বাংলার নীলবিদ্রোহ এবং নীলচাষের ঘটনা বাদ দিয়ে নীলদর্পণ নাটকের আলোচনা হতে পারে না। কারণ বাংলার নীলচাষের ঘটনা না ঘটলে নীলদর্পণ নাটক লেখারই কোনো প্রয়োজন পড়ত না। নীলদর্পণ নাটক রচনা প্রসঙ্গে নাট্যকার নিজেই ভূমিকায় লিখেছেন, ‘নীলকরনিকরকরে নীলদর্পণ অর্পণ করিলাম। এক্ষণে তাঁহারা নিজ মুখ সন্দর্শনপূর্বক তাঁহাদিগের ললাটে বিরাজমান স্বার্থপরতা-কলঙ্ক-তিলক বিমোচন করিয়া তৎপরিবর্তে পরোপকার-শ্বেতচন্দন ধারণ করুন, তাহা হইলেই আমার পরিশ্রমের সাফল্য, নিরাশ্রয় প্রজাব্রজের মঙ্গল এবং বিলাতের মুখরক্ষা।’ খুব স্পষ্ট করেই নাট্যকার বলতে চেয়েছেন নীলচাষই তাঁর নাটকের বিষয়, বিশেষ করে নীলকরদের অত্যাচার। তিনি নিজদেশের নিরাশ্রয় লোকদের নীলকরদের অত্যাচার থেকে বাঁচাতে চান, আবার বিলাতেরও মুখরক্ষা করতে চান। নাট্যকার নীলচাষের হাত থেকে চাষীদের বাঁচাবার জন্য মূলত ইংরেজ শাসকদের দয়া চাইছেন। তিনি চাষীদের লড়াই করার কথা বলছেন না। ঠিক এইখানে এসেই বর্তমান প্রবন্ধের সূত্রপাত। নীলদর্পণ নাটক সম্পর্কে ইতিমধ্যেই ন্যূনতম দুটি চমৎকার সমালোচনা লেখা হয়েছে। যার একটি আশুতোষ ভট্টাচার্যের এবং অপরটি উৎপল দত্তের। সে দুটি রচনায় বিশদভাবে নাটকটিকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। বর্তমান নিবন্ধটি কিছু ভিন্ন প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা রাখে। বিশেষ করে নাট্যকারের ইংরেজ শাসকদের কাছে দয়া চাইবার ব্যাপারাটকে প্রবন্ধকার ভিন্ন অবস্থান থেকে দেখতে চাইছেন। নাট্যকারের উল্লিখিত বক্তব্যের ভিতর দিয়ে নীলবিদ্রোহের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। যথা সময়ে সে প্রসঙ্গে আসা যাবে। তার পূর্বে বাংলার নীলচাষ সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা যাক।
বাংলায় বিদেশী মূলধন বিনিয়োগে নীল ও পাট চাষ দুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে রয়েছে। ইংরেজ ধনীকরা বুঝলেন নীল ও পাট ইত্যাদি বাণিজ্য-ফসল বাংলার মাটিতে ফলাতে পারলে প্রচুর লাভ। বাংলার দরিদ্র চাষী-মজুরের সুলভ পারিশ্রমিকে নীল ও পাট চাষ করিয়ে ইংল্যান্ড ও অন্যত্র রপ্তানী করতে পারলে পর্যাপ্ত মুনাফা লাভের সম্ভাবনা, যা ভিন্ন কোনো সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে সহজে করা সম্ভব নয়। ব্রিটিশ ব্যবসায়ীর মূলধন তাই বাণিজ্য-ফসলে বিনিয়োগ করা হলো। বিশেষ করে নীলচাষে। বাংলার গ্রাম্যজীবনের সাথে নীলকর এবং নীলচাষের সম্পর্ক ইতিহাসের একটি নির্মম অধ্যায়। কারণ নীল চাষের ব্যাপারে নীলকর সাহেবরা বাংলার গ্রামাঞ্চলে শুধু ব্যবসায়ীরূপে নয়, ভয়াবহ অত্যাচারী রূপেও বিরাজ করতো। চাষের ক্ষেত্র থেকে আরম্ভ করে তাদের নীলকুঠি পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে তারা এক বিচিত্র রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে বসেছিল। নীলকর সাহেবরা ছিল বিদেশী শাসকদের প্রতিভূ, কাজেই স্থানীয় জমিদার-তালুকদার-পত্তনিদারদের চেয়েও তাদের প্রতাপ-প্রতিপত্তি শতগুণ বেশি ছিল। দোর্দন্ড প্রতাপ জমিদাররাও তাদের অধীন নীলকর সাহেবদের যথেষ্ট সমীহ ও ভয় করে চলতেন।
সতেরশো সত্তর থেকে সতেরশো আশি সালের মধ্যে বাংলাদেশে নীল চাষ আরম্ভ হয়। কোন্ ব্যক্তি প্রথমে নীলচাষ আরম্ভ করে তা নিয়ে মতভেদ থাকলেও জানা যায় যে, ল্যুই বোনদ নামে এক ব্যক্তি মরিশাসে নীলচাষ করে ব্যর্থ হয়ে বাংলায় আসে। সতেরশো বাহাত্তর সালে সে চন্দননগরের কাছে গোঁদলপাড়া গ্রামে একটি ছোট নীলকুঠি স্থাপন করে। এটাই বাংলার প্রথম নীলকুঠি। সতেরশো তিয়াত্তর সালে বোনদ চন্দননগর ও চুচুঁড়ার মাঝামাঝি একটি জায়গায় আর একটি নীলকুঠি স্থাপন করে। হাওড়ার শ্যামপুকুরে দু-জন ফরাসী চিকিৎসক প্রায় এই একই সময় একটি নীলকুঠি স্থাপন করে। সতেরশো তিরাশি সালের মধ্যে বাংলার বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি কুঠি স্থাপিত হয়। বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে সে বছর বারো-তেরোশো মন নীল রপ্তানী হয়। সতেরশো ছিয়ানব্বই থেকে আঠারশো চার সালের মধ্যে বছরে চব্বিশশো থেকে বেড়ে বাষট্টি হাজার মন নীল উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে। আঠারশো পনেরো সালে পঁচাশি হাজার চারশো আট মন নীল কলকাতা থেকে লন্ডনে চালান দেওয়া হয়। বাংলায় নীলচাষের জন্য ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এবং ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী উভয়েই মূলধন খাটাতো। দেখা গেছে বাংলা থেকে দেড়শো-দুশো টাকা মনে নীল কিনে তারা তিন-চার গুণ বেশিমূল্যে লন্ডনের বাজারে বিক্রি করতো। নীলকরদের দাদন দিয়ে নীল সরবরাহের ব্যবস্থা করা হতো। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আঠারশো বিশ সাল থেকে আঠারশো সাতাশ সাল পর্যন্ত নীলবাণিজ্য থেকে ইংরেজরা মুনাফা করে পঁয়তাল্লিশ লক্ষ টাকা। এটা ব্যবসায়ীদের ঘোষিত মুনাফা, মূল মুনাফা ছিল অন্তত দ্বিগুণ। আঠারশো বিশ থেকে ত্রিশ সাল পর্যন্ত নীলচাষ থেকে শুধুমাত্র ইস্টেইন্ডিয়া কোম্পানীর বাৎসরিক মুনাফার পরিমাণ ছিল দশ-বারো লক্ষ টাকা।
নীলচাষের এই প্রথম পর্বের ইতিহাস থেকে বোঝা যায় আঠার শতকের শেষ দশক থেকে উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত বাণিজ্য-ফসল নীলচাষে কতদূর পর্যন্ত জবর দখল করা হয়েছিল এবং নীলকর ও নীলকুঠির প্রভাব বাংলার গ্রামে কতদূর বিস্তৃত হয়েছিল। হাওড়া-হুগলি, চব্বিশ পরগণা, বর্ধমান, বীরভূম, নদীয়া, যশোর প্রভৃতি জেলায় কিছুকাল আগেও নীলকুঠির ভগ্নস্তুপ দেখা যেতো। উনিশ শতকের বাংলা ও ইংরেজী সাময়িকপত্রে নীলকরদের দৌরাত্ম্য ও দুর্বিনীত আচরণের প্রচুর সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। বাংলা বারশো পঞ্চান্ন সালের তেশরা আষাঢ় সংবাদ প্রভাকর-এ লেখা হয়েছিল, নীলকরদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বা মামলা-মোকদ্দমা করা যায় না। কারণ ম্যাজিস্ট্রেটদের সাথে নীলকরদের ঘনিষ্ট পরিচয় থাকে এবং ম্যাজিস্ট্রেটরা প্রায় নীলকরদের আতিথ্য গ্রহণ করে। জেলার কর্তা যদি শিকারে যায় স্থানীয় কোনো নীলকর সাহেবের অতিথি হয়ে নীলকুঠিতে অবস্থান করে। ফলে দেখা যায়, নীলকরদের নিষ্ঠুরতা ও হত্যাঘটিত বহু মোকদ্দমা হলেও তাতে সাধারণের কোনো উপকার হয় না। নীলকরদের শোষণ ও অত্যাচার কিছুমাত্র খর্ব করা যায় না। নদীয়া জেলায় নীলকরদের অত্যাচার প্রসঙ্গে সংবাদ প্রভাকর-এর বারশো ছিষট্টি সালের ছয় মাঘ সংখ্যায় লেখা হচ্ছে, ‘প্রদেশ মধ্যে রাজশাসন প্রণালী নাই বলিলেই হয়। নীলকরেরাই রাজা এবং হর্তা কর্তা যাহা মনে করেন তাহাই করিতে পারেন।’
নীলচাষের পক্ষে একের পর এক আইন করা হলো নীলকরদের শোষণকে নিরঙ্কুশ করতে। নীলকররা অধিকার পেল বাংলার তালুক ক্রয় করার। দেখা গেল নীলকরদের স্বার্থে আইনের যথেচ্ছ এবং নির্লজ্জ ব্যবহার। কারণ ইংরেজ বড়-ছোট কর্তা সকলেই নীলচাষের দ্বারা বহু ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছিল। মরে সাহেব নামে একজন নীলকরের সুন্দরবনে নীলের আবাদ ছিল। তার নামেই বাগেরহাটের মরেলগঞ্জ গ্রাম। সোমপ্রকাশ পত্রিকার বারোশো উনসত্তর সালের দোশরা বৈশাখ সংখ্যায় মরের স্বেচ্ছাচারিতার বিস্তৃত বিবরণ ছাপা হয়। তাতে দেখা যায়, হত্যা, বলাৎকার, জালকারিতা; সবধরনের দুষ্কর্মের সাথে সে জড়িত ছিল। বিদেশী একজনের লেখার বিবরণ থেকে দেখা যায়, নীলকুঠিতে গড়ে একশো বিশটি গরুর গাড়ি ও আটচল্লিশটি নৌকা থাকতো নীল ও অন্যান্য মালামাল বহণের জন্য। কুলির সংখ্যা থাকতো ন্যূনতম চারশো। ভদ্রলোক কর্মচারী; নায়েব, গোমস্তা, সরকার প্রভৃতি সংখ্যায় কম থাকে না। এর থেকে ধারণা করা যায় কেমন রমরমা ব্যবসা ছিল নীলচাষে।
বণিক ইংরেজদের এই অত্যাচার ও ব্যভিচারের ফলে দেশের চাষীদের মধ্যে বিদ্রোহের সত্তা জাগ্রত হয়। নীলকরদের চরম অত্যাচারের ফলেই আঠারশো ষাট সালে নীল বিদ্রোহ দেখা দেয়। নীল চাষীদের মনে জেগেছিল এক সুদৃঢ় সংকল্প তারা নীলচাষ করবে না। নীলচাষীদের এই বিদ্রোহ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। নীলকররা সেই সময়ে বাংলার ছোটলাট সাহেবের নিকট স্মারক লিখে জানায় যে, চাষীদের দ্বারা কিছুতেই নীলের চাষ করানো সম্ভব হচ্ছে না। সে স্মারকপত্রে আরো লেখা হয়, ‘মফস্বলের আদালতগুলিতে কোনো রায়তের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা সম্ভব হয় না, কারণ অভিযোগ প্রমাণ করার জন্য স্বাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। এমন কি আমাদের কর্মচারিগণ পর্যন্ত আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে সাহস পায় না। রায়তরা খুবই উত্তেজিত অবস্থায় রয়েছে। প্রতিদিন তারা আমাদের কুঠি ও বীজের গোলায় আগুন লাগিয়ে দেবার চেষ্টায় রত আছে। বাসার অধিকাংশ চাকর-চাকরানী আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। কারণ, রায়তগণ তাদের হত্যা করার ভয় দেখিয়েছে। যে দু-একজন চাকর আমাদের সঙ্গে আছে তারাও শীঘ্র চলে যেতে বাধ্য হবে। কারণ, পার্শ্ববর্তী বাজার থেকে তারা নিজেদের খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতে পারছে না।’
সমগ্র বঙ্গদেশের কৃষকদের আসন্ন বিদ্রোহের পূর্বাভাস লক্ষ্য করে ক্যালকাটা রিভিউ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, বাংলার গ্রামবাসীদের মধ্যে একটি আকস্মিক ও অত্যাশ্চর্য পরিবর্তন এসেছে। যে রায়তদের সাথে আমরা ক্রীতদাসদের মতো ব্যবহার করতে অভ্যস্ত ছিলাম, জমিদার ও নীলকরদের নির্বিরোধ যন্ত্ররূপে যাদের জানতাম অবশেষে তারা জেগে উঠেছে। কর্মতৎপর হয়েছে এবং প্রতিজ্ঞা করেছে নীলচাষ আর করবে না। আঠার ষাট সালে ইন্ডিয়ান ফিল্ড নামের মাসিক পত্রিকায় নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর হতে একজন জর্মন পাদ্রীর লিখিত পত্র থেকে বিদ্রোহের মূল চেহারা পাওয়া যায়। পত্রের বিবরণে বলা হয়, কৃষকগণ ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন দলে নিজেদের বিভক্ত করেছে। একটি দল গঠিত হয়েছে শুধুমাত্র তীর-ধনুক নিয়ে, ইটওয়ালাদের নিয়ে আর একটি দল; যারা ইটপাটকেল সংগ্রহ করছে। আর একটি দল বেলওয়ালাদের, তাদের কাজ শক্ত কাঁচা বেল নীলকুঠির লাঠিয়ালদের মাথা লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করা। থালাওয়ালাদের নিয়ে একটি দল, তারা তাদের পিতলের থালাগুলি শত্রুকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারে। তাতে শত্রুনিধন উত্তমরূপেই হয়। আর একটি দল যারা পোড়ানো খণ্ড কিংবা অখণ্ড মাটির বাসন নিয়ে শত্রুকে অভ্যর্থনা জানায়। বিশেষত বাঙালী স্ত্রীলোকরা এই অস্ত্র উত্তমরূপে ব্যবহার করতে জানে। যারা লাঠি চালাইতে পারে তাদের নিয়ে আর একটি দল গঠিত হয়েছে। দলের সর্বশ্রেষ্ঠ বাহিনীটি হলো বল্লমধারী বাহিনী। এরা সংখ্যায় অল্প হলেও খুবই দুর্ধর্ষ। নীলকরদের লাঠিয়ালরা এদের ভয়ে এতোই ভীত যে, কোনোরকম আক্রমণ করতে সাহস পাচ্ছে না।
কৃষকগণ নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য চমৎকার সব কৌশল গ্রহণ করেছিল। প্রত্যেক পল্লীর প্রান্তে তারা একটি করে দুন্দুভি রেখেছে। যখন কুঠির লাঠিয়ালরা গ্রাম আক্রমণ করার চেষ্টা করতো, কৃষকগণ তখন দুন্দুভির ধ্বনিদ্বারা পরবর্তী গ্রামের লোকদের সজাগ করে দিতো। এতে করে চার-পাঁচ গ্রামের লোক দ্রুত একত্র হয়ে কুঠির লাঠিয়ালদের কাবু করে ফেলতো। ঠিক এই ব্যাপারেই সতীশ মিত্র লিখেছেন, গ্রামের সীমায় একস্থানে একটি ঢাক থাকিত। নীলকরের লোক অত্যাচার করতে আসলে সেই ঢাক বাজানো হতো, অমনি শত শত লোক লাঠিসোটা নিয়ে দৌড়ে আসতো। নীলকরের লোকরা এই প্রতিরোধের সামনে দাঁড়াতে পারতো না। কারণ সম্মিলিত প্রজাশক্তির বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হওয়া সহজ ছিল না। সমগ্র বঙ্গদেশব্যাপী নীল-বিদ্রোহে ষাট লক্ষাধিক কৃষক যোগদান করেছিল। নদীয়া, যশোহর, খুলনা, ফরিদপুর, চব্বিশ পরগণা, পাবনা প্রভৃতি জেলার এরূপ গ্রাম কমই ছিল যে স্থানের সকল কৃষক সক্রিয়ভাবে এই সংগ্রামে অংশ নেয়নি। কৃষক জনসাধারণের উপর বহুকালের অসহনীয় শোষণ উৎপীড়নই এই বিদ্রোহকে ধীরে ধীরে প্রাণ সঞ্চার করে।
নীল চাষীদের মধ্যে যে বিদ্রোহ শুরু হলো, যে ক্ষোভ প্রতিভাত হলো তাতে বড়লাট ক্যানিং পর্যন্ত বিব্রত হলেন। তিনি একটা চিঠিতে লিখেছিলেন যে, নীলবিদ্রোহ আরম্ভ হবার প্রায় এক সপ্তাহকাল তিনি খুবই উৎকণ্ঠিত ছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহের সময় দিল্লীর অবরোধেও তিনি এতোটা উদ্বিগ্ন হননি। তিনি সব সময় ভাবছিলেন, কোনো নির্বোধ নীলকর যদি ভয়ে বা ক্রোধে বিদ্রোহীদের দিকে একটিও গুলি ছোঁড়ে তা হলে সে মুহূর্তেই দক্ষিণবঙ্গের সকল কুঠিতে আগুন জ্বলবে। ক্যানিংয়ের ভয় মিথ্যা ছিল না। সমগ্র বঙ্গদেশব্যাপী সে আগুন সত্যিই জ্বলে উঠেছিল। চাষীগণ মরিয়া হয়ে ঘোষণা দিল তারা আর নীলচাষ করবে না। নীলকররাও বলপূর্বক নীলচাষ করাতে উদ্যত হলো। বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন তখন ইডেন। চাষীদের সাথে নীলকরদের গোলযোগ দেখে কর্তৃপক্ষের নিকট স্পষ্ট লিখে জানালেন, ‘প্রজাই জমির মালিক, নীলকর নহে। প্রজার জমি বলপূর্বক দখল করবার কোনো অধিকার নীলকরদের নেই এবং নীলকরেরা যেখানে আইন অমান্য করবে, ম্যাজিস্ট্রেট সেখানে প্রজার স্বত্ব রক্ষা করতে বাধ্য।’ আঠারশো ঊনষাট সালে ইডেন বাংলা ভাষায় এক ঘোষণা দ্বারা জনসাধারণকে জানিয়ে দিলেন যে, নীলের চুক্তি করা বা না করা প্রজাদের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন। নদীয়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হার্সেলও ইডেন সাহেবের পন্থা অনুসরণ করলেন। বঙ্গীয় সরকারের সম্মতি অনুসারে প্রজাদিগকে এই ঘোষণার নকল দিবার ব্যবস্থা করা হলো। শত শত প্রজা নকল সংগ্রহ করে তা সর্বত্র ছড়িয়ে দিল। এরপর প্রজারা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে নীলের চাষ বন্ধ করে দিল।
সমগ্র বঙ্গদেশ জুড়ে নীল-বিদ্রোহ আরম্ভ হবার সঙ্গে সঙ্গেই শাসকগণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আঠারশো ষাট সালের একত্রিশে মার্চ নীলচাষীদের বিক্ষোভ ও নীলচাষ সম্বন্ধে তদন্ত করবার জন্য নীল-কমিশন গঠন করে। এই কমিশন যাঁদের নিয়ে গঠিত হয় তাঁদের মধ্যে একজন ব্যতীত বাকি সকলেই ছিলেন ইংরেজ। বঙ্গীয় জমিদার সভার একজন সদস্যকে কমিশনে রাখা হলেও কৃষকদের কোনো প্রতিনিধি ছিল না। নীল কমিশন প্রায় তিনমাস কালের মধ্যে সরকারের নিকট তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিশন নীলকরদের বিরুদ্ধে অভিযোগসমূহের অধিকাংশ স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয় এবং স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দেয় যে, ‘নীলকরদিগের ব্যবসা-পদ্ধতি উদ্দেশ্যত পাপজনক, কার্যত ক্ষতিকারক এবং মূলত ভ্রমসঙ্কুল’। প্রতিবেদন সম্পর্কে বাংলার ছোটলাট গ্র্যাণ্ট যে মন্তব্য করেছিলেন তাতে নীলকরদের অপকর্মের ধারাবাহিক বিবরণ পাওয়া যায়। ছোটলাট স্পষ্ট স্বীকার করেন, ‘বাংলার প্রজা ক্রীতদাস নহে, পরন্তু প্রকৃতপক্ষে জমির স্বত্বাধিকারী। নিজেদের ক্ষতি হয় এমন কিছুর বিপক্ষে দাঁড়ানো তাদের জন্য বিস্ময়কর নহে। যা ক্ষতিজনক তা করাতে গেলে অত্যাচার অবশ্যম্ভাবী, এই অত্যাচারের আতিশয্যই নীল বপনে প্রজার আপত্তির মূল কারণ।
নীল-কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার পর এই আইন বিধিবদ্ধ করা হলো যে, কোনো নীলকরই আর রায়তদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপূর্বক চাষীদের দ্বারা নীলের চাষ করাতে পারবে না। নীলের চাষ করা সম্পূর্ণ চাষীদের ইচ্ছাধীন। সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, সরকার নীলচাষের পক্ষে বা বিরুদ্ধে নহে। অন্য শষ্যের মতো নীলচাষ করা না করা সম্পূর্ণরূপে প্রজার ইচ্ছাধীন। আইন অমান্য করে অত্যাচার বা অশান্তির কারণ হলে নীলকর বা বিদ্রোহী প্রজা কেউই কঠোর শাস্তি থেকে নিস্কৃতি পাবে না।’ এই ঘোষণা দ্বারা ইংরেজ সরকার নীল-বিদ্রোহেরই জয় ঘোষণা করলেন। নীলের চাষ চাষীদের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন ঘোষণা করা হলে নীলকররা নিজেদের কুঠি ও কারবার গুছিয়ে অন্য ব্যবসায় মনোনিবেশ করে। অন্যান্য কুঠিও আর কিছুকাল নীলচাষের চেষ্টা করে অবশেষে কুঠি বন্ধ করে দেয়। নীলবিদ্রোহের মধ্য দিয়েই বাংলায় নীলচাষ এভাবে বন্ধ হয়। মহাবিদ্রোহের পর শাসকরা চাইছিল না বড় ধরনের নতুন কোনো বিদ্রোহ বা ঝামেলার মুখোমুখী হতে। নীলচাষ বন্ধ হবার আর একটি কারণ হলো, তখন কৃত্রিম বা রাসায়ণিকভাবে রং বানানো সম্ভব হলে, নীলের প্রয়োজন কমে যায়।
নীলবিদ্রোহের পরেই দীনবন্ধুর যুগান্তকারী নীলদর্পণ নাটকটি প্রকাশিত হয়। স্বভাবকই নীল-বিদ্রোহ সৃষ্টিতে কিংবা নীলচাষ বন্ধে নীলদর্পণ নাটকের কোনো ভূমিকা নেই। তাহলে নীলদর্পণ নাটক নিয়ে একশো ষাট বছর পর নতুন করে অলোচনা উত্থাপন করার কারণ কী বা যৌক্তিকতা কোথায়। সত্যিকার অর্থে বিবেচনা করলে নীল বিদ্রোহই দীনবন্ধু মিত্রকে নীলদর্পণ নাটক লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। ব্যক্তি ইতিহাস চালায় না, ইতিহাসই ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ন্ত্রণ করে। দীনবন্ধুও ইতিহাসের নিয়মে নিয়ন্ত্রিত হলেন। তিনি ইংরেজদের বিপক্ষে নীলবিদ্রোহীদের পক্ষে দাঁড়ালেন।নাটকটির একটি উদ্দেশ্য ছিল নীলকরদের অত্যাচারের খতিয়ান তুলে ধরা। ইংরেজী শিক্ষিত এবং ইংরেজের চাকরিরত বঙ্কিমচন্দ্র সে কারণে নাটকটিকে ভাল মনে গ্রহণ করতে পারেননি। নীলদর্পণ প্রকাশিত হবার পর বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদর্শনে লিখলেন, নাটকে সামাজিক কুপ্রথা সংশোধনের চেষ্টা করলে আর সেটা নাটক থাকে না। তিনি বলেন, ‘কাব্যের উদ্দেশ্য সৌন্দর্য সৃষ্টি-সমাজ সংস্কার নহে। নাটক নাম কলঙ্কিত হইয়াছে।’ দীনবন্ধুর মৃত্যুর পর বঙ্কিমচন্দ্র এ কথাও লিখেছিলেন, ‘দীনবন্ধু পরের দুঃখে নিতান্ত কাতর হইতেন। “নীলদর্পণ” এই গুণের ফল।’ সন্দেহ নেই নীলদর্পণ বাংলার প্রথম উদ্দেশ্যমূলক নাটকগুলির একটি।
নীলদর্পণ নাটকের সবচেয়ে বড় পরিচয় বাংলা নাটকে সচেতন প্রতিবাদী বা রাজনৈতিক নাট্যধারার সূচনা হয় এর দ্বারা। ভদ্রসমাজে নিম্নবর্গের মানুষের সুখ দুঃখের কথা এতদিন অপাংক্তেয় ছিল, দীনবন্ধুর কৃতিত্ব এই যে তিনিই সর্বপ্রথম নীলদর্পণে তাদের স্থান দিয়েছেন। কৃর্পা করে নয়, আন্তরিক শ্রদ্ধা ও দরদের সাথে তিনি তাদের চিত্র এঁকেছেন। নীলদর্পণ প্রকাশিত হবার আগে বাংলার কৃষকের দুর্দশার চিত্র ও সংগ্রাম নাটক তো দূরের কথা, সাহিত্যে মাত্র একবার তা স্থান পেয়েছে। পিয়ারিচাঁদ মিত্র যিনি প্যারীচাঁদ মিত্র নামে আলালের ঘরে দুলাল লিখেছেন, ‘তিনি সে গ্রন্থে নীলকরদের অত্যাচারের বর্ণনা দেন। তিনি আঠারশো ছাপান্ন সালে লিখছেন, ‘নীলকরের জুলুম অতিশয় বৃদ্ধি হইয়াছে। প্রজারা নীল বুনিতে ইচ্ছুক নহে, কারণ ধান্যাদি বোনাতে অধিক লাভ, আর যিনি নীলকরের কুঠিতে যাইয়া একবার দাদন লইয়াছিলেন তাঁহার দফা একেবারে রফা হয়।’ প্যারীচাঁদের উল্লিখিত গ্রন্থে এ ব্যাপারে বলা আছে, ‘নীলকর বেটাদের জুলুমে মুলুক খাক হইয়া গেল। প্রজারা ভয়ে ত্রাহি ত্রাহি করিতেছে। হাকিমরা স্বজাতির অনুরোধে তাহাদিগের বশ্য হইয়া পড়ে, আর আইনের যেরূপ গতিক তাহাতে নীলকরদিগের পলাইবার পথও বিলক্ষণ আছে।’ ‘নীলদর্পণ’ই দ্বিতীয় রচনা যেখানে নীলকরদের অত্যাচারের বিশদ বিবরণ রয়েছে।
কৃষক জীবনের দৈনিন্দন খুঁটিনাটি এবং সীমাহীন লাঞ্ছনা-বঞ্চনা এই প্রথম বাংলা নাটকে দৃষ্ট হলো। নতুন এক শ্রেণীকে দেয়া হলো সম্মানিত স্থান। সত্যি কথাটা হচ্ছে এই যে, দীনবন্ধু যখন নাটকে গণচরিত্রের বিদ্রোহ আনলেন ইউরোপের নাট্য তখনও সে পথে পা বাড়ায়নি। ফরাসী বিপ্লবের পর বারবার জনগণকে নায়ক করার চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে গণবিদ্রোহ লক্ষ্য করা যায়নি। শাসকদের উপর তোরাপ যেভাবে চড়াও হয় তা পাওয়া যায়নি। গণনাট্য সম্পর্কে রঁম্যা রলাঁর লেখা প্রকাশিত হয় উনিশশো তিন সালে। নীলদর্পণ মঞ্চস্থ হবার বহু পরে। নীলদর্পণ নাটক প্রথম মুদ্রিত হয় ঢাকায় এবং প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে নাটকটি এত জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে এক বছরের মধ্যেই পুনমুদ্রিত হয়। নীলকরদের অত্যাচারে জর্জরিত নীলচাষীদের দুরবস্থা অবলম্বনে রচিত নীলদর্পণ প্রকাশিত হবার পর তা তুমুল আলোড়ন তোলে। বাংলা ভাষায় রচিত নীলদর্পণ অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও ইংরেজ মহলে তা পৌঁছতে পারেনি। মধুসূদন দত্ত এর ইংরেজী অনুবাদ করেন যা কলকাতার কাশীটোলার প্রিন্টি এন্ড পাবলিশিং প্রেসের পক্ষে মুদ্রিত হয়। ইংরেজী অনুবাদ হাতে পেয়ে কলকাতার ব্রিটিশ প্রেস আর নীলকরদের সংগঠন ল্যান্ডহোল্ডার অ্যান্ড কমার্শিয়াল অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। বইটির মুদ্রাকর সি, এইচ ম্যানুয়েলের নামে কলকাতা সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা দায়ের করা হলো। নীলদর্পণ নিয়ে এটি প্রথম মামলা।
নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশের টাকাটা দিয়েছিলেন পাদ্রী রেভারেন্ড জেমস লঙ। বিচারের সময়ে পাদ্রী লংয়ের পরামর্শে ম্যানুয়েল আদালতে প্রবেশ করে বলেন যে, গ্রন্থটির প্রকাশক রেভারেন্ড জেমস লঙ। যখন জানা গেল ইংরেজী অনুবাদের জন্য জেমসই দায়ী তখন ম্যানুয়েলকে দশ টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। ম্যানুয়েল রেহাই পেল এবং লঙের বিরুদ্ধে মামলা শুরু হলো। মামলার বাদী এবং বিবাদী হলো, ইংল্যান্ডের রানী বনাম রেভারেন্ড লঙ। এটি ভারতের প্রথম রাস্ট্রমামলা। প্রধান বিচারক ভারত বিদ্বেষী কুখ্যাত মরডান্ট ওয়েলস। লঙের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা হলো নীলদর্পণ প্রকাশ করে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার করছেন। রেভারেন্ড লঙের বিরুদ্ধে আগে থেকেই ফরিয়াদীদের রাগ ছিল, কারণ লঙ নীল কমিশনের তদন্তকালে চাষীদের পক্ষে স্বাক্ষী দিয়েছিলেন। নীলদর্পণ মামলার জেরা, স্বাক্ষ্য থেকে এই গ্রন্থটির প্রচারের ব্যাপারে সিটনকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা জানা যায়। ইংরেজী নীলদর্পণ ছাপা হবার পর সেগুলি সিটনকারের বাড়িতে পাঠানো হয়। সেখান থেকেই সরকারী খামে সরকারী ডাকব্যয়ে ভারতের ও লন্ডনের বিভিন্ন অঞ্চলে সংসদ সদস্য, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, সংবাদপত্রের কাছে দুশো দুইটি বই পাঠানো হয়। কিন্তু এর জন্য সিটনকারকে আসামীর কাঠগড়ায় তোলা যায়নি। লর্ড ক্যানিংয়ের দৃঢ়তায় তিনি রেহাই পান। স্মরণ রাখতে হবে, কয়েকজন ইংরেজ যখন নীলচাষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে তখন বাঙালী শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা কিন্তু বাংলার চাষীদের পক্ষে ছিলেন না। ব্যতিক্রম ছিলেন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং শিশির ঘোষ।
পাদ্রী লঙের সাথে দীনবন্ধুর সম্পর্ক বহুদিনের। পাদ্রী লঙের সাহায্যেই দরিদ্র দীনবন্ধু অবৈতনিক ইংরেজী পাঠশালায় ভর্তি হতে পেরেছিলেন। জেমস লঙের বিরুদ্ধে মামলা চলেছে মাত্র তিনদিন। বিচার নয়, বিচারের নামে প্রহসন। বিচারে লঙের হাজার টাকা জরিমানা ও একমাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড হয়। কালীপ্রসন্ন সিংহ সঙ্গে সঙ্গে এই জরিমানার টাকা পরিশোধ করেন। এই বিচার নিয়ে দারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামগোপাল ঘোষ, দিগম্বর মিত্র, কালীপ্রসন্ন সিংহ প্রমুখের উদ্যোগে বিচারক ওয়েলসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা ডাকা হয়। রাধাকান্ত দেববাহাদুর সভায় সভাপতিত্ব করেন। বিচারকের পক্ষপাত দুষ্ট আচরণের জন্য এই সভার প্রস্তাবক্রমে বিশ হাজার লোকের স্বাক্ষর সম্বলিত এক অভিযোগপত্র ভারত সচিব স্যার লর্ড উডের কাছে পাঠানো হয়। বিচার চলাকালীর দীনবন্ধু মিত্রও আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তখন কেউ মূল নাট্যকারের নাম জানতেন না। বাংলা নীলদর্পণ ‘কস্যচিৎ পথিকস্য’ ছদ্মনামে ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। ইংরেজ চাকুরে দীনবন্ধু নিজের নামে নাটকটি প্রকাশ করতে সাহস পাননি।
স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলা নাটকের দুঃসাহসিক এবং অদম্য অভিযান শুরু হলো এখান থেকে। নীলদর্পণ এই ধারার পথিকৃত। নীলদর্পণ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর পূর্বে রচিত ও মঞ্চায়িত সকল নাটকের গোত্রান্তর ঘটলো। নীলদর্পণের পূর্বে কিছু সামাজিক নাটক হচ্ছিল। নাটকগুলো ছিল ব্যঙ্গ বিদ্রুপ-প্রধান নক্সা জাতীয়। এই সময় রামনারায়ণ তর্করত্নের কুলীনকূলসর্বস্ব এবং বিদ্যাসাগর প্রবর্তিত বিধবাবিবাহের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে রচিত নাটকগুলিই প্রাধান্য লাভ করেছিল। কিন্তু কোনোটিই একত্রে জাতির সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবদমনের বিরুদ্ধে দৃপ্ত ছিল না। নীলদর্পণ নাটকে তিনটি দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ ছিল। সেই সঙ্গে বিদেশী শাসকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আহ্বান ছিল। নীলদর্পণ নাটক রচনার ভিতর দিয়ে জাতির এক চরম সঙ্কটে বাংলা নাটকের নতুন ঐতিহ্য শুরু হলো। ইংরেজদের অত্যাচার যে কতো নির্মম রূপ নিয়েছিল সেই বর্বরতার জ্বলন্ত কাহিনী রূপায়িত হলো নীলদর্পণ নাটকে। নীলবিদ্রোহ ঘটে গেছে তখন। সরকার কৃষকদের দাবী মেনে নিয়েছে। কিন্তু নীলকরদের বর্বরতার ইতিহাস তখনও সকলের জানা ছিল না। বিশেষ করে শহুরে শিক্ষিতদের কাছে নীলকরদের মূল চরিত্র ছিল অজানা। পত্রিকায় নীলকরদের সম্পর্কে যে-সব খবর ছাপা হতো তা হয়তো তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। নীলদর্পণ নাটকের মধ্য দিয়েই তা সকলের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।
নীলদর্পণ নাটক প্রকাশে সবচেয়ে বেশি বিব্রত বোধ করেছিল নীলকররা এবং সেই সাথে ইংরেজ শাসকরা। কারণ নীলবিদ্রোহের ফলে নীলচাষ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নীলকররা লোকসানের মুখোমুখি হলো অর্থাৎ তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। নীলচাষ রদ হওয়ায় তাদের রমরমা মুনাফা বন্ধ হয়েছে এখন যদি আবার তাদের অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে টানাহেঁচড়া চলে তাহলে নিজেদের মান বজায় রাখা দায়। পরাজয়ের গঞ্জনাতো আছেই, নীলদর্পণ নাটকে তায় আবার তাদেরকে নারী উৎপীড়ক হিসেবে দেখানো হয়েছে। ফলে স্বভাবতই ইংরেজরা নীলদর্পণ প্রকাশে ভীষণ ক্ষুব্ধ হলো। কারণ গত প্রায় নব্বই বছরের নীলচাষের গোপন অধ্যায়গুলো জানাজানি হয়ে যাচ্ছে। গ্রন্থ প্রকাশের ফলে শুধু ভারতবর্ষেই নয়, এর ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশে বিদেশেও তাদের কুকীর্তি ফাঁস হবে। ইংল্যান্ডের সংসদ খুব সহজভাবে নেবে না এই ঘটনা। সেখানে নীলকরদের বিরুদ্ধ পক্ষ রয়েছে, তারা সংসদে যথেষ্ট শক্তিশালী। সবমিলিয়ে নীলদর্পণ নাটকের প্রকাশ ইংরেজদের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে উঠল। নীলদর্পণ নাটক রচনার মধ্য দিয়ে দীনবন্ধু ইংরেজদের মনে ভয় ধরিয়ে দেবার এই কাজটিই করেছিলেন। সেটাই হচ্ছে তাঁর নাটক রচনার একটি সাফল্য। যে-কারণে দেড়শো বছর পরেও তাঁর নাটক নিয়ে আলোচনা করতে হয়। নাটকের যে কী ভয়াবহ শক্তি রয়েছে তা নতুন করে প্রমাণ করার জন্য।
নীলদর্পণের দ্বিতীয় সাফল্যটি আরো বৃহত্তর। নাট্যকার এই নাটক রচনার মধ্যে দিয়ে আর একটি কাজ করলেন, বাংলার বুদ্ধিজীবীদের একাংশকে টেনে আনলেন কৃষকদের পক্ষে। পূর্বেই বলা হয়েছে, যখন ইংরেজরা পর্যন্ত নীলচাষীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে তখন বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা দূরে সরে ছিলেন। কৃষকদের সাথে বিচ্ছিন্নতাবোধে ভুগেছেন। সেই সময়ে নীলদর্পণ হয়ে দাঁড়াল গোটা জাতির হতাশা-আক্ষেপ ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঘৃণার দলিল। মহাবিদ্রোহে যে বুদ্ধিজীবীরা মুক হয়েছিল নীলবিদ্রোহের পর নীলদর্পণকে ঘিরে রুদ্র রোষে ফেটে পড়ল সেই বুদ্ধিজীবীদের একাংশ। উৎপল দত্তের ভাষায়, বুদ্ধিজীবীর মোহভঙ্গ একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। দীনবন্ধুর ব্যক্তিত্ব দ্বারা নয়, ঘটনা পরাম্পরায় ঘটেছিল তা। নীলচাষ চলছিল দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন নীরব। চাষীদের পক্ষে তো ছিলেনই না, বরং কখনো কখনো নীলকরদের পক্ষাবলম্বনকারী হিসেবে দেখা গেছে তাঁদের। শিক্ষিতদের মধ্যে হরিশচন্দ্র তখন বাংলার চাষীদের একমাত্র আপনজন। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় শুধু সংবাদ ছেপেই ক্ষান্ত ছিলেন না, সরাসরি নীলকরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। নীল চাষীদের সংগঠিত করা এবং আদালতে তাদের মামলা পরিচালনা করায় সহায়ত করেন। হরিশচন্দ্রের সহযোগী হিসেবে আর একজন যোদ্ধাকে পাওয়া গিয়েছিল তিনি হলেন শিশির ঘোষ।
বঙ্গদেশে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দ প্রভৃতি বহু দিকপাল আবির্ভুত হয়েছিলেন, সমাজ সংস্কারের নতুন আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু নিজ শ্রেণীর বাইরে যেতে পারেননি। মহাবিদ্রোহের সময় যেমন ঠিক তেমনি একইভাবে নীলবিদ্রোহ থেকে দূরে অবস্থান করছিলেন। দ্বারকানাথ ছিলেন নীলচাষের বড় একজন সমর্থক। দ্বারকানাথ শিল্পপতি, তিনি জমিদারের বেগার খাটার চেয়ে নীলকরের হয়ে কাজ করাটা কৃষকের জন্য লাভজনক মনে করেছিলেন। রামমোহনের মতো তিনি মনে করতেন নীলচাষ বাংলার ভাগ্য ফিরাবে। কিন্তু দ্বারকানাথের ছেলে ও নাতীরা ইতিহাসের নিয়মে নীলদর্পণ প্রকাশিত হবার পর নীলচাষের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। ইংরেজ শাসন সম্পর্কে মোহমুক্তি শুধু যে দীনবন্ধু মিত্রের ঘটেছিল তা নয়, বাংলার বুদ্ধিজীবীরা বেশ ব্যাপকভাবে নীলবিদ্রোহের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন, নীলকরদের অত্যাচার এবং সাহেবদের বিচার ব্যবস্থার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
নাটকের বিষয়বস্তুর মধ্যে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, যেভাবে কৃষকদের শত্রু বা প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তাতে করে বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখে লজ্জা পেয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে কৃষকদের সাথে তাদের বিচ্ছিন্নতা তাদের নতুন ভাবনায় উদ্দীপ্ত করেছে। বিশেষ করে একদল ইংরেজ পাদ্রী ও আমলা নীলবিদ্রোহে কৃষকদের পক্ষ নেওয়ায় তাদের মনে নিজেদের সম্পর্কে ধিক্কার জেগেছে। তাঁদের মানসিকতায় পরিবর্তন এনেছে। যেখানে ম্যাজিস্ট্রেট এশলে ইডেন এবং খোদ গভর্ণর গ্র্যাণ্ট নীলকরদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, সেখানে বাংলার বুদ্ধিজীবীদের দূরে সরে থাকা সম্ভব ছিল না। বাংলার ইংরেজদের এক অংশ নীলকরদের বিরোধিতা করেছিল ব্রিটিশ শিল্পপতির স্বার্থে। কারণ বাংলা থেকে ব্যাপক পরিমাণ নীল রপ্তানীর ফলে বহু ইংরেজের ব্যবসা ধ্বংস হতে বসেছিল। ইংল্যান্ডের সংসদের এ নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল। বাংলার বুদ্ধিজীবীরাও সেই বিরোধিতায় অংশ নেয়। নিজেরা এও অনুভব করতে পেরেছেন, বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন ছাড়াই কৃষকরা ইংরেজদের বাধ্য করেছে নীলচাষ বন্ধ করতে। নিজেরা সেই আলোড়নকারী ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারেননি সেটাও তাদের অহংঙ্কারে লেগেছিল। নীল বিদ্রোহ এবং নীলদর্পণ নাটকের বিভিন্ন রকম ঘটনার ধাক্কায় বুদ্ধিজীবীদের মানস পাল্টায় যা পরে তাঁদেরকে ধীরে ধীরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দিকে নিয়ে যাবার পথ প্রস্তুত করে।
দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটক সর্বপ্রথম ঢাকা নগরীতেই মঞ্চস্থ হয়। নীলদর্পণ নাটক আঠারশো ষাট সালে লেখা হয় এবং ঢাকাতে আঠারশো একষট্টি সালে তা প্রথম মঞ্চায়িত হয়। পরের দুই বছর বিপুল উদ্দীপনার সাথে ঢাকার বিভিন্ন পাড়ায় নাটকটি অভিনীত হতে থাকে। নীলদর্পণ নাটক সমগ্র বাংলাদেশে জাতীয় জাগরণের এক অপূর্ব সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ঢাকার রঙ্গভূমিতে পুনঃপুনঃ এই নাটক অত্যন্ত সাফল্যের সাথে অভিনীত হওয়ায় নীলকরদের অসহনীয় অত্যাচার সম্বন্ধে জনসাধারণের চক্ষু খুলে গেল এবং তাতে করেই বাংলার একপ্রান্ত থেকে আর একপ্রান্ত পর্যন্ত জাতীয় আন্দোলনের ঢেউ লাগে। নীলদর্পণ নাটক কলকাতায় প্রথম ন্যাশনাল থিয়েটার কর্তৃক মঞ্চস্থ হয় আঠারশো বাহাত্তর সালে। দর্শনীর বিনিময় হার রাখা হয় এক টাকা এবং আট আনা। পরবর্তীতে আঠারশো তিয়াত্তর সালের জুন মাসে কলকাতার হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার ঢাকায় নীলদর্পণ নাটকটি মঞ্চস্থ করে। পত্রিকার বিজ্ঞাপন অনুযায়ী ঢাকার দর্শনীর হার ছিল চার টাকা, দুই টাকা, এক টাকা এবং আট আনা। লক্ষণীয় ঢাকার দর্শনীর হার ছিল উচ্চ।
নীলদর্পণ নাটকের ব্যাপক প্রভাব সম্পর্কে শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন, ‘নাটকখানি বঙ্গ সমাজে কি মহা উদ্দীপনার আবির্ভাব
করিয়াছিল, তাহা কখনও ভুলিব না। আবাল বৃদ্ধ বনিতা আমরা সকলেই ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া গিয়াছিলাম। ঘরে ঘরে সেই কথা, বাসাতে বাসাতে তার অভিনয়। ভূমিকম্পের ন্যায় বঙ্গদেশের সীমা হইতে সীমান্ত পর্যন্ত কাঁপিয়া যাইতে লাগিল। এই মহাউদ্দীপনার ফলস্বরূপ নীলকরের অত্যাচার জন্মের মত বঙ্গদেশ হইতে বিদায় লইল।’ শিবনাথ শাস্ত্রীর বক্তব্য যথার্থ নয়। যদিও মম্মথ রায় শিবনাথ শাস্ত্রী উদ্ধৃতি প্রসঙ্গে বলেন, ‘একটি জাতির জীবনে একটিমাত্র নাটক কতদূর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, কাম্য ফলকে কতো অনিবার্য করে তুলতে পারে, একটি নাটক কেমন করে অর্থ ও অস্ত্রসজ্জিত অত্যাচারী শাসককে পরাভূত করতে পারে নীলদর্পণ প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়ের এই সাক্ষ্য স্মরণীয়।’ নীলচাষ রোধে নীলদর্পণ নাটকের কোনো ভূমিকা নেই যা শিবনাথ শাস্ত্রী বলছেন। কারণ নীলবিদ্রোহ সংগঠিত হবার পরই নীলদর্পণ নাটক রচিত হয়। ঢাকার বাইরে কোথাও বাহাত্তর সালের আগে এই নাটক মঞ্চস্থ হয়নি। কলকাতার ন্যাশনাল থিয়েটার এই নাটক মঞ্চস্থ করে আঠারশো বাহাত্তর সালে। তার বহুপূর্বেই নীলচাষ বন্ধ হয়। নীলচাষ বন্ধে কোনো কৃতিত্ব তাই নীলদর্পণ নাটকের নেই। বরং বলা যায় নীলচাষ বন্ধ হয়ে গেল, নীলবিদ্রোহ সফলতা লাভ করল কিন্তু নীলদর্পণ নাটকে দেখা যাবে সে-সব ঘটনার বিন্দুবিসর্গ নাই।
নীলদর্পণ নাটকের গল্প কিভাবে আগাচ্ছে দেখা যাক। স্বরপুরগ্রামের বাসিন্দা গোলকচন্দ্র বসু সম্পন্ন গৃহস্থ। তিনি বয়সে প্রবীণ এবং অত্যন্ত নীরিহ প্রকৃতির লোক। তার পৈত্রিক জমিজমা যা আছে তাতে সারাবছর সংসার ভালোভাবে চলে যায় এবং অতিথি সেবাও চলে। স্ত্রী, দুই পুত্র এবং দুই পুত্রবধূ নিয়ে তাঁর সংসার। কিন্তু নীলকরদের অত্যাচারে সে এবং গ্রামের অন্যান্যরা অতিষ্ঠ হয়ে আছে। নীলকরদের নির্দেশে গত বছর সে পঞ্চাশ বিঘা জমিতে নীল চাষ করতে বাধ্য হয়। নীলকররা গত বছরে পাওনা টাকা শোধ না করেই এইবছর ষাট বিঘা জমিতে নীল চাষ করার হুকুম দিয়েছে। শুধু তাই নয়, যে পুকুরে গৃহের মেয়েরা স্নান করে সে পুকুরের পাড়েও নীল চাষ করার নির্দেশ রয়েছে। নীলদর্পণ নাটকের এই বক্তব্য মিথ্যা নয়। নীলকররা কিভাবে জোর করে চাষীদের দিয়ে নীলচাষ করায় তার একটি মর্মস্পর্শী বিবরণ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার আটাশি সংখ্যায় পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়, নীল চাষ করা চাষীদের ইচ্ছা নয়, বলপূর্বক তাদের দিয়ে এ কাজ করানো হয়। নীলকররা নীলবীজ বপন করার জন্য চাষীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভাল ভূমি নির্দিষ্ট করে দেয়। কখনো কখনো এমনও ঘটে, চাষী ধান চাষের জন্য কোনো উৎকৃষ্ট ক্ষেত্রসমূহ সুচারুরূপে কর্ষণ করে রেখেছে, নীলকরের লোকরা এসে সেখানে জোর করে নীলের বীজ বপন করে যায়। নীল উৎপাদন করার পরেও চাষীর নিস্তার নেই। নীলকর সাহেবরা তাদের ন্যায্য দামের অর্ধেক প্রদান করতেও রাজী হয় না। নীলকুঠিতে যখন চাষী নীল নিয়ে আসে তখনও তাদের পীড়ন করা হয়। পঁচিশ মন নীল খাতায় পাঁচ মন লেখা হবে এই ভয় দেখিয়ে কুঠির দেশীয় ভদ্রলোক আমলারা টাকা আদায় করতে ছাড়ে না। পল্লীগ্রামে নীলকুঠির সাথে সংশ্লিষ্ট ভদ্রলোক আমলাদের এক-একটা অত্যাচারী গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, গ্রামের শান্ত ও নিরীহ লোকজন তাদের সাক্ষাৎ যমদূত মনে করে। প্রভাকরের সংবাদ থেকে বোঝা যায় নীলকুঠির দেশীয় কর্মকতারাও কম নিষ্ঠুর নয়। তারাও নীলকরদের পক্ষে প্রজাদের উপর নানারকম অত্যাচার চালায়।
নাটকে দেখা যায় গোলক বসুর প্রতিবেশি নিম্নবিত্ত সাধুচরণের অবস্থা আরো খারাপ। ধান চাষ করার জন্য তার ভ্রাতা রাইচরণ যে জমিটুকু চাষ করেছিল নীলকুঠির আমিন নিজে এসে সেই উৎকৃষ্ট জমিতে নতুন করে দাগ দিয়ে নীল চাষ করবার হুকুম দিয়েছে। রাইচরণ এ নিয়ে প্রশ্ন তোলায় এবং নীলকরদের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা বলায় কুঠির লোকরা সামান্য পরে এসে দুভাইকে ধরে নিয়ে যায়। সাধুচরণ যতো নিজের সমস্যা বোঝাতে চায় নীলকর উড তা বুঝতে নারাজ। সাধুুচরণ বলে নীলকরদের সাথে তার বিরোধ করার ইচ্ছা ও ক্ষমতা কোনোটাই নেই। কিন্তু ধান চাষ না করে শুধু নীল চাষ করলে তাদের না খেয়ে মরতে হবে। বাঙালী দেওয়ান উডকে উস্কে দেয় সাধুচরণের বিরুদ্ধে এবং আমিন বলে, বেটা সাহেবের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা করতে চায়। সাধুর কোনো কথা উড শোনে না। নীলকুঠিতে অভুক্ত রাইচরণকে উড নিজ হাতে চাবুক মারে। রাইচরণ ভাইকে বলে, দাদা যা বলছে লিখে দে, ক্ষুধায় নাড়ী ছিঁড়ে পড়ছে। নবীনমাধব খবর পেয়ে সাধুচরণ-রাইচরণের হয়ে উড সাহেবকে অনুনয় করতে আসে। সাহেব নবীনকে নিজের চরকায় তেল দিতে বলে সাধুচরণকেও চাবকাতে শুরু করে। উড নবীনকেও গালাগাল করতে ছাড়ে না। দেওয়ান নবীনকে মানসম্মান নিয়ে চলে যেতে বলে। নবীন বাধ্য হয়ে ফিরে আসে। উড দুভাইকে দিয়ে যা খুশি লিখিয়ে নেয়।
নবীনমাধব গোলকচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র, সে পিতার বাধ্যগত। সে নীলকরদের সাথে বিরোধে লিপ্ত হতে চায়, মামলা মোকদ্দমায় যেতে চায় কিন্তু নির্বিরোধ এবং নীলকরদের ভয়ে ভীত পিতার নির্দেশে তা করতে পারে না। নীলকুঠির দেওয়ান গোপীনাথ নীলকরদের বোঝায়, নবীন নীলকুঠির প্রধান শত্রু; কারণ সে নীলকরদের বিরুদ্ধে চাষীদের দরখাস্ত লিখে দেয়, মোক্তারদের এমন পরামর্শ দেয় যে হাকিমের রায় কৃষকদের পক্ষে যায়। নবীন গরীবদের রক্ষক হয়েছে। নীলকররা তাই নবীনকে উচিৎ শিক্ষা দেবার জন্য তার পিতা গোলকচন্দ্রের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে। নীলকররা স্থানীয় চাষীদেরকে কুঠিরে ধরে এনেছে গোলকচন্দ্রের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে। মুসলামান তোরাপ সাক্ষ্য দিতে রাজী হয় না। ভিন্ন একজন চাষী বলে, সাহেবদের লাথি আর চাবুকের বাড়ি খেয়ে সে স্বাক্ষী দিতে রাজী হয়েছে। নইলে গোলকবাবুর নুন তো সেও খেয়েছে কিন্তু সাহেবেদের অত্যাচারের ভয়ে স্বাক্ষী না দিয়ে উপায় কি? তোরাপ বলে সে জীবন গেলেও গোলকচন্দ্রের বিরুদ্ধে মিথ্যা স্বাক্ষী দেবে না। রাইয়তদের একজন দুঃখ করে স্থানীয় ভাষায় যা বলে তার অর্থ, খোদ গভর্নর যেখানে নীলকরের জামাই সেজে ভোজসভায় উপস্থিত হয় সেখানে কৃষকদের ন্যায়বিচার পাবার কোনো উপায় নেই। সামান্য পরেই চাবুক হাতে বের হয়ে আসে নীলকর রোগ সাহেব। তোরাপ মিথ্যা স্বাক্ষী দিতে রাজী নয় জেনে রোগ তাকে চাবকাতে থাকে। তোরাপ মারের হাত থেকে বাঁচার জন্য চালাকি করে স্বাক্ষী দিতে রাজী হয়, পরে নীলকুঠির বন্দীদশা থেকে পালিয়ে আসে। নীলদর্পণ নাটকের দুই ইংরেজ নীলকর চরিত্র বঙ্গ নাট্যশালায় বুর্জোয়া সমাজের, সাম্রাজ্যবাদের প্রথম প্রতিনিধি। দীনবন্ধু তাদের দানবীয় চেহারাই নাটকে তুলে ধরেছেন।
সাধুচরণের একমাত্র কন্যা ক্ষেত্রমণি, সে বিবাহিত এবং অন্তঃসত্ত্বা। ক্ষেত্রমণি নীলকুঠির আমিনের নজরে পরে। এই আমিন নিজের বোনকে নীলকরদের হাতে তুলে দিয়ে আমিনের চাকরি পেয়েছে। সে ভাবে ক্ষেত্রমণিকে যদি নীলকর রোগ সাহেবের হাতে তুলে দেয়া যায় তার আরো উন্নতি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। নীলকুঠির রোগ সাহেব লম্পট হলেও উড সাহেবের চরিত্রটা লম্পটের নয়, সে চায় মুনাফা। শুধু নীল ব্যবসায় তার আগ্রহ। সেজন্য রোগের লাম্পট্য তার পছন্দ নয়। কিন্তু আমিন রোগ সাহেবের দুর্বলতা নিজের স্বার্থে কাজে লাগাতে চায়। পদী ময়রাণীকে পাঠানো হয় ক্ষেত্রমণিকে রাজী করানো জন্য। ক্ষেত্রমণি এই কুপ্রস্তাবে রাজী না হলে তাকে জোর করে নীলকর সাহেবের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। ক্ষেত্রমণি রোগ সাহেবের কথায় রাজী না হয়ে তাকে ভর্ৎসনা করলে রোগ ক্ষেত্রমণির পেটে ঘুষি মেরে তার চুল টেনে ধরে। ঠিক তখনি, ক্ষেত্রমণির সতীত্ব হরণের সামান্য আগে নবীন ও তোরাপ সেখানে পৌঁছে তাকে মুক্ত করে নিয়ে আসে। নীলদর্পণ নাটকে নীলকরদের দ্বারা নারীহরণ ও নারীর উপর নীলকরের যে অত্যাচারের কাহিনী সন্নিবেশিত করা হয়েছে তা একটি সত্য ঘটনা। যশোরের কাচিকাটা কুঠির ব্যবস্থাপক অর্চিবল্ড হিলের দ্বারা এটা ঘটেছিল। এই ঘটনা হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেজন্য হিল হরিশচন্দ্রে বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করে। ম্যাজিস্ট্রেট এই মামলায় হিলের পক্ষ নেয়। এই মামলা চলাকালে হরিশচন্দ্র হঠাৎ মারা গেলে তার স্ত্রীর নামে মোকদ্দমা চলেছিল। হরিশচন্দ্রের অসহায় স্ত্রী অনন্যোপায় হয়ে এক হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে এই মামলা নিষ্পত্তি করতে বাধ্য হন। নীলদর্পণ নাটকে ক্ষেত্রমণির উপর উডের আত্রমণাত্মক ভূমিকা দেখানো হলেও শেষপর্যন্ত নাট্যকার ক্ষেত্রমণির সতীত্ব রক্ষা করেন। নাট্যকার এখানে বাস্তববাদী না হয়ে নারীর সতীত্বের সংস্কারকে গুরুত্ব দেন এবং অকস্মাৎ তোরাপের আগমনে ক্ষেত্রমনির সতীত্ব রক্ষা পায়।
দীনবন্ধু মিত্র রচিত নীলদর্পণ নাটকের বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে সোমনাথ পত্রিকার একজন গ্রাহক বারোশো উনসত্তর সালের চব্বিশে ভাদ্র সংখ্যায় লিখছেন, ‘নীলদর্পণের বর্ণনায় যদি কোন মহাত্মার সন্দেহ থাকে, তবে বারেক এ প্রদেশে আগমন করিয়া নীলকরের অত্যাচার ও বিচার প্রণালী ও অস্মদের অবস্থা ক্ষণকাল অবলোকন করলেই বর্ণিত পুস্তকের একটি কথার প্রতিও অবিশ্বাস করিবার অনুমাত্র কারণ থাকিবে না।’ দীনবন্ধু সত্যিই তাঁর বর্ণনায় কোনো বাড়াবাড়ি করেননি। নীলকরদের দ্বারা যে-সব অন্যায় হয়েছে তিনি তাই সততার সাথে নাটকে চিত্রিত করেছেন। তিনিই ইংরেজদের বিচারের প্রহসন বাংলা সাহিত্যে প্রথম তুলে ধরেন। ইংরেজ শ্বেতাঙ্গরা কিভাবে বিচারকে নিজেদের পক্ষে প্রভাবিত করে তার বর্ণনা দেন নাট্যকার। নাটকে উড সাহেব খুব তৃপ্তির সাথেই বলেন কৃষকরা আদালতে গেলে সুবিচার পাবে না।
নীলকরদের বিরুদ্ধে মামলা করে রাইয়তদের কোনো লাভ হবে না। মামলা পাঁচ বছর ধরে ঝুলতে থাকবে। নাটকে উডের সংলাপ, ‘মোকদ্দমা কিছু হইবে না, এ ম্যাজিষ্ট্রেট বড় ভাল লোক আছে। দেওয়ানী করলে পাঁচ বছরে মোকদ্দমা শেষ হোবে না। ম্যাজিষ্ট্রেট আমার বড় দোস্ত।’
নীলকরদের পক্ষ থেকে গোলক বসুর বিরুদ্ধে সত্যি সত্যি মিথ্যা মামলা করা হয়। ইন্দ্রবাদের আদালতে বিচারক শুনানীতে বসেছেন। নাটকের আদালতের দৃশ্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশের শাসন ব্যবস্থা এবং দেশীয় শিক্ষিতদের তোষামদকারীদের চরিত্রটি খুব চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। বাংলা নাটকে আদালতের দৃশ্য খুবই কম দেখা যায়। খুব বাস্তবসম্মতভাবে নাট্যকার আদালতের দৃশ্যটি তুলে ধরেছেন যার সাথে তৎকালীন সংবাদপত্র বা বিভিন্ন দলিলের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে মোক্তারের সংলাপে ব্রিটিশ শাসনে ভদ্রলোকদের মানসিকতার ছাপ স্পষ্ট। মোক্তার বলছে, ‘ধর্মাবতার মোক্তারগণের বৃত্তিই প্রতারণা। কিন্তু নীলকরের মোক্তারদিগের দ্বারা কোনরূপ কোন প্রতারণা হইতে পারে না। নীলকর সাহেবরা খ্রীষ্টিয়ান.; খ্রীষ্টিয়ান ধর্মে মিথ্যা অতি উৎকট পাপ বলিয়া গণ্য হইয়াছে, পরদ্রব্য অপহরণ, পরনারীগমন, নরহত্যা প্রভৃতি জঘন্য কার্য খ্রীষ্টিয়ান ধর্মে অতিশয় ঘৃণিত, খ্রীষ্টিয়ান ধর্মে অসৎ কর্ম নিষ্পন্ন করা দূরে থাক্ মনের ভিতরে অসৎ অভিসন্ধিকে স্থান দিলেই নরকানলে দগ্ধ হইতে হয়। করুণা, মার্জনা, বিনয়, পরোপকার খ্রীষ্টিয়ান ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য, এমন সত্য সনাতন ধর্মপরায়ণ নীলকরগণ কর্তৃক মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া কখনই সম্ভব না।’ যখন নীলকররা গোলকচন্দ্র বসুর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে এনেছে, ঠিক তখনই বাঙালী শিক্ষিত মোক্তার আদালতকে খ্রীষ্টান ধর্মের ন্যায়পরায়ণার কথা শোনাচ্ছে। চোখ-কান-নাক দিয়ে সে মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছে। বাংলার শিক্ষিত সমাজের এই হয়েছে হাল। ইন্দ্রাবাদের আদালতের দৃশ্যে দেখা যায় ম্যাজিস্ট্রেট ও উড পাশাপাশি বসে হাসি মস্করা করছে এবং পাশাপাশি গোলক বসুর প্রহসনমূলক মামলার বিচার চলছে। কিন্তু এর পরেই দেখা যাবে নাটক মূল লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে ভিন্ন পথে হাঁটতে শুরু করে।
নাটকের ঘটনাগুলো এরপর খুব দ্রুত ঘটতে থাকে। নীলচাষ বা নীলবিদ্রোহ আর আলোচনায় থাকে না। দুটো পরিবারের দুঃখ বেদনা নাটকের প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মিথ্যা মামলার মুখোমুখি হয়ে কারারুদ্ধ হয় গোলক বসু। ভিন্ন জাতের হাতে কিছু খাবে না বলে সে তিনদিন উপোষ থাকে। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট পাচক ব্রাহ্মণকে রান্নার জন্য জেলে ঢুকবার অনুমতি দিচ্ছে না। এর মধ্যে খবর আসে গোলকচন্দ্র গলায় দড়ি দিয়ে জেলখানার ভিতর আত্মহত্যা করেছে। পিতার সৎকারের পর পিতার শ্রাদ্ধ শেষ করে নবীন গ্রাম ছেড়ে চলে যাবার সংকল্প করে। কিন্তু তার আগে পুকুরপাড়ে নীল বুনলে নারীদের সম্ভ্রম থাকে না। সেজন্য নীলকুঠির সাহেবদের হাতে পায়ে ধরে নবীনমাধব পিতৃশ্রাদ্ধের দিন পর্যন্ত পুকুরপাড়ে নীলচাষ বন্ধ রাখতে বলে। এতে সাহেবরা তাকে উল্টো অপমান করে। নবীন অপমান সহ্য করতে না পেরে সাহেবের বুকে পদাঘাত করলে সাহেবের লোকরা ইচ্ছামতো নবীনকে মারধর করে। নবীনকে তলোয়ারের কোপে হত্যাই করা হতো কিন্তু তোরাপ মাঝখানে গিয়ে বাধা দিলে তোরাপের বাম হাত কেটে গিয়ে নবীনের বুকে শুধু তরবারির খোঁচা লাগে। তোরাপের সাহায্যে নবীনকে অজ্ঞান অবস্থায় গৃহে আনা হয় এবং সে প্রাণ হারায়। বিদ্রোহ করতে গিয়ে নয়, বরং নীলকুঠি সাহেবের দয়া চাইতে গিয়ে আকস্মিক উত্তেজনাই নবীনের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এদিকে সাধুচরণের বাড়িতে ভিন্ন ঘটনা ঘটে। নীলকর রোগ সাহেবের ঘুষির আঘাতে ক্ষেত্রমণির পেটের সন্তান নষ্ট হয় এবং ক্ষেত্রমণিও এই ঘটনায় মারা যায়।
নাটকের ঘটনা এরপর আরো দ্রুত এবং অস্বাভাবিক গতিতে ঘটতে থাকে। নবীনের মৃত্যুতে তার মা সাবিত্রী উন্মাদ হয়ে প্রথমে মৃত নবীনের মুখে নিজের স্তন তুলে দিয়ে দুগ্ধ পান করতে বলে। সাবিত্রীর এরপরের সংলাপ নাটককে পাগলামীর পর্যায় নিয়ে যায়। সাবিত্রী উন্মাদ অবস্থায় তারপর যা করে তাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। নিজ কনিষ্ঠ পুত্রবধূ সরলতার গলায় পা দিয়ে তাকে হত্যা করে। সরলতার মৃত্যুর ব্যাপারটা খুবই অবাস্তব লাগে। উন্মাদিনী সাবিত্রী দুই হাতে সরলতার গলা টিপে ধরে ভূমিতে ফেলে দেয়, তারপর গলায় পা দিয়ে দণ্ডায়মাণ হয়। তারপর গলার উপর নৃত্য করতে করতে সরলতার মৃত্যু ঘটায়। সরলতাও শাশুরীর ইচ্ছায় কোনো বাধা দেয় না, মৃত্যু বরণ করে। খুবই হাস্যকর এবং অবিশ্বাস্য একটি দৃশ্য। সহসা সাবিত্রীর জ্ঞান ফিরলে যখন বুঝতে পারে সে আপন পুত্রবধূকে হত্যা করেছে তখন আকস্মিক মানসিক আঘাতে তারও মৃত্যু ঘটে। সাবিত্রীর মৃত্যুও যেমন আকস্মিক তেমনি অস্বাভাবিক। সরলতার এবং সাবিত্রীর মৃত্যু খুবই কৃত্রিমভাবে প্রকাশ পেয়েছে। নাটকের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা এই শেষ অংশটুকু। খুবই অতিনাটকীয়তায় ভরা। গোলকচন্দ্রের কনিষ্ঠ পুত্র বিন্দুমাধব ফিরে এসে নিজের স্ত্রী এবং মায়ের মৃত্যুর কারণ জেনে মায়ের মৃত্যুতেই যেন অধিক কষ্ট পায়। সব ঘটনা দেখে নবীনমাধবের স্ত্রী স্বামীর সাথে সহমরণে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। বিন্দুমাধবের বিলাপের মধ্য দিয়ে নাটকটির এভাবেই সমাপ্তি হয়। সতীদাহ যখন নিষিদ্ধ হয়ে গেছে তখন নাট্যকারের এ বক্তব্য সতীদাহর পক্ষে য়ায়। নারীরা স্বামীর সঙ্গে সহমরণ পছন্দ করে, নাট্যকার যেন তাই বোঝাতে চান।
নাট্যকার যে উদ্দেশ্য নিয়ে নাটক রচনা আরম্ভ করেছিলেন, রচনার পথে কিছুদূর অগ্রসর হয়েই তিনি সে লক্ষ্য হতে সরে দাঁড়ালেন। কিংবা বলা যায় লক্ষ্য পথ ভ্রষ্ট হলেন। দীনবন্ধু কৃষকদের উপর নীলকরদের অত্যাচারের একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরতে নাটক রচনা আরম্ভ করলেও নাটকের পরিণতি পর্যন্ত সে লক্ষ্যে স্থির থাকতে পারেননি। নাটকের ঘটনা নীলবিদ্রোহ থেকে সরে গিয়ে দুটি পরিবারের দুঃখকষ্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল এবং একটি পরিবারের করুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলতে নাট্যঘটনা অতিনাটকীয়তার আশ্রয় নিল। নাটকের কাহিনী যখন বৃহত্তর সমাজকে পরিত্যাগ করে পারিবারিক করুণ রসে পরিণত হলো দীনবন্ধু তখন আর উদ্দেশ্যমূলক রচনার লক্ষ্যে স্থির রইলেন না। নাটকের পরিণতিতে মৃত্যুর যে ঘনঘটা দেখা যায় তা খুবই অবাস্তবভাবে উপস্থিত করা হয়েছে। ক্ষেত্রমণি ছাড়া আর কোনো মৃত্যুই কাহিনীর সুদীর্ঘধারার অনিবার্য পরিণতিরূপে সংঘটিত হয়নি, যা নীলকরদের অত্যাচারের ফল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। শেষ কয়েকটি দৃশ্যে নাট্যকার নীল বিদ্রোহকে গুরুত্ব দেয়ার চেয়ে নাটককে করুণ রসে সিক্ত করতে অধিক মনোযোগ দিয়েছেন। নাটকের বলিষ্ঠ চরিত্র ছিল তোরাপ কিন্তু সেই চরিত্রটি কোনো পূর্ণ রূপ পায়নি। নীলদর্পণ নাটকে মৃত্যুর আধিক্য নহে, মৃত্যুর যে কারণ দেখানো হয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয়। বিশেষ করে শেষ দুটি মৃত্যু।
বিভিন্ন চরিত্রের আকস্মিক মৃত্যু নাটককে পূর্ণ পরিণতি না দিয়ে নাটকের রসকে বিক্ষিপ্ত করেছে। নাটকটি জীবন ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠবার সুযোগ পায়নি। প্রথমে গোলক বসু পরে নবীনমাধব, ক্ষেত্রমণি, সরলতা ও সাবিত্রীর মৃত্যু নাটককে কোনোভাবেই পূর্ণতা দিতে পারেনি। আশুতোষ ভট্টাচার্যের ভাষায়, নাটকে কোনো কৃষকের মৃত্যু সংঘটিত হয়নি, তাতে করে কোনো কৃষকচরিত্র প্রাধান্য লাভ করতে পারেনি। বরং তার পরিবর্তে নিরীহ কায়স্থ পরিবারের লোকজনের মৃত্যু দেখানো হয়েছে। ক্ষেত্রমণির মৃত্যুও যেভাবে হয়েছে তার সাথে কৃষিকমের্র কোনো সম্পর্ক নেই। নীলদর্পণ নাটকে ব্যাষ্টিক সমস্যা অপেক্ষা সমষ্টির সমস্যা ফুটিয়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে নাটকের যাত্রা শুরু হয়। নাটক শেষপর্যন্ত আর সেখানে থাকতে পারেনি। নাটকের ঘটনা প্রধানত দুটি পরিবারের ভিতরেই অন্তর্ভুক্ত ছিল। মধ্যবিত্তের সংকীর্ণ মূল্যবোধ দীনবন্ধুকে বহুভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। সতীত্বের মোহ, গ্রামীণ সামন্ত সমাজের প্রচলিত বিশ্বাস তার নাটকের পরতে পরতে তাই পাখা মেলতে দেখি। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আনুগত্য এই সকল মূল্যবোধকে তিনি নাটকে খুব যত্নের সাথে স্থান দেন এবং তা করতে গিয়ে নাটকের সর্বনাশ ডেকে আনেন।
উৎপল দত্ত লিখছেন, নীলদর্পণে বসুদের নায়কের স্থানে মেনে নিতে আমাদের প্রাথমিক কোনও আপত্তিই থাকত না; যদি গোলক, নবীন ও বিন্দুমাধবে আস্ত নীলবিদ্রোহ প্রতিফলিত হতো। তিনি আরো লিখছেন, ‘নীলকর সাহেবদ্বয় এবং তাদের কর্মচারীবৃন্দ; গোপী, আমিন ইত্যাদি; এঁরা হচ্ছে নাটকের নেতিবাচক শক্তি। এঁরা নীল-উৎপাদন ও ব্যবসাকে বাঁচিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। তার জন্যে যে কোনও জুলুম-জবরদস্তি তারা করতে প্রস্তুত। কিন্তু নেতির শক্তি কোথায় দেখছি? বসু পরিবারের মধ্যে কি নীলের ব্যবস্থাকে ওলট-পালট করে দেওয়ার তেজ ও উদ্যম মুহূর্তের জন্যও পরিলক্ষিত হয়? সেই তেজ দেখি তোরাপের মধ্যে।’ তিনি আরো লিখছেন, নাট্য কাঠামো তবু ভারসাম্য পেতে পারত যদি নীলবিদ্রোহের আগুনে পুড়ে বসু-পরিবার পরিবর্তিত হতো, নাটকটা যদি হতো তাদের মানসিক বিকাশের ইতিবৃত্ত। দীনবন্ধু তাঁর নির্বাচিত চরিত্রদের বাস্তব ক্ষুদ্রতা দ্বারা সীমিত হয়ে রয়েছেন। তাদের অকিঞ্চিতকর জীবনধারায় মনোনিবেশ করতে গিয়ে নাটককে পঙ্গু করে ফেলেছেন। নীলদর্পণের শেষ দুই অঙ্ক জুড়ে শুধু নারী চরিত্রদের আহা! আহা! প্রাণনাথ এবং আহা! এইসব আর্তনাদে মুখর। সেই সঙ্গে মূর্ছা এবং পতন ও মৃত্যু। অথচ দর্শকদের হৃদয় দ্রবীভূত হয় না, কেননা যে গোলক ও নবীনমাধবের জন্যে এই রোদন, তাঁরা মৃত্যুর পূর্বে নাটকে বীরের ভূমিকা পালন করেননি; বস্তুত এমন কিছু করেননি যার জন্য দর্শকদের সমবেদনার জমি প্রস্তুত হবে। উৎপল দত্ত সঠিক কথাই বলেছেন।
নীলদর্পণ নাটকের চরিত্রগুলি দুভাগে বিভক্ত; অত্যাচারী ও অত্যাচরিত। কিন্তু কোনো অত্যাচারীর চরিত্র সমগ্র নাটক জুড়ে নেই। নাটকের চরিত্র সৃষ্টি সম্পর্কে সুন্দর কথা বলেছেন আশুতোষ ভট্টাচার্য। তিনি দেখিয়েছেন, ভদ্রশ্রেণীর চরিত্র সম্পর্কে দীনবন্ধুর অভিজ্ঞতার অভাব না থাকলেও তিনি চরিত্রগুলোকে যথাযথ চিত্রিত করতে পারেননি। সকলের মধ্যে তিনি শুধু আদর্শ গুণেরই সন্ধান করেছেন; রক্ত মাংশের মানুষের যে-সকল ভুল-ভ্রান্ত-বিচ্যুতি থাকে তা থেকে চরিত্রগুলোকে দূরে রেখেছেন। চরিত্রগুলো কেবলই ভাল আর ভাল। পুত্রের প্রতি পিতার স্নেহ, পিতার প্রতি পুত্রের কর্তব্যবোধ, ভ্রাতার প্রতি ভ্রাতার মমতা, সন্তানের প্রতি মাতার বাৎসল্য, শাশুড়ীর প্রতি পুত্রবধূর শ্রদ্ধা, জায়ের প্রতি জায়ের ভক্তি ও স্নেহে একই পরিবারের প্রত্যেকটি চরিত্রই আদর্শ। দোষে গুণে যে মানুষের জীবন নিত্য নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, ক্ষুদ্র ইর্ষা ও স্বার্থবোধ দ্বারা যে জীবন নিত্য পীড়িত, গোলক বসুর পরিবারের কারো মধ্যে তা দেখা যায় না। এরূপ একদেশদর্শী দৃষ্টি দ্বারা চরিত্র সৃষ্টি সার্থক হয় না, সুতরাং নাট্যকার চরিত্রগুলিকে প্রাণহীন পুত্তলিকায় পরিণত করেছেন। চরিত্রে প্রাণ সঞ্চার করতে পারেননি। কিন্তু এ নাটকের পদী ময়রাণীর চরিত্রটি সত্যিই অনাবদ্য সৃষ্টি। তার চরিত্র অতি ঘৃণিত, তথাপি তার মধ্যে একটি শ্বাশত মানবিত গুণাবলী উপস্থিত। নীজের কাজের নীচতা সম্পর্কে সে অসচেতন নয়, কিন্তু বাধ্য হয়ে তাকে এ পথে আসতে হয়েছে। যতোই খারাপ হোক সে তার হৃদয় বিসর্জন দেয়নি। ক্ষেত্রমণিকে সে বাঁচাবার চেষ্টা করে। ক্ষেত্রমণি পদী ময়রাকে পিসি বলে ডাকে, পদী সেই স্নেহের ক্ষেত্রমণিকে বাঘের মুখে দিতে চায় না। কিন্তু সে নিতান্ত অসহায়, রোগ সাহেবের লালসার দৃষ্টি থেকে সে ক্ষেত্রমণিকে রক্ষা করার উপায় জানে না।
দুর্বল হতদরিদ্র মানুষ ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তকে দিয়ে হেন কোনো পাপকর্ম নেই যা সাহেবরা করিয়ে নিচ্ছে না। ইংরেজদের চাকরি ছিল যাদের পরম গৌরব, দেখা গেল তারা নিজ জাতির শত্রু। গোপী-আমিন-পেশকার-দেওয়ানের নির্মমতার মূল এইখানে; এরা দেশের মানুষের প্রতি সহজাত সমবেদনাটা হারিয়ে ফেলেছে। গোপী হঠাৎ নিজেই বসু পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা রুজু করার জন্য অনুতাপ প্রকাশ করে বলে, ‘মিথ্যা মোকদ্দমা করে মানী মানুষটাকে নষ্ট করলাম। নবীনের শিরঃপীড়া আর নবীনের মার এই মলিন দশা শুনে আমি বড় ক্লেশ পাইয়াছি।’ গোপী অনুতাপ করতেই ব্যঙ্গ করে গোপ বলে, ‘ব্যাঙের সর্দি!’ শিক্ষিত মধ্যবিত্তের চেহারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন গোপ আরো বলে, ‘সাহেবরাই সব কত্তি নেগেছে। সাহেবরা কামার, আপনারা খাঁড়া। যেখানে পড়ায় সেখানে পড়ে!’ নাটকের এই সব বিশ্লেষণ সত্যিই চমৎকার। নাট্যকারের শক্তির পরিচয়। মধ্যবিত্তের চরিত্র ও অবস্থার আরো চমৎকার বিশ্লেষণ দেন নাট্যকার যখন বিপর্যস্ত গোপী বলে, ‘ধর্মাবতার, গালাগালি খেতেও আমরা, পয়জার খেতেও আমরা, শ্রীঘর যেতেও আমরা, কুটিতে ডিসপেনসারি স্কুল হলেই আপনারা, খুন গুমি হইলেই আমরা।’ নীলকণ্ঠের মতন সাহেবদের সব পাপ গলাধঃকরণ করে এক একজন দানব তৈরি হচ্ছে, এই সত্য নাট্যকারের চোখ এড়ায়নি। গোপী নিজে এই সত্যটাকে আরো স্পষ্ট করে যখন বলে, ‘আমরা হুজুর কসায়ের কুকুর, নাড়িভুঁড়িতেই উদর পূর্ণ করি।’ নাটকে চমৎকারভাবে মধ্যবিত্তের চরিত্র বিশ্লেষণ করছেন নাট্যকার। কিন্তু ঘটে যাওয়া নীলবিদ্রোহ সম্পর্কে একটা বাক্য উচ্চারণ করছেন না।
দীনবন্ধু নাটককে অকারণে করুণাসিক্ত করতে গিয়ে অতিনাটকীয়তার আশ্রয় নিয়েছেন, যার সাথে মূল কাহিনীর কোনো ধারাবাহিকতা নেই। উৎপল দত্ত যর্থাথই বলেছেন, ‘দীনবন্ধু ঢের বেশি সফল হতেন যদি মূল নেতির শক্তি তিনি কেন্দ্রিভূত করতেন তোরাপে। তোরাপকে দেখলে মনে হয় এই ব্যক্তি সত্যিই পারে উডকে এবং রোগকে গলা টিপে হত্যা করতে, এই পারে নীল চাষটাই বন্ধ করে দিতে।’ নবীন মাধব বলছেন, ‘নীলের দৌরাত্ম্য যদি রহিত হয় তবে আমি পাঁচ দিবসের মধ্যে এই সকল বালকদের পাঠের জন্য স্কুল স্থাপন করিয়া দিতে পারি।’ নীলদর্পণ যখন লেখা হচ্ছে তখন নীলচাষ রহিত হয়ে গেছে। নাটকে দীনবন্ধুর এ কথার মূল্য কী তবে? পুরো নাটক জুড়ে স্বশ্রেণীর দেশদ্রোহিতার ও নীতিবিবর্জিত লুণ্ঠনবৃত্তির যে দলিল তিনি রচনা করেছেন, সেখানে নীলবিদ্রোহের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার কারণ বোঝা শক্ত। উৎপল দত্ত যে কথা বলেন, দীনবন্ধু দৃশ্যের পর দৃশ্যে গোলকবাবুর গৃহাভ্যন্তরের ঘর-গেরস্থালির কথা উত্থাপন করেছেন, যা কখনই নীল বিদ্রোহের কোনও প্রাসঙ্গিক চিত্র তুলে ধরে না বা কথা প্রসঙ্গেও কোনও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের জানায় না। যে নাটকে ব্যাপক এক কৃষক বিদ্রোহ হচ্ছে মূল কাহিনী, সেখানে মধ্যবিত্ত পরিবারের হেঁসেলে-শয়নকক্ষে অত ঘন ঘন প্রবেশ করলে সময় ও সংলাপের যে অপচয় হয় তা দীনবন্ধু আর সামলে উঠতে পারেননি। সরকারী চাকুরে আবার বাঙালীর প্রতি মমতা দীনবন্ধুর মানস দুই বিপরীত ধারায় বিভাজিত হয়ে আছে এবং এ থেকেই নীলদর্পণ নাটকের যাবতীয় দোষ- ত্রুটি, অনর্থক নাটুকেপনা, মৃত্যু-মূর্ছা-পাগল হওয়া।
বাংলার শত বছরের কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা নীল বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহকেই নাটকে জায়গা দেওয়া হলো না। কৃষককুলের একটি বৃহত্তর সামাজিক সমস্যা নিয়ে নাটকটি শুরু হয়ে দুটি পরিবারের করুণ কাহিনীতে গিয়ে নাটক শেষ হয়েছে। নাটকটি ক্রমে ক্রমে বৃহত্তর সামাজিক সমস্যা থেকে সরে গিয়ে অন্তঃপুরে কয়েকটি নারী চরিত্রকে আশ্রয় করেছে। নীল বিদ্রোহের বিদ্রোহী কোনো নারীর চরিত্র এ নাটকে নেই। নাটকের বৃহত্তর সামাজিক-অর্থনৈতিক বিশেষ করে সংগ্রামের দিকটি গৌণ হয়ে পড়েছে। নাটকের শেষে জোর করে বিপ্লব ঘটাবার দরকার ছিল না। কারণ কৃষকরা নীলবিদ্রোহে সত্যিই বিজয় অর্জন করেছিল। নাটকে তা দেখনো হলে নাটকটির ঐতিহাসিক মূল্য প্রকাশ পেত। বাংলার চাষীদের এই নাটকে অনেক বেশি নিবীর্য করে দেখানো হয়েছে। বিগত বছরের টাকা পরিশোধ না করা, বর্তমান বছরে অধিক জমির জোর করে দাদন দেওয়া, মিথ্যা মামলায় গোলকচন্দ্রকে জড়িত করা, নবীনমাধবকে কুটুক্তি করা, পুকুরপাড়ে নীল চাষ করা, নবীন বসুকে অস্ত্রঘাত করা সব ঘটনার মধ্য দিয়ে নীলকরদের অত্যাচারের বাস্তবসম্মত চিত্রই পাওয়া যায়। সাধুচরণ বা রাইচরণদের সাথে অমিন যে আচরণ করে, যেভাবে জোর করে তাদের কর্ষিত জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য করে, যেভাবে জোর করে তাদেরকে কুঠিতে নিয়ে যায় এবং চাবুক মারে, যেভাবে ক্ষেত্রমণিকে জোর করে ধরে নিয়ে যায় তার মাধ্যমে দুটি পরিবারকে ঘিরে নীলকরদের অত্যাচারের ঘটনা সুন্দরভাবেই প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে যে কৃষক বিদ্রোহ দানা বাঁধে পুরো নাটকে সে ঘটনার কোনো প্রকাশ নেই।
নীলচাষের বিরুদ্ধে কৃষকদের ক্ষোভের কথা বহুপূর্ব থেকেই জানা যায়। হিকির স্মৃতিকথার এর একটি চমৎকার উল্লেখ রয়েছে। ইংল্যান্ড থেকে আগত উইলিয়াম হিকি ছিলেন কলকাতার সর্বোচ্চ আদালতে আইনজীবী। তিনি সতেরশো সাতাত্তর সাল থেকে আঠার নয় সাল পর্যন্ত কলকাতায় অবস্থান করেন। হিকির স্মৃতি কথা থেকে জানা একজন নীলকর সাহেব সম্পর্কে। হিকির বন্ধু ফ্রেডারিক মেটল্যান্ড আর্নট নীলচাষীদের হাতে মারা যায়। ফ্রেডারিক সেনাবাহিনীর চাকরি নিয়ে ভারতবর্ষে আসে এবং ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হয়। পরে চাকরি ছেড়ে বেশি রোজগারের আশায় নীলের ব্যবসা আরম্ভ করে এবং কৃষ্ণনগরে বসবাস করতে থাকে। প্রথা অনুযায়ী সে চাষীদের টাকা দাদন দিয়ে নীলচাষ করাতো। চাষীরা একবার নাকি তার কাছ থেকে দাদন নিয়ে চুক্তি অনুযায়ী নীল সরবরাহ করেনি। চাষীদের ব্যবহারে আর্নট ক্রুদ্ধ হয়ে গ্রামের চাষীদের উপর ক্রুদ্ধ হয় এবং দু-একজনকে টেনে-হেঁচড়ে ধরে আনার চেষ্টা করে। নিজেই আইনের প্রয়োগ করতে গিয়ে আর্নট ভীষণ বিপদে পড়ে। কয়েকশত চাষী দলবদ্ধ হয়ে বাঁশ লাঠি ইত্যাদি নিয়ে তাকে ঘেরাও করে এবং জবরদস্তির জবাব চায়। জবাব না পেয়ে চাষীরা আর্নটকে বাঁশপেটা করে, এমনভাবে তাকে পেটানো হয় যে সে জড়পিণ্ডের মতন দলা পাকিয়ে যায়। তার কাকুতি-মিনতি সবই ব্যর্থ হয়। ফাটা মাথা, হাড়গোড় ও পাঁজর সুদ্ধ জখম আর্নটকে বাড়িতে বয়ে আনা হয় এবং সেখানে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে প্রাণ ত্যাগ করে। সরকার এ হত্যাকােণ্ডের বিচারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। বরং হিকি ইংরেজ মহলে বলাবলি হতে শুনেছে যে, নিজ দোষের উপযুক্ত দন্ড পেয়েছে আর্নট। বহু দোষ ছিল তার, দু-জন চাষীকে সে নাকি এই ঘটনার আগে অত্যাচার করে মেরে ফেলেছিল। হিকির স্মৃতি কথায় ঘটনার সাল উল্লেখ নেই। নিশ্চয় সেটা যে আঠারশো নয় সালের আগেই হবে, কারণ আঠারশো নয় সালে হিকি ভারত ছেড়ে চলে যায়। হিকির উল্লেখিত এই ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, বহুদিন ধরেই নীলচাষীদের উপর অত্যাচার চলছিল এবং চাষীরাও ভিতরে ভিতরে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।
দীনবন্ধু কেন সে প্রসঙ্গ নাটকে আনলেন না সেটা খুবই বিস্ময় উদ্রেক করে। সুপ্রকাশ রায় স্পষ্টই বলেছেন, নীলদর্পণ কোনো কৃষক বিদ্রোহের নাটক নয়। এই নাটকে তোরাপ চরিত্রকে ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রোহী হিসেবে অঙ্কিত করা হলেও কৃষকদের যে বিরাট বিদ্রোহের ঝড় সারা বঙ্গদেশ কাঁপিয়ে তুলেছিল তা এই নাটকে একেবারেই স্থান পায়নি। সারা বাংলা জুড়ে নীলচাষকে ঘিরে যে ভয়াবহ বিদ্রোহ ঘটে গেল, নাটকের সমাপ্তি সে বিদ্রোহকে ঘিরেই হওয়া উচিৎ ছিল। গোলক বসুর বিরুদ্ধে মামলা সাজাবার পরের দৃশ্য থেকে নাটক দুই পরিবারে অন্তঃপুরে না ঢুকে বিদ্রোহকে সামনে নিয়ে আসতে পারত, যা ছিল ইতিহাসের সত্য। বাংলার শত বছরের কৃষক বিদ্রোহের এক যুগ সন্ধিক্ষণ। দীনবন্ধুর নিশ্চয় এই ঘটনা না জানবার কথা নয়। সব জেনেশুনে তিনি এক গৌরবময় আখ্যানকে কেন এড়িয়ে গেলেন সেটা বিরাট প্রশ্ন। তিনি কি বিদ্রোহকে ভয় পেতেন? সশস্ত্র সংগ্রামকে অনেক বড় প্রগতিশীলরাও খুব ভীতির চোখে দেখে থাকেন। গান্ধী যেমন ভারতের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন কিন্তু সশস্ত্র সংগ্রাম চাননি, দীনবন্ধুও কি সেইরকম গান্ধীবাদী ছিলেন? ব্রিটিশ শাসকদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি কি তাঁর দৃষ্টিকে বিভ্রান্ত করে রেখেছিল? সেইসব প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া গেলেও এ কথা নির্মমভাবে সত্য যে, নীলদর্পণ নাটকে বাংলার ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। বিরাট এক কৃষক বিদ্রোহকে নাট্যকার যেভাবে ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেছেন তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষ করে তিনি যখন ভূমিকায় ইংরেজদের দয়া ভিক্ষা করেন, তখন কৃষকদের গৌরবময় বিদ্রোহকে অসম্মানই করা হয়।
নীলদর্পণ নাটকে দীনবন্ধুর ইংরেজ শাসকদের কাছে দয়া ভিক্ষা করার কোনো কারণ ছিল না। কারণ নীলদর্পণ নাটক লেখার পূর্বেই বাংলার চাষীরা দয়া ভিক্ষা করে নয়, বিদ্রোহ করে-সংগ্রাম করে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। শাসকদের বাধ্য করে তাদের দাবী মেনে নিতে। শাসকরা মাথা নত করে চাষীদের সম্মিলিত শক্তির কাছে। সেখানে নাটকে সে ঘটনা না তুলে ধরা উপরন্তু একটি সফল বিদ্রোহের পর দীনবন্ধুর ইংরেজদের নিকট কৃপা ভিক্ষা করা একদিকে অর্থহীন, দ্বিতীয়ত তা বিদ্রোহকে খাটো করা। তিনি কেন এটা করলেন তা চূড়ান্তভাবে বোধগম্য নয়। কৃষকের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে তিনি কিন্তু ইতিহাসের বিপক্ষেও দাঁড়ালেন। কৃষক সংগ্রামের সত্যিকারের ইতিহাস তুলে ধরতে পারলেন না। বাংলার ইতিহাসকে তিনি এ নাটকের মধ্যে দিয়ে পিছনের দিকে টেনে নিতে চাইলেন। বিদ্রোহী কৃষক বাঙালী চাষীদের তিনি ইংরেজের করুণার কাঙাল বানালেন।
(২০১০ সালের ২৩ ডিসেম্বুর নীলদর্পণ নাটকের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ অতিথি হিসেবে দেয়া লেখকের বক্তব্য। -সম্পাদক)
লেখক পরিচিতি:
রাহমান চৌধুরী, লেখক, শিল্প সমালোচক