গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের একজন সচেতন নাগরিক এবং ‘আইন ও মানবাধিকার’ বিভাগের একজন ছাত্র হিসেবে আমি সর্বদা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সাথে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আমি সমর্থন করি না। কারন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যেমনি নাশকতার সমাধান নয় তেমনি সংবিধান ও আইনের পরিপন্থি।
আচ্ছা চলুন দেখা যাক ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড’ কি?
বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড হচ্ছে একপ্রকার বেআইনী হত্যাকাণ্ড যা সাধারণত রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, সামাজিক ব্যক্তি, বা অপরাধীকে রাষ্ট্রপ্রদত্ত আইনগত বিচারের পূর্বেই হত্যা করা। এটি সাধারণত সরকার, প্রাদেশিক সরকারের মাধ্যমে, যেমন: পুলিশ বা সশস্ত্র বাহিনী অথবা বিভিন্ন অপরাধী সংগঠন দ্বারা সংঘটিত হয়।
‘প্রিন্সিপাল অব ন্যাচারাল জাস্টিস’ বলে যে একটা নীতি আছে, যে কাউকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে দোষী সব্যস্ত করা যাবে না। সেকথা অবশ্যই আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
হোক সে আস্তিক বা নাস্তিক, যদু বা মধু, রাম বা রহিম। মনে রাখবেন আমারা সবাই রক্ত মাংসের মানুষ। একটা মানুষ যত বড়ই অপরাধ করুক না কেন তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় এনে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। তারপর সে যদি দোষী সাব্যস্ত হয় তাকে অবশ্যই দেশের প্রচলিত আইনের মাধ্যমে কঠোর থেকে কঠোরতর শাস্তি দেওয়া হবে। (এটাই আইন) বিপরীতে, যদি সে নির্দোষ হয়। তবে তাকে সম্মানসহ খালাস করতে বাধ্য।
আজ কাল অনেক মানুষই কথায় কথায় বলেন যে, ‘ফ্রিডম অব স্পিচ’ নেই দেশে। ভাই এ কথাটি বুঝতে আপনাদের এত সময় লেগেছে?
আচ্ছা চলুন দেখি, ‘ফ্রিডম অব স্পিচ’ খায় না মাথায় দেয়!?
মানবাধিকার সনদ (১৯৪৯) এর ১৯ নং অনুচ্ছেদ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী অভিব্যক্তির স্বাধীন প্রকাশকে শনাক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে “প্রত্যেকের অধিকার আছে নিজের মতামত এবং অভিব্যক্তি প্রকাশ করার। এই অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে নিজের স্বাধীনচেতায় কোনো বাধা ব্যতীত অটল থাকা; পুরো বিশ্বের যে কোনো মাধ্যম থেকে যে কোনো তথ্য অর্জন করা বা অন্য কোথাও সে তথ্য বা চিন্তা মৌখিক, লিখিত, চিত্রকলা অথবা অন্য কোনো মাধ্যম দ্বারা জ্ঞাপন করার অধিকার”। এই ১৯ নং অনুচ্ছেদ পরবর্তীতে আইসিসিপিয়ার দ্বারা সংশোধিত হয়, উদ্ধৃতিতে বলা হয়; এইসব অধিকারের চর্চা বিশেষায়িত নিয়ম এবং দায়িত্বকে ধারণ করে; তবে যদি এই চর্চার দ্বারা কারো সম্মান হানি হয় বা জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় তবে কিছু ক্ষেত্রে এর অবাধ চর্চা রহিত করা হয়।
আরও পড়ুন:
ছাত্র রাজনীতি এবং ”ফার্স্ট বয়” সংস্কৃতি
ছাত্ররাজনীতি, অতীত ঐতিহ্য ও চলমান বাস্তবতা
বাকস্বাধীনতাকে চূড়ান্ত হিসেবে স্বীকার নাও করা হতে পারে। মর্যাদাহানি, কুৎসা রটানো, পর্নোগ্রাফি, অশ্লীলতা, আক্রমণাত্মক শব্দ এবং মেধাসম্পদ, বাণিজ্যিক গোপনীয়তা, জননিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতা যদি অন্য কারও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে বা কারও অপকার করে তবে অপকার নীতির মাধ্যমে বাকস্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে।
‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’ এর ৩৯ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী- “চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতা কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে।’’
কি ভাবছেন? বুঝছেন তো ব্যাপারটা নাকি আবার কোপাতে যাবেন? উওর হলো অবশ্যই আপনি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। মনে রাখবেন মানুষ হয়ে মানুষ মারার আধিকার আমাদের কারো নেই আর আইন অবশ্যই নিজের হাতে তুলে নিবেন না। আইন হাতে তুলে নেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট ) মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যায় বিক্ষোভে উত্তাল দেশ। সত্যি বলতে আমি মনে করি আবরাব যেমন মুক্তচিন্তা করতেন এবং তেমন সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। তা অবশ্যই বর্তমানে প্রশংসার দাবিদার। সবচেয়ে বড় কথা হলো যে তা আমি অনুভব করেছি। আবরার ফাহাদ তার জীবন দিয়ে হলেও আমাদের শিখিয়েছে যে বাকস্বাধীনতার সাথে কোন ধরনের আপস না করা। কিন্তু চিন্তার বিষয় যে তার এই শেখানো পথ ধরে আপনারা কত দূর আগাতে পারবেন? আপনারা মুক্তচিন্তা তো কখনো করেননি এবং কেউ করলে তাদের বার বার বাধা দিয়েছেন এবং আমার বিশ্বাস ভবিষ্যতেও দেবেন। কারণ কামড়ানোর অভ্যাস তা অনেক পুরোনো। আর সভ্য পৃথিবীতে বাস করেও অসভ্যর মত আচরণ তো আরো অনেক পুরোনো। এত দ্রুত কি অভ্যাস যায়?
“মতের অমিল হলেই গায়ে হাত তোলা যায়” এটা আমাদের রক্তে মিশে গেছে। এর জন্য আপনি আমি এ সমাজর সকলেই সমান ভাবে দায়ী। আপনারা পড়ালেখা শিখেছি ঠিকই কিন্তু মানুষ হতে পারেননি। হবেন কিনা তাও সন্দেহ আছে।
কি জানতে ইচ্ছে করে না যে এমন অপসংস্কৃতি আপনারা কবে থেকে ধারণ করেছেন?
শুনুন তবে বলি। হয় শুনতে খারাপ লাগবে, তারপরও শুনুন। গিলতে তেতো লাগবে, তারপরও গিলুন। ব্যাপারটা কিছুটা ইতিহাসের বইয়ের মত আমাদের নবাব, রাজা-বাদশা, জমিদারা যুদ্ধে হেরেছে এমন কয়েকটি পৃষ্ঠা পড়তে কষ্ট হলেও এবং মনের বিরুদ্ধে হলেও পড়তে হয়। কারণ আমাদের ইতিহাস জানতে হবে। কারণ অতীত না জেনে কখনোই বর্তমান বোঝা যায় না। আর কখনো অতীতকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। যে অতীতকে অস্বীকার করে তার অস্তিত্ব দ্রুতই বিলীন হয়ে যায়।
বি: দ্র: আমি যা লেখছি সব ‘ফ্রিডম অব স্পিচ’ রক্ষায় এবং আমার বাকস্বাধীনতা আছে তাই। আপনারাও অবশ্যই চাননি যে, শুধু লেখার জন্য আবরার ফাহাদের হত্যা হোক? আমি মনে করি অবশ্যই চাননি এবং যদি চান তবে চাওয়াটা একদমই অনুচিত।
‘মুক্তচিন্তা’ কি?
সচেতনভাবে মুক্তচিন্তার প্রয়োগকে বলে “মুক্তচিন্তন” এবং এর অনুশীলনকারীদের বলে “মুক্তমনা”।
“মুক্তচিন্তার উপর আক্রমণ”
আমার বিশ্বাস অবশ্যই আপনারা কেউ মুক্তচিন্তার উপর আক্রমণ সমর্থন করেন না। কারণ সমগ্র দেশ আজ ‘আবরার ফাহাদ’ এর হত্যায় প্রতিবাদী। যদি সমর্থন করতেন তবে অবশ্যই এত কঠোর কর্মসূচি পালন করতেন না।
চলুন দেখি, এমন কত আবরার ফাহাদ কে আপনারা হত্যা করেছেন এবং বাধা সৃষ্টি করেছেন!
‘নাগরিক কবি শামসুর রাহমানের উপর হামলা’ কি জানেন না? অজানা মনে হচ্ছে?? তবে বলি শুনুন।
ইসলাম বিরোধী কবি অভিযোগ এনে শামসুর রাহমানকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। নিজেদের ছাত্রলীগের কর্মী পরিচয় দিয়ে ১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারী “হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী” (সংক্ষেপে হুজি) দলের সদস্যরা কবিতা সংগ্রহের নামে শামসুর রাহমানের বাড়িতে যায়। সময়-সুযোগ বুঝে ঈদের আগে কবিকে হত্যা করার পূর্ব-পরিকল্পনা করে জঙ্গিরা। সৌভাগ্যক্রমে কবি বেঁচে যান কিন্তু হামলাকারীদের প্রতিহত করতে গিয়ে কবি পত্নী ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন। শামসুর রাহমানের বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের আক্রোশের অন্যতম কারণ এই যে, তিনি তাদের যাবতীয় অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে নির্ভয়ে কলম ধরেছেন।
আটক হওয়া ৯ জন জবানবন্দিতে উল্লেখ করে যে, জানুয়ারী মাসে বুদ্ধিজীবী হত্যার নির্দেশ দেয় ধর্মীয় নেতা শেখ ফরিদ। অধ্যাপক কবির চৌধুরী, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক আব্দুল আউয়াল, বেগম সুফিয়া কামাল, তসলিমা নাসরিনকে হত্যার আদেশ দেয় সে। জানুয়ারীতে হামলার নির্দেশ দিয়ে শেখ ফরিদ দুবাই চলে যায়।
‘তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ বই নিষিদ্ধকরণ’
১৯৯৩ সালে তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। জনমনে বিভ্রান্তি ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অঙ্গনে বিঘ্ন ঘটানো এবং রাষ্ট্র বিরোধী উসকানিমূলক বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার জন্য ‘লজ্জা’ নামক বইটির সকল সংস্করণ সরকার বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। প্রকৃতপক্ষে মৌলবাদীদের আন্দোলনের কাছে মাথা নত করা সরকার, মৌলবাদীদের খুশি করতে বইটিকে বাজেয়াপ্ত করে। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হলেও পরবর্তীতে ৩০টিরও বেশি ভাষায় বইটি অনূদিত হয়। ১৯৯৩ সালের ১১ জুলাই সরকারি এক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, ‘‘জনমনে বিভ্রান্তি ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অঙ্গনে বিঘ্ন ঘটানো এবং রাষ্ট্রবিরোধী উসকানিসূলক বক্তব্য প্রকাশের জন্য নিষিদ্ধ করা হলো তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ উপন্যাসটি।’’
‘তসলিমা নাসরিনের দেশ ত্যাগ’
১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে তিনি ইসলামি ধর্মীয় আইন শরিয়া অবলুপ্তির মাধ্যমে কুরআন সংশোধনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এর ফলে ইসলামি মৌলবাদীরা তাঁর ফাঁসির দাবী জানাতে শুরু করে। তিন লাখ মৌলবাদী একটি জমায়েতে তাঁকে ইসলামের অবমাননাকারী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দালালরূপে অভিহিত করে। দেশ জুড়ে তাঁর শাস্তির দাবীতে সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে জনগণের ধর্মীয় ভাবনাকে আঘাত করার অভিযোগে মামলা রুজু করা হয় এবং জামিন-অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। গ্রেপ্তার এড়াতে পরবর্তী দুই মাস লুকিয়ে থাকার পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে তাঁর জামিন মঞ্জুর করা হয় এবং একই বছর ৯ আগস্ট বাধ্য হয়ে গোপনে দেশ ত্যাগ করতে সক্ষম হন।
‘অধ্যাপক সনৎকুমার সাহাকে জবাই করে হত্যা চেষ্টা’
২০০১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর শিবিরের সন্ত্রাসীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিমপাড়ায় অবস্থিত শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় ঢুকে অর্থনীতি বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক সনৎকুমার সাহাকে জবাই করে হত্যা চেষ্টা করে। এ ঘটনায় মতিহার থানায় মামলা হলেও পুলিশ কোন সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
‘তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ নিষিদ্ধ’
তারেক মাসুদ কিন্তু দেশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। আপনারা টিভি ও পত্রিকায় দেখেছেন অবশ্যই।
২০০২ সাল বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য একটি বিশেষ বছর। এ বছর তারেক মাসুদ পরিচালিত ‘মাটির ময়না’ চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে কান ফিল্ম ফেস্টিভালের জন্য নির্বাচিত হয়। উৎসবে মাটির ময়না ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট বিভাগের সূচনা চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বেগের পটভূমিতে তারেক মাসুদের ছেলেবেলার মাদ্রাসা জীবনের অভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে। পুরো চলচ্চিত্র জুড়ে ঐতিহাসিক ঘটনার উদ্ধৃতি থাকলেও সেগুলো একটি কিশোরের মানবিক অভিজ্ঞতায় প্রকাশিত হয়েছে। মাদ্রাসায় তার শিক্ষক, সহপাঠীদের আচরণ আর পরিবারের সদস্যদের সাথে তার সম্পর্কের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রটির কাহিনী এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড মাটির ময়নাকে প্রদর্শনের অনুমতি না দিয়ে নিষিদ্ধ করে। নিষিদ্ধ করার সঠিক তারিখ সংগ্রহ করতে পারিনি। সেন্সরবোর্ডের অভিযোগ ছিলো এই চলচ্চিত্র বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করবে এবং দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে। কিন্তু তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে মামলা করেন এবং তাদের সপক্ষে সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয়। ফলে, ২০০২ সালের শেষের দিকে চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশে প্রদর্শিত হবার অনুমতি লাভ করে।
‘হুমায়ূন আজাদের আলোচিত বই ‘নারী’ নিষিদ্ধ’ কি ভাবছেন? এমন ও হয়েছে দেশে? আমি বলি হ্যাঁ।
১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ১৯ নভেম্বর নারী (১৯৯২) নিষিদ্ধ করে তখনকার বিএনপি সরকার। বইটি নিষিদ্ধ করার আদেশপত্রে বলা হয়, “পুস্তকটিতে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি তথা মৌলিক বিশ্বাসের পরিপন্থী আপত্তিকর বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ায় সরকার কর্তৃক ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৯ ‘ক’ ধারার ক্ষমতাবলে বর্ণিত পুস্তকটি বাজেয়াপ্ত হইল।” এর সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয় দুই পাতার একটি সুপারিশ। দ্বীনি দাওয়াত ও সংস্কৃতি বিভাগ এবং ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এ দুটি বিশেষজ্ঞ থেকেই আসে সুপারিশটি। এরা নারী থেকে ১৪টি বাক্য উদ্ধৃত করে বইটি বাজেয়াপ্ত করার পরামর্শ দেয়। হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, ‘এত বড় বই পড়ার শক্তি ওই দুই মৌলবাদীর ছিল না; তারা বইটি থেকে কয়েকটি বাক্য তুলে পরামর্শ দেয় নিষিদ্ধ করার।’ তবে, বেশি দিন নারী নিষিদ্ধ রাখা যায়নি; ২০০০ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ বাংলাদেশের উচ্চ বিচারালয় ওই আদেশ অবৈধ ঘোষণা করলে পরের মাসেই বইটির তৃতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ বেরোয়। আমার সংগ্রহে ‘নারী’ বইটি আছে সেটা তৃতীয় সংস্করণ, চতুর্বিংশ মুদ্রণ চৈত্র ১৪২৩: মার্চ ২০১৭। আরো মুদ্রণ হয়েছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
‘হুমায়ুন আজাদকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা’
২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারী বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত বইমেলা থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিজের বাসায় যাওয়ার পথে ঘাতকদের আক্রমণের শিকার হন তিনি। বিদেশে নিবিড় চিকিৎসার মাধ্যমে তিনি কিছুটা সুস্থ হন। জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (বা সংক্ষেপে জেএমবি) নামক ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের একজন শীর্ষনেতা শায়খ আব্দুর রহমান পরবর্তিতে হুমায়ুন আজাদ এবং একইসাথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম ইউনুসকে হত্যার নির্দেশ দেবার কথা স্বীকার করে। এই হত্যা প্রচেষ্টার মামলা দ্রুত শেষ করার জন্য উচ্চ আদালত ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তে আদেশ প্রদান করে। (দ্য ডেইলি স্টার)
‘আরিফ রায়হান দ্বীপ কুপিয়ে হত্যা’
চিন্তার মুক্তির জন্য লেখালেখির ফলে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হওয়া শুরু হয়। ৯ এপ্রিল ২০১৩ সালে বুয়েটের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আরিফ রায়হান দ্বীপকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বুয়েট ক্যাম্পাসে। দ্বীপ হেফাজত ও জামাতের বিরুদ্ধে লেখালেখি করতো। হত্যাকারী ছিলো হেফাজতে ইসলামের সক্রিয় সমর্থক বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মেজবাহ। (দ্য ডেইলি স্টার)
‘ব্লগার রাজীব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যা’
রাজাকার কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগ আন্দোলনে উত্তাল তখন সারাদেশ। আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য আনসারুল্লাহ বাঙলা টিম ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩ ব্লগার রাজীব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যা করে। অভিযোগ ছিলো ব্লগে ধর্মীয় কুসংস্কার নিয়ে লেখালেখি করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতেন রাজীব হায়দার। ব্লগে লেখালেখির কারণ রাজীব হায়দারই প্রথম ব্যক্তি যিনি খুন হন। এরপর এই মিছিল বাড়তেই থাকে। (ইত্তেফাক। বিডি নিউজ ২৪। নিউ ইয়র্ক টাইমস।)
‘মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী খুন’
২৭ অগাস্ট ২০১৪ সালে নিজ বাসায় খুন হন চ্যানেল আই টেলিভিশনে ‘কাফেলার পথে পথে’ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ও সুফিবাদী লেখক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী। তাঁর মতের অনুসারীরা এই খুনের জন্য জামাতকে দায়ী করেছে। (দ্য ডেইলি স্টার)
‘ব্লগার নীলয় নীলকে কুপিয়ে হত্যা’
নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাস লেখেন ২০১৫ সালের ১৫ মে ব্লগার নীলয় নীল। অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত একটি সমাবেশে যোগ দিয়ে ফেরার পথে নিলয়কে কয়েকজন অনুসরণ করছিল। বুঝতে পেরে তিনি পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন জিডি করতে, তার জিডি কেউ নিতে রাজি হয়নি। এরপর ৭ আগষ্ট আনসারুল্লাহ বাঙলা টিম তার বাসায় ঢুকে তাকে হত্যা করে চলে যায়। বাসা ভাড়া নিতে আসার ভান করে তার বাসায় প্রথমে একজন এবং পরে আরো কয়েকজন ঢুকে বাসার অন্যদেরকে এক ঘরে আটকে রেখে তাকে অন্য ঘরে কুপিয়ে খুন করে। নিজের জীবন দিয়ে ব্লগার নীলয় নীল প্রমাণ করে যান বাংলাদেশে নাস্তিক, নির্ধর্মী, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, মৌলবাদবিরোধী, বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসীদের কোনো নিরাপত্তা নেই, দেশত্যাগ ছাড়া তাদের বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। এমনকি পুলিশও তাদের নিরাপত্তা দিতে অক্ষম।
‘অনন্ত বিজয় দাশকে কুপিয়ে হত্যা’
২০১৩ সালে ঢাকার শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে সিলেটেও গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে তোলা হয়; অনন্ত বিজয় দাশ ছিলেন এর অন্যতম উদ্যোক্তা।
৩১ বছর বয়সী অনন্ত অভিজিতের ব্লগ মুক্তমনায় লেখার পাশাপাশি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগসহ অনলাইনে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ও যুক্তিনির্ভর লেখালেখি করতেন। অনন্তের সম্পাদনায় সিলেট থেকে বিজ্ঞান বিষয়ক ছোটকাগজ ‘যুক্তি’ প্রকাশিত হয়ে আসছিল। ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে বিজ্ঞান ও বিপ্লব: লিসেঙ্কো অধ্যায়’, ‘জীববিবর্তন সাধারণ পাঠ’, ‘ডারউইন: একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা’ শিরোনামে তিনটি বইও রয়েছে তার। জঙ্গীদের কাছ থেকে রেহাই পাননি তিনিও। ২০১৫ সালের ১২ মে সকালে কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হওয়ার পরে সিলেট নগরের সুবিদবাজারের নূরানি আবাসিক এলাকার চৌরাস্তার মোড়ে অনন্ত বিজয় দাশকে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা।
‘অভিজিৎ রায় বর্বর জঙ্গীদের চাপাতির কোপে নিহত এবং তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদ আহত’
অভিজিৎ রায়কে হত্যার মাধ্যমে বাংলার ব্লগার এবং অনলাইন কমিউনিটিতে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করে ফেলে আনসারুল্লাহ বাঙলা টিম। অভিযোগ সেই একই ধর্মীয় অনুভূতি। ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫ একুশে বইমেলা থেকে বাড়ি ফেরার সময় সাড়ে আটটা নাগাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের নিকটে অপরিচিত দুস্কৃতিকারীদের দ্বারা আক্রান্ত হন অভিজিৎ রায় এবং তার স্ত্রী বন্যা আহমেদ।
সাক্ষীদের মতে, দুইজন দুষ্কৃতিকারী তাঁদের থামিয়ে রিকশা থেকে নামিয়ে রাস্তায় ফেলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁদের কোপাতে থাকে। অভিজিতের মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়। তাঁর স্ত্রীর কাঁধে ধারালো অস্ত্রের আঘাত লাগে এবং বাম হাতের আঙুলগুলি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। উভয়কে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে অভিজিৎ রাত সাড়ে দশটা নাগাদ মৃত্যুবরণ করেন। রাফিদা আহমেদ বন্যা চিকিৎসার পর বেঁচে যান। অভিজিৎ রায়কে অনেক আগ থেকেই উগ্রবাদীরা হুমকি ধমকি দিয়ে আসছিল তবে অভিজিৎ রায় এ হুমকিতে কখনো ভয় পাননি। এদের হুমকি ধামকি উপেক্ষা করে ২০১৫ সালে তিনি ঢাকায় আসেন। এই আসাই তার কাল হয়ে দাঁড়ালো।
‘প্রকাশক দীপন খুন, টুটুল সহ আহত ৩’
২০১৫ সালে মৃত্যুর এই দীর্ঘ মিছিল শেষ হয় প্রকাশক দীপনকে হত্যার মাধ্যমে। যে অভিজিৎ রায়কে হত্যার মাধ্যমে ২০১৫ সালে নারকীয় উৎসব শুরু হয়েছিলো, তার বই প্রকাশের অপরাধে প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে আজিজ সুপার মার্কেটে কুপিয়ে হত্যা করে আনসার-আল ইসলাম জঙ্গিরা। ৩১ অক্টোবর ২০১৫ সালে রাজধানীর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে তাঁর কার্যালয়ে ঢুকে দুর্বৃত্তরা তাঁকে কুপিয়ে ভেতরে ফেলে রেখে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে যায়।
নিহত ফয়সালের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক আবুল কাশেম ফজলুল হক সাংবাদিকদের বলেন, আজ দুপুর দেড়টা পর্যন্ত ফয়সাল তাঁর সঙ্গেই বাসায় ছিলেন। পরে তিনি শাহবাগে তাঁর প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানে যান। খোঁজ নেওয়ার জন্য তিনি কয়েকবার ছেলেকে ফোন করেন। কিন্তু ছেলে ফোন ধরেননি। বিকেল চারটার দিকে তিনি আজিজ সুপার মার্কেটের তিন তলায় ১৩১ নম্বর রুমের সামনে যান। এটি তাঁর ছেলের কার্যালয়। নিহতের বাবা আরও বলেন, ওই সময় তিনি কার্যালয়ের দরজা খুলতে গিয়ে বন্ধ পান। এ সময় কাচের দরজা দিয়ে ভেতরে আলো জ্বলতে দেখেন। ছেলে বাইরে গেছে ভেবে তখন তিনি সেখান থেকে চলে যান। পরে ছেলের বউকে ফোন করলে জানতে পারেন, দুর্বৃত্তরা লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে কুপিয়ে জখম করেছে। এই কথা শুনে তিনি লোকজন নিয়ে আবার ছেলের কার্যালয়ে গিয়ে দরজা ভেঙে দেখেন, রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁর ছেলে পড়ে আছে।
ওই অবস্থায় ফয়সাল আরেফিনকে উদ্ধার করে তাঁরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সন্ধ্যা সাতটার দিকে হাসপাতালের আবাসিক সার্জন রিয়াজ মোর্শেদ তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
‘ড. এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী’কে জবাই’
২৩ এপ্রিল, ২০১৬ প্রগতিশীল শিক্ষক হওয়ার অপরাধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী’কে নিজ বাসার পাশে সকাল বেলায় জবাই করে হত্যা করে ইসলামি জঙ্গিরা। আনসার-আল-ইসলাম এই হত্যার দায় স্বীকার করে।
‘নাজিমুদ্দীন সামাদকে হত্যা’
একটু যেন বিরতিতে ছিলো জঙ্গিরা। ৬ এপ্রিল ২০১৬ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র নাজিমুদ্দীন সামাদকে হত্যা করে জঙ্গিরা। রাত সাড়ে ৯টার দিকে নাজিম উদ্দিন ইকরামপুর মোড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। ওই সময় কয়েক যুবক তার গতিরোধ করে এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকে। এক পর্যায়ে তিনি রাস্তায় পড়ে গেলে তাকে গুলি করে চলে যায় দুর্বৃত্তরা। ওই সময় তারা ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দেয়। আনসার-আল-ইসলামের দায় স্বীকার।
‘জুলহাস মান্নান ও তাঁর বন্ধু মাহবুব তনয় খুন’
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা জুলহাস মান্নানকে ২৬ এপ্রিল, ২০১৬ খুন করে জঙ্গিরা। তিনি ছিলেন ঢাকায় সমকামী বিষয়ক পত্রিকা রূপবানের সম্পাদক। মান্নানের সাথে খুন হন মাহবুব তম্ময়। তিনি নাট্য ও সমকামীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের কর্মী ছিলেন।
‘সুলতানা কামালের জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলার হুমকি’
২০১৭ সালের ৯ জুন সুলতানা কামালকে ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে তাঁর জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলার হুমকি দিয়েছে মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ জেলা হেফাজতের সমন্বয়ক। (বাংলাদেশে প্রতিদিন)
‘লেখক ও বুদ্ধিজীবী জাফর ইকবালের উপর হামলা’ আপনাদের অনেক প্রিয় বা অপ্রিয় একজন মানুষ। ঠিক বলছি না?
বেশ অনেকদিন বিরতির পর বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক ও বুদ্ধিজীবী জাফর ইকবালের উপর হামলা চালায় এক জঙ্গি। হামলাকারী ফয়জুর রহমান পেছন থেকে মাথায় ছুরি দিয়ে আঘাত করে, এ সময় জাফর ইকবাল মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন। ফয়জুর বলেন, “নাস্তেক জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু, আল্লা আর নবীর শত্রু তাই তারে কোপাইসি। উনি নিজেও নাস্তিক এবং অন্য সবাইকেও নাস্তিক বানানোর জন্য প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। তার লেখা পড়ে মানুষ বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ছে।” ভূতের বাচ্চা সোলায়মান নামক একটি উপন্যাসের কথা উল্লেখ করে ফয়জুর বলেছে, এই উপন্যাসের মাধ্যমে জাফর ইকবাল নবীকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন। তাই আমি হামলা করেছি। (প্রথম আলো) (৩মার্চ, ২০১৮)
‘প্রকাশক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট শাহজাহান বাচ্চুকে গুলি করে হত্যা’
ব্লগার হিসেবে সর্বশেষ খুন হন লেখক ও প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চু। ১১ জুন, ২০১৮ মুন্সিগঞ্জে নিজ প্রতিষ্ঠানে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। দু’বছর ধরেই তিনি ফেসবুকে এবং ফোনে বিভিন্ন হুমকি ধামকি পেয়ে আসছিলেন, যার সমাপ্তি ঘটে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। পুলিশ ও আত্মীয়স্বজনরা বলছেন, মতাদর্শের কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তীতে ২৮ জুন হত্যার ‘প্রধান পরিকল্পনাকারী’ জেএমবি সদস্য আব্দুর রহমানকে পুলিশ তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মেরে ফেলে।
‘বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ‘শিবির সন্দেহে স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা’ ‘
দেশ ও দেশের বাইরের চলমান ইস্যুগুলো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মাঝে মধ্যে পোস্ট দিতেন আবরার। সেগুলো নিয়ে মন্তব্যও করতেন তিনি। (দ্য ডেইলি স্টার- অক্টোবর ০৭, ২০১৯)
কি ভাইজান আপনাদের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে না তো? কপালে ঘাম চলে আসেনি তো আবার?
যদি এমন হয় তবে যান পানি খেয়ে আসেন। কথা দিচ্ছি অপেক্ষা করবো। আর হ্যাঁ কপালের ঘাম মুছে আসবেন। ভয় পাবেন না অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবেই। না হয় অতীত যেমন শামসুর রাহমান, হুমায়ূন আজাদ, রাজিব, অন্তর, দীপ, অভিজিৎ, দীপন, বাবু ও বর্তমানে ‘আবরার ফাহাদ’ এবং ভবিষ্যতে হয়তো আমি বা আপনি।
কবির ভাষাতে ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’!
“মনে রাখবেন ‘প্লাটফর্ম’ যদি একবার তৈরি হয়ে। সেখানে কিন্তু পারফর্মেন্স চলতেই থাকে। শুধু নায়ক ও খলনায়ক পরিবর্তন ঘটে। বাস্তবে নাটক কিন্তু একই থাকে।’’
আহা, মুক্তচিন্তার অধিকারী আলোর পথযাত্রী। আপনাদের স্মরণ করি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। আপনারা ছিলেন এবং থাকবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘দি ওল্ড ম্যান এন্ড দি সি’-তে বলেছেন, “মানুষকে হত্যা করা যায়, কিন্তু ধ্বংস করা যায় না”।
আবরার হত্যাকাণ্ড কে কেন্দ্র করে আমরা আপনারা যেমন প্রতিবাদী হতে পেরেছি। কিন্তু তাঁদের সময় আমরা আসলে ব্যর্থ হয়েছি। বর্তমান আবরারের জন্য যেমন প্রতিশোধ, প্রতিরোধের ডাক আসছে। আমরা কিন্তু তাঁদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে এতো বিপ্লবী হতে পারিনি।
দোষটা সত্যিই আমাদের। যদি সেদিনই আমরা এমন প্রতিবাদী হতে পারতাম। তাহলে আজ হয়তো আবরার ফাহাদ আমাদের মাঝে বেঁচে থাকতেন।
বর্তমানে আমরা যারা আবরার ইস্যু নিয়ে চরম মাত্রার বিপ্লবী হতে পেরেছি, আমরা ও আপনারা মিলেও কিন্তু অতীতে কেনো রগ কাটা শিবিরের পৈশাচিক নির্যাতন নিয়ে প্রতিবাদ করিনি?
আপনারা সবাই মিলে কিন্তু তখন লেখক, মুক্তচিন্তক ও ব্লগারদের হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ বলে ঘোষণা দিয়েছিলাম? মনে আছে অবশ্যই আপনাদের।
আমরা কিন্তু সত্যিই নির্লজ্জ বেহায়া।
লজ্জা নেই আমাদের একদমই। বিশ্বাস হচ্ছে না? না হওয়ারই কথা। কিন্তু প্রমাণ দিতে আমি প্রস্তুত। আপনি শুনতে প্রস্তুত তো? তবে বলি শুনুন, উপরে অবশ্যই কয়েকবার বলেছি। তারপরও আবার বলছি।
আরিফ রায়হান দীপ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। মনে আছে কি? ‘ছাএলীগ করতো’ অবশ্যই ভুলে গেছেন। কিন্তু চিন্তা করবেন না আমি সব মনে করিয়ে দেব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর থেকে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ছিলেন দীপ। বুয়েটের হল ও বিভাগের বন্ধুদের মাতিয়ে রাখতো সে। পড়ালেখার পাশাপাশি ছাত্র অধিকার প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে ছিল অগ্রসৈনিক। ছাত্রদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে লড়াই করাই যেন তার একমাত্র ব্রত। হেফাজত ও জামাতের বিরুদ্ধে লেখালেখি করতেন। প্রতিক্রিয়াশীলতার ছোবল আসবে জেনেও দীপ নিজের সংগঠন, আদর্শ ও নৈতিকতার সাথে কখনো আপোস করেনি। ৯ এপ্রিল, ২০১৩ সালে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বুয়েটের নজরুল ইসলাম হলের ১১২ নম্বর কক্ষের সামনে তাকে হত্যা করা হয়।
১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩ ‘রাজীব হায়দার’ রাজাকার কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহাবাগ আন্দোলনে উত্তাল তখন সারদেশ। আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য আনসারুল্লাহ বাঙলা টিম ১৫ ফেব্রুয়ারী ব্লগার রাজীব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যা করে। এখন আপনি নিজেই বলুন স্বাধীন দেশে বাস করে কি আপনি রাজাকারের বিচার চাইতে পারেন না?
১২ মে, ২০১৫ ‘অনন্ত বিজয় দাস’ সিলেট গণজাগরণ মঞ্চ এর অন্যতম উদোক্তা। ৩১ বছর বয়সী অনন্তকে শুধু ভিন্নমত ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি করছে বলে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা।
এগুলো হয়ত এখানেই থামলে পারতো। কিন্তু না এভাবেই বারংবার আঘাত এসেছে বাকস্বাধীনতার উপর। আর সবাই ভাল ভাবেই জানেন এর জন্যই কারা দায়ী। প্রশ্ন জাগছে কি মনে?
আরে ভাই এর জন্য আমাদের ও আপনাদের অতীতের নীরব দর্শক হওয়ে থাকাকেই দায়ী বলে মনে করছি আমি।
একেক জন বড় বড় বিপ্লবী হচ্ছেন এখন।
টু বি অনেস্ট! সেদিন যদি সে ব্লগার দের হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করতেন, শিবিরের পৈশাচিক নির্যাতন এর দিকে আঙ্গুল তুলতেন তবে আজ ‘আবরার ফাহাদ’ ও ভিন্নমত প্রকাশের কারণে কেউকে মরতে হতো না।
এই রীতি শুরুতেই শেষ হয়ে যেতো।
কোপাকুপি আর পিটিয়ে মেরে ফেলার রীতি দেখে সমর্থন দিয়েছিলেন আপনারা সুশীল!
এবং সে কোপাকুপির রীতি কে জায়েজ করেছিলেন আপনারা সুশীল।
আবরার হত্যার দায়ভারটাও আপনারা এড়িয়ে যেতে পারেন না!
শুধু আবরার না বরং অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত যত মুক্তচিন্তার, ভিন্নমত ও অন্যান্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় যত গুম-ঘুন এবং যে সকল হত্যা কান্ড ঘটেছে। তাতে অবশ্যই বাকস্বাধীনতার বিঘ্নিত হয়েছে। তাই এদের সাথে যারা জড়িত তাদের কঠোর শাস্তি দাবি করছি।
কারন, বিচার বহির্ভূত যে কোন হত্যাকাণ্ডই অপরাধ। সেটা যেই করুক সে অপরাধী, সে খুনি। সেই অপরাধকে কোনকিছু দিয়ে জাস্টিফাই করতে চাওয়াও অপরাধ।
কারো বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যে, সে আস্তিক বা নাস্তিক, যদু বা মধু, অমুক বা তমুক দলের এমন ধোঁয়া দিয়ে জল ঘোলা করবেন না। সাবধান। তাহলে যে শ্লোগানে আজ উত্তাল ‘বুয়েট’ সাথে পুরো বাংলাদেশ। এটা সম্পূর্ণ বিফলে যাবে। বুঝতে পারছেন? ও হে, ‘সুশীল সমাজ’!
যদি কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকে! সে যদি আপনার বিরুদ্ধে কিছু লেখে থাকে? এতে যদি আপনি ব্যথিত হয়ে থাকেন। তবে অভিযোগ জানান আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে। মনে রাখবেন কখনোই জাজমেন্ট করার দায়িত্ব আমাদের বা আপনাদের না। এর জন্য রয়েছে দেশে আইন, ‘ল’ এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি, ডিবি, পুলিশ, ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি, র্যাব ইত্যাদি। আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি কোন অভিযোগ থাকলে তাদের জানান। তাঁরা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আইনের আওতায় এনে বিচার-বিশ্লেষণ করে তার উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবে। আইন কখনো নিজের হাতে তুলে নিবেন না। মনে রাখবেন অপরাধ দিয়ে কখনো অপরাধ মেটানো যায় না।
পরিশেষে যেটা বলতে চাই, তা হলো ‘আবরার ফাহাদ’ হত্যাকান্ড সাথে জড়িতদের যত দ্রুত সম্ভব আইনের মাধ্যমে কঠোর থেকে কঠোর শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। সাথে ‘ফ্রিডম অব স্পিচ’ রক্ষায় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য রাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আর জানি কোন প্রকার বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের সাক্ষী হতে না হয় আমাদের সেই আবেদন ও জানাচ্ছি।
সেই সঙ্গে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায়। আপনাদের এধার অব্যাহত থাকুক ঈশ্বরের কাছে কামনা করি।
আমার মনে হচ্ছে এ সমাজের পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু যদি ব্যাপারটা এমন হয়, যে ‘সুশীল’ ব্যক্তিবর্গদের দেখলাম ‘আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডে’ আন্দোলন করতে তাঁরা যেন শুধু কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে আন্দোলন না করে। তাই আপনাদের আহ্বান জানাবো সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার।
অতীতের ভুল শোধরানোর এখনই উপযুক্ত সময়। আর আজ থেকেই প্রতিজ্ঞা নেন যেন অতীতের ভুল ভবিষ্যতে না হয়। মনে রাখবেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা আপনাদের অতীতের ইতিহাস বাংলাদেশের মানুষের ভাল জানা আছে।
যদি আপনাদের চিন্তা ভাবনা এমন হয় তবে খুবই ভয়ংকর দিন অপেক্ষা করছে দেশের জন্য। উদাহরণ দিচ্ছি,
‘শাওন ভট্টাচার্য’ যেহেতু বুয়েটের ছাত্র না (ময়মনসিংহ কর্মাস কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র), যেহেতু প্রতিমা বিসর্জন দিতে গেছে (নাউজুবিল্লাহ), যেহেতু হিন্দু (কাফের), যেহেতু খুনের সাথে ছাত্রলীগের নাম আসে নাই (যাহ্ কপাল খারাপ), সেহেতু আমরা ছুরির আঘাতে নিহত শাওন হত্যার বিচার চাই না।
“ধর্মান্ধরা শোনো, অন্যের পাপ গণিবার আগে নিজের পাপ গোনো”!
**লেখাটি উৎসর্গ করছি তাঁদের সকলকে যারা ভিন্নমত প্রকাশের জন্য নিহত হয়েছেন।
লেখক:
রঞ্জন সরকার, শিক্ষার্থী, চতুর্থ বর্ষ, আইন ও মানবাধিকার বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক (ইউএপি)