ধলাই যুদ্ধ ও বীর সিপাহী হামিদুর

Comments

শ্রীমঙ্গল শহরের মাইল দশেক দক্ষিণ-পূর্বে ধলাই বিওপি। মার্চ মাসের গোড়া থেকেই ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স এক কোম্পানি রাজাকারসহ এখানে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। তাদের এই শক্ত অবস্থানের কারণে ধলই-শ্রীমঙ্গল অক্ষে এবং সীমান্ত বরাবর প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকায় মুক্তিসেনাদের চলাচল অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়লো। তাছাড়া ধলই বিওপির ওপারেই ছিল ভারতের কমলপুর শহর যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা প্রায়ই তাদের অপারেশন শেষে সীমান্ত পেরিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিত। পাকিস্তানিরা ধলাই বিওপির ভেতরে রাখা কামান আর মর্টার দিয়ে কমলপুরের ওপর নিয়মিত গোলাবর্ষণ চালিয়ে শহরটাকে প্রায় পরিত্যক্তই বানিয়ে ফেলেছিল।

তাই একদিকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীও যেমন তাদের আসন্ন সিলেট-শ্রীমঙ্গল অভিযান ধলাই বিওপি দিয়েই শুরু করতে চাইছিল, তেমনি মুক্তিসেনাদের জেড ফোর্সও ধলাই বিওপির পতন ঘটাতে উদগ্রীব হয়েছিল। অক্টোবরের শুরু থেকেই ভারতীয় ৪র্থ কোরের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্বগত সিং মুক্তিসেনাদের জেড ফোর্স আর ফ্যান্টম ফোর্স (ভারতীয় ৬১ মাউন্টেন ব্রিগেড) সহ ধলাই আক্রমণের পরিকল্পনা শুরু করলেন।

দ্বিমত দেখা দিল ধলাই বিওপিতে কী পরিমাণ পাকিস্তানি ডিফেন্স নিয়েছে তা নিয়ে। ফ্যান্টম ফোর্স কমান্ডারের দাবি সাকুল্যে এক কোম্পানি পাকসেনা আর কিছু মুজাহিদ; কিন্তু মুক্তিসেনাদের ধারণা ন্যূনতম তিন কোম্পানি ফ্রন্টিয়ার ফোর্স আর এক কোম্পানি মুজাহিদ। কে যে সঠিক তা অনিশ্চিত।

ধলাই বিওপিতে পাকিস্তানের ৩০ ফ্রন্টিয়ারের অধিনায়ক তার সামরিক জ্ঞানের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে অনুপম এক ডিফেন্স নিয়েছিলেন। ক্যামোফ্লাজ আর কন্সিলমেন্ট ছিল এতই নিখুঁত এবং বিওপির নিরাপত্তা আর চলাচলের গোপনীয়তা ছিল এতই কড়া যে, এমনকি স্থানীয়রাও তেমন কার্যকর কোনো তথ্য দিতে পারছিল না।

প্রতিটা ট্রেঞ্চ আর বাংকার ছিল সুপরিসর আর মাথার ওপর ছিল শক্ত আচ্ছাদন যেন মাঝারি আর্টিলারি গোলাবর্ষণেও ট্রেঞ্চের ভেতরে কোনো ক্ষতি না হয়। ট্রেঞ্চ থেকে ট্রেঞ্চে এমুনিশন সাপ্লাই পৌঁছে দেওয়ার জন্য ছিল সুরক্ষিত লেন। বিওপির প্রবেশপথও ছিল সুরক্ষিত আর বিওপির চারপাশে পাতা ছিল সুপরিকল্পিত মাইনফিল্ড। আবার মাইনফিল্ডের ফাঁকে হাঁটুসমান বাঁশের চোখা পাঞ্জির গাঁথা ছিল যেন আচমকা কেউ বিওপির ওপর এসে হামলা করতে না পারে। এ ছাড়া আক্রান্ত হলে নিরবচ্ছিন্ন আর্টিলারি ফায়ারের ব্যবস্থাও করা ছিল। তাই ধলাই বিওপিকে পাকিস্তানিদের দুর্ভেদ্য দুর্গই বলা চলে।

ধলাই বিওপির দক্ষিণে ছিল জলা-কাদার মাঠ, তারপর নালা; তা ছাড়া পাকিস্তানিদের ডিফেন্সের প্যাটার্ন পর্যালোচনায়ও বোঝা যায় দক্ষিণমুখী করেই তারা বেশি সংখ্যায় অস্ত্র মোতায়েন করেছে। তারপরও উপায়ান্তর না পেয়ে দক্ষিণ থেকেই আক্রমণের পরিকল্পনা করা হলো। লেফটেন্যান্ট কাইয়ুমের সি কোম্পানি দায়িত্ব পেল মূল আক্রমণ পরিচালনার। অন্যরা চারদিক থেকে ধলাই বিওপিকে আলাদা (Isolate) করে ফেলবে যেন পাকিস্তানিরা কোনো রিইনফোর্সমেন্ট পাঠাতে না পারে অথবা বিওপি ছেড়ে একজন পাকিস্তানি বা মুজাহিদও যেন পালাতে না পারে।

ভোর চারটায় লেফটেন্যান্ট কাইয়ুমের সি কোম্পানি দক্ষিণের নালা পেরিয়ে ধলাই বিওপি আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। বামে ৭নং প্লাটুন নিয়ে এগোচ্ছিলেন লেফটেন্যান্ট নূর চৌধুরী, ডানে ৮নং প্লাটুন নিয়ে নায়েব সুবেদার আবুল হাসেম, মাঝে ৯নং প্লাটুন নিয়ে লেফটেন্যান্ট আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী স্বয়ং আর সাথে তার রানার সিপাহী হামিদুর রহমান।

৭ আর ৮নং প্লাটুন মর্টার ফায়ারের কাভারে বাম আর ডান থেকে শত্রুর কাছাকাছি পৌঁছে হামলে পড়বে আর ১০৬ মিমি রিকোয়েললেস রাইফেল দিয়ে শত্রু বাংকারগুলো ধ্বংস করা হবে। সবশেষে ৯নং প্লাটুন গিয়ে বিওপির পূর্ণ দখল নেবে। এই ছিল পরিকল্পনা।

প্রথম ৫০০ গজ সন্তর্পণে পেরিয়ে শত্রুর ২০০ গজের ভেতর পৌঁছে গেল ৭ আর ৮নং প্লাটুন, শুরু হলো গোলাগুলি, মুক্তিসেনাদের রিকোয়েললেস রাইফেল আর মর্টারও গর্জে উঠল, হতাহতের আহাজারি আর হামলার গর্জনে আকাশ ভারী হয়ে উঠল। মুহূর্তে ধলাই বিওপি পরিণত হলো রণক্ষেত্রে।

লেফটেন্যান্ট কাইয়ুমের প্লাটুন পাকিস্তানিদের অবিরাম মেশিনগানের গুলি বৃষ্টির জন্য আটকে গেল পথেই, লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম আহত হয়ে চিকিৎসার জন্য পেছনে যেতে বাধ্য হলেন। সুবেদার হাসেম প্রাণপণে চেষ্টা করছিলেন এগিয়ে যেতে, কিন্তু চারপাশে হতাহতের সংখ্যা আর শত্রুর ফায়ারের তোড়ে তিনিও থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হলেন। লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম পরিষ্কার বুঝলেন শত্রুর সংখ্যা তাদের অনুমানের চেয়ে অনেক বেশি।

লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম মেশিনগান পোস্ট দুটো আবার দেখলেন, একটা ঠিক তার বরাবর আর আরেকটা বিওপির পশ্চিম পাশে। এই মেশিনগান দুটো ধ্বংস না করতে পারলে না এগোনো যাচ্ছে, না পিছু হটা যাচ্ছে। লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম দেখতে পেলেন পোস্ট দুটোর মাঝ দিয়ে একটা নালা বয়ে যাচ্ছে। উপায়ন্তর না দেখে তিনি সিপাহী হামিদুরকে নির্দেশ দিলেন সেই নালা হয়ে ক্রলিং করে এগিয়ে গিয়ে যেকোনো একটা মেশিনগান পোস্ট ধ্বংস করে আসতে।

হামিদুর শুরু থেকেই তার কমান্ডারের পাশে থেকে যুদ্ধের অগ্রগতি দেখছিলেন, রানার হিসেবে বেশ কয়েকবারই লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম আর সুবেদার হাসেমের কাছে কোম্পানি কমান্ডারের মেসেজ আনা-নেওয়া করেছেন। তাই মেশিনগান পোস্টটা ধ্বংসের প্রয়োজনীয়তা তিনিও খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন। অতএব কোনো বাক্য ব্যয় না করে তিনি পাশের সহযোদ্ধার সাথে নিজের অস্ত্রটা বদল করে একটা সাবমেশিন কারবাইন হাতে নির্ভীক এগিয়ে গেলেন।

লেফটেন্যান্ট কাইয়ুমের কাভারিং ফায়ারের সুযোগে ক্রলিং করে শত্রু মেশিনগান পোস্টের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন হামিদুর, প্রায় পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে তিনি বাংকারের ভেতর গুলি ছুড়লেন। তারপর পিন খোলা একটা গ্রেনেড হাতে তাকে শত্রুর বাংকারের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

পরে সেই বাংকারে দুজন পাকসেনার মৃতদেহের সাথে হামিদুরের মৃতদেহ পাওয়া গেল। মরার আগে হামিদুর ঐ দুজনকে মেরে মরেছেন। তার সফল আত্মত্যাগের কারণে সি কোম্পানির বাকিদের প্রাণ রক্ষা হয়েছে।

ভারতীয় মিত্রবাহিনী দ্রুতই বেলিজারেন্ট রেশিও-সংক্রান্ত তাদের ভুল বুঝতে পেরেছিল। ২য় জাট রেজিমেন্ট রিইনফোর্স করতে এগিয়ে এলে, ৩০ অক্টোবর সকালে মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে ধলাই বিওপির পতন ঘটে।

হামিদুর রহমানকে সীমান্তের অদূরেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হাতিমেরছড়া গ্রামে দাফন করা হয়। কালক্রমে কবরটি একসময় পানির তলায় তলিয়ে যায়। ৪নং সেক্টরের অন্যতম মু্ক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরের অক্লান্ত, নিরলস ও একাগ্র প্রচেষ্টায় হামিদুরের কবর খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় এবং  ২০০৭ সালের ২৭ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ২০০৭ সালের ১০ ডিসেম্বর যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে কুমিল্লার বিবিরহাট সীমান্ত দিয়ে তার দেহাবশেষ বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানকে ঢাকার মিরপুরে বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে সংরক্ষিত কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

ফিচার ফটোতে ব্যবহৃত স্কেচ সৌজন্য: রহমান আজাদ

বাঙালীয়ানা/এসএল

অগ্নিঝরা একাত্তরের দিনগুলো, পড়ুন

অক্টোবর ১৯৭১

সেপ্টেম্বর ১৯৭১

আগস্ট ১৯৭১

জুলাই ১৯৭১

জুন ১৯৭১

মে ১৯৭১

এপ্রিল ১৯৭১

মার্চ ১৯৭১

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.