নিরলস সংগ্রামী সাম্যবাদী ফয়েজ আহমদ

Comments

ছড়াকার, সাহিত্যিক, সংগঠক, রাজনৈতিক কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব – সর্বোপরি একজন বিশাল মাপের মানুষ ফয়েজ আহমদ ছিলেন দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক জগতের ‘বটবৃক্ষ’।

ফয়েজ আহমদদের অজপাড়া গ্রামের বাড়িতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়েও ‘সওগাত’সহ আরো কয়েকটি পত্রিকা কলকাতা থেকে আসত। ‘পরিচয়’ ও ‘কবিতা’-র মত সাহিত্য পত্রিকা অনিয়মিতভাবে হলেও তাঁরা পেতেন। ‘শিশু সওগাত’ পত্রিকাটি প্রকাশের পর তিনি তার গ্রাহক হয়েছিলেন। হাফপ্যান্ট পরা স্কুলগামী কিশোর ‘বসুমতী’, ‘সওগাত’, ‘পরিচয়’, ‘কবিতা’ ইত্যাদি পত্রিকার সাথে পরিচিত হলেও এর অনেক লেখার অর্থ তখন উদ্ধার করা তাঁর পক্ষে সহজ ছিল না। কিন্তু তারপরও এইসব পত্রিকা বিশেষ করে ‘সওগাত’ সম্পাদকের সাথে সাক্ষাতের প্রবল আগ্রহ তাঁর মনে জেগেছিল। মাস শেষে উদগ্রীব হয়ে থাকতেন ‘শিশু সওগাত’-এর নতুন সংখ্যার জন্য, আর পিয়নকে তাগাদা দিয়ে অস্থির করে তুলতেন; ভাবখানা এমন যেন তার দোষেই পত্রিকা আসতে দেরী হচ্ছে। পত্রিকাটিতে প্রকাশিত কোন কোন লেখকের লেখা তাঁকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলতো যে, তিনি মনে করতেন তাঁরা বুঝি পৃথক প্রজাতি। ‘সওগাত’-এ প্রকাশিত ‘আসুন চুরি করি’ শীর্ষক মুনীর চৌধুরীর একটি ব্যাঙ্গাত্মক লেখা পড়ে ফয়েজ আহমদ এতই আপ্লুত হয়েছিলেন যে তিনি কলকাতা গিয়ে তাঁর সাথে পরিচিত হবার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন।

পত্রিকা পড়ার আগ্রহের পাশাপাশি ছেলেবেলা থেকেই লেখালেখির প্রতিও তাঁর আগ্রহ ছিল খুব। ১৯৪৪ সালে ষোল বছর বয়সেই ‘শিশু সওগাত’-এ ফয়েজ আহমদের লেখা ‘নাম বিভ্রাট’ শিরোনামে একটি রচনা প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তাঁর জীবনের প্রথম মুদ্রিত লেখা। এ লেখা প্রকাশের পর গ্রামে ও স্কুলে তাঁর পরিচিতি বৃদ্ধি পায়। এরপর তিনি কলকাতা যাবার বিষয়ে আর কারো কোন বাধা মানেননি। একদিন স্কুলের বেতন না দিয়ে ক্লাস পালিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন কলকাতার পথে। সাথে সম্বল ছিল শুধু স্কুলের বেতন, বই কেনার সামান্য টাকা আর শিশু সওগাতের সেই সংখ্যাটি যাতে তাঁর লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল।

ফয়েজ আহমদ ১৯২৮ সালের ২ মে বিক্রমপুরের বাসাইলডোগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম গোলাম মোস্তফা চৌধুরী। ফয়েজ আহমদ সংসার করেননি। তাঁরা চার ভাই পাঁচ বোন। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। তাঁর দাদা গোলাম সারওয়ার চৌধুরীর সময় থেকে উচ্চস্তরের লেখাপড়ার আয়োজন শুরু হয়। দাদা বহু জায়গা জমির মালিক হয়ে একটি সামন্ত পরিবারের প্রধান হয়ে দাঁড়ান। তখন তাঁর নাম হয় চাঁদ মিয়া বা চান মিয়া, অর্থাৎ চাঁদের মতো কপাল বলেই তিনি ধনী। তাঁদের বাড়িতে অলিখিত বিধান ছিলো যে ছেলেরা লেখাপড়া শেষ করে সরাসরি সরকারি চাকরিতে যাবে। এমনকি ব্যবসা করার রীতিও তাঁদের বাড়িতে ছিল না। তাঁরা ছিলেন ক্ষুদ্র সামন্ত পরিবার, যেখানে প্রজা সাধারণ ও খাস জায়গা জমির আধিপত্য ছিলো বিশাল। যেহেতু সরকারি চাকরি সে আমলে একটা গৌরবের বিষয় ছিলো, সেহেতু তাঁর ভাইদের সরকারি চাকরির দিকেই ঠেলে দেয়া হয়েছিলো। তাঁদের এলাকায় মুসলমানদের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রচলন ছিল না বললেই চলে। হিন্দুরা মূলত ব্যবসা করতো। ধোপা, নাপিত, মুচি, মিষ্টির কারিগররা সবাই ছিলেন হিন্দুদেরই বিভিন্ন শাখার মানুষ। এই পরিবেশের মধ্যে ষোলঘর স্কুলে যখন তিনি বড় হচ্ছিলেন, তখন তিনটি বিষয় তাঁকে প্রভাবিত করে। এগুলো হলো দেশ বিভাগ, ৪২ সালের ভারত ছাড় আন্দোলন এবং বাংলা ৪২-৪৩ সালের মহামন্বন্তর। তখন থেকেই ভেতরে ভেতরে তিনি যেন একটি ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। এইসব পারিপার্শ্বিকতা তাঁকে আছন্ন করে রেখেছিল। তিনি তাঁর বাড়িতে ভাইদের মধ্যে ব্যতিক্রমী চরিত্র হয়ে ওঠেন।

ব্যতিক্রমী চরিত্রের অধিকারী ফয়েজ আহমদ সাহিত্যের প্রতি দুর্বার টানে ১৯৪৪ সালে ষোল বছর বয়সে স্কুল ফাঁকি দিয়ে কলকাতার সওগাত অফিসে পৌঁছবার পর প্রথমে তাঁর পরিচয় হয় বিখ্যাত দুই কবি আহসান হাবীব ও হাবীবুর রহমানের সাথে। হাবীবুর রহমান ও আহসান হাবীব তাঁকে আরো লেখার জন্য উৎসাহিত করেন। ‘শিশু সওগাত’-এ প্রকাশিত ফয়েজ আহমদের লেখাটি প্রকৃত পক্ষে প্রকাশিত হয়েছিল বড়দের লেখা হিসাবে। ফয়েজ আহমদের সাথে ‘সওগাত’ পত্রিকার সকলের একটি সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়।

দেশ বিভাগের পর ‘সওগাত’ পত্রিকা ঢাকায় চলে আসে। ‘সওগাত’ অফিসেই নাসিরুদ্দিন সাহেবের সর্বাত্মক সহযোগিতায় প্রগতি ও মুক্তবুদ্ধির ধারক হিসেবে পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের জন্ম হয়। ফয়েজ আহমদ সেসময় এই সংসদের প্রথম সাধারণ সম্পাদক হিসাবে ঢাকায় একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলার অনন্য প্রয়াস নিয়েছিলেন। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণে আইবির লোকজন তাঁদের পেছনে লেগে থাকতো। ফয়েজ আহমদের সাথে সাথে সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে এ প্রতিষ্ঠানে যাঁরা প্রকাশ্যে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অধ্যাপক অজিত গুহ, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক সৈয়দ নুরুদ্দিন, অধ্যাপক খান সারোয়ার মুরশিদ, আবদুল গণি হাজারী, মুনীর চৌধুরী, কবীর চৌধুরী, কবি শামসুর রাহমানসহ আরও অনেকে। এছাড়াও কয়েকজন উর্দু প্রগতিশীল কবি সাহিত্যিক ফয়েজ আহমদ ও তাঁর সংসদের ডাকে তাঁদের সাথে সামিল হয়েছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ফয়েজ আহমদদেরকে অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে ফয়েজ আহমদ সাহসিকতা ও দক্ষতার সাথে সাংগঠনিক কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। ১৯৫২ সালে ঢাকায় সম্মেলন করার অনুমতি না পাওয়ার কারণে কুমিল্লাতে স্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ আয়োজন করে একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলন। এরপর তিনি এই সংসদের পক্ষ থেকে ১৯৫৪ সালে ঢাকার কার্জন হলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উপর একটি সম্মেলন আয়োজন করেন। এই সম্মেলনে কলকাতা থেকে বহু বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক, গায়ক- গায়িকা অংশগ্রহণ করেছিলেন।

পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি তিনি ১৯৪৮ সাল থেকেই সাংবাদিকতার সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েন। যারা এই ভূ-খন্ডের সংবাদ মাধ্যমকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন ফয়েজ আহমদ ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ‘ইত্তেফাক’, ‘সংবাদ’, ‘আজাদ’ ও পরবর্তীতে ‘পূর্বদেশ’-এ চীফ রিপোর্টার ছিলেন। তিনি সাপ্তাহিক ‘ইনসাফ’ ও ‘ইনসান’ পত্রিকায় রিপোর্টিং করেছেন। ১৯৫০ সালে ‘হুল্লোড়’ এবং ১৯৭১ সালে ‘স্বরাজ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি জাতীয় সংবাদ সংস্থার প্রথম প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন। পরে দৈনিক ‘বঙ্গবার্তা’-র প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাবার পর তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বিশেষভাবে জড়িত হন।

১৯৪৯ সালে যখন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় তখন ফয়েজ আহমদ মওলানা ভাসানীর সঙ্গে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করার সুযোগ পেয়েও যাননি। তবে তখনকার মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে যে যুব সমাজ দাঁড়িয়েছিল তাঁদের অন্যতম হিসাবে বিশেষভাবে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পৃথক সত্ত্বা নিয়ে ফয়েজ আহমদ আত্মপ্রকাশ করেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে ছিলেন। ফয়েজ আহমদ এবং শেখ মুজিবুর রহমান, দুজনের রাজনৈতিক জীবনপ্রণালীতে পরস্পরের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। শেখ মুজিব জানতেন, ফয়েজ আহমদ বাম দলের সাথে সম্পৃক্ত তা সত্ত্বেও তাঁদের দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ছিল সুগভীর। ফয়েজ আহমদের ভাষায় – ‘তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আমি দুই রেললাইনের মতো পাশাপাশি গিয়েছি , কোথাও ক্রস করিনি।’

ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার সময় ঢাকার পত্রিকাসমূহ ও সাংবাদিকদের প্রায় সবাই ছিলেন শেখ মুজিবের পক্ষে ও এই মামলার বিপক্ষে। এর মধ্যে ‘আজাদ’ পত্রিকা ছিল সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও সোচ্চার। ফয়েজ আহমদ তখন এই পত্রিকার চীফ রিপোর্টার হিসাবে অফিস থেকে এই মামলা কভারেজ করার দায়িত্ব পান। কিন্তু মামলা শুরু হবার আগের দিন পর্যন্ত সেনাবাহিনী রাজী ছিল না ফয়েজ আহমদকে এই মামলার রির্পোট করার অনুমতি দিতে। ‘আজাদ’ কর্তৃপক্ষ সেনাবাহিনীকে জানিয়েছিল যে, যদি তারা ‘আজাদ’ পত্রিকার মনোনীত সাংবাদিক হিসাবে ফয়েজ আহমদকে ট্রাইব্যুনাল কভার করার জন্য যেতে না দেয়, তবে ‘আজাদ’ পত্রিকা ট্রাইব্যুনালের কোন নিঊজ ছাপবে না বা তার বদলে অন্য কোন সাংবাদিককেও প্রেরণ করবে না। মামলা আরম্ভ হওয়ার পর প্রথমদিন ভোরবেলা ফয়েজ আহমদ কার্ড পান। প্রথমদিন তারা ৬ পত্রিকার ৬ জন রির্পোটার রির্পোটিং করতে যান। কক্ষের সম্মুখেই ডিএফআইর লোকজন তাদেরকে কারো সাথে কথা না বলার জন্য সর্তক করে দেয়। জজের ডানপাশে এক চিলতে জায়গায় সাংবাদিকদের বসার জায়গা করা হয়েছিল। ফয়েজ আহমদ কক্ষে প্রবেশ করেই প্রথম চেয়ারটায় বসে পড়েন।

বিচার শুরু হওয়ার ৫ মিনিট আগে অভিযুক্ত ৩৫ জনকে কাঠের বেড়া দেয়া তাঁদের পাশের জায়গায় নিয়ে আসা হয়। সিরিয়াল অনুযায়ী প্রত্যেকের আসন নির্দিষ্ট ছিল। যেহেতু শেখ মুজিব প্রধান আসামী, সেহেতু তিনি এক নম্বরে। তাঁর আসন থেকে ফয়েজ আহমদের আসনের দূরত্ব ছিল দেড় হাত মাত্র। বিচার পর্ব শুরু হবার কিছুক্ষণের মধ্যে ফয়েজ আহমদ তাঁর ডান উরুতে একটা আঘাত অনুভব করেন। সেই সাথে এক নম্র কন্ঠস্বর ভেসে এল- এই ফয়েজ! ছয় রিপোর্টার প্রথমদিন ভয়ে ছিলেন কখন কি ভুল হয়ে যায় তাঁদের! সেজন্য তাঁরা জজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন আর মাঝে মাঝে কৌসুলিদের বক্তব্য শোনার জন্য তাঁদের দিকে ঘাড় ফেরাতেন। একটু পরে আবার তাঁর উরুতে শেখ সাহেব তাঁর খালি পাইপের ডগা দিয়ে কয়েকটি আঘাত করলেন। ফয়েজ আহমদ জজের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন : “মুজিব ভাই কথা বলা নিষিদ্ধ। পরে কথা হবে।” তিনি আবার ডাকলেন : “এই ফয়েজ”! এবার একটু জোরে। তখন মাথা নিচু করে ফয়েজ আহমদ বললেন, “কথা বলা নিষিদ্ধ মুজিব ভাই”। সেসময় শেখ মুজিব আশ্চর্যজনকভাবে উচ্চকন্ঠে বলে উঠলেন, “ফয়েজ, বাংলাদেশে থাকতে হলে শেখ মুজিবের সাথে কথা বলতে হবে।” স্তম্ভিত বিচারকক্ষের বিচারকগণ, সকল আইনজীবী ও উপস্থিত দর্শকবৃন্দ সবাই অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে একথা শুনলেন !

সাংবাদিকতা করার সময় থেকে তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটেরও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামী ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিক কারণেই ১৯৮২-৮৩ সালে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের জন্ম। তাঁর নেতৃত্বে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যেমন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছিল তেমনি ১৯৮৮ সালের মহাপ্লাবন, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সাধারণ মানুষের পাশে গিয়ে স্বতঃস্ফুর্তভাবে দাঁড়িয়েছিল। এছাড়াও সেসময় তাঁর নেতৃত্বে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিরপেক্ষ সরকারের আমলে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করার অভিযানে চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূল থেকে রংপুর পর্যন্ত গণতন্ত্রের অভিযাত্রা আয়োজন করেছিল। নির্বাচনের পরপরই সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট অন্তর্বর্তীকালীন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি শাহবুদ্দিন আহমদের কাছে ১১ দফা সম্বলিত একটি সাংস্কৃতিক দাবীনামা পেশ করে। এই দাবীনামা পরে ১৯৯১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার কাছেও উপস্থাপন করা হয়। প্রগতিশীল অসাম্প্রাদায়িক সংগঠন হিসাবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট তাঁর কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এভাবে দ্রুত পৌঁছে যায় সাধারণ মানুষের কাছে। তের বছর দক্ষতা ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করার পর তিনি জোট থেকে পদত্যাগ করেন।

‘৮০-র দশকে ফয়েজ আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর সিণ্ডিকেটের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি জাতীয় কবিতা উৎসবের প্রথম পাঁচ বছর আহ্বায়ক ছিলেন। এছাড়া ১৯৮২-তে বাংলা একাডেমীর কাউন্সিল সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু পরে এরশাদের সামরিক শাসনের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন।

কিশোর বয়স থেকেই তিনি বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত হন। ষোলঘর উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা কালিন শ্রীনগরের রাজা শ্রীনাথ হাসপাতালের প্রখ্যাত ডাক্তার এম এন নন্দীর সংস্পর্শে আসেন তিনি। ডাক্তার নন্দী ছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। তাঁর কাছ থেকে সমাজতন্ত্র ও মানুষের মুক্তির আদর্শে অনুপ্রেরণা পান ফয়েজ আহমদ। মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন তখন থেকেই। ১৯৬০ সালে জেলে থাকা অবস্থায় অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে সদস্যপদ দেয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করে। কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়ার আগেই পার্টির নির্দেশে ১৯৫৪ সালে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্টদের সহায়তায় বিনা পাসপোর্টে তিনি ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক যুব সম্মেলনে যোগ দেন। এজন্য তাকে ‘হিরো’ বলা হতো। এই সম্মেলনে ইরান থেকে ১৮ জন ও মেক্সিকো থেকে ৬ জন তাঁর মতো গুপ্তপথে ও পরিচয়ে সম্মেলনে যোগ দেন।

পাকিস্তানের সাবেক সামরিক শাসক আইয়ুব খানের আমলে তিনি ১৯৫৯ সাল থেকে ৪ বছর কারাবন্দী ছিলেন। হাইকোর্ট গঠিত বোর্ডের মাধ্যমে বিচারের পর তিনি মুক্তি পান। কিন্তু জেলগেটেই এক বছরের জন্য তাঁর ঢাকা শহরের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয় এবং রমনা থানা এলাকায় নজরবন্দী করে রাখা হয়। এভাবেই তাঁর জীবনের পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়। একইভাবে বাংলাদেশেও তিনি সামরিক শাসক এরশাদের আমলে আর একবার কারাগারে গিয়েছেন। রাজনৈতিক কারণে তিনবার দীর্ঘ সময়ের জন্য তাঁকে আণ্ডারগ্রাউন্ডে থাকতে হয়েছে।

ফয়েজ আহমদ ভারতীয় সাংবাদিক ইউনিয়নের আমন্ত্রণে আরো চারজন সাংবাদিকের সঙ্গে একমাসব্যাপী সারা ভারতের পুরাকীর্তি সমূহ পরিদর্শন করেন। ১৯৫৭ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত প্রথম এশীয় লেখক সম্মেলনে, ১৯৯৫ সালে কিউবার হাভানায় অনুষ্ঠিত মার্কিন ব্লকেড বিরোধী সম্মেলনে এবং একই বিষয়ের উপর ভিয়েতনামের হ্যানয়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যোগদান করেন। সর্বশেষে ১৯৯৮ সালে উত্তর আমেরিকার নিউইয়র্কে বাঙালীদের ‘ফোবানা’ সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন। তিনি ‘মাষ্টারদা সূর্যসেন স্মৃতি কমিটির’ প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ শক্তি ও জামাতের বিরুদ্ধে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। এই কমিটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালে গণআদালত তৈরি করে। তিনি সেই গণআদালতের ১১ জন বিচারকের মধ্যে অন্যতম বিচারক ছিলেন। এই গণআদালতের সাথে সংশ্লিষ্ট যে ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল তিনিও তাঁদের মধ্যে একজন। এই মামলার আসামী হিসেবে তিনি পাঁচ বছর জামিনে ছিলেন।

তিনি ঢাকার প্রাচীন ও সুবৃহৎ আর্ট গ্যালারী ‘শিল্পাঙ্গণ’ এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৯২ সালে। তিনি প্রগতিশীল পাঠাগার ‘সমাজতান্ত্রিক আর্কাইভ’ এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৯৬৬ সালে পিকিং রেডিওতে বাংলা ভাষার অনুষ্ঠান শুরু করার জন্যে তিনবছর মেয়াদে নিযুক্ত হন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম আর নেতৃত্বের ফলে অল্প সময়েই পিকিং রেডিওতে বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। সে সময় চীনে কালচারাল রেভ্যুলিউশন শুরু হয়। এছাড়া তিনি ঢাকা রেডিওতে ১৯৫২-৫৪ সালে ‘সবুজ মেলা’ নামের ছোটদের বিভাগটি পরিচালনা করতেন।

মুক্তিযুদ্ধে ফয়েজ আহমদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। পাকিস্তানের প্রথম যুগে যেসব তরুণরা নানা ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান শাসনের বিরুদ্ধে দেশের মানুষদের সংগঠিত করার জন্য কাজ করেছেন তিনি তাঁদেরই একজন। এজন্য তাঁকে দীর্ঘকাল আত্মগোপন করতে হয়েছে। তিনি যুব সম্মেলন এবং শান্তি সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। দেশে তাঁর নামে হুলিয়া বেরিয়েছে। মাওলানা ভাসানীর সাথে বিলেতে, কলকাতায় কাটিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবাসী সরকারে যোগ দেননি, কিন্তু প্রবাসী সরকারের সংবাদ সারাবিশ্বে প্রচারের জন্য সরকারের নেতারা তাঁর ওপর অনেকখানি নির্ভর করতেন। ঢাকা মুক্ত হবার সময় প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে ২২ ডিসেম্বর যে অগ্রবর্তী দলটিকে ঢাকায় পাঠানো হয় তিনি সেই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তিনি প্রেসক্লাবে ছিলেন। ভোর রাতে ট্যাঙ্ক দিয়ে শত্রুবাহিনী প্রেস ক্লাবের দোতালায় তাঁর আশ্রয় কক্ষে গোলাবর্ষণ করে। তিনি বাঁ পায়ের উরুতে আঘাত পেয়ে মেঝেতে পড়ে থাকেন। পরে জ্ঞান ফিরে পেয়ে তিনি সচিবালয়ে আশ্রয় নেন এবং ২৭ মার্চ সকালে চিকিৎসার জন্য বেরিয়ে যান। পরবর্তীতে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করেন এবং সেখানে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের উপর ‘পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে’ শেষ দিন পর্যন্ত লিখেছেন।

গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিশেষ বিশেষ সময়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৭ সালের দিকে যখন এরশাদের সামরিক শাসন বিরোধী গণআন্দোলন চলছে, তখন আন্দোলনকে বেগবান করার স্বার্থে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সামনাসামনি বৈঠকের প্রয়োজন তীব্রভাবে অনুভূত হলেও নানা কারণে তা সম্ভব হচ্ছিল না। একমাত্র ফয়েজ আহমদের উদ্যোগেই তা সম্ভব হয়েছিলো। প্রথম বারের মতো দুই নেত্রী ১৯৮৮ সালের অক্টোবর মাসে মুখোমুখি বসে আলোচনা করেন। এই ঘটনাটি সে সময় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে।

কর্মজীবন এবং রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি তিনি প্রধানত শিশুকিশোরদের জন্য ছড়া ও কবিতা লিখেছেন। তাঁর বইয়ের সংখ্যা প্রায় একশ। এর মধ্যে শিশুকিশোরদের জন্য বই রয়েছে ৬০টি। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী শিশুদের জন্য রচিত তাঁর চারটি বই ইংরেজীতে অনুবাদ করেছেন। এর মধ্যে কবীর চৌধুরীর ইংরেজীতে অনুদিত ১০০ টি ছড়ার একটি পুস্তক বাংলা একাডেমী ২০০৮ সালে প্রকাশ করেছে। তাঁর লেখা ছড়া নিয়ে একটি আবৃত্তি ও সঙ্গীতের ক্যাসেট বেরিয়েছে। ফয়েজ আহমদের বইগুলোর মধ্যে ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ সবচেয়ে বিখ্যাত। এটি তাঁর শ্রেষ্ঠ পুস্তক বলে বিবেচিত। ছড়ার বইয়ের মধ্যে-‘হে কিশোর’, ‘কামরুল হাসানের চিত্রশালায়’, ‘গুচ্ছ ছড়া’, ‘রিমঝিম’, ‘বোঁ বোঁ কাট্টা’, ‘পুতলি’ ‘টুং’, ‘জোনাকী’, ‘জুড়ি নেই’, ‘ত্রিয়ং’, ‘তুলির সাথে লড়াই’, ‘টিউটিউ’, ‘একালের ছড়া’, ‘ছড়ায় ছড়ায় ২০০’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তিনি চীনসহ বিভিন্ন দেশের পাঁচটি বই অনুবাদ করেছেন। এর মধ্যে হোচিমিনের ‘জেলের কবিতা’ উল্লেখযোগ্য।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য ফয়েজ আহমদ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি ১৯৬৫ সালে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান পুরস্কার, ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮০,১৯৮২ সালে ভাসানী স্মৃতি পুরস্কার, ১৯৮০ সালে অগ্রনী ব্যাংক পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে সাব্বির সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯১ সালে একুশে পদক, ১৯৯৭ সালে শিশু একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া নুরুল কাদের শিশু সাহিত্য ও মোদাব্বের হোসেন আরা শিশু সাহিত্য পুরস্কারসহ আরও অনেক পুরস্কারে ভূষিত করা হয় তাঁকে।

অকৃতদার ফয়েজ আহমেদ ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী ভোর বেলা শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর শেষ ইচ্ছে অনুসারে মৃতদেহ ঢেকে রাখা হয়েছিল বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা দিয়ে আর পাশে রাখা হয়েছিল মার্ক্স ও এঙ্গেল্‌স এর বই ও কমিউনিস্ট পার্টির মেনিফেস্টো।

মৃত্যুর দশ বছর আগে সন্ধানীর আন্তর্জাতিক চক্ষু ব্যাংকে মৃত্যুর পর চোখ দান করার অঙ্গীকার করেছিলেন ফয়েজ আহমদ। ফয়েজ আহমদের দান করা দুই চোখের দুই কর্নিয়া দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছে দুই অন্ধ যুবককে। ২৯ বছর বয়সী এক সফ্‌টওয়ার ইঞ্জিনিয়ার ও ২৫ বছর বয়সী এক ডাক্তার ফয়েজ আহমদের কর্নিয়া প্রতিস্থাপনে এখন দেখতে পাচ্ছেন। নিজের শরীরটাও দান করে গেছেন বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে বলে।

মুক্তচিন্তার একজন ফয়েজ আহমদ মৃত্যুর পরেও এভাবেই মানুষের জন্যে কাজ করে গেছেন। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ তা অক্ষরে অক্ষরে বুঝিয়ে দিয়ে হয়েছেন মানুষের হৃদয়ে চিরভাস্বর।

বাঙালীয়ানা/এসএল

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.