আহমদীয়া সম্প্রদায়ের বার্ষিক জলসার অনুমতি প্রদানে ২৯ এপ্রিলের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের চিঠিকে প্রশাসন ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসহযোগিতা, বৈষম্যমূলক আচরণ ও দেশের সংবিধানের বরখেলাপ হিসেবে উল্লেখ করে আহমদীয়া নেতারা এই চিঠিকে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে “সাম্প্রদায়িক মাষ্টারপিস” আখ্যায়িত করেছেন।
রোববার, ৫ মে, ২০১৯, সকালে এক মতবিনিময় সভা এবং প্রেস ব্রিফিং এ পঞ্চগড়ের আহমদনগরে বৃহস্পতিবার, ২ মে, ২০১৯-এ অনুষ্ঠিত সালানা জলসা বা বার্ষিক সম্মেলন ও তার পূর্বাপর বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে তুলে ধরতে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিং এ তারা এ কথা বলেন।
প্রেস ব্রিফিং এ সাংবাদিকদের আহমদীয়া সম্প্রদায়ের বার্ষিক জলসার অনুমতি প্রদানের ২৯ এপ্রিলের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের চিঠিটির কপি সরবরাহ করা হয়। তাতে ১৭টি শর্তের উল্লেখ রয়েছে, আহমদীয়া নেতারা এই শর্তগুলোর বেশীর ভাগকেই প্রশাসনের একপেশে চাপ, অন্যায় শর্ত এবং কয়েকটি শর্ত সংবিধান পরিপন্থী বলে মনে করেন।

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্বাক্ষরিত আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বার্ষিক সম্মেলনের অনুমতিপত্র
আহমদীয়া মুসলিম জামাতের পঞ্চগড়ের সভাপতি মোহাম্মদ তাহের যুগলের নাম উল্লেখ করে দেয়া প্রশাসনের এই পত্রে বলা হয়,
“আহমদীয়া মুসলিম জামাত, আহমদনগর, ধাক্কামারা, পঞ্চগড় কর্তৃক দাখিলকৃত আবেদনের প্রেক্ষিতে আহমদনগরস্থ নবনির্মিত শিক্ষা কমপ্লেক্স ভবনের অভ্যন্তরে দেয়াল ঘেরা আড়াই একর জায়গায় আগামী ০২-০৫-২০১৯ তাৰিখে নিমােক্ত শর্ত সাপেক্ষে স্থগিতকৃত সালানা জলসা বা বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের অনুমতি প্রদান করা হলো।
শর্তাবলী:
০১) সরকার বিরােধী এবং রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান করা হতে বিরত থাকতে হবে।
০২) সম্মেলনে যে সকল ব্যক্তি বক্তব্য পেশ করবেন তাদের নামের তালিকা ও কি কি বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করবেন তা জানাতে হবে।
০৩) ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন বক্তব্য প্রদান করা যাবে না।
০৪) পর্যাপ্ত সংখ্যক নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক নিয়ােগ করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
০৫) অনুষ্ঠান স্থলের চারদিকে সিসি টিভি স্থাপন করতে হবে।
০৬) অনুষ্ঠান সকাল ০৯.০০ ঘটিকা হতে বিকাল ১৫.০০ ঘটিকার মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে।
০৭) আহমদীয়া সম্প্রদায় (কাদিয়ানী) ব্যতিত অন্য কোন বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করা যাবে না।
০৮) এলাকার সহজ সরল ও দরিদ্র শ্রেণীর লোকজনদেরকে আহমদীয়া সম্প্রদায়ে যোগদানের বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা যাবে না।
০৯) প্রয়োজনের অতিরিক্ত শব্দ যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না।
১০) অনুষ্ঠানটি সার্বক্ষণিক ভিডিও যন্ত্রের মাধ্যমে রেকর্ড করতে হবে। |
১১) উক্ত অনুষ্ঠানে আইনশৃখলা পরিস্থিতি অবনতির কোন ঘটনা ঘটলে আয়ােজকগণ দায়ী থাকবে।
১২) সম্মিলিত খতমে নবুওয়ত সংরক্ষণ পরিষদ সংক্রান্তে কোন প্রকার নেতিবাচক বা উস্কানীমূলক বক্তব্য প্রদান করা যাবে না।
১৩) সম্মেলনে তৃতীয় কোন অপশক্তি যাতে হামলা করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি করতে না পারে সে বিষয়ে নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
১৪) বার্ষিক সম্মেলন (সালানা জলসা) অনুষ্ঠানকে রাজনৈতিক সমাবেশে পরিণত করা যাবে না।
১৫) শর্তসমূহ যথাযথভাবে প্রতিপালন না হলে প্রশাসনিকভাবে অনুষ্ঠান বন্ধ করা হবে।
১৬) উক্ত সম্মেলন অনুষ্ঠান চলাকালে প্রাথমিক দায়-দায়িত্ব আবেদনকারীদ্বয়কে বহন করতে হবে।
১৭) কর্তৃপক্ষ যে কোন সময় বিনা কারণ দর্শনান্তে এই অনুমতি বাতিল করতে পারবেন।”
প্রেস ব্রিফিং এ আহমদীয়া মুসলিম জামাতের মিশনারী ইন-চার্জ আব্দুল আউয়াল খান চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের শান্তিপূর্ণ এবং ঐতিহ্যবাহী জলসা নিয়ে যে ছিনিমিনি খেলা হল তা বাংলাদেশের মূল অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিপন্থী এবং আমাদের সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের ধারণা, সরকার বা প্রশাসনের মধ্যে এমন কিছু ব্যাক্তি বা গোষ্ঠী রয়েছে যারা কৌশলে বর্তমান সরকারের অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে অকার্যকর করে বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মীয় বিভেদপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মনে করি সরকারের উচ্চমহলের নির্দেশনার পরেও স্থানীয় প্রশাসন তা গ্রাহ্যে না আনা সরকারকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন। এর পেছনে রয়েছে দেশ-বিরোধী গভীর ষড়যন্ত্র যা আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মত একটি সাম্প্রদায়িক ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করবে’।
ব্রিফিং এর শুরুতে লিখিত বক্তব্যে আহমদীয়া মুসলিম জামাতের নায়েব ন্যাশনাল আমীর (গণ-সংযোগ, প্রেস-মিডিয়া ও বহিঃসম্পর্ক বিভাগ) আহমদ তবশির চৌধুরী জানান, ‘”খতমে নবুওয়ত” সংগঠন এবং হেফাজতে ইসলামসহ তাদের সমমনা কিছু উগ্র ধর্মীয় সংগঠনের অন্যায় দাবীর মুখে গত ২২ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারী পঞ্চগড়ে অনুষ্ঠেয় আহমদীয়া মুসলিম জামাতের ঐতিহ্যবাহী বার্ষিক সম্মেলন পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন স্থগিত ঘোষণা করে। প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে উগ্রবাদীরা গত ১২ ফেব্রুয়ারী রাতে সেখানে আহমদীদের বাড়ী-ঘরে হামলা, অগ্নি সংযোগ এবং শারিরীক নির্যাতন করে আমাদের প্রায় ২৫ জন সদস্যকে আহত করে যাদের মধ্যে ৬ জনকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আহতদের কয়েকজন এখনো স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যেতে পারেননি। আক্রমণের তান্ডব ও ভয়াবহতা এখনো আক্রান্তদের পরিবারের সদস্যদের মাঝে বিভিষিকাময় স্মৃতি হিসেবে বিরাজ করছে’।
প্রশাসনের একপেশে আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আক্রমণকারী এবং উষ্কানীদাতারা প্রকাশ্যে আহমদীদের ‘ধরে ধরে জবাই করার’ ঘোষণা দিলেও এবং তাদের সেইসব (বক্তব্যের) ভিডিও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে জমা দেয়া সত্বেও আজ পর্যন্ত তাদেরকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আমাদের আক্রান্ত সদস্যদের পক্ষ থেকে থানায় আসামীদের নাম উল্লেখ করে মামলা দিলেও পঞ্চগড় সদর থানা আজ আড়াই মাসেও মামলা গ্রহণ করেনি, উপরন্তু আসামিদের নামগুলোর পরিবর্তে ‘অজ্ঞাতনামা’ লিখার জন্যও জেলা পুলিশের উর্ধতন কর্তৃপক্ষ এবং সদর থানার কর্মকর্তারা আমাদের সদস্যদের বার বার চাপ দিতে থাকেন, কিন্তু তাদের অন্যায় পরামর্শ না মানার কারণে মামলাগুলো আজও আমলে নেয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। আমরা বার বার প্রশাসনকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি যে, মামলা মোকদ্দমা আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয়, আমরা চাই এর মাধ্যমে দুষ্কৃতিকারীরা আইনের শাসনের আওতায় আসুক , প্রয়োজনে ওরা অপরাধ স্বীকার করে ভবিষ্যতে এধরণের ঘটনার পুণরাবৃত্তি না ঘটানোর অঙ্গীকার করে মুচলেকা প্রদান করুক, শান্তিপূর্ণ অবস্থানের জন্য একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হোক, যার ফলে এলাকায় দীর্ঘস্থায়ী একটি শান্তির পরিবেশ করবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় স্থানীয় তথা জেলা পুলিশ প্রশাসন এ বিষয়ে কোনরূপ ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি”।
প্রেস ব্রিফিং এ অন্যান্যের মাঝে আহমদীয়া মুসলিম জামাতের ন্যাশনাল আমীর মোবাশশের উর রহমান ও কেন্দ্রীয় বাংলাডেস্ক ইন-চার্জ আহমদ তারেক মোবাশ্বের উপস্থিত ছিলেন।
বাঙালীয়ানা/এসএল
মন্তব্য করুন (Comments)
comments