দুরাই হিন্দুরাষ্ট্রের পুরোদস্তুর নাগরিক। হিন্দুদের পবিত্র ভূমির উপর দাবি উত্থাপনকারী মুসলমানদের তিনি “বিদেশী” আখ্যা দিয়ে ‘অখণ্ড ভারত’ ধ্বনি তোলেন। সাভারকারের মতে, স্বাধীন ভারতই জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র অথবা হিন্দুরাজই হতে পারে। কিছুদিন পর বলা হলো, হিন্দুরাই ‘প্রথম শ্রেণীর নাগরিক’ আর মুসলিম সম্প্রদায় হলো ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক’। অতএব সর্বাগ্রে মুসলিমদের ভারত থেকে বিতাড়িত করতে হবে। মুসলমানদের ভারতে থাকতে হলে, হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেই থাকতে হবে। কংগ্রেসের নেতা গান্ধী তখন মৃদুস্বরে সাভারকারের বক্তব্যের বা তত্ত্বের বিরূপ সমালোচনা করলেন। তিনি প্রথম কী বললেন? যদি ভারতে কোনো রাষ্ট্র বা হিন্দুরাষ্ট্র্রই গঠিত হয় তাহলে হিন্দুধর্মের পরমতসহিষ্ণুতা সেখানে মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের স্থানও পাকা করে দেবে। গান্ধী ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় এইসব কথা লিখেছিলেন। গান্ধী বললেন, ‘যদি হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয় মুসলমানদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। হিন্দুধর্মের পরমসহিষ্ণুতা দ্বারা মুসলমানরা রক্ষা পাবে।’ মুসলমানরা রক্ষা পাবে কি তাহ‌লে হিন্দুদের দয়ায়? গান্ধী সরাসরি ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে শক্ত বিরোধিতা উপস্থাপন করলেন না। তিনি যেন সাভারকারের ঘোষণায় ক্ষুব্ধ নন। গান্ধী নিজেই স্বরাজ বলতে বুঝতেন রামরাজত্ব, ফলে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তার দাবির বিশেষ পার্থক্য ছিল না। গান্ধীর নিজেরও হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মূলত তেমন আপত্তি নেই। কিন্তু হিন্দুরাষ্ট্রে তিনি মুসলমান এবং খ্রিষ্টানদের হিন্দুধর্মের পরমত সহিষ্ণুতার মতো উদারতার উপর ছেড়ে দেবেন।
জিন্নাহ নিজের পথ এবার বেছে নিলেন। জিন্নাহ রেগে গিয়ে বলেছিলেন, কংগ্রেস মুসলমানদের ধ্বংস করতে চায়। মুসলিম লীগের বাৎসরিক অধিবেশনে জিন্নাহ ঘোষণা দেন যে, সমানে সমান না হলে কিংবা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভীতিবোধ না থাকলে দুটো দলের মধ্যে সম্মানজনক বোঝাপড়া সম্ভব হতে পারে না। দুর্বল পক্ষের এক তরফা শান্তির আবেদনে কেবল দুর্বলতাই প্রকাশ পায়। ক্ষমতার দ্বারা দল পরিচালনা করতে না পারলে রক্ষাকবচ এবং সমঝোতা দাবির মূল্য ছেঁড়া কাগজের টুকরোর মতোই হয়। রাজনীতির অর্থই হচ্ছে ক্ষমতা, যা কেবল ন্যায়বিচার, সুন্দর ব্যবহার এবং সদিচ্ছার জন্য চিৎকার করলেই লাভ করা যায় না। তিনি আরো ঘোষণা করেন, ‘এতদিন মুসলমানদেরকে ভুলবশত সংখ্যালঘু হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আসলে তারা সংখ্যালঘু নয়। জাতীয়তার যেকোনো সংজ্ঞা অনুসারে মুসলমানরা একটি জাতি। ব্রিটিশ ভারতের মানচিত্র অনুযায়ী বাংলা, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু, বেলুচিস্তানের মতো এদেশের বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে মুসলমানরা; সেখানে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সুতরাং ভারতের সমস্যাকে জিন্নাহ আন্তঃসাম্প্রদায়িকতা নয়, আন্তঃজাতিগত সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেন। জিন্নাহ জানিয়ে দিলেন, ভারতের মুসলমানরা শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নয়, ভিন্ন একটি জাতি। মুসলমানরা যে একটি ভিন্ন জাতি এ কথাটা আগেই হিন্দু মহাসভার মুখ থেকে বের হয়েছিল। জিন্নাহ মুসলমানদের স্বার্থে এবার সেটা মেনে নিলেন।
বর্ণহিন্দুরাই ত্রিশের দশকের শেষে জিন্নাহকে বাধ্য করেন মুসলমানদের আলাদা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। মুসলমানদের অবজ্ঞা করে হিন্দু মহাসভার হিন্দুত্বের ঘোষণা, গান্ধীর রামরাজত্ব আর গো-রক্ষার দর্শন এবং সর্বোপরি কংগ্রেস সরকারে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি জিন্নাহকে এটা বুঝিয়ে দেয় বর্ণহিন্দুদের কাছে সংখ্যালঘু মুসলমানরা কখনোই ন্যায় বিচার পাবে না। জিন্নাহ এরকম ধারণা লাভ করার পর, বর্ণহিন্দুদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করলেন। জিন্নাহর কট্টর সমালোচক শ্যামাপ্রসাদ বসু পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে জিন্নাহর পক্ষ নিয়ে দেখাচ্ছেন যে, উনিশশো ছয় সাল থেকে উনিশশো পঁয়ত্রিশ সাল সময়কালে জিন্নাহ ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী। কিন্তু গান্ধীর সময়কার কংগ্রেস নেতাদের কট্টর একপেশে মনোভাবের কারণেই জিন্নাহ বাধ্য হলেন সংখ্যালঘু মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে। ভারতকে বিভক্ত করে নয়, তিনি সংযুক্ত ভারতের ভিতরে মুসলমানদের জন্য আলাদা আবাস বা ভূখণ্ড চাইলেন চল্লিশ সালে। শ্যামাপ্রসাদ বসু দেখাচ্ছেন, ‘লাহোর প্রস্তাব’-এর পরও জিন্নাহ ভারতের অখণ্ডতায় আস্থা হারাননি।
হিন্দুরা যখন মুসলমানদের আলাদা জাতি হিসেবে আলাদা করে দিতে চেয়েছেন, জিন্নাহ বিরোধ এড়াবার জন্য ১৯৪০ সালে প্রথমবার তা স্বীকার করে নিয়েছেন মাত্র। বর্ণহিন্দুদের এই দ্বিমুখি দৃষ্টিভঙ্গি দেখে শান্তিতে থাকার জন্য তিনি মুসলমানদের আলাদা জাতি হিসেবে স্বীকার করে নিলেন। সেই সঙ্গে সংযুক্ত ভারত রাষ্ট্রের ভিতরে আলাদা ভূখণ্ড দাবি করলেন যাতে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের দমন পীড়নে তাদের থাকতে না হয়। জিন্নাহর লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তানের দাবি তো দূরের কথা, পাকিস্তান বলে কোনো শব্দই ছিল না। মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবের কার্যকরী সভা শেষ হয় গভীর রাতে। কিন্তু পরদিন সকল পত্রিকায় বলা হলো, মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। লাহোর প্রস্তাবে সংবাদপত্রগুলিই ‘পাকিস্তান’ শব্দটি বসিয়ে দিয়েছিল। হিন্দু প্রভাবিত পত্রিকাগুলি জিন্নাহর বক্তব্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করলো। তিনি কোনো প্রদেশ ভাগ করতে চাননি হিন্দু মুসলমানের ভিত্তিতে। তিনি চেয়েছেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলির হাতে স্বায়ত্বশাসন। কিন্তু পত্রপত্রিকার ভুল সংবাদ প্রচার সাধারণ হিন্দু মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করেছিল। জিন্নাহকে স্বভাবতই ঘটনাটা খুব বেকাদায় ফেলে দিয়েছিল। লাহোর প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার ভুল সংবাদ প্রচারে কী সমস্যা হয়েছিল? মানুষ সর্বদাই পত্রিকার খবরকে খুব গুরুত্ব দেয়, বিশেষ করে সে-যুগে তা আরো বেশি দেওয়া হতো। পত্রিকার খবরের দিকে তাকিয়ে যাঁরা দেশের রাজনীতির হালচাল বুঝতে চাইতেন, সেইসব শিক্ষিত সাধারণ মুসলমানরা মনে করলেন জিন্নাহ তাহলে তাঁদের জন্য পাকিস্তানই চাইছেন। স্বভাবতই এইরকম খবরে অনেক মুসলমানই খুশি হয়েছিলেন।
পত্রিকাগুলি কার ইঙ্গিতে ‘পাকিস্তান’ শব্দটা বসিয়ে দিয়েছিল সেটা বিরাট একটা প্রশ্ন। ভারতের বর্ণহিন্দু বণিক সম্প্রদায়গুলিই তো পত্রিকাগুলি নিয়ন্ত্রণ করতেন। জিন্নাহর লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হবার সপ্তাহখানেক আগেই গান্ধী ভারত ভাগের কথা তুলেছিলেন। তিনি উনিশশো চল্লিশ সালের পনেরো মার্চ রামগড় কংগ্রেসের সময় কংগ্রেস নির্বাহী কমিটির সদস্যদের প্রশ্ন করেছিলেন, যদি ভারতবর্ষকে হিন্দু ভারত ও মুসলিম ভারতে ভাগ করার দাবি ওঠে তাহলে কংগ্রেসের নীতি কী হবে? পরে সঙ্গত কোনো কারণ ছাড়াই তিনি সতেরোই মার্চ আবার লিখছেন, যদি মুসলমানরা ভারতকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করতে চায় তাহলে ভারতবর্ষের মুসলিমদের ইচ্ছাকে কংগ্রেস জোর করে দমন করতে পারে না। কথাটা হলো, মুসলমানরা যা দাবি করেনি, জিন্নাহ তখনো যে দ্বিজাতি প্রসঙ্গ উত্থাপন করেননি, কংগ্রেসের সভায় বা তাঁর লেখনিতে গান্ধী আগ বাড়িয়ে সে কথাটা বলছেন কেন? সূক্ষ্ম কৌশল বা ভিন্ন একটি কারণ এর পিছনে ছিল। ঘনশ্যামদাস বিড়লাই এই দাবিটি রেখেছিলেন গান্ধী ও ভাইসরয় লিনলিথগোর কাছে উনিশশো আটত্রিশ সালের জানুয়ারি মাসে। তিনি ভারতকে হিন্দু ফেডারেশন আর মুসলিম ফেডারেশন-এ ভাগ করবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি ক্রীপস মিশনের ক্রীপসের নিকট উনিশশো উনচল্লিশ সালে পৃথকভাবে হিন্দু ও মুসলমান জাতির জন্য ধর্মের ভিত্তিতে দুটো রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন।
(দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য)

লেখক পরিচিতি:
রাহমান চৌধুরী, লেখক, শিল্প সমালোচক
Raahman Chowdhury

*এই বিভাগে প্রকাশিত লেখার মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই এখানে প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা বানানরীতি বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট