তখন শুনতাম ৭৮ আর পি এম এর রেকএকটা ছোটবেলাকার স্মৃতি খুব মনে পড়ে, তখন আমাদের বাড়িতে একটা দম দেওয়া গ্রামোফোন ছিলো। বাবা যে প্রবল গান-বাজনার অনুরাগী ছিলেন তা নয়। কিন্তু ওটি বাবা সখ করে কিনেছিলেন। ওই গ্রামোফোনের সঙ্গে কিছু রেকর্ড ও ছিল। বাবার খুব প্রিয় শিল্পী ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। র্ড এ কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এর গান। রেকর্ড এর দুপিঠে দুটো গান থাকতো, একদিকে ছিল “আমি মারের সাগর পাড়ি দেব গো”, আর অন্যদিকে ছিল “আনন্দধারা বহিছে ভুবনে”। এই গানটি মোহরদির গলা থেকে শুনেই প্রথম ভালোলাগা। তখন আমি খুবই ছোটো। সেই গান যে আমি সারাদিনে কতবার বাজিয়ে শুনতাম তার ইয়ত্তা ছিলো না।
তারপর যখন কণিকা বন্দোপাধ্যায় কে প্রথম চোখে দেখলাম, তখন আমার বয়স ১১ কি ১২র মতো। তখন আমি খুব উত্তেজিত হয়ে গেছিলাম। কারণ যার গান ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি তাকে সামনাসামনি চোখে দেখতে পেয়েছিলাম। আমি যেখানে গান শিখতাম দক্ষিণীতে তখন দক্ষিণী রবীন্দ্র সদনে আয়োজন করেছিল একটি তিনদিন ব্যাপী সম্মেলন।অতো বড় রবীন্দ্রসংগীত উৎসব তারপরে কলকাতায় আমি আর হতে দেখিনি। এই সম্মেলনের কথা এইজন্যই মনে আছে কারণ এপার বাংলা ও ওপার বাংলার সমস্ত প্রথিতযশা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীরা এসেছিলেন। শুধুমাত্র দুজন ছাড়া। একজন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং অপরজন দেবব্রত বিশ্বাস। তবে সেই সম্মেলনে সবাই একটি করেই গান গেয়েছিলেন। তৃতীয়দিনে অর্থাৎ শেষদিনে শিশু বিভাগ বলে একটা বিভাগ রাখা হয়েছিল। সেখানে আমি দক্ষিণীর তরফ থেকে গান পেয়েছিলাম। এছাড়াও কলকাতার বিভিন্ন নামী-দামী গানের স্কুল থেকে তাদের শিল্পীদের পাঠিয়েছিলেন। সেদিন কণিকা বন্দোপাধ্যায় গেয়েছিলেন “তোমায় নতুন করে পাবো বলে” — সেই গান এখনো আমার কানে বাজে। আমি ওই স্মৃতিটা কিছুতেই ভুলতে পারি না। সেটা আমার কাছে ছিল একটা হেভেনলি এক্সপিরিয়েন্স।
সেই মোহরদির কাছে যাওয়ার সুযোগ হলো নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে। তার আগে এরকম একটা ব্যাপার ছিল, আমারই কিছু বন্ধু-বান্ধব পারিবারিক দিক থেকে মোহরদির সঙ্গে যুক্ত ছিল। সুতরাং আমরা তখন গান নিয়ে পাগলামি করতাম, সেই সূত্রে মোহরদি আমাদের কথা জানতেন। কিন্তু আমি বলছি যখনকার কথা ১৯ শতকের ৮০ দশকের শেষ দিকে আমারই এক বন্ধু যার নাম এখন সবাই জানে, প্রবুদ্ধ রাহা। প্রবুদ্ধ আর আমি ছোটবেলাকার বন্ধু, একসঙ্গে পড়েছি, একসঙ্গে গান শিখেছি। যদিও প্রবুদ্ধ আমার থেকে এক বছরের সিনিয়র। প্রবুদ্ধ এবং ওর এক বন্ধুর উদ্যোগে আমরা দুটো ক্যাসেট করেছিলাম সেই ক্যাসেট এ গানগুলো বেছে দেওয়া ও সংগীত পরিচালনা করেছিলেন মোহরদি। মোহরদি আমাকে আর প্রবুদ্ধ কে খুবই ভালোবাসতেন।
ওই প্রথম মোহরদির কাছে যেতে পারা। তারপর মোহরদির শরীর ক্রমশ খুবই খারাপ হতে শুরু করেছিল, ওনার চলাফেরাও খুব রেস্ট্রিক্টেড হয়ে গেল, তো শান্তিনিকেতনে আমার মাঝে মাঝে যাতায়াত ছিল, মানে শান্তিনিকেতনে আমার শ্বশুর মশাইয়ের একটা বাড়ি ছিল। তাই ছুটিতে মাঝে মাঝে যেতাম। সেটা এখনো যাই। তখন সন্ধ্যে বেলার দিকে ফ্রী থাকলে মোহরদির সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। এটা বেশ কয়েকবার হয়েছে। অন্তত দুই থেকে তিনবার তো হয়েইছে। আমার এখনও মনে আছে আমরা গেলে মোহরদি ঘরে বসে টেলিভিশন দেখছেন, ওই কুটকুট করে যাতি দিয়ে সুপারি কাটছেন, তখন স্পন্ডেরলাটিস এ ঘাড় শক্ত হয়ে গেছিল, চোখও খুব এফেক্টেড হয়েছিল, শরীর পুরো রুগ্ন ফেকাশে দুর্বল হয়ে গেছিল। কিন্তু মাথা খুব শার্প ছিল। আরেকটা ব্যাপার মোহরদি একেবারে ছেলেমানুষের মতো ছিলেন। মোহরদির মধ্যে একটা শিশু ছিল। সেটা যারা মোহরদিকে কাছ থেকে দেখেছে তারা তো জানেনই। আমরা আর কতক্ষণই বা দেখেছি। তাঁর মনটা এতটাই পবিত্র ছিল যে কারোর মধ্যে তিনি কোনো খারাপ দেখতে পেতেন না। মোহরদির সামনে যখন গান গেয়েছিলাম জানতাম গানটা কিচ্ছু হচ্ছে না, কিন্তু কখনো মোহরদি বলতেন না যে , “এই তোমার গানটা হচ্ছে না”। তিনি বলতেন, “বাঃ খুব ভালো হচ্ছে, এই জায়গাটা একটু এরকম করো আরো ভালো হবে”। এই যে সন্ধ্যে বেলায় গিয়ে আমি আর আমার বউ বসতে পারছি তার কাছে, আমার মেয়ে তখন খুব ছোটো। উনি আমাদের সঙ্গে গল্প করতেন খুব আন্তরিক ভাবে স্নেহ দিয়ে।
এই যে স্নেহ সেটা কিন্তু সবাই দিতে পারে না। এখন তো এসব উঠেই গেছে। ওই মানুষগুলোর মধ্যে সেইসব জিনিস ছিল। যার প্রতি স্নেহ করবো সেটা জেনুইন করবো, যাতে সে বুঝতে পারে, এইজন্য মোহরদির কাছে গিয়ে বসলে মনটা ভালো হয়ে যেত। কারণ আমি জানতাম যতক্ষণ বসবো আমি ঐ স্নেহটা পাবো। যেগুলো আজকাল প্রায় বিরল। এইসব মানুষ সারাজীবন গান নিয়ে কাটিয়েছেন। গান ছাড়া আর কিছু ভাবেননি। রবীন্দ্রনাথ এর গানই ছিল তাঁর দুনিয়া। উনি তার ভেতরেই পরিপূর্ণ থেকেছেন। সেটা নিয়েই সাধনা করেছেন। একটা মানুষ যে রবীন্দ্রসংগীত এ কতটা বিভোর থাকতে পারে তা মোহরদি কে দেখলেই বোঝা যায়। তাঁর সঙ্গে মিশতে পেরেছি বলেই আজ এই কথা বলছি তিনি ডাউন টু আর্থ ছিলেন। কোনো ইগো ছিলো না। শুধু যেই গানটা ভালোবেসেছেন, রবীন্দ্রনাথ কে ধ্রুবতারা মনে করেছেন, তার গানের প্রতি একনিষ্ঠ থেকেছেন। সেখানে কখনও কোনো কমপ্রোমাইস করেননি। যখন আমরা মোহরদির কাছে গিয়ে বসতাম মনে হত একটা পবিত্র স্বত্তা । তখন মনে হত আমরা ওনার সামনে গিয়ে বসার যোগ্য নই। তাঁর মনের মধ্যে কোনো কালিমা নেই। সকলকে শুধু প্রশংসা করতেন। আশীর্বাদ করতেন।
লেখক পরিচিতি:
শ্রীকান্ত আচার্য, সঙ্গীত শিল্পী
অনুলেখন: মাল্যবান এষ