।। বেণুবর্ণা অধিকারী ।।
ছাতিম গাছের ডালের গঠন ও পাতার বিন্যাস এতই সুন্দর যে পথ চলতে যে কেউ মুগ্ধ হবে। আর এর ফুলের তীব্র গন্ধ অনেক দূর থেকেই পথিককে কাছে টানবে। কাণ্ডগুলো ছাতার মতো বেষ্টিত হয়ে থাকে। হয়তো এ কারণেও গাছটির নাম ছাতিম।
সাতটি পাতা একসঙ্গে যুক্ত থাকে, যা দেখতে অনেক দৃষ্টিনন্দন। এজন্য ছাতিমের সংস্কৃতি নাম ‘সপ্তপর্ণী’ বা ‘সপ্তপর্ণা’। ৪০ মিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হয় এ গাছ। এই গাছ অনেকটা উঁচু বলে সাধারণ অবস্থান থেকে ছাতিম ফুল সহজে চোখে পড়ে না। কিছুটা উঁচু জায়গায় উঠলে দেখা যায় গাছজুড়ে গুচ্ছ গুচ্ছ ক্রিম (হালকা ঘিয়ে) রঙের ফুল। মনে হবে যেন কেউ অসংখ্য ফুলের স্তবক তৈরি করে রেখেছে। অনেক দূর থেকে এই ফুলের তীব্রগন্ধ আপনাকে জানান দেবে তার উপস্থিতি। গন্ধ মূলত রাত্রে ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে। ছাতিমের ফল সুতার মতো ঝুলে থাকে, যা দেখতে অনেকটা ধইঞ্চা ফলের মতো। রমনার বটতলার পাশেই বিশাল উঁচু এই গাছের নিচে গিয়ে আমি উদ্ভ্রান্ত হয়ে গেলাম গন্ধে।
অঞ্চলভেদে একে ছাতিয়ান, ছাইত্যানসহ নানা নামে ডাকা হয়। ছাতিম ঘিরে অনেক মিথও রয়েছে। এ গাছে নাকি ভূত থাকে তাই শয়তানের গাছও বলে। পশ্চিমা বিশ্বেও আছে ছাতিমের বদনাম, ইংরেজিতে ডাকা হয় ‘ডেভিলস ট্রি’। বৈজ্ঞানিক নাম Alstonia Scholaris । স্কলারিস শব্দটির সঙ্গে বিদ্যা অর্থাৎ লেখাপড়ার যোগ আছে। এ ধরনের নামকরণের কারণ, ছাতিমের নরম কাঠ থেকে ব্ল্যাকবোর্ড ও পেনসিল তৈরি হয়। এ ছাড়া প্যাকিং বাক্স তৈরির জন্যও এটির কাঠ ব্যবহার করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এর আদি নিবাস ভারত, চীন ও মালয়েশিয়া। আমার অনেক প্রিয় গাছ, যদি কোন অপশন থাকতো গাছ হওয়ার আমি হতাম ছাতিম গাছ। রবি ঠাকুরের প্রিয় ফুলের মধ্যে এই ফুল অন্যতম। তাই শান্তিনিকেতনে অজস্র ছাতিম ফুলের গাছ আছে।
ছাতিমের কাঠ নানা রকম আসবাব তৈরিতে ব্যবহার হয়। আগে শিশুদের লেখার জন্য স্লেট তৈরি করা হতো এর কাঠ দিয়ে। আমাদের দেশে দিয়াশলাইয়ের কাঠি তৈরি করতে ছাতিম গাছের কাঠ ব্যবহার হয়। এজন্য শিমুলের মতো এ গাছও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। ছাতিমের রয়েছে অনেক ঔষধি গুণ। নানা রকম চর্ম রোগ, ম্যালেরিয়া, আমাশয় প্রভৃতিতে ছাতিমের বাকল, মূল, পাতা ব্যবহার করা হয়। এ গাছটির কাণ্ডের প্রতি দৃষ্টি আয়ুর্বেদিক গুণের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ না করলেও চলে কারণ মানুষ এ গাছটির প্রতি এতই অত্যাচার করে যে এর ছাল চামড়া কিছুই থাকে না বললেও চলে। বাকল দিয়ে দুধের মতো সাদা কষ বের হয়। যদিও এ কষ অত্যন্ত তেতো। আয়ূর্বেদমতে এই বাকল ভিজিয়ে সকালে এই জল খেলে নাকি গ্যাস্টিকের সমস্যা দূর হয়।
আরোও পড়ুন ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যের অশোক: শাল
ঢাকা শহরে অনেক জায়গাতেই ছাতিম গাছ দেখা যায়। রমনা পার্ক, বলধা গার্ডেন, ধানমন্ডি লেক এলাকায় ছাতিম গাছ চোখে পড়ে। ইন্দিরা রোডের গাছগুলো বেশ বয়সী, সুউচ্চ।কলকাতার ফুটপাতে অনেক ছাতিম গাছ দেখা যায়। বাংলাদেশে তেমন একটা চোখে পড়ে না। মানিকগঞ্জের হাইওয়েতে আরিচা যাবার পথে কয়েকটা দেখেছিলাম ফল ঝুলে আছে। রাত একটু গভীর হলে মনে হয় যেন কোনো এক দানব জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে। ইদানীং সড়কদ্বীপে (রোড আইল্যান্ড) ছোট জাতের ছাতিম গাছ লাগানো হচ্ছে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই উপভোগ করা যাবে প্রিয় ফুলের গন্ধ।