আজ শহর! আজ কুয়াশা! রশ্মিছেঁড়া দিন!
মুখস্থ সংসারের সন্যাস আমি।
জলস্তরে কান অব্দি ডুবিয়ে কুমির কামড়ে
খেজুর গাছ!
পেছনে ধেয়েছে ফাল্গুন বসন্ত!
পেছনে ধেয়েছে কোকিল করতাল!
পেছনে ধেয়েছে রঙিন হলুদ টলুদ!
পেছনে সূর্যাস্ত সুর। পেছনে উটের উটরামি।
পেছনে মেঘবৃষ্টির গাছ থেকে থোকা থোকা
বৃষ্টি ফলে।
কুয়াশাধূসর চোখ টিপে ডাকে!
পেছনে পিছুটানের রশ্মি ছিঁড়ে উড়ে,
যাই।
যাই…
কোকিল ডাকছে! শহর হাসছে!
আজ সূর্য কুয়াশা মেখেছে! আজ সূর্য দেবদারু ঝুলছে!
আজ বসন্ত ফাল্গুন বলছে!
আজ আমার ভ্রুণ
গর্ভ থেকে বেরোনোর প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে!
আজ প্রথম পৃথিবী দেখছি!
আকুল কান্নায় প্রান্তর পাচ্ছে!
আজ আমরা দোলনার পাঠশালায়
ঝুল উড়ে খেলা খেলা পড়ছি!
আজ হৃদয় বলছে নিজেকে আর অস্ফুট রেখো না!
ভেবো না! আজ সূর্য ছেঁড়ার দিন!
আজ মৃত্যু প্রদীপ পাখা ওড়ানোর দিন!
আজ ঘুমোও! জেগে থাকো!

সবকিছু চাষেদের দলে
দেখো, সবকিছু চাষেদের দলে চলে যাবে
রোদহীন, বাতাসহীন সবুজহীন এ নগরের
পাখিহীন আকাশের পাখি
ঝুড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ফেরিওয়ালা,
দেখো, সবকিছু চাষেদের দলে চলে যাবে,
জন্মেই শিশু ঢুকে পড়ছে বাক্সে আর
হরিণ চাষ নিয়ে দেখো কেমন ফিসফিস উত্তেজনা?
আমাদের সব ব্যালকনি গিলে ফেলেছে
পাশের বাড়ির দেয়াল।
দেখো, সবকিছুই চাষেদের দলে চলে যাবে,
কেননা কোন গাছেই পাওয়া যাচ্ছে না ফুল!
ফুলহীন, ঋতুহীন, আত্মাহীন শহরের ডাক শুনছ?
দলে দলে ওরা ফাল্গুন বিক্রি করছে!

যে জীবনের শেষ নেই
যারা চলে যায়, মাটির বরফের সিঁড়ি বেয়ে
প্রথমে অপরিসীম বেদনার পথ ধরে যেতে গিয়ে
শেষকৃত্যের সুচিজলের অপেক্ষা করে খনিক,
এরপর সব বয়সের সবাই
যৌবন হয়ে, প্রজাপতি হয়ে
মানুষপাখি হয়ে সুন্দরী পিঁপড়ের সারির মতো
অনন্ত যাত্রায় যেতে থাকে, যেতেই থাকে,
ফের হেঁটে পাতালের কাছে নাভিমূলে কান্নার শব্দ শোনে
তারা স্বজনদের স্মৃতির হিমবাতাস পাঠায়,
সীমানাহীন শেষের কাছে তারা সার হয়ে বসে অথবা দাঁড়ায়,
এই শেষহীন লাইন দীর্ঘ থেকে
অসীমতর হয়,
যখন পৃথিবী ঘুরতে থাকে তারা আকাশের দেখা পেয়ে
নিবিড় ভস্মতায় স্পর্শ করে পরস্পরকে।
জানো, কেউ তোমাকে মনে রাখেনি,
সুদর্শন সারি এগোতে থাকে,
জানো, তোমার জন্য জগত কাঁদছে,
নির্বিকার সারি এগোতে থাকে,
এসব শব্দাবলি মনে যায় না কারণ তারা ফিরবে,
একই মানুষ হয়ে, তারা মৃত্যুর নামে এখন সৌর
পরে বিশ্বভ্রমণে ঘুরবে,
আমি আছি আছি করে মিহি প্রান্তর
গানের গুনগুনে বিমোহিত করে তোলে,
আহা! আর জীবনের শংকা নেই
আহা! আর মরণের ভয় নেই,
চারপাশে ঢেউ তোলে খিলখিল বাতাস-
এরপর, তুলোর মতো
সোনালি মেঘের সুতোর মতো
একজন আরেকজনকে জড়িয়ে রাখে ৷
জীবনের ঘুরস্বভাবে তারা যখন নিচে শিহরিত শরীর পাতে,
মাটি উলটে যায়, তারা মাথা তোলে বিহবল হয়ে দেখে
মাটির মানুষেরা ওপরের পৃথিবী বা আকাশের কান ফাটিয়ে দিচ্ছে চিৎকার আর রক্ত রক্ত করে করে
ওই জঙ্গলে ছিলাম আমরা?
অস্ফুট ভয়ে আর্তনাদ করে তারা,
এরপর মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনার সঙ্গীতের মতো হয়ে যায়।
এরপর, মেঘ ও মাটি, জলস্রোতে সাঁতারে ভাসতে থাকে,
যারা চলে যায় ছায়া ফেলে,
তারা সুন্দর অন্যকিছু হয়ে যায়…

পরস্পর মুখোমুখি
নিষ্প্রভ আলো ছড়িয়ে আছে চারপাশে,
ব্রিজটির বিপরীতে জ্বলজ্বল করছে আঁধার,
দিঘি, নদী; এবার সমুদ্রে পা ফেলেছে মানুষ,
মঙ্গল মার্কেটের সীমানা সেই গ্রহকেও ছাপিয়ে যাবে,
তাই সমুদ্রকেও সভ্যতার জলে চুইয়ে নুন ঝরিয়ে ছাড়বে,
আমি নীলতিমি অতল থেকে একটা গাছে লটকে আছি,
অথবা আমাকে লটকে আছে গাছ,
দাঁড়িয়ে ছিলাম শূন্য চরাচরে, বাঘ কুমির আর অরণ্য কাটা ক্লান্ত মানুষ এখন আমাদের নিচে
সে বসবে,
নিস্প্রভ আলো ছড়িয়ে আছে চারপাশে,
তারও ওপরে বিশাল কংক্রিটের চাঁই,
প্রচন্ড ক্ষুধায় টানটান এলিয়েছি,
এদ্দিন কেবল নিজেদের বুকস্পন্দের শব্দ শুনে গেছি,
মানুষের জোরালো শব্দ কানে বাজতে বাজতে আসছে,
আমি আর গাছ,
এই প্রথম পরস্পরের দিকে তাকাই,
ধীরে ধীরে আকুল নিবিড়ে বিদায়ের আলিঙ্গন জানাই…

শহরে হাওয়া বদলাতে এসে
ঘুম থেকে উঠে হাই তুলে ব্যালকনিতে,
সামনের পাহাড় একী!
অট্টালিকার মতো স্থির দাঁড়িয়ে এমন জাদু,!
নিঃশ্বাস আটকে যায়,
চারপাশে কোন গাছপালা নেই,
বিশাল বিল্ডিং পাহাড়ের নিচে,
মরে পড়ে আছে আকাশ!

লেখক:
নাসরীন জাহান, কথাসাহিত্যিক ও কবি