ধর্ম ও বিজ্ঞান: দু’টির মাঝে মিল কাকতালীয়, যৌক্তিক নয় । ডা. নাজমুল হাসান

Comments

নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপে তোলা মহাকাশের ছবিটি বিশ্বব্যাপী ভাইরাল হ‌ওয়ার পর, এটা যে নতুন কিছু নয়, অনেক ধর্মগ্রন্থ আগেই এ বিষয়ে বলে গেছে- এমন একটা গুঞ্জন ও প্রচারণাও শুরু হয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়, বিজ্ঞানের প্রতিটি বড় বড় আবিষ্কারের পরেই সেই আবিষ্কারের কৃতিত্ব বিজ্ঞানকে না দিয়ে ধর্মের দিকে টেনে আনার এ লড়াই বহু আগে থেকেই চলে আসছে। এ নিয়ে আমি আজকের লেখায় কয়েকটি উদাহরণ দেবো।

তার আগে একটা বিষয় পরিষ্কার করে নেই যে, আমার এ লেখাটিকে ধর্মবিরোধী হিসেবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নাই। উদাহরণগুলির মাধ্যমে আমি এই বিষয়টিকে পরিষ্কার করতে চাচ্ছি যে, বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা, গবেষণাগার, গবেষক, গবেষণার প্রক্রিয়া ইত্যাদির সাথে ধর্মগ্রন্থের কোনো সম্পর্ক নাই। সেটা তার নিজস্ব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, তার নিজের নিয়মে চলে। একজন গবেষক যে কোনো ধর্মের অনুসারী হতে পারেন কিন্তু গবেষণার এই প্রক্রিয়াগুলির  সাথে তার ব্যক্তিগত ধর্ম বিশ্বাসের কোনো সম্পর্ক নাই। এর কারণ হচ্ছে বিজ্ঞান ও ধর্ম দুটি দুই মেরুর বিষয়। ‘ধর্ম’ ভাববাদ, ‘বিজ্ঞান’ বস্তুবাদ ফলে এর একটার সাথে অন্যটার মিল কাকতালীয় হতে পারে কিন্তু তা যৌক্তিক নয়। ধর্ম উপাসনালয় কেন্দ্রীক, বিজ্ঞান গবেষণাগার কেন্দ্রীক। দুটোর ধারা সম্পুর্ণ আলাদা।

প্রতিটি যুগে খুব ফলাও করে ধর্ম ও বিজ্ঞানের সমন্বয় কিংবা সম্প্রীতির কথা বলা হলেও বিজ্ঞান এবং ধর্মের দ্বন্দ্বযুদ্ধের ইতিহাস কিন্তু বেশ দীর্ঘ ও রক্তাক্ত। এর কারণ হচ্ছে দুটো বিষয় দুই মেরুর হলেও কখন‌ও কখন‌ও এ দুটোকে মেলানোর চেষ্টা করা, আবার কখন‌ও কখন‌ও আলাদা করার চেষ্টা করা। কাজটা ধর্মবিদরা করে থাকেন। যখন বিজ্ঞানের কোনো আবিষ্কার ধর্মের সাথে মিলে যায় তখন সেটাকে ধর্মের বলে দাবি করেন, যখন ধর্মের বিপরীতে যায় তখন বিরোধীতা করে মারমুখী হন। যারা এই কাজগুলি করেন তারা কিন্তু কিছুই আবিষ্কার করতে পারেন না, তারা কোনো আবিষ্কার করতে পেরেছেন পৃথিবীতে এমন ইতিহাস নাই।

অনেক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি অনেক আবিষ্কার করেছেন এমন ইতিহাস আছে কিন্তু তার মানে এই না যে সেই আবিষ্কারের পিছনে তার ধর্ম বিশ্বাস কোনো ভূমিকা রেখেছে। তিনি গবেষণার প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আবিষ্কার করেছেন, ধর্মকে কাজে লাগিয়ে নয়, করেছেন গবেষণাগারে, উপাসনালয়ে বসে করেননি। যে আবিষ্কার উনারা করেছেন তার কোথাও ধর্মের রেফারেন্স দেননি, কারণ তেমন রেফারেন্স ধর্মগ্রন্থে তারাও পাননি। অথচ আবিষ্কারের পিছনে ধর্মের রেফারেন্স যারা দিচ্ছেন তারা গবেষণার কিছুই জানেন না। ধর্ম বিশ্বাস বা ধর্মাচার বা ধর্মগ্রন্থকে কাজে লাগিয়ে যদি আবিষ্কার করা যেতো তবে পৃথিবীর সকল আবিষ্কারের মালিক হতেন ধর্মবিদগণ। কারণ, তারা ধর্ম নিয়েই সারাক্ষণ পড়ে থাকেন এবং বিজ্ঞান যা কিছু আবিস্কার করে আবিস্কারের পরে তারা তা ধর্মগ্রন্থের মধ্যে খুঁজে পান, আগে থেকে কিছু‌ই খুঁজে পান না।

খ্রিস্টের জন্মের পাঁচশত বছর আগে পিথাগোরাস, এনাকু সিমন্ডের মত অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানী ও দার্শনিকেরা জানিয়েছিলেন পৃথিবী সূর্যের একটি গ্রহমাত্র, সূর্যকে ঘিরে অন্য সকল গ্রহের মতো পৃথিবীও ঘুরছে। ধর্মবিরোধী এই মতামত প্রকাশের জন্য তখন তাদের অনেককেই সইতে হয়েছিল অমানুষিক নির্যাতন। এই মতবাদকে দুই হাজার বছর পরে পুস্তক আকারে প্রকাশ করেছিলেন পোল্যান্ডের বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাস। বাইবেল বিরোধী এই সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব প্রচারের জন্য কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও আর ব্রুনোর উপরে যে অত্যাচারের স্টিমরোলার চালানো হয়েছিল তা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন।

ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। ১৬০০ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি রোমের ক্যাসটেল সেন্ট এঞ্জোলোতে সুদীর্ঘ ৮ বছর ধরে পরিচালিত বিচারের রায় ঘোষণা করা হয়েছিল। এই সুদীর্ঘ ৮ বছর ব্রুনোকে কারাগারে অবরুদ্ধ রাখা হয়েছিল। তাকে কোন গবেষণার কাজ করতে দেওয়া হয়নি।

রায় ঘোষণার পূর্বে সর্বশেষবারের মতো অপরাধীকে তার বক্তব্য পেশের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ব্রুনোকে বলা হয়েছিল, বাইবেলের প্রার্থনা সঙ্গীতের ৯৩ তম লাইনে বলা হয়েছে- পৃথিবী স্থির এবং একে গতিশীল করা যায় না। এই বক্তব্যকে মেনে নিলে তার বিরুদ্ধে কৃত রায় পুনর্বিবেচনা করা হবে।

জবাবে ব্রুনো মহামান্য চার্চকে তার গবেষণার ফল মেনে নেবার অনুরোধ করেন এবং নিজের বক্তব্যে অটল থাকার চেষ্টা করেন। চার্চের প্রচণ্ড নির্যাতনের মুখে তিনি শেষ পর্যন্ত নিজের মতের উপরে অটল থাকতে পারেননি। কারণ, তাকে দিয়ে চার্চ লিখিত নিয়ে নেন যে, তিনি যা বলেছেন তা ভুল। এই ভুল বিষয়কে তিনি আর প্রচার করবেন না এবং সমাজকে এর প্রভাবমুক্ত রাখবেন। তিনি এ ধরনের গবেষণা কর্ম হতেও নিজে বিরত থাকবেন।

লিখিত দেবার পরেও ব্রুনোর শেষরক্ষা হয়নি, শেষ পর্যন্ত সর্বশক্তিমান চার্চ ব্রুনোকে পুড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেয়। ব্রুনো তখন বলেছিলেন, আমার গবেষণার ফলাফলে তোমরা খুবই ভীত হয়ে পড়েছ বলেই আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিলে! অথচ আমার গবেষণার ফল সত্য। ব্রুনোর কথা শেষ হবার সাথে সাথেই লোহার কপাট দিয়ে তার চোয়াল আটকে দেওয়া হয় এবং জিভ টেনে বের করে লোহার সিক দিয়ে এফোড়-ওফোড় করে গেঁথে রাখা হয়।

১৬০০ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার সকালে শহরের রাস্তা দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে ব্রুনোকে নিয়ে যাওয়া হয় কম্পো-ডি-ফায়োরা মঞ্চে। সেখানে উম্মুক্ত স্থানে তাকে নগ্ন করা হয় এবং গায়ে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। ধর্মবিরোধী এক বিজ্ঞানীর হাত থেকে রক্ষা করা হয় মানব জাতির প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস।

কিন্তু তারপরও কি সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর ঘোরা ঠেকানো গিয়েছে? ধর্মবাদীরা হয়তো এরও একটা ব্যাখ্যা দেবেন। কারণ, ব্যাখ্যা বানানোর জন্য তাদের হাতে অঢেল সময় আছে।

শুধু ব্রুনোই নন, তার সমসাময়িক লুচিলিও ভানিনি, টমাস কিড, ফ্রান্সিস কেট, বার্থৌলোমিউ লিগেট-সহ অনেককেই ধর্মান্ধদের হাতে নিগৃহীত এবং নির্যাতিত হয়ে নিহত হতে হয়। ধর্মকে বাঁচানোর জন্য, ধর্মবিদদের দেওয়া ধর্মীয় যুক্তিকে আমলে নিয়ে তাদের মেরে না ফেলা হলে বিজ্ঞান এতোদিনে আরো কোথায় যেত কে জানে।

খ্রিস্টের জন্মের চারশ বছর আগে এনাক্সোগোরাস বলেছিলেন চন্দ্রের নিজের কোনো আলো নাই। সেই সঙ্গে সঠিকভাবে অনুসন্ধান করেছিলেন চন্দ্রের হ্রাস বৃদ্ধি আর চন্দ্রগ্রহণের কারণ। এনাক্সোগোরাসের প্রতিটি আবিস্কারই ছিল ধর্মাবাদীদের চোখে জঘন্য রকমের অসত্য। ঈশ্বর বিরোধিতা, ধর্ম বিরোধিতা আর অসত্য প্রচারের অপরাধে দীর্ঘ আর নিষ্ঠুর নির্যাতনের পর তাঁকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হয়। কিন্তু চন্দ্রের আলো তাতে ফিরে আসেনি। চন্দ্রের হ্রাস বৃদ্ধি আর চন্দ্রগ্রহণের কারণ তাতে পরিবর্তন হয়ে যায়নি।

ষোড়শ শতকে সুইজারল্যান্ডের বেসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন শাস্ত্র এবং ভেষজবিদ্যার অধ্যাপক ফিলিপ্রাস প্যারাসেলসাস ঘোষণা করেন; মানুষের অসুস্থাতার কারণ কোন পাপের ফল কিংবা অশুভ শক্তি নয়, রোগের কারণ হলো জীবাণু। ওষুধ প্রয়োগে জীবাণুনাশ করতে পারলেই রোগ ভাল হয়ে যায়। প্যারাসেলসাসের এই অদ্ভুত তত্ত্ব শুনে ধর্মের ধ্বজাধারীরা হা-রে-রে করে উঠেছিলেন। কারণ, ধর্মমতে রোগ সৃষ্টিকর্তার অভিশাপের ফসল।

সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক ধর্মবিরোধী মতবাদ প্রচারের জন্য প্যারাসেলসাসকে হাজির করা হয়েছিল বিচার নামক এক প্রহসনের মুখোমুখি। ধর্মান্ধ বিচারকেরা ব্রুনোর মতই প্যারসেলসাসকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন। প্যারাসেলসাসকে সেদিন জীবন বাঁচাতে মাতৃভূমি ছেড়ে পালাতে হয়েছিলো। এজন্য রোগ যে জীবাণু ঘটিত সে কথা মিথ্যা হয়ে যায়নি।‌

ইবনে খালিদ, যিরহাম, আল দিমিস্কি, ওমর খৈয়াম, ইবনে সিনা, ইবনে বাজা, আল কিন্দী, আল রাজি কিংবা ইবনে রুশদের মতো মুসলিম ধর্মের অনুসারী বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের জন্য মুসলমানরা আজ গর্ববোধ করেন অথচ এ সব দার্শনিকদের সবাই তাদের সময়ে বৈজ্ঞানিক সত্য কিংবা মুক্তমত প্রকাশের কারণে তখনকার ধর্মবাদীদের হাতে নিগৃহীত, নির্যাতিত হয়েছিলেন।

সক্রেটিসকে হেমলক খাইয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছিল। প্লেতো এরিস্টোটলকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। ইবনে খালদুন, আল মা আরীকে কীভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল সে সম্পর্কে সারা পৃথিবী আজ জ্ঞাত।

আজকের দিনের পরিবর্তিত পরিবেশেও পৃথিবীর ধর্মপ্রবণ রাষ্ট্রগুলিতে মুক্তচিন্তার লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞানীদের উপর ধর্মের দোহাই দিয়ে ঢালাওভাবে অত্যাচার করা হয়। ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা সুযোগ পেলে এখনো বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঠেকাতে ধর্মের যুক্তি হাতে নিয়ে মুখিয়ে থাকেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে অযুক্তিকে যুক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সহিংসভাবে মাঠে নেমে পড়েন।

যখনই বিজ্ঞানের কোনো নতুন আবিস্কার তাদের নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত বিশ্বাসের বিপরীতে যায়, তখন খোদ বিজ্ঞানকে তারা ফেলে দিতে চায় আস্তাকুঁড়ে। আর যখন কাকতালীয়ভাবে কোনো গোঁজামিল দিয়ে মিলিয়ে ফেলতে পারেন, তখন বলে এটা ধর্ম আগেই বলেছে। আগেই বলেছি- ধর্ম ভাববাদ, বিজ্ঞান বস্তুবাদ; একটার সাথে অন্যটার মিল কাকতালীয়, যৌক্তিক নয়।

এখনও সুযোগ পেলেই ধর্মান্ধ লোকের দল প্রগতিশীল দার্শনিক, বিজ্ঞানী, শিল্পী, লেখকদের মুরতাদ আখ্যা দেয়। এখনও স্বল্পশিক্ষিত ধর্মবিশ্বাসী, ধর্মশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত পাদ্রী আর মোল্লারা উপযাজক সেজে দার্শনিক, লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞানীদের পরামর্শ দিতে আসে, তাদের কোন্ গবেষণা বা কৃত কাজ নৈতিক বা অনৈতিক। তাদের এ নৈতিক এবং অনৈতিকতার ভিত্তি একমাত্র ধর্মজ্ঞান, যা বৈজ্ঞানিকভাবে যুক্তিহীন এবং সম্পূর্ণভাবে ভাববাদীয় আবেগের উপরে প্রতিষ্ঠিত।

ধর্মকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তারা ইভোলুয়েশন থিওরিকে গায়ের জোরে অস্বীকার করে। কারণ, ধর্মমতে মানুষ কখনও জঙ্গলে ছিল না, সৃষ্টির প্রথম থেকেই মানুষ এখনকার মতো বুদ্ধিমান ছিল। ধর্মবিদরা ধর্মের সাথে ইভোলুয়েশন থিওরির তুলনামূলক আলোচনাগুলিকে ধর্মানুভূতি নামক চরম অযৌক্তিকতার প্রলেপ দিয়ে বিজ্ঞানী, লেখকদেরকে মারতে আসে এবং মেরেও ফেলে। এ বিষয়ে কেউই পিছিয়ে নেই- না ধর্মান্ধ, না ধর্মবিদ, না ধর্মপ্রবণ, না ধর্ম ব্যবসায়ী।

লেখক:
Nazmul Hassan
ডা. নাজমুল হাসান, লেখক, গল্পকার, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

*এই লেখার মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই এখানে প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা বানানরীতি বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট