(১)
দীর্ঘদিন বাদে নিঃসন্তান ব্রাহ্মন দম্পতি কন্যা সন্তান লাভ করলেন। ফুটফুটে লক্ষ্মী প্রতিমা ঘর আলো করে এলো। ব্রাহ্মণী আঁতুড় থেকেই পূর্ণচন্দ্র দেখতে পেলেন। চরাচর ভাসিয়ে সেদিন রূপোলী জ্যোৎস্নার বন্যা। দু’হাত তুলে প্রণাম জানালেন আঁতুড় থেকেই। মেয়ের নাম দিলেন চন্দ্রিমা। চন্দ্রিমা একটু একটু করে চাঁদের মতই ঘর আলো করে বড় হতে থাকল। মুখে বুলি ফুটলে মনে হত পাহাড়ি ঝর্নার গান। বাবার কাছে অ, আ, ক, খ শিখল তিন বছরেই। বাবা দেখলেন মেয়ে তাঁর বিদুষী। চলল তালিম। বছর আটের হতে না হতেই সে সংস্কৃত শিখে ফেলল। দশ বছরেই ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ দুলে দুলে শুনত। গণিতের কঠিন হিসেব মুহূর্তে তাঁর নখদর্পণে। বাবা শিউরে উঠলেন মনে মনে। এই মেয়েকে কোথায় রাখবেন! একে দিতে হবে কুলীন ৬০ বছর বয়েসী ব্রাহ্মণের চরণে। কন্যা এখন দশম বর্ষীয়া, গৌরিদানের সময় দুই বছর আগেই অতিক্রান্ত। বাবা, মা লুকিয়েছেন বয়েস কন্যার- দু’বছর। রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেন না চন্দ্রিমার বাবা। একদিন শেষরাতে দু’চোখের পাতা লেগে যায়। স্বপ্নে দেখেন লেলিহান চিতার জিহ্বা, আর সেই জিহ্বার মধ্যে থেকে দুটো কচি শাঁখা পলা পরা হাত প্রাণপণ তাঁকে ডাকছে। ঘেমে নেয়ে উঠে বসলেন ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণী পাশে শুয়ে সব লক্ষ্য করছিলেন, বললেন, ‘সব বুঝি , কিসের ধর্ম, কিসের সংস্কার, যে ধর্মের সংস্কারের আগুনে আমাদের চন্দ্রিমাকে পুড়িয়ে মারা হবে সেই ধর্মে আমার বিশ্বাস নেই। আজ রাতেই চল রাজার কাছে, দেখি তিনি কি বিধান দেন’। মেয়েকে কোলে করে চললেন দম্পতি রাজার বাড়ী। রাজামশাই তখনও ঘুমে। রানীমা বাসি কাপড় ছেড়ে স্নান করে ফুল তুলছিলেন। দূর থেকে দুই ছায়া মূর্তি এগিয়ে এলো সিংহ দরজায়। প্রহরীরও তন্দ্রা এসেছিল রাত চার প্রহরে। রানী মা দেখলেন সেই ব্রাহ্ম! মুহূর্তে ঘুমন্ত প্রহরীকে এড়িয়ে ঢুকে আসছে দুই উদ্ভ্রান্ত পিতামাতা। কোলে তাদের ফুটফুটে লক্ষ্মী প্রতিমার মত দশম বর্ষীয়া বালিকা। ব্যাপারটা বুঝলেন রানী মা। ব্রাহ্মণ পরিবারকে অতিথিশালায় বসিয়ে তড়িঘড়ি রাজামশাইকে ডেকে তুললেন রানীমা। ঘুমন্ত চোখে কোনমতে বাইরে এলেন রাজামশাই। না। এবার নেশায় টলমল, কপালে মাথায় সিঁদুর ল্যাপা শশ্মানের হিংস্র নেকড়ের খপ্পর থেকে ভীত হরিণী শাবকের মত প্রাণ নিয়ে পালানো সতীমাতা নয়। এর পিতামাতা আগেই সজাগ হয়েছেন। দু’হাত কপালে ঠেকালেন রাজামশাই। বললেন, ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’। অর্থাৎ ‘অন্ধকার থেকে আমায় আলোতে নিয়ে যাও’। পরম ব্রহ্মকে প্রণতি জানান রাজামশাই। বলাই বাহুল্য এই রাজামশাই ‘রাজা রামমোহন রায়’।
(২)
১৮২৯ সন লর্ড বেন্টিঙ্ক আইন করে রদ করলেন সতীদাহ । ১৮১২ সন থেকে যে আন্দোলন করেছিলেন রামমোহন, ইংরেজদের আইন তা স্বীকৃতি দিল। সংবাদ কৌমুদীর পাতায় পাতায় যে আন্দোলন নিরন্তর চলেছে তা এতদিনে সফল হল। সংবাদ কৌমুদী হাতে এসে পৌঁছেছে এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের ব্রাহ্মণের ঘরে। সে ব্রাহ্মণের অসামান্য জ্ঞানপিপাসা। টোলে সংস্কৃত চর্চা শেষ করে, প্রতি সন্ধ্যায় পশ্চিমী বিজ্ঞান চর্চা করেন প্রদীপের আলোতে। রাতের আহারাদির পরও চলে জ্ঞানচর্চা। প্রদীপের আলো তেলের অভাবে নিভে এলে তিনি এসে বসেন তারা ভরা আকাশের নীচে, নক্ষত্রদের অবস্থান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে ভাবেন রাতের পর রাত। আজ সংবাদ কৌমুদী পড়ে তাঁর চিত্ত উদ্বেলিত। আর দুদিন বাদেই তাঁর বিবাহ। পাত্রীর বয়স আট। তিনি নিজে বছর ত্রিশের যুবক। সমাজ এবং সংস্কারের চাপে বাধ্য হয়ে এর আগেও তিনি দুটি বিবাহ করেছেন। কিন্তু তখন তিনি নিতান্তই অন্ধকারে। পশ্চিমী বিজ্ঞান চর্চা তাঁর অন্তরে জ্বালিয়েছে নতুন আলো। আর আজ সংবাদ কৌমুদীর পৃষ্ঠাতে রাজা রামমোহন রায়ের সাফল্যে তৈরি হয়েছে বিপুল ঝড়। এবার একটা কিছু না করলেই নয়। রাত্রি তখন ভোরের বুকে তন্দ্রাচ্ছন্ন, পুবের আকাশে নরম লালের আভা ছড়াচ্ছেন সূর্যদেব। ব্রাহ্মণ শেষবারের মত উচ্চারণ করলেন ‘ওং জবাকুসুম সঙ্কাসন……..’। পথে নামলেন তিনি সেই ব্রাহ্ম মুহূর্তে। তিন ক্রোশের পথ তাঁর প্রথম পক্ষের শ্বশুর বাড়ী। প্রথমা পত্নীটি তাঁর বারো বছরের বালিকা। প্রথম পক্ষের শ্বশুরবাড়ী পৌঁছতে সন্ধ্যে গড়িয়ে গেল। বারো বছরের সেই কন্যা খেলছিল তাঁর সাথীদের সঙ্গে। পরের দিন কন্যার মা কন্যাকে সাজিয়ে গুছিয়ে উচ্চস্বরে ক্রন্দন করতে করতে কন্যা বিদায় দিলেন। বারো বছরের কন্যেটি ভয়ে, আতঙ্কে জড়সড় হয়ে চলল পালকি চেপে।
আরও তিন ক্রোশ পথ অতিক্রম করে ব্রাহ্মণ দ্বিতীয় শ্বশুরালয় পৌঁছলেন। সেখানেও একটি বারো বৎসরের কন্যার খেলার সময় ফুরোল। একই পালকি ঠেসাঠেসি করে জায়গা হল তাঁর সতীনের সাথে। দ্বিতীয় শ্বশুরালয়তে কিঞ্চিৎ জলগ্রহণের পর, ব্রাহ্মণের খেয়াল হল পালকিতে তাঁর প্রথমা স্ত্রীর কিছু বিশ্রাম প্রয়োজন। তিনি বিধান দিলেন আজ রাত্রিবাস এখানেই করবেন। রাতে সকলে ঘুমিয়ে পড়লে ভীত, সন্ত্রস্ত দুই নাবালিকা স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেন ব্রাহ্মণ। অভয় দিলেন। দুই বালিকা প্রায় গলাগলি করে নিদ্রা গেল। পরদিন দুই স্ত্রীকে সঙ্গে করে তৃতীয় বিবাহ বাসরে পৌঁছে অষ্টম বর্ষীয়া কন্যাটিকে উদ্ধার করে রাজা রামমোহন রায়ের কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়ীতে উপস্থিত হলেন সেই দ্যুতিময় ব্রাহ্মণ। রাজামশাই অভিভূত হলেন। পরেরদিন আত্মীয়সভার দরবারে আলোচনা বসলে সিধান্ত হল, ধর্মান্তরিত হবেন এই দ্যুতিময় ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করবেন। আর তাঁর তিন নাবালিকা স্ত্রীর দায়িত্ব নেবে আত্মীয় সমাজ। তারা খ্রিষ্টান মিশনারিদের কাছে আপাতত থাকবে, লেখাপড়া শিখবে। এদের সাথে রাজামশাইয়ের বিশেষ জানাশোনা। অন্তত ঠাকুরদার বয়সী ব্রাহ্মণের চিতার আগুন আর ধর্ষণের হাত থেকে তো বেঁচে গেল তিন নাবালিকা, নতুন আলোর গুণে।
(৩)
ল্যাপটপ থেকে চোখ সরালো প্রজ্ঞা। হারিয়ে গিয়েছিল থিসিস লিখতে লিখতে। থিসিসের সঙ্গে সঙ্গে কত গল্প প্রজাপতি পাখা মেলছিল। অষ্টাদশ আর উনবিংশ শতকের উপর গবেষণা করছে প্রজ্ঞা বন্দ্যোপাধ্যায়। রামমোহন রায়কে নিয়ে তার বিশেষ পড়াশোনা। বরাবরি গা কাঁটা দেয়া সতীদাহ প্রথা নিয়ে ভেবেছে প্রজ্ঞা। রামমোহনের দ্যুতিময় অস্তিত্ব ছোট থেকেই তাকে আকর্ষণ করত। ব্রাহ্মণ সন্তান হয়েও সংস্কৃত ছাড়াও, তার আরবি, ফার্সি ভাষার চর্চা প্রজ্ঞাকে অবাক করেছে। ঐ অতল অন্ধকারে দাঁড়িয়ে যে পরম পুরুষ ভাবতে পেরেছে আলোর কথা, তাঁকে বারবার প্রণতি জানিয়েছে সে। গবেষণার সুবাদে রামমোহন রায়ের ওকালতির বিষয়ে সে নাড়াচাড়া করেছে। দেখেছে কি ভাবে পঙ্কিল বাংলাদেশের সমাজ রাজার গায়ে কালি ছিটিয়েছে। বিধবাদের হয়ে মামলা লড়তেন। প্রজ্ঞা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও ব্রাহ্মণ কন্যা, তার জন্ম যদি সেই সময়ে হত আজ সে চিতার আগুনে খুন হত, নয়তো ষাট ঊর্ধ্ব বৃদ্ধের বিকৃত কামনার শিকার। শিউড়ে ওঠে প্রজ্ঞা। ল্যাপটপ বন্ধ করে। মোবাইলটা খুলে দেখে প্রায় দশটা মিস্ড কল। হ্যাঁ প্রজ্জল ফোন করেছে। আজ বেরনোর কথা ওর সাথে। বইপত্র ল্যাপটপ গুছিয়ে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আসে প্রজ্ঞা। বিশাল রামমোহন রায়ের অয়েল পেইনটিংটার সামনে এসে দাঁড়ায় মনে মনে প্রণাম করে সেই দিব্য পুরুষকে। স্বগতোক্তি করে, ‘ভাগ্যিস লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন আপনি আর বিদ্যাসাগর। শুধু আজকে আমাদের ব্ল্যাক বেল্ট হওয়ারও দরকার পড়েছে, কারণ তখনকার দুষ্টু লোকেদের আত্মারা এখন নেকড়ে সেজে পথে পথে ঘুরছে। ভাগ্যিস আপনারা চোখ খুলতে শিখিয়ে গেছেন’।
লাইব্রেরির বাইরে বেরিয়ে এলো প্রজ্ঞা বন্দ্যোপাধ্যায়। একবিংশ শতাব্দীর কন্যাসন্তান। হাতে মোবাইল, কাঁধে ল্যাপটপ, পরনে জিন্সের উপর কালো টি শার্ট। আগামী সপ্তাহে ব্রিস্টল যাচ্ছে প্রজ্ঞা। তার পরম পুরুষ যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত। গবেষণার কাজেই যাচ্ছে। প্রজ্জল এক্ষুনি ওয়াটসঅ্যাপে জানাল ভিসা প্রস্তুত। ফিরে এসে প্রজ্জলের সাথে বিয়েটা নিয়ে ভাববে সে। সূর্য পাটে বসতে বসতে নতুন আলো মাখিয়ে গেল প্রজ্ঞার গালে। পরম পুরুষ আকাশ থেকে হাসলেন।।
লেখক পরিচিতি:

ইন্দ্রাণী ঘোষ
ইন্দ্রাণী ঘোষ। জন্ম মহারাষ্ট্রের পুনা শহরে। পড়াশুনা দশম শ্রেণী অবধি দক্ষিণ কলকাতার নব নালন্দা ও দ্বাদশ, একাদশ শ্রেণী ডায়সেশন স্কুলে। পরবর্তী কালে স্নাতকত্তর ডিগ্রী লাভ বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতন থেকে। স্বামীর চাকরি সুত্রে বেশ কিছুদিন কলকাতার বাইরে এবং দেশের বাইরে বসবাস।একটি কন্যা সন্তানের জননী। বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতায় স্থিত এবং একটি বেসরকারি স্কুলে কর্মরত। পিতা অধ্যাপক ছিলেন।
বাঙালীয়ানা/এজে/এসএল