১)
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া নাকি বাংলাদেশে একটা বিরাট অপরাধ। এইতো সেদিন দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের এক জেলায় এক নিতান্ত দরিদ্র হিন্দু মহিলাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার মামলায়। সেই মহিলা কলতলা নাকি জলের ঘাটে জড়ো হওয়া অন্যান্য নারীদের সাথে সাধারণ কথাবার্তায় কি যেন বলেছিলেন- সেইটাই নাকি ধর্মীয় অনুভূতিতে বিরাট আঘাত হয়ে গেছে। (এই ঘটনায় পাকিস্তানের খ্রিস্টান মেয়ে আছিয়ার কথা মনে পড়ে যায় না?)। তাহলে হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অপরাধে কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারকে এখনো কেন গ্রেফতার করা হলো না?
এই প্রশ্নটা সরকারের কাছে করি। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া যদি আপনাদের চোখে আসলেই অপরাধ বিবেচিত হয়, তাহলে বাহারকে এখনো কেন গ্রেফতার করলেন না? গ্রেফতার তো দূরের কথা, বাহারের অশোভন অনুচিত ও অন্যায় কথার প্রতিবাদে যখন হিন্দু বৌদ্ধ খৃস্টান ঐক্য পরিষদ প্রতিবাদ করতে গেছে সেই মিছিলে পুলিশ বাধা দিয়েছে। ছাত্রলীগ যুবলীগ সেই মিছিলে হামলা করেছে। পুলিশ এখনো বাহারকে গ্রেফতার করেনি, বাহারের বিরুদ্ধে কোন মামলা হয়নি- কোন প্রকার ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি বাহারের বিরুদ্ধে। কেন? তাহলে কি আপনারা আমাকে বলছেন যে এই দেশে হিন্দু ধর্ম বা মুসলমানদের ধর্ম ছাড়া অন্য কোন ধর্মের অবমাননা করা জায়েজ?
বাহারের বক্তব্য কি তবে সরকারের এবং সরকারী দলেরও বক্তব্য? বাহারের বক্তব্য আপনারা শুনেছেন। অনলাইনে ছড়িয়েছে সেই বক্তব্যের ভিডিও। বাহার বলছেন, পূজার সময় হিন্দুরা মদ্যপান করে রাতভর পূজা মণ্ডপে নাচতে থাকে। বাহার বক্তব্য শুরুই করেছেন এই বলে যে, দোষ আমাদের কিছু আছে আপনাদেরও আছে। আমরা বাহারের কাছে ‘আমরা’ মানে মুসলিম আর ‘আপনারা’ মানে হিন্দু। এইটাই তবে আওয়ামী লীগ? মুসলমানদের পার্টি? এইজন্যেই তবে আওয়ামী লীগের প্রতিটা পোস্টার লিফলেট বা প্রকাশনার উপর লেখা থাকে মুসলমানদের ধর্মীয় নারা দোয়া বা দরুদ! তাহলে নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে ভণ্ডামি করেন কেন? সোজা নেমে যান আল্লাহু আকবর বলে!
(২)
আর হিন্দুদের পূজায় মদ্যপান করা হয়? পূজায় নৃত্য করা মানে মদ্যপান করে নৃত্য করা? এই তথ্য বাহারকে কে বলেছে? মদ্যপান নিতান্ত ব্যক্তিগত বিষয়, এর সাথে পূজার সম্পর্ক কি? কে মদ্যপান করবে আর কে করবে না সেটা কি পূজার সময় শান্তিরক্ষার পূর্ব শর্ত? মানে কী? যদি কেউ মদ্যপান করে পূজামণ্ডপে নৃত্য করে সেটার জন্যে পূজামণ্ডপে হামলা করা জায়েজ হয়ে যায়? এর মানে কি তবে পূজার সময় পুলিশ গিয়ে বলবে যে না, এই মণ্ডপে মদ্যপান করে নেচেছে একদল যুবক সুতরাং এই মণ্ডপ আমরা পাহারা দেব না? এটা কি ধরনের কথা? ধরুন প্রতিটা পূজামণ্ডপেই কিছু যুবক মদ্যপান করে নাচতে যায়, তাতে এমপি সাহেবের পিত্তি জ্বলে যায়?
বাহারকে কে অধিকার দিয়েছে এই শর্ত আরোপ করার যে পূজামণ্ডপে কেউ মদ্যপান করে যাবে কী যাবে না? বাহার এইসব কথা বলেছেন কোথায়? জেলা প্রশাসনের সভায়, যেখানে পূজার সময় আইন শৃঙ্খলা রক্ষা নিয়ে আলোচনা হবে। সেখানে বাহার শর্ত দিচ্ছে যে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা ‘আমরা’ অর্থাৎ মুসলিমরা করবে যদি ওদের শর্ত মেনে নেয়? এইটা জেলা প্রশাসনের কাজ? পূজার সময় প্রতিটা জেলায় এবং প্রতিটা বড় শহরে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা নিয়ে প্রশাসনের সভা হয়। কেন? কারণ সকলের মনে সেই শঙ্কা থাকে- মুসলিমরা আক্রমণ করতে পারে। সেখানে গিয়ে বাহার বলেন কিনা ‘আমরা’ ও ‘আপনারা’! এর মানে কী?
এইসব মিটিংএ তো এমপিরা যায় জনপ্রতিনিধি হিসাবে। বাহারও সেই যোগ্যতায়ই গেছেন? প্রকৃত জনপ্রতিনিধি হলে তো তিনি মুসলিমদের যেমন প্রতিনিধি সেরকম হিন্দুদেরও প্রতিনিধি। কিন্তু তিনি সেখানে যেভাবে বলেছেন যে, দোষ আমাদের যেমন আছে আপনাদেরও কিছু আছে, এটার মানে কী? তিনি কি তবে হামলাকারী তস্করদের পক্ষ থেকে সেখানে দরকষাকষি করতে গেছেন? তাহলে কি যে গুজবটা চালু আছে যে বিগত বছরের গদা ইকবাল কাণ্ডের পেছনে বাহারের হাত আছে সেই কথাটি সত্যি? এখন কেউ যদি বলে যে এইজন্যেই গদা ইকবালকে অতি সামান্য সাজা দিয়ে কায়দা করে বাঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে তাহলে তার জবাব কী হবে?
(৩)
শুনুন, আমি জানি বাহার সাহেব আওয়ামী লীগের একজন বড় নেতা এবং খুবই লোকপ্রিয় নেতা। তাকে হেয় করা বা ছোট করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু আমি যদি আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ অর্জন করতে চাই, যদি দেশে অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে চাই তাহলে এটা তো আমার দায়িত্ব যে আমি সকল প্রকার ও ধরনের সাম্প্রদায়িকতার বিরোধ করবো এবং সমালোচনা করবো এবং প্রতিরোধ করবো। এইটা আমার প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমির প্রতিটা নাগরিকের দায়িত্ব- কেননা আমরা একটা দেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্যে লড়েছি, প্রাণ দিয়েছি, শত্রু হত্যা করেছি তাঁর কারণই ছিল যে আমরা একটা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
এই দেশের একজন নেতার কথার ফর্মে এবং কন্টেন্টে যদি দেখা যায় যে তিনি দেশের একটি সম্প্রদায়কে ‘আমরা’ ও ‘আপনারা’ করছেন, আমি তো তার নিন্দা করবোই। কেননা আমি চাই এই দেশে মানুষের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে কারো প্রতি বৈষম্য করা হবে না। কেবলই ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু বলেই কাউকে দুর্বল ভাবা হবে না। আর সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে এইসব ঘটনার বিচার করতে হবে না? হবে তো। সেই দাবীটাই করছি। নতুবা সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র মুখোশটি ঝেড়ে ফেলুন।
লেখক:
ইমতিয়াজ মাহমুদ, মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী