ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো তবে? বণিক ঘনশ্যামদাসের আকাঙক্ষাই গান্ধীর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়েছিল লাহোর প্রস্তাবের আগেই। কিন্তু তিনি এমনভাবে বললেন, যেন মুসলমানদের দাবি ছিল সেটা। কথাটা নিজেই বারবার এভাবে উচ্চারণ করে মহাত্মা কি আলাদা রাষ্ট্রের দাবি করার জন্য মুসলমানদের প্রভাবিত করতে চেয়েছিলেন? নিজেদের স্বার্থে সাংবাদিকদের কাছে কি আগাম কিছু বার্তা দিয়েছিলেন? সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ সালে হিন্দু মহাসভা যখন বারবার দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা উচ্চারণ করছিল, জিন্নাহ সম্ভবত তার প্রেক্ষিতেই বাধ্য হয়ে উনিশশো চল্লিশ সালের উনিশে জানুয়ারি লন্ডনের ‘টাইম অ্যান্ড টাইড’ পত্রিকায় একটা লেখা লিখলেন। তিনি সেখানে বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষে দুটি জাতি আছে এবং দুয়েরই মাতৃভূমি এক। তার শাসন ব্যবস্থা পরিচালনায় উভয়ের শরিকানা থাকতে হবে।’ জিন্নাহ তাঁর চিরন্তন বক্তব্যই পুনরাবৃত্তি করলেন, ভারতবর্ষ পরিচালনায় হিন্দু মুসলমান দুপক্ষেরই অধিকার থাকতে হবে। তিনি হিন্দু মহাসভার দ্বিজাতিতত্ত্বকে বাতিল না করে বরং স্বীকার করে নিয়েই বললেন, হিন্দু-মুসলমান দুই জাতি হলেও দুয়েরই মাতৃভূমি এক। দুয়ের মাতৃভূমি এক, জিন্নাহর এ বক্তব্যের মধ্যে রয়েছে সমন্বয়ের চেষ্টা; কাউকেই ছোটো করা নয়। ভারতবর্ষকে আলাদা করার দাবিও নয়।
জিন্নাহর ‘টাইম অ্যান্ড টাইড’ পত্রিকার বক্তব্যে যেমন ভারত ভাগের প্রশ্ন নেই, লাহোর প্রস্তাবেও ছিল না। তিনি সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য স্বায়ত্বশাসিত একটি ভূখণ্ড দাবি করেছিলেন মাত্র। সেটা কোনো প্রদেশকে বিভক্ত করে নয়। লাহোর প্রস্তাবকে সংবাদপত্রে ভুলভাবে পাকিস্তান প্রস্তাব ছাপা হলো। গান্ধী তার উপর ভিত্তি করে উনিশশো চল্লিশ সালের ছয়ই এপ্রিল হরিজন পত্রিকায় তো বটেই এবং তারপরেও এপ্রিল মাসেই একাধিকবার বলেছেন যে, মুসলমানরা ভারতবর্ষ ভাগ করতে চাইলে তিনি বাধা দেবেন না। মুসলমানরা ভারতবর্ষ ভাগ করতে চাইছে কথাটা গান্ধী বারবার বলছিলেন কেন? তিনি কি পরিকল্পিতভাবেই ভারত ভাগের দায় মুসলমানদের উপর চাপিয়ে নিজেই আসলে বণিকদের দাবি মেনে নিয়ে ভারত ভাগ করতে চেয়েছিলেন? মহাত্মা জানতেন যে, ঘনশ্যামদাস বিড়লাই ভারত ভাগ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মুসলমানদের দিক থেকে কেউ এ প্রস্তাবটা দেননি। তিনি তাহলে ঘনশামদাস বিড়লার নাম ব্যবহার না করে মুসলমানদের নাম ব্যবহার করছেন কেন? কংগ্রেস এবং গান্ধী চলতেন বিড়লাসহ বড় বড় বণিকদের টাকায়। হ্যাঁ, ঘনশ্যামদাস বিড়লা যেভাবে হিন্দু এবং মুসলমানের দুটা ফেডারেশন চেয়েছিলেন, জিন্নাহ দুই বছর পর লাহোর প্রস্তাবে ঠিক তাই বলেছিলেন। ঘনশ্যামদাস ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ চেয়েছিলেন, জিন্নাহ ধর্মের ভিত্তিতে তা চাননি। তিনি চেয়েছিলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য স্বায়ত্বশাসিত একটি ভূখণ্ড ভারত রাষ্ট্রের ভিতরে, ভারতকে বিভক্ত করে নয়।
জিন্নাহর লাহোর প্রস্তাবের পর জওহরলালও বললেন তিনি লাহোর প্রস্তাবে খুশি হয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, প্রস্তাবটি যে তিনি খুব পছন্দ করছেন ব্যাপারটা তা নয়। কিন্তু এটি সমস্যার সমাধান খুব সহজেই করে দিয়েছে। কারণ এতে করে আইনসভায়, চাকরিতে. মন্ত্রীসভা ইত্যাদিতে আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্বের দাবি থেকে তারা রেহাই পেতে পারবেন। দেখা যাচ্ছে, জিন্নাহর ঘাড়ে যতো দোষ চাপানোর চেষ্টা করা হোক না কেন, ধর্মীয়ভাবে হিন্দু-মুসলমানকে বিভেদ করে দুটো রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা বহু আগে থেকেই চলছিল। ফলে এটা ভাবাই যেতে পারে পত্রিকায় পাকিস্তান কথাটা বসিয়ে দেয়া নেহাৎ নির্দোষ সাংবাদিকতা ছিল না, ইচ্ছাকৃতভাবেই তা করা হয়েছিল। জিন্নাহ তখন খুবই জনপ্রিয় ব্যক্তি মুসলমানদের মধ্যে, সেই জিন্নাহকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার জন্যই এটা করা হয়ে থাকবে। জিন্নাহ সে ষড়যন্ত্রটা প্রথম টের পাননি বলেই পরবর্তী চাল চালতে ভুল করেছিলেন। জিন্নাহর সামনে তখন দুটো সঙ্কট। মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে তিনি সাধারণ মুসলমানের বিশ্বাস বা দাবিকে অগ্রাহ্য করতে পারেন না। তিনি তা করতে পারতেন যদি তিনি কংগ্রেসের সহযোগিতা পেতেন। তিনি দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা দিয়ে এটা বুঝেছিলেন, মুসলমানদের সামান্যতম দাবি মেনে নেওয়ার অবস্থায় কংগ্রেস নেই। সংখ্যাগরিষ্টতার অহঙ্কারে তারা মুসলমানদেরকে তো বটেই, মুসলিম লীগকে ধর্তব্যের মধ্যে আনছে না।
দ্বিজাতিতত্ত্ব: নানা ভ্রান্তি ও তার প্রচার – পর্ব ১
এখানে পড়ুন
কংগ্রেস বহুবার আলোচনায় বসে নিজেদের ইচ্ছাটাই চাপিয়ে দিতে চেয়েছে মুসলিম লীগের উপর। জিন্নাহ তা মেনে না নিলে আলোচনা সফল না হবার জন্য তাঁকে দায়ী করেছে। মুসলিম লীগকে একেবারে পাত্তা না দেবার ক্ষেত্রে কংগ্রেসের জোরটা কোথায়? তিন-চতুর্থাংশ হিন্দু জনগণ রয়েছে তার সঙ্গে। কংগ্রেসের সেই জোরটাই সবচেয়ে বড় জোর। জোর যার মুল্লুক তার। কংগ্রেসের সেই ক্ষমতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সংখ্যালঘু মুসলমানদের স্বার্থরক্ষায় লড়তে হচ্ছে জিন্নাহকে। কাজটা সহজ নয়। তিনি মুসলিম লীগেরও একচ্ছত্র অধিপতি নন। তিনি ইসলাম ধর্ম নিয়ে ভাবছেন না, কিন্তু মানুষ হিসেবে ভারতের বিরাট সংখ্যক মুসলমান সম্প্রদায়কে তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের পায়ের নীচে দলিত হতে দিতে চান না। পাকিস্তান শব্দটা যখন পত্রিকায় চলে এলো এবং জনগণের তাতে সম্মতি প্রকাশ পেল, জিন্নাহ অবশেষে তাই মনে করলেন, কংগ্রেসের সঙ্গে লড়বার জন্য তিনি একটা শক্তিশালী অস্ত্র পেয়েছেন। মনে প্রাণে তিনি সবসময় ভারত ভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু যখন দেখলেন, পত্র-পত্রিকাগুলি জিন্নাহর বিরুদ্ধে প্রচারণা হিসেবে পাকিস্তান আর দেশভাগের দায় তাঁর উপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে আর মুসলমান জনগণ তাতে খুশিই হয়েছে, মুসলমানরা পাকিস্তান পেতে চাইছে, জিন্নাহ তখন এটাকে নতুন অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করলেন। জিন্নাহ বিশ্বাস করতেন, গান্ধী এবং কংগ্রেস কখনোই ভারত বিভাগ মেনে নেবেন না। ফলে ভারত বিভাজন ঠেকাতে তাঁরা মুসলিম লীগের দাবি মেনে নেবেন। জিন্নাহ সেরকম চাল চেলেছিলেন যাতে গান্ধী ভারত ভাগ ঠেকাতে মুসলমানদের ন্যায্য দাবিগুলি মেনে নেন। জিন্নাহ তখন ঘটনার পিছনের খেলাটা আন্দাজ করতে পারেননি। মনে করলেন, তিনি পাকিস্তানের দাবির পক্ষে থাকলে কংগ্রেস যেভাবেই হোক ভারত ভাগ ঠেকাতে চাইবে। নিজেদের একগুয়েমি ছেড়ে তখন মুসলমানদের সঙ্গে দাবিদাওয়ার প্রশ্নে আপোষ করতে রাজি হবে।
ভাইসরয় ওয়াভেল, আবুল কালাম আজাদসহ পরবর্তী বহু গবেষকই এই কথাটি স্বীকার করেছেন। জিন্নাহ ভারত ভাগ চাননি বলেই বারবার গান্ধীর সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়েছেন সমঝোতায় আসবার জন্য, ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন। জিন্নাহ ভারত বিভাগ চাইলে, উনিশশো চল্লিশ সালের পর ভাইসরয়ের দেয়া প্রতিটি প্রস্তাব মেনে নিতেন। জিন্নাহর মনে এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল, গান্ধী কিছুতেই ভারত ভাগ চাইতে পারেন না, গান্ধী অবশ্যই মুসলিম লীগের সঙ্গে বসে মুসলমানদের যৌক্তিক দাবিগুলি বিবেচনা করবেন। গান্ধী যে শেষ পর্যন্ত জওহরলাল আর বল্লভভাই প্যাটেলের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভারত ভাগ মেনে নেবেন, এটা ছিল তাঁর সম্পূর্ণ ধারণার বাইরে। গান্ধী যে ভারত ভাগের প্রশ্নে বহু আগেই একবার ঘনশ্যামদাশ বিড়লার সঙ্গে এক পা এগিয়ে দিয়েছিলেন জিন্নাহর সে তথ্য জানা ছিল না। ক্রীপস সমস্যার সমাধানে সবদলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়েছিলেন। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, স্বাধীন ভূখণ্ডগুলির রাজকুমারবৃন্দ এবং হিন্দু মহাসভার সঙ্গে পর্যন্ত। কংগ্রেস সভাপতি আজাদের তা পছন্দ ছিল না। তিনি মনে করতেন, কংগ্রেস যে ভারতবর্ষের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মুখপাত্র তা সুবিদিত ছিল। ফলে অন্যদলের সঙ্গে না বসে, ক্রীপসের শুধুমাত্র কংগ্রেসের সঙ্গে বসলেই সেটা সঙ্গত হতো। ভারত স্বাধীন হলো গ্রন্থে তিনি একথা লিখেছেন। আজাদের বক্তব্য থেকে কংগ্রেসের আত্মঅহমিকা এবং অন্যান্য দল সম্পর্কে তাঁদের অবজ্ঞার মনোভাব টের পাওয়া যায়। মুসলিম লীগকে সামান্য পাত্তা দেবার মতো কোনো দলই তারা মনে করতেন না।
গান্ধীর যুগ থেকেই কংগ্রেস চেয়েছে ভারতের সকল ক্ষমতা নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করতে, আর সেটাই ভারতের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছিল। কংগ্রেস নিজেদের অস্তিত্ব ছাড়া ভারতের আর সকল রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব মুছে ফেলতে চেয়েছিল। শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় দেখাচ্ছেন, কংগ্রেসের সভাপতি আজাদ যখন মিথ্যা দম্ভ করছে নিজের দল নিয়ে, তখন মুসলিম লীগের সদস্য সংখ্যা ত্রিশ লাখের বেশি আর কংগ্রেসের সদস্য সংখ্যা কমে গিয়ে মাত্র চোদ্দ লাখে দাঁড়িয়েছে। কংগ্রেস সভাপতি যখন দাবি করছেন, কংগ্রেস ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মুখপাত্র, তখন ভারতবর্ষের অর্ধেকের বেশি জনগণ কংগ্রেসের সঙ্গে নেই। বাকি অর্ধেকের সবাই যে কংগ্রেসের পক্ষে তাও নয়। সুভাষচন্দ্র আর সাম্যবাদীরা কংগ্রেস থেকে আলাদা হয়ে গেছেন। মিথ্যা দম্ভের ভিতর দিয়ে এইভাবেই কংগ্রেস ভারতকে দ্বিখণ্ডিত হবার পথে নিয়ে গেছে। কংগ্রেস চাইছিল, ভারতকে স্বাধীনতা দিয়ে কংগ্রেসের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করুক ব্রিটিশ সরকার। যুদ্ধকালীন সময়ে এটাই ছিল কংগ্রেসের রাজনীতি। কংগ্রেসের দিক থেকে যখন ক্রীপস মিশন প্রত্যাখান করা হলো, মাদ্রাজের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী জাতীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে একটি বিকল্প প্রস্তাব দেন। তিনি মুসলিম লীগ সমেত ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি স্বীকারের ভিত্তিতে জাপানের বিরুদ্ধে জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা বলেন। সারা ভারত কংগ্রেস কমিটি রাজা গোপালাচারীর প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলে তিনি কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন।
জিন্নাহ জানতেন, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষমতার লড়াইয়ে দেশের বৃহত্তম প্রভাবশালী দল হিসেবে কংগ্রেসের জয় ছিল অবধারিত। কিন্তু তার মানে কী দাঁড়াবে? সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের দয়াদাক্ষিণ্য নিয়ে টিকে থাকতে হবে মুসলমান সম্প্রদায়কে। জিন্নাহ তাই লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় গৃহীত প্রস্তাবে সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে বললেন, পাকিস্তান বিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হলে অথবা ভারতীয় মুসলমানদের সংখ্যালঘু হিসেবে গণ্য করে ভারতে কোনো একক কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের চেষ্টা করা হলে মুসলিম ভারত সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিহত করবে। মুসলমানরা যেখানে বেঁচে থাকার জন্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের জন্য লড়ছে, কংগ্রেসসহ হিন্দু সংগঠনগুলি সেখানে শক্তিশালী এককেন্দ্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের প্রাধান্য ও শাসন প্রতিষ্ঠা ত্বরান্বিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। জিন্নাহ বলেন, ভারতের মুসলমানরা স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙক্ষায় অন্য সম্প্রদায় থেকে পিছিয়ে নেই। স্বাধীনতার নামে “হিন্দু ভারত” প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র তারা মেনে নিতে পারে না। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের হিন্দু ভাইদের স্বাধীনতা চাই, কিন্তু তাদের দ্বারা শাসিত হতে চাই না। আমরাও মুক্ত হতে চাই। তিনি সংযুক্ত ভারতে মুসলমানদের জন্য চান আলাদা সার্বভৌম ভূখণ্ড। হতে পারে সেটা সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র, হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতের ভিতরে স্বায়ত্বশাসিত সার্বভৌম ভূখণ্ড। কিন্তু সব ক্ষমতা থাকতে হবে প্রদেশগুলির হাতে, প্রদেশগুলির উপর কেন্দ্রের কর্তৃত্ব চলবে না।
গান্ধী এ সময়ে সর্বভারতীয় নেতা হিসেবেই একটি সমঝোতা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। গান্ধীর প্রস্তাবে বলা হলো, মুসলিম লীগ যদি নির্দ্বিধায় অবিলম্বে কংগ্রেসের স্বাধীনতা পাবার দাবির সঙ্গে পূর্ণমাত্রায় সহযোগিতা করে তাহলে ব্রিটিশ সরকার সমগ্র ভারতবর্ষের তরফ থেকে সকল ক্ষমতা মুসলিম লীগকে হস্তান্তর করলেও কংগ্রেস সামান্য আপত্তি করবে না। বরং সরকার পরিচালনায় লীগকে সহায়তা করবে। জিন্নাহ এই ক্ষমতা গ্রহণ করতেন কি না, কংগ্রেসের সকল নেতৃত্ব গান্ধীর বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতেন কি না সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু ঘটনা যা ঘটেছিল সেটা হলো এই যে, যেদিন গান্ধীর এই প্রস্তাব পত্রিকায় প্রকাশিত হয় সেটা ছিল উনিশশো বিয়াল্লিশ সালের আটই আগস্ট, সেই দিনই ওয়ার্ধায় গান্ধীর পরামর্শে কংগ্রেস “ভারত ছাড়ো” আন্দোলনের কথা ঘোষণা করে। জিন্নাহকে গান্ধীর প্রস্তাব গ্রহণের জন্য কোনো সুযোগই দেয়া হয়নি। গান্ধীর মুখে সেখানে লীগের হাতে দেশের ক্ষমতা তুলে দেওয়ার প্রশ্নটাই ভাওতা মাত্র। গান্ধী একদিকে জিন্নাহকে বলছেন সমগ্র ভারতের ক্ষমতা গ্রহণ করতে আর ঠিক সেদিনই ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দিলেন। গান্ধী জিন্নাহকে খলনায়ক বানিয়ে নিজের উদারতা প্রচার করার জন্য এরকম অনেক শঠতার আশ্রয় নিতেন।
জিন্নাহ গান্ধীর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সমালোচনা করলেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সমালোচনা করলেন তেজবাহাদুর সাপ্রু, আম্বেদকর, সিকান্দার হায়াত খান প্রমুখ। জিন্নাহ পরিহাস করে বললেন, ‘এখন গান্ধীর হাতে নতুন সূত্র রচিত হয়েছে, ভারত ছাড়ো।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, এটাই কি জীবন সন্ধ্যায় গান্ধীর ভারতের প্রতি সর্বাধিক অবদান। বহুজনই জিন্নাহর ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে সমর্থন না করার জন্য তাঁকে ব্রিটিশ সরকারের দালাল বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। বহুজন বলেছেন তিনি ভারতের স্বাধীনতা চাইতেন না। কথাটা যদি তাই হয়, তাহলে জওহরলাল নেহরু এবং কংগ্রেস সভাপতি আজাদও ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনকে প্রথম সমর্থন করেননি। বহু বিতর্কের পর অনিচ্ছায় তাঁরা তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। রাজা গোপালাচারী কেন ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলেন? ভারতের সাম্যবাদীরা পর্যন্ত কেন ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন? ভারত ছাড়ো আন্দোলন সমর্থন না করার জন্য অন্য কাউকে তো ব্রিটিশের দালাল বলা হয়নি। জিন্নাহর বিরুদ্ধেই শুধু কেন এই অভিযোগ তোলা হয়েছিল? যা প্রমাণ করে এটা ছিল অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত। বাকিদেরকে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য খলনায়ক বানানো হলো না, জিন্নাহকে সেই কারণেই কেন খলনায়ক বানানো হলো? পুরো আন্দোলনের ত্রুটিগুলিকে আড়াল করে নিজেদের দোষ ঢাকবার জন্য।
কংগ্রেস বা গান্ধীর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মূল্যায়ন কীভাবে হতে পারে? ভারত ছাড়ো আন্দোলন প্রস্তাব গৃহীত হবার পর পরই গান্ধী সমেত সমস্ত প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হয়ে যান। ব্রিটিশ সরকার গান্ধীকে গ্রেফতার করে প্রত্যক্ষ গণ-সংগ্রাম পরিচালনার দায়িত্ব থেকে তাঁকে দূরে সরিয়ে রাখলো। তাঁকে যদি গ্রেফতার করা না হতো তাহলে গণ-আন্দোলনের চেহারা কী হতো এবং তিনি কী ধরনের নেতৃত্ব দিতেন সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ভারত কংগ্রেস কমিটির ছিল না। বাস্তবক্ষেত্রে গান্ধীর পুরো চিন্তাই ভুল প্রমাণিত হলো। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ধরপাকড়ের পর একমাস কাটতে না কাটতে উনিশশো বিয়াল্লিশ সালের আগস্ট মাসে বম্বেতে মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ছিল। সে বৈঠকে লীগ-সদস্যদের কেউ কেউ মনে করেছিলেন, কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্রিটিশ বিতারণের এটাই মহেন্দ্রক্ষণ। চৌধুরী খলিকুজ্জামানও প্রায় একই সুরে কথা বলেছিলেন। কিন্তু জিন্নাহর দৃঢ় মত ছিল, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের এ সময় রাস্তায় নামা উচিত নয়। জিন্নাহ তবুও ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কংগ্রেসকে সমর্থন করা হবে কি না, তা নিয়ে লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে প্রস্তাব রাখার সুযোগ করে দিলেন। যাঁরা প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা অনেকেই তখন ভোটদানে বিরত থাকলেন।
মুসলিম লীগ বা জিন্নাহ যদি ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিতে চাইতেন, গান্ধীর শর্ত মেনে নিয়ে কি তাঁদের পক্ষে যোগ দেওয়া সম্ভব ছিল? গান্ধীর লড়াইয়ের মূল কথা ছিল অহিংস সংগ্রাম, সংগ্রাম আবার অহিংস হয় কী করে? যখন কংগ্রেস নেতারা কারাগারে, সাধারণ জনগণ নিজেদের মতো করে এই আন্দোলনকে সফল করে তুলেছিল। স্বভাবতই ব্রিটিশ বিরোধী নাশকতামূলক কার্যকলাপ চলতে থাকে। সাতারায় উনিশশো তেতাল্লিশ সালের মধ্যবর্তী সময় থেকে প্রায় এক বছর ধরে বিদ্রোহীরা সমান্তরাল সরকার পরিচালনা করে। গান্ধী এটা সমর্থন করতে পারেন না, তিনি তখন কারাগারে বসে নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য একুশ দিনের অনশনে বসলেন। গান্ধীর এইরকম হটকারি কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্তিবাদী কোনো মানুষের পক্ষে একমত হওয়া সম্ভব ছিল কি? সন্দেহ নেই, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন প্রবল মাত্রা পেয়েছিল কৃষক শ্রমিকরা এর সঙ্গে যুক্ত হবার ফলে। গান্ধী যদিও কৃষক-শ্রমিকদের এই আন্দোলনে ডাক দেননি। ফলে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করার কৃতিত্ব কংগ্রেসের নয়। কিন্তু তবুও এই আন্দোলন একটা মাত্রা পর্যন্ত বিকশিত হয়ে থেমে পড়লো। উনিশশো পঁয়তাল্লিশ সালে জওহরলাল, বল্লভভাই প্যাটেল আর গোবিন্দবল্লভ পন্থ মিলিতভাবে বিবৃতি দিয়ে বললেন, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেস কিংবা গান্ধী কোনো আনুষ্ঠানিক আন্দোলন শুরু করেননি। সকলে তাঁরা বলতে চাইলেন, ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন আরম্ভ করার আগেই তাঁরা গ্রেফতার হয়েছিলেন, ফলে জনতা সে সময়ে যা করেছে তার দায় কংগ্রেসের নয়। ব্রিটিশের সঙ্গে আপোষ করার জন্য কংগ্রেস ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের দায় সম্পূর্ণ অস্বীকার করলো। মানে বলা হলো, ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন তারা আরম্ভই করেনি। পরবর্তীতে ভারতে স্বাধীনতার ইতিহাস রচনায় সেই আন্দোলনকেই কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলন বলে প্রচার করতে থাকলো। দ্বিচারিতা আর কাকে বলে!
কারাগারের ভিতর গান্ধী বৃদ্ধ বয়সে একুশ দিন অনশন করার কারণে তাঁর শরীর খারাপ হতে থাকে। যুদ্ধের গতিও এই সময় ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। মিত্রশক্তি জয় লাভ করতে থাকে। লর্ড ওয়াভেল উনিশশো চুয়াল্লিশ সালের ছয় এপ্রিল শারীরিক অসুস্থতার কারণে গান্ধীকে কারাগার থেকে মুক্তি দিলেন। গান্ধী কারাগার থেকে বের হয়েই বললেন, তিনি জিন্নাহর সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান। গান্ধী জিন্নাহর সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হন কারণ কংগ্রেসের রাজনৈতিক অবস্থান তখন খুবই দুর্বল। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন করার ভুল তারা বুঝতে পেরেছে। ব্রিটিশ সরকার তখন যুদ্ধ জয়ের পথে। ফলে ব্রিটিশদের কাছে কংগ্রেসের গুরুত্ব কমে গিয়েছিল। সেই অবস্থায় গান্ধী মুসলিম লীগের সঙ্গে মিটমাট করে নিতে চাইলেন। মুসলিম লীগ ভারতের রাজনীতিতে তখন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ অংশিদার। জিন্নাহর কারণে মুসলিম লীগের সদস্য সংখ্যা ত্রিশ লাখে দাঁড়িয়েছিল, জিন্নাহকে এজন্য জনগণকে রাস্তায় নামাতে হয়নি। জনগণকে সরকারের বুলেটের সামনে দাঁড় করাননি। মুসলমানদের মূল সমস্যাটা তিনি শুধুমাত্র অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।
গান্ধীর সঙ্গে আলোচনায়ও জিন্নাহ মুসলমানদের জন্য ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ভিতরে আলাদা ভূখণ্ড দাবি করলেন। গান্ধী তা মেনে নিয়েছেন একটি ‘কিন্তু’ রেখে দিয়ে। তিনি বললেন, ব্রিটিশরা আগে চলে যাক। জিন্নাহকে গান্ধীর বক্তব্য, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা আপনার সঙ্গে থাকলে আপনি যা চান তাই হবে। কিন্তু এক শর্তে। ব্রিটিশরা এখানে থাকার সময়ে ওই ভাগাভাগি চলবে না। জিন্নাহ বলেছেন, ব্রিটিশরা চলে যাবার আগেই সাংবিধানিকভাবে কংগ্রেসকে এটা মেনে নিতে হবে। গান্ধী যখন বললেন, ব্রিটিশরা সরে না গেলে হিন্দু-মুসলমানরা কখনোই শান্তিতে বসবাস করতে পারবে না। ব্রিটিশরা চলে গেলে স্বাধীন দেশে আমরাই নিজেদের সীমানা পুননির্ধারণ, গণভোট এবং দেশভাগের কথা চিন্তা করবো। জিন্নাহ গান্ধীর বক্তব্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলেন, ‘স্বাধীন দেশে আমরাই নিজেদের সীমানা পুননির্ধারণ করতে পারবো’ বলতে সেই “আমরা” কারা? গান্ধী বললেন, স্বাধীন হলে পরে লীগ আর কংগ্রেস মিলে সিদ্ধান্ত নেবে।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, ব্রিটিশরা চলে গেলে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ট দল হিসেবে যদি মুসলিম লীগের সঙ্গে একমত না হতে চায়, মুসলিম লীগের তখন কী করার থাকবে? যখন দুপক্ষ একমত হতে পারবে না, কংগ্রেস ভোটাধিকারের কথা বলবে। সংখ্যাগুরুদের সঙ্গে ভোটাধিকারের প্রশ্নে সংখ্যালঘুরা পেরে উঠবে না সেটাই বাস্তব সত্যি কথা। জিন্নাহ তাই গান্ধীর কাছে চাইলেন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব। জিন্নাহ গান্ধীকে বললেন, আমাদের দুজনের এ আলোচনায় বসা, এটা আপনার প্রস্তাব। ফলে সুনির্দিষ্ট সূত্রটি আপনাকেই দিতে হবে। গান্ধী জানালেন এই ধরনের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তাঁর হাতে নেই। জিন্নাহ বললেন, সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ছাড়াতো মুখের কথায় রাজনৈতিক জটিল সমসার সমাধান হতে পারে না।
গান্ধী আর জিন্নাহর দীর্ঘ বিতর্কে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমাধান কিছু হয়নি। গান্ধী রাজি হয়েছিলেন জিন্নাহকে পাকিস্তান দিতে কিন্তু বললেন বাংলা আর পাঞ্জাবকে দ্বিখণ্ডিত করে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়কে বিভক্ত করে তবেই দেবেন। জিন্নাহ কিছুতেই বাংলা এবং পাঞ্জাবকে বিভাজন করার পক্ষে ছিলেন না বলে আলোচনা ব্যর্থ হলো। লাহোর প্রস্তাবের আগে এবং পরে গান্ধী বারবার মুসলমানদের জন্য আলাদা ভূখণ্ড মেনে নিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন। জিন্নাহ ভারতকে দ্বিখণ্ডিত না করে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই মুসলমানদের জন্য একটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সবগুলি প্রদেশই হবে স্বায়ত্বশাসিত। আর কংগ্রেস চেয়েছে প্রদেশগুলিকে কেন্দ্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখতে। জিন্নাহ যদি ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করে পাকিস্তান সৃষ্টি করে চলে যেতেন তাতে কংগ্রেসের আপত্তি হতো না। কিন্তু জিন্নাহ চাইছেন ভারত যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বায়ত্বশাসিত কতোগুলি মুসলিম প্রদেশ, কংগ্রেস সেটাই মানতে পারছিল না। জিন্নাহকে প্রদেশের স্বায়ত্বশাসনের দাবি থেকে সরাতে না পারার জন্যই বারবার আলোচনায় বসতে হয়েছে। পাঞ্জাব আর বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে জিন্নাহ ক্ষুদ্র একটি অংশ নিয়ে আলাদা হয়ে যাক, কংগ্রেসের তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু কিছুতেই প্রদেশগুলিকে স্বায়ত্ব শাসন দিতে রাজি নয় কংগ্রেস।
জিন্নাহ গান্ধী আলোচনা ভেঙে গেলেও গান্ধী তখনো আশা ছাড়লেন না। গান্ধী চাইছেন, জিন্নাহ যেন কংগ্রেসের দাবি মতো শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার মেনে নেন। শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার মানেই ভারতবর্ষের সকল ক্ষমতা সংখ্যাগুরু হিন্দুদের হাতে রয়ে যাবে। জিন্নাহ ছিলেন স্বাধীনচেতা, যুক্তিবাদী নিয়মতান্ত্রিক মানুষ। গান্ধী ছিলেন ধার্মিক, নিজের বিশ্বাসকে তিনি ধর্মের মতো লালন করতেন। তিনি রামরাজত্ব চাইতেন বলে মুসলমানদের ন্যায়সঙ্গত অনেক দাবির যর্থাথতা বুঝতেন না। ভারত ভাগ সম্পর্কে গান্ধী বণিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছিলেন। ফলে যতোই আলোচনা হোক সমাধানে পৌঁছানো তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। বণিকদের স্বার্থের বাইরে যেমন তিনি যেতে পারতেন না, ভিন্ন দিকে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে দিনের শেষে তিনি একটি হিন্দুরাষ্ট্রের কথাই ভাবতেন যেখানে গোহত্যা চলবে না। ফলে গান্ধী যতোই উদার মন নিয়ে আপোস আলোচনা চালাক না কেন সমাধানের সুযোগ ছিল না। কারণ তিনি তাঁর গোহত্যা বন্ধের দাবি ছাড়তে রাজি ছিলেন না। মুসলমানদের পক্ষে এ দাবি মেনে নেয়া মানে, নিজেদের ধর্মীয় এবং খাদ্যখাবার স্বাধীনতা বাদ দিয়ে গান্ধীর ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা ধর্মীয় ইচ্ছার কাছে নিজেদের সমর্পণ করা। লখনৌ চুক্তির সময় বা তার আগে গোহত্যা নিয়ে কংগ্রেস কখনো আপত্তি করেনি। ধর্মীয় এসব সংকীর্ণতার জায়গা তখন কংগ্রেসে ছিল না।
সারা দেশের মুসলমানরা যে মুসলিম লীগের সঙ্গে রয়েছে তা প্রমাণ করার জন্য দরকার ছিল একটি নির্বাচন। জিন্নাহ বুঝতে পারছিলেন, সেক্ষেত্রে কংগ্রেস একটা ধাক্কা খাবে। সারা ভারতবর্ষের মানুষদের যে কংগ্রেস প্রতিনিধিত্ব করে না সেটা সকলের কাছে প্রতিষ্ঠিত হবে। সরকারও ঠিক তাই ভাবছিল। সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, মুসলিম লীগ সব মুসলিম আসনে নব্বই শতাংশের মতো ভোট পেয়ে জয়ী হয়ে প্রমাণ করলো যে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব সম্পূর্ণভাবে তারাই করে। কংগ্রেস হিন্দু আসনগুলিতে ভালো করলো, বাষট্টির মধ্যে সাতান্নটিতে বিজয়ী হয়ে। কংগ্রেস মুসলমানদের ন্যায্য দাবির প্রতি বারবার অবজ্ঞা প্রদর্শন করে এবং হিন্দুত্বকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে নয় কোটি মুসলমান থেকে ততদিনে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। নির্বাচনের ফলাফল একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করলো, দেশের মুসলমান ভোট দাতারা মুসলিম লীগের পিছনে আছেন। সাধারণ নির্বাচনের ফলে একথা স্পষ্ট হয়েছিল যে লীগই মুসলমানদের প্রতিনিধিস্থানীয় প্রতিষ্ঠান। ভারতের স্বাধীনতা দান এবং সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ক্যাবিনেট মিশনকে পাঠানো হলো। কংগ্রেসের সভাপতি আজাদ জানাচ্ছেন, ক্যাবিনেট মিশনে ‘স্ট্যাফোর্ড ক্রীপস আছেন এ জন্যও আমি সুখী হয়েছি, কারণ তিনি অবশ্যই আমাদের পুরানো বন্ধু।’ কংগ্রেস সভাপতি আজাদের এ বক্তব্য প্রমাণ করে, ক্যাবিনেট মিশনের লোকরা তাদের বন্ধু পক্ষ। ফলে জিন্নাহ ইংরেজদের দালাল ছিল কথাটা আর টিকছে না।
সিদ্ধার্থ গুহ রায় ও সুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, প্রথম থেকেই ক্যাবিনেট মিশন কংগ্রেসের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছিল। ক্যাবিনেট মিশন প্রথমেই জানালেন, ব্রিটেন নীতিগতভাবে ভারতকে স্বাধীনতা দিতে প্রস্তুত। কিন্তু পাকিস্তান গঠন প্রশ্নে তারা দ্বিমত প্রকাশ করেন। স্মরণ রাখতে হবে, লাহোর প্রস্তাবে জিন্নাহ পাকিস্তান দাবি না করলেও পত্রিকাগুলি সেরকম ভুল তথ্যই দিয়েছিল। ক্যাবিনেট মিশন পাকিস্তান দাবিকে এড়িয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু গান্ধী উনিশশো ছিচল্লিশ সালের তেশরা এপ্রিল ক্যাবিনেট মিশনকে জানিয়ে দেন যে, তিনি রাজা গোপালাচারীর সূত্র মেনে জিন্নাহর পাকিস্তান দাবি মেনে নিতে রাজি আছেন। কথাটার মানে দাঁড়ায় বাংলা আর পাঞ্জাবকে ভাগ করার শর্তে তিনি পাকিস্তান মেনে নেবেন। জিন্নাহ সেই শর্ত ইতিপূর্বেই পাকিস্তান দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কথাটা আবার স্পষ্ট হওয়া দরকার পাকিস্তান আসলে জিন্নাহর দাবি ছিল না। তিনি চেয়েছেন প্রদেশগুলির স্বয়ত্বশাসন। কখনোই কেন্দ্রের হাতে প্রদেশগুলির নিয়ন্ত্রণ দেয়া হবে না। কংগ্রেস চেয়েছে, সকল ক্ষমতা থাকবে কেন্দ্রের হাতে, প্রদেশগুলি থাকবে সম্পূর্ণ কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে। সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেস এটাও চেয়েছে মুসলিম প্রধান প্রদেশ বাংলা আর পাঞ্জাবকে ভাগ করে হিন্দুদের আলাদা করে ফেলতে।
ক্যাবিনেট মিশন প্রথমত দুটি প্রস্তাব রাখে, কিন্তু দুটি প্রস্তাবই বাতিল হয়ে গেল। কারণ জিন্নাহ কলকাতা বাদ দিয়ে বা বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে এবং পাঞ্জাবকে টুকরা করে পাকিস্তান নিতে চাননি। জিন্নাহ বাঙালী এবং পাঞ্জাবী জনগোষ্ঠীকে ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা আলাদা ভূখণ্ডে বিভক্ত করতে রাজি ছিলেন না। কংগ্রেসের আবার কেন্দ্রের হাতে স্বল্প ক্ষমতা সম্পন্ন ‘ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র’ মেনে নিতে আপত্তি ছিল। যখন লীগ আর কংগ্রেসের মধ্যে মিল হলো না তখন দু’ পক্ষ নিজেদের পৃথক পৃথক বিকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করলো। মুসলিম লীগের প্রস্তাব ছিল হিন্দু মুসলমান দুটি অঞ্চল নিয়ে সংযুক্ত ভারত রাষ্ট্র গঠিত হবে। দুটি অঞ্চলের কেন্দ্রের হাতে বিদেশ সংক্রান্ত বিষয়, প্রতিরক্ষা এবং প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়া বাকি সব ক্ষমতা থাকবে প্রদেশগুলির হাতে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ছয়টি প্রদেশ পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত, বেলুচিস্তান, সিন্ধু, বঙ্গ ও আসাম নিয়ে একটি অঞ্চল করতে হবে। ছয়টি মুসলিম প্রদেশের জন্য পৃথক একটি সংবিধান রচনাকারী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে। দুই অঞ্চলে পূর্বোক্ত দুই সংবিধান সভা স্থির করবে যে কেন্দ্রে কোনো আইনসভা থাকবে কিনা। কেন্দ্রকে রাজস্ব দেবার জন্য কোন্ পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে তাও দুই সংবিধান সভা স্থির করবে। তবে কোনোক্রমেই কেন্দ্রকে কর ধার্য করার অধিকার দেওয়া হবে না। দশ বৎসর কাল অতিবাহিত হবার পর কোনো প্রদেশ কেন্দ্র থেকে পৃথক হয়ে যাবার অধিকারী হবে। জিন্নাহর এই প্রস্তাবে প্রদেশগুলির জন্য যথেষ্ট স্বাধীনতা রাখা হয়েছিল। প্রদেশগুলি কখনোই কেন্দ্রের ইচ্ছাধীন থাকবে না। ফলে প্রদেশগুলি দশ বছর পর স্বাধীন হতে চাইলে কোনো রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম বা যুদ্ধের প্রয়োজন পড়বে না। মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবের সঙ্গে এই দৃষ্টিভঙ্গির কিছু মৌলিক পার্থক্য ছিল। স্বাধীন সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের কথা এখানে বলা হয়নি।
দ্বিজাতিতত্ত্ব: নানা ভ্রান্তি ও তার প্রচার – পর্ব ১
এখানে পড়ুন
ক্যাবিনেট মিশন এরপর ষোলই মে যে চূড়ান্ত প্রস্তাবটি দিয়েছিল তা জিন্নাহর মূলনীতির কাছাকাছি। ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনায় ছিল, ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশগুলিকে তিনটি বর্গে ভাগ করা হবে। ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবে মাদ্রাজ, বোম্বাই সংযুক্ত প্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত হবে ক বর্গ। ঠিক একইভাবে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব, সিন্ধু ও বালুচিস্তান নিয়ে গঠিত হবে খ বর্গ। বঙ্গ এবং আসাম নিয়ে গঠিত হবে গ বর্গ। মিশনের চূড়ান্ত প্রস্তাবে বলা হলো, কেন্দ্রের আওতাভুক্ত বিষয়াবলী ছাড়া আর সব বিষয় এবং অবশিষ্ট ক্ষমতা প্রদেশগুলির উপর বর্তাবে। কেন্দ্রকে যেসব ক্ষমতা দেওয়া হবে তা ছাড়া আর সব ক্ষমতা দেশীয় রাজ্যগুলিতে ন্যস্ত থাকবে। প্রদেশগুলির নিজেদের মধ্যে দল গঠনের অধিকার থাকবে এবং এই দল বা প্রদেশগোষ্ঠীগুলির স্বতন্ত্র প্রশাসন ব্যবস্থা ও আইনসভা থাকবে। ক্যাবিনেট মিশনের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে আরো বলা হয়, নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থা কার্যকরী হবার পর প্রদেশগুলির যাকে যে বর্গের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার বাইরে চলে আসার অধিকার থাকবে।
কংগ্রেস সভাপতি আজাদ দশ বারো বছর পর লিখছেন, তিনি মনে করেন না যে এই পর্বে ভারত এবং ব্রিটেনের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ নিয়ে সঙ্কট ছিল। বরং সঙ্কটটা ছিল, ভারতের মধ্যকার নিজস্ব সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন নিয়ে। তিনি বলেন, কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানগণ তাদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে তখন খুবই উদ্বিগ্ন ছিল। সত্য যে কয়েকটা প্রদেশে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। প্রাদেশিক পর্যায়ে এই সকল জায়গায় তাদের কোনো ভয় ছিল না। কিন্তু সমগ্র ভারতবর্ষের দিক থেকে মুসলমানরা সংখ্যালঘু ছিল। সেই জন্য তাদের মনে এই ভয় সর্বসময় তাড়িত করতো যে হয়তো স্বাধীন ভারতবর্ষে তাদের অবস্থান এবং মর্যাদা সংরক্ষিত নাও হতে পারে। জিন্নাহ যা বারবার বলতেন বা বিশ্বাস করতেন, আজাদ সে কথাটাই লিখছেন তাঁর বইয়ে স্বাধীনতার দশ বছর পর। যদি আজাদের বক্তব্য মতো মুসলমানদের মনে ভয় থাকে নিশ্চয় তার কারণও থাকবে। সংখ্যাগুরুদের সম্পর্কে এই ভয়টার কথাই তো জিন্নাহ বারবার বলতেন। ফলে জিন্নাহ যে মুসলমানদের উস্কে দিয়েছিলেন সে কথাটা ঠিক নয়। মুসলমানদের মধ্যে সত্যিই একটা ভয় ছিল সংখ্যাগুরুদের সম্পর্কে।
কংগ্রেস নেতা আজাদের যে গ্রন্থ থেকে এই কথাগুলি জানা যাচ্ছে, যা তিনি লিখেছিলেন স্বাধীনতার দশ বছর পর। সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষায় প্রদেশগুলির হাতে যে অধিক ক্ষমতা আর কেন্দ্রের হাতে খুব সামান্য ক্ষমতা থাকা দরকার ছিল আজাদ তাঁর গ্রন্থে খোলাখুলি সে কথা স্বীকার করেন। কিন্তু গান্ধীসহ কংগ্রেস সে কথাগুলি মানতে চায়নি। তিনি লিখেছেন, ‘যদি এমন একটি সংবিধানের রূপরেখা গঠন করা হয়, যা এ নীতিকে রূপায়িত করবে, নিশ্চিত করবে যে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে শুধু তিনটি বিষয় ছাড়া সব বিষয় প্রদেশ নিজেই পরিচালনা করবে। এতে করে হিন্দুদের আধিপত্যের আশঙ্কা মুসলমানদের মন থেকে দূর হবে। সাম্প্রদায়িক সমস্যা ছাড়াও ভারতের মতো একটি দেশের জন্য এটা হবে সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক সমাধান। ভারতবর্ষ একটি বিশাল দেশ, বিশাল জনসংখ্যা সম্বলিত; যারা কমবেশি সমসত্ত্ব এককে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন প্রদেশে বাস করে। তাই প্রয়োজন ছিল প্রদেশগুলিকে সম্ভাব্য ব্যাপকতর স্বায়ত্বশাসনের আশ্বাস দেয়া।’ জিন্নাহর কথাগুলিই আজাদ তাঁর বইয়ে হুবহু বলছেন। যা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় জিন্নাহর পথটাই আসলে সঠিক ছিল। যদি তিনি দশ বছর আগে কথাগুলি চিন্তা করতে পারতেন তাহলে ভারত ভাগ হবার প্রয়োজন ছিল না, অবশ্য কংগ্রেসের নেতারা তাঁর সঙ্গে এক মত হলে। কংগ্রেসের সভাপতি আজাদের বক্তব্যে বারবার এটাই প্রমাণিত হবে ভারত ভাগের দায় জিন্নাহর নয়।
ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব কংগ্রেস গ্রহণ করতে রাজি হলো না। গান্ধীর পরিষ্কার বক্তব্য ছিল, কোনো প্রদেশকেই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বর্গে যোগ দিতে বাধ্য করা চলবে না। কংগ্রেসের সব আপত্তির পিছনে প্রধান কারণ ছিল সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছিল ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনায়। কংগ্রেস আসলে হিন্দু প্রধান আসামকে গ বর্গে অর্থাৎ মুসলিম প্রধান বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করাটা মেনে নিতে পারছিল না। ফলে ভারতের বৃহত্তর স্বার্থের কথা বাদ দিয়ে কংগ্রেস হিন্দুস্বার্থ রক্ষায় সংকীর্ণতার পরিচয় দিচ্ছিলো। অথচ সংবিধান রচনার পর আসাম চাইলেই গ বর্গ হতে বের হয়ে যাবার স্বাধীনতা তার ছিল। ব্রিটিশ শক্তি যে সংখ্যালঘুদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে মুসলিম লীগের বহু দাবি মেনে নিয়েছিল সেটা কংগ্রেসের অনেকের পছন্দ ছিল না। কংগ্রেসের কাছে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কেন্দ্রের হাতে ক্ষমতা না থাকা। কংগ্রেস যখন বলে প্রদেশগুলির স্বাধীকার নষ্ট হতে পারে বর্গ কর্তৃক তাদের সংবিধান প্রণীত হলে, তখন কংগ্রেসের এই বক্তব্য মায়াকান্নার মতো শোনায়। যারা প্রদেশের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে সব ক্ষমতা দিতে চায় কেন্দ্রকে তাদের মুখে কি এ কথা আদৌ মানায়? দ্বিতীয়ত তারা মনে করলো, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলিকে আলাদা বর্গে রাখার মানে হলো ভবিষ্যতে সেগুলি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবে কিন্তু প্রদেশগুলির যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করা হয়নি।
মুসলিম লীগেরও ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা নিয়ে কিছু আপত্তি ছিল। সব আপত্তি সত্ত্বেও ছয়ই জুন মুসলিম লীগ ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল। জিন্নাহ ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু আপত্তি সত্ত্বেও এ কথাও স্বীকার করেছিলেন, সংখ্যালঘু সমস্যার এর চেয়ে ভালো সমাধান হতে পারে না। পাকিস্তান সৃষ্টি সম্পর্কে প্রস্তাবে কিছু না থাকা সত্ত্বেও মুসলিম লীগ ক্যবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে গান্ধীবাদী শৈলেশকুমার সে সম্পর্কে বলছেন, লীগের এই স্পষ্ট প্রতীয়মান পরিবর্তিত ভূমিকার পিছনে জিন্নাহর বিশেষ অবদান ছিল। জিন্নাহ ভারত থেকে কখনো সম্পূর্ণভাবে বের হয়ে যাবার কথা বলেননি। জিন্নাহ হিন্দু প্রধান এবং মুসলিম প্রধান প্রদেশের ভিত্তিতে ভারতকে দুটো অঞ্চলে ভাগ করার কথা বলেছিলেন। জিন্নাহর মূল যে দাবি প্রদেশগুলির হাতে স্বায়ত্বশাসন বা অবশিষ্ট ক্ষমতা দান সেটা ক্যাবিনেট মিশন মেনে নিলে তিনি ক্যাবিনেট মিশনের যুক্তরাষ্ট্রীয় কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের পক্ষে প্রস্তাবে সম্মতি জানান। জিন্নাহর তরফে এটি এক বিরাট বিবেচনার পরিচায়ক। লীগ কাউন্সিলের তেরো জন সদস্য প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিলেও বাকিরা জিন্নাহর কথা মেনে নিলেন। মুসলিম লীগ ক্যাবিনেট মিশনের স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী দুটো প্রস্তাবই গ্রহণ করলো।
কংগ্রেসের আজাদ তাঁর গ্রন্থের অন্যত্র লিখলেন, দশই আগস্ট কংগ্রেসের গৃহীত প্রস্তাব জিন্নাহকে সন্তুষ্ট করতে পারলো না। কারণ ক্যাবিনেট মিশন নিয়ে গান্ধীর ভূমিকা সম্পর্কে আজাদ কী লিখেছেন? সূচনাতে গান্ধীজি ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। গান্ধী বলেছিলেন, ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনায় রয়েছে দুঃখপূর্ণ দেশকে দুঃখযন্ত্রণাহীন দেশে পরিণত করার বীজ। হরিজন পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ভাইসরয় ও ক্যাবিনেট মিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত রাষ্ট্রীয় দলিলপত্র চারদিন ধরে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে এমন পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার যা করতে পারতো তার সর্বত্তম দলিল এটি।’ কংগ্রেস তাহলে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করলো না কেন? গান্ধী তাহলে আবার সিদ্ধান্ত পাল্টালেন কেন? ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনায় যেভাবে আসাম এবং বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল তার বিরোধিতা করলেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বারদোলাই। তিনি ভারতের বৃহত্তর স্বার্থ বাদ দিয়ে নিজের সুবিধার কথা ভেবে তাঁর বিরোধিতায় স্থির রইলেন। গান্ধীও তাঁর মত পাল্টে ফেললেন এবং তিনি বারদৌলিকে সমর্থন দিলেন। গান্ধী বারদৌলির মতো হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ় মত পোষণ করলেন। ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখার স্বার্থে জওহরলাল এবং আজাদও এই ক্ষেত্রে গান্ধীর মত পরিবর্তন করাতে পারলেন না। গান্ধী সম্পর্কে আজাদই এ তথ্য দিচ্ছেন তাঁর গ্রন্থে।
সংখ্যালঘুর রাজনৈতিক অধিকার দিয়েই ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখা যেতো। কিন্তু যাঁরা সেটা দিতে চাইলেন না, ভারত ভাগের দায় কি তাঁদের নয়? সংখ্যালঘুরা তাদের মুক্তির জন্য সংখ্যাগুরুদের শাসন থেকে বের হয়ে আসতে চাইবেই। ক্যাবিনেট মিশন বা আজাদ বা জিন্নাহর দাবিগুলি সেখান থেকে ভারতকে রক্ষা করার জন্য ভিন্ন সূত্র দিয়েছিল। দ্বিখণ্ডিত ভারত নয়, চাইলেন যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারত। ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা মেনে নিয়ে জিন্নাহ চাইলেন, মুসলমানদের নিয়ে ভারতের ভিতরেই থেকে যেতে যেখানে প্রতিটি প্রদেশ স্বশাসন লাভ করবে। কংগ্রেসের নেতারাই শেষ পর্যন্ত তা মানতে পারলেন না। দ্বিজাতিতত্ত্বকে তবে কারা বেড়ে উঠতে দিয়েছিল? ভারত ভাগের দায় কার? কাদের কট্টোর মনোভাবের কারণে ভারত দ্বিখণ্ডিত হলো! আজাদ আরো লিখেছেন, ‘দশ বছর পর পিছনে তাকিয়ে আমি স্বীকার করছি যে জনাব জিন্নাহ যে কথা বলেছিলেন তাতে জোর ছিল। চুক্তিতে কংগ্রেস ও লীগ উভয় দলই ছিল এবং কেন্দ্র, প্রদেশসমূহ ও বর্গসমূহের মধ্যে বণ্টনের ভিত্তিতেই কেবল লীগ পরিকল্পনাটি গ্রহণ করেছিল। কংগ্রেস সন্দেহ উত্থাপন করে সঠিক বা বুদ্ধিমানের কাজ কোনোটিই করেনি। যদি ভারতের ঐক্যের পক্ষে কংগ্রেস দৃঢ় হতো তবে পরিকল্পনাটি সন্দেহাতীতভাবে তার গ্রহণ করা উচিৎ ছিল।’
ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ বা বর্জন করার সঙ্গে মূলত ভারত ভাগের ব্যাপারটা পরবর্তীতে চূড়ান্ত হয়েছে। দ্বিজাতিতত্ত্বকে ঘিরে আর সেটা প্রাধান্য পায়নি। জিন্নাহ তখন দ্বিজাতিতত্ত্ব থেকে সরে এসেছিলেন। সবশেষে মাউন্টব্যাটেন ভাইসরয় হিসেবে ভারত ভাগকে অনেক বেশি ত্বরান্বিত করেছিলেন।
(সমাপ্ত)
দ্বিজাতিতত্ত্ব: নানা ভ্রান্তি ও তার প্রচার – পর্ব ১
এখানে পড়ুন
লেখক পরিচিতি:
রাহমান চৌধুরী, লেখক, শিল্প সমালোচক