৪০ হাজার মানুষের সামনে জর্জ হ্যারিসন সেদিন যে গানটি বাংলাদেশের জন্য গেয়েছিলেন সে কি ভোলা যায়!
‘বন্ধু আমার এল একদিন
চোখ ভরা তার শুধু হাহাকার
বলল কেবল সহায়তা চাই
বাঁচাতে হবে যে দেশটাকে তার
বেদনা যদিবা না-ও থাকে তবু
জানি আমি, কিছু করতেই হবে
সকলের কাছে মিনতি জানাই
আজ আমি তাই
কয়েকটি প্রাণ এসো না বাঁচাই
বাংলাদেশ, বাংলাদেশ।’
সময়টা তখন ১৯৭১। যুদ্ধের বিভীষিকায় রক্তাক্ত বাংলাদেশ। লক্ষ, লক্ষ নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, পুষ্টিহীন-গুলিবিদ্ধ, নিরীহ নিরন্ন মানুষ এক বস্ত্রে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এত বিপুলসংখ্যক, বিশ্বে আজও সর্বোচ্চ উদ্বাস্তু পরিস্থিতি, শরণার্থীদের ভরণ-পোষণ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে ভারতকে। দেখা দিয়েছে খাদ্য, চিকিৎসা ও ত্রাণ-সামগ্রীর অপ্রতুলতা। খোলা আকাশের নিচে চাটাই, ত্রিপল, সুয়্যেরেজ পাইপ আর গাছের তলায় অবস্থানরত শরণার্থীদের মাঝে এরই মাঝে দেখা দিয়েছে কলেরা, ম্যালেরিয়ার মত মারী। পুষ্টিহীনতায় মারা যাচ্ছে অসংখ্য শিশু আর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা।
এ অবস্থা দর্শনে বিচলিত বিশ্বখ্যাত সেতার বাদক পণ্ডিত রবি শঙ্কর চুপ করে বসে থাকতে পারলেন না। কী করে বসে থাকবেন? তাঁরও যে পূর্ব প্রজন্মের নাড়ী পোতা আছে সেই বাংলাদেশের নড়াইলে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গুরু পণ্ডিত রবি শঙ্কর যোগাযোগ করলেন জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হ্যারিসনকে যুক্তরাষ্ট্রে দাতব্য সঙ্গীতানুষ্ঠান আয়োজনের কথা বললেন। রবি শঙ্কর অন্তত ২৫ হাজার মার্কিন ডলার অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বন্ধু হ্যারিসনের সাহায্য চাইলেন। হ্যারিসন অকুণ্ঠ চিত্তে বন্ধুর প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। গুরুভাই ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ জানালেন তিনিও আছেন রবি শঙ্কর হ্যারিসনের সাথে।
নিজ দেশের জন্য রবির কিছু করার তাড়না দেখে, মানবতার তাগিদে হ্যারিসন বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন সেদিন। ব্যাস শুরু হয়ে গেল তোরজোড়, হ্যারিসন তাঁর বন্ধুদের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে যোগদানের আমন্ত্রণ জানালেন। ‘আই-মি-মাইন’ বইতে এ কনসার্ট সম্পর্কে হ্যারিসন লিখেছেন যে পরবর্তী তিন মাস তিনি টেলিফোন যোগাযোগ করতে থাকেন অন্যদের সাথে, তাদের কনসার্ট ফর বাংলাদেশের সাথে যুক্ত করতে। তখন বিটলস ভেঙে গেছে এবং অন্য সদস্যদের সাথে আগের মতো সর্ম্পক নেই হ্যারিসনের। তারপরেও তাঁদের এ কনসার্টে যোগ দিতে বলেন হ্যারিসন। রিঙ্গো স্টার রাজি হয়ে গেলেন। পল ম্যাককার্টনি রাজি হলেন না, আর জন লেননের যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও পরে পারিবারিক মামলাজনিত কারণে আর যোগ দিতে পারেননি।
প্রস্তুতি শেষে ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই তার বিখ্যাত ‘বাংলাদেশ’ গানটি মুক্তি দেয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সংকটের কথা তুলে ধরেন হ্যারিসন। ঐ দিনই এক প্রেস কনফারেন্সের মধ্য দিয়ে হ্যারিসন ও রবি শঙ্কর কনসার্ট ফর বাংলাদেশের ঘোষণা দেন। হ্যারিসন কেন এ কনসার্ট করতে আগ্রহী হলেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘তাঁর বন্ধু চেয়েছিল, তাই’। কনসার্ট ফর বাংলাদেশের স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হল নিউইর্য়কের বিখ্যাত ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন আর তারিখ নির্ধারণ করা হল ১ আগস্ট।

সেদিন মঞ্চে পণ্ডিত রবি শঙ্কর, ওস্তাদ আল্লা রাখা ও ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ পরিবেশনায় মগ্ন।
১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইর্য়কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ঐতিহাসিক এ কনসার্ট। শ্রোতা দর্শকের চাপে ২টি কনসার্টের আয়োজন করা হল, প্রথমটি দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে এবং দ্বিতীয়টি সন্ধ্যা ৮ টায়। কনসার্ট ফর বাংলাদেশে ছিলেন সব খ্যাতনামা শিল্পী-তারকা। তাঁদের এই লাইনআপকে বলা হয়েছিল ‘সুপার গ্রুপ’। কনসার্টের পূর্বে সুপার গ্রুপের সকলকে কল করে উপস্থিতি নিশ্চিত করেছিলেন হ্যারিসন। তবে ডিলান আসবেন কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না তিনি, তাই ডিলানের নামের পাশে এঁকে দিয়েছিলেন প্রশ্নবোধক ‘?’ চিহ্ন।
কনসার্টে আগত হাজার হাজার শ্রোতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে শুরুতেই জর্জ হ্যারিসন বলেন, ‘ভারতীয় সংগীত আমাদের চেয়ে অনেক গভীর।’ তারপর পণ্ডিত রবি শঙ্কর ও ওস্তাদ আলী আকবর খান এবং সহশিল্পীদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। কনসার্টটির শুরুতেই পণ্ডিত রবি শঙ্কর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বললেন, ‘প্রথম ভাগে ভারতীয় সঙ্গীত থাকবে। এর জন্য কিছু মনোনিবেশ দরকার। পরে আপনারা প্রিয় শিল্পীদের গান শুনবেন। আমাদের বাদন শুধুই সুর নয়, এতে বাণী আছে। আমরা শিল্পী, রাজনীতিক নই। বাংলাদেশে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের পল্লিগীতির সুরের ভিত্তিতে আমরা বাজাব “বাংলা ধুন”।’
পন্ডিতজি ‘বাংলা ধুন’ নামের একটি নতুন সুর সৃষ্টি করেছিলেন। সেটি দিয়েই আলী আকবরের সঙ্গে যুগলবন্দীতে কনসার্ট শুরু হয়েছিল। তবলায় ছিলেন ওস্তাদ আল্লা রাখা এবং তানপুরায় ছিলেন কমলা চক্রবর্তী। তাঁদের ৪৫ মিনিটের পরিবেশনা শেষে একটি সংক্ষিপ্ত বিরতি দেয়া হল।

দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ এলবামের প্রচ্ছদ
৪০ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে ইউনিসেফের তত্ত্বাবধানের কনসার্টটিতে বিরতির পর ডাচ এক টিভি চ্যানেলের ধারণ করা পাক হানাদারদের নৃশংস অত্যাচার ও বিপর্যস্ত বাংলাদেশের ফুটেজ দেখানো হল। এ ফুটেজটি উপস্থিত দর্শকদের বাংলাদেশে চলা সংকটের এক বাস্তব ধারণা দিয়েছিল। এরপর ছিল হ্যারিসন পরিবেশন করলেন ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’। তাঁর সাথে ছিলেন রিঙ্গো স্টার, এরিক ক্লাপটন (যিনি অসুস্থতার মাঝেও উপস্থিত ছিলেন সেই কনসার্টে), বিলি প্রিস্টন, লিয়ন রাসেল, ক্লাউস ভোরম্যান, জিম কেল্টনারসহ ১৮ জন মিউজিশিয়ান। এটি ছিল হ্যারিসন ও ক্লাপটনের বেশ কয়েক বছর বিরতির পর প্রথম কোনো কনসার্টে পরিবেশনা।
হ্যারিসন এক সময় হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখলেন ডিলান উপস্থিত হয়েছেন। ডিলানের উপস্থিতি শুধু হ্যারিসনের জন্য নয়, দর্শকদের জন্যেও এক বিশাল চমক ছিল।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রথম কনসার্টটির সব টিকিট বিক্রি হয়ে যাওয়ায় হ্যারিসন-ডিলানসহ সকলে আগ্রহের সাথে দ্বিতীয় কনসার্টটি করলেন। দ্বিতীয় কনসার্টটিতে পরিবেশনা তালিকায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হইয়েছিল। এবারও কনসার্টের সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেল এবং কনসার্ট শেষে বব ডিলান হ্যারিসনকে বললেন, আমরা হয়তো আরও একটি কনসার্ট করতে পারতাম।

জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান এবং লিয়ন রাসেল সেদিনের কনসার্টে।
হ্যারিসনের বন্ধু রবির ভাষায়, ‘হ্যারিসন বাংলাদেশের বিপর্যয়ের কথা শোনা মাত্রই রাজি হয়ে যান কনসার্টটি আয়োজন করার জন্য’। পাকিস্তানকে যে দেশের সরকার তখন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সরাসরি সমর্থন দিয়েছিল, সামরিক-আর্থিক-কূটনৈতিক সমর্থনকারী যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতেই ব্রিটিশ-বাঙালী দুই শিল্পী সৃষ্টি করলো ইতিহাসের। সেই কনসার্ট থেকে তৎকালীন অর্থে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার অনুদান সংগ্রহ হয়েছিল।
ঐতিহাসিক এই কনসার্টটি হ্যারিসনের জীবনকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। কনসার্ট ফর বাংলাদেশ শুধু কনসার্টের মধ্যেই আবর্তিত ছিল না, হ্যারিসনের এই কনসার্টকে কেন্দ্র করে লেখা ‘বাংলাদেশ’, এরপরের ৩ টি অ্যালবাম এবং একটি ফিল্মের থেকে প্রাপ্ত প্রায় ১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ইউনিসিফের তহবিল জমা পড়ে। বাংলাদেশ থেকে শুরু করে যেই অর্থে বিশ্বের বিপর্যস্ত স্থানে ছড়িয়ে পড়ে, অ্যাঙ্গোলা থেকে রোমানিয়ার বিপর্যস্ত মানুষকে সহায়তা করেছে এমনকি হর্ন অব আফ্রিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সাহায্যে ব্যয় হচ্ছে এখনও। বাংলাদেশ, হ্যারিসন নাম দুটো তাই সঙ্গীত আর মানবিকতার সঙ্গে জড়িত থাকবে অনন্তকাল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যে বীরেরা রণাঙ্গনে থেকে দেশের জন্যে লড়াই করেছে, নিজের, পরিবারের মানুষদের জন্য জীবন দিয়েছে তাদের আমরা মুক্তিযোদ্ধা কিংবা শহীদ আখ্যা দিয়ে সম্মান দিচ্ছি। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে যে মানুষগুলোর কোনোভাবে কোনো সম্পর্ক নেই, সেসব মানুষগুলো বিশ্ব দরবারে মানবিকতার জন্য বাংলাদেশের নামটি তুলে ধরেছিল নিঃস্বার্থভাবে, তাদের কি আমরা যথাযথ সম্মান দিতে পেরেছি? হ্যাঁ কিছুটা হলেও পেরেছি তবে এসব মহাত্মা, বাংলাদেশের নিঃস্বার্থ বন্ধুদের ধন্যবাদ জানাতে বাংলাদেশের লেগে গেছে অনেক বছর।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা নিউইয়র্কে কনসার্টের মাধ্যমে রবি শঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন। তাঁদের প্রচেষ্টা ছাড়া বাংলাদেশের জনগণের সে সময়ের সয়ে যাওয়া অত্যাচারগুলো বিশ্বের মানুষের অলক্ষ্যেই থেকে যেত হয়তো। আরও কত লাখ লাখ মানুষ যে মারা যেত, হাজারো নারী ধর্ষিত হতো তা এখন আমাদের চিন্তায়ও আসবে না।
পৃথিবীর ইতিহাসে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ শুধু একটা সফলতম কনসার্টই নয়, এটা মানবিকতার সঙ্গে সঙ্গীতকে সরাসরি যুক্ত করার সেই দ্বার যাকে অনুসরণ করে এখন প্রায়ই মানুষের কল্যাণের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে দেখা যায় সারা বিশ্বে এমনকি বাংলাদেশের পথে পথেও।
লেখক: সাগর লোহানী, সম্পাদক, বাঙালীয়ানা
অগ্নিঝরা একাত্তরের দিনগুলো, পড়ুন –
আগস্ট ১৯৭১
জুলাই ১৯৭১
জুন ১৯৭১
মে ১৯৭১
এপ্রিল ১৯৭১
মার্চ ১৯৭১