পূর্ববঙ্গের প্রতিরোধ লড়াই এবং রবীন্দ্রনাথ – পর্ব ০১

Comments

।। কামাল লোহানী ।।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালী জাতিসত্ত্বার কতটা যে জুড়ে রয়েছেন, তা বর্ণনা দিয়ে বোঝানো যাবেনা। জাতির মনস্তত্বে যে স্বাদেশিকতার দর্শন ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর কথায় ও লেখায় ; আমরা যারা জীবন সংগ্রামে মগ্ন হয়েছিলাম, তারা বুঝি কী তাঁর অবদান আর অদম্য ভূমিকা। বৃটিশ বেনিয়া সাম্রাজ্যবাদের আমলেই তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধও প্রত্যক্ষ করেছেন, যদিও মহাপ্রয়াণ হয়েছে তাঁর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হবার আগেই।

পূর্ববঙ্গের প্রতিরোধ লড়াই এবং রবীন্দ্রনাথ -এর চারটি পর্ব পড়ুন

পর্ব ০১
পর্ব ০২
পর্ব ০৩
শেষ পর্ব

স্বদেশী আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপান্তরিত হবার সময়কাল প্রচন্ডভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন, লড়েছেন তাঁর রচিত সাহিত্যের ভান্ডার দিয়ে। দেশাত্মবোধক গানের রচনা করেছেন অগণিত। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতা কত যে প্রখর ছিল, বিবেক কতটা তীক্ষ্ণ ছিল, তা তাঁর বিপুল সাহিত্য আর সঙ্গীত জগৎকে পাঠ করলে বিস্মিত হতে হয় আজও। দেশের মাটির প্রতি তাঁর যে বিপুল আনুগত্য এবং মানুষকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করতে যে কতটা কার্যকরী , তা আমরা বাংলার তাবৎ মানুষ যেভাবে উপলব্ধি করেছি, তা আর কেউ করতে পারবে না।

rabindranath-tagore

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যুদ্ধের বীভৎসতা, শোষণ-যন্ত্রণা, সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে আর মানবমুক্তির প্রচন্ড জীবন-দর্শন ও সংগ্রামের প্রেরণা উৎসারিত করে গেছেন, তাঁর মৃত্যুর পরে আজও তা অনুভব ও উপলব্ধি করছি। আর সে কারণেই রবীন্দ্রনাথের অমোঘ বাণী-“মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ”কে জীবনযুদ্ধের বিপুল শক্তির আধার বলেই মেনে নিয়েছিলাম। আর তাই তাঁর দৃপ্ত ঘোষণা-“বাধা দিলে বাধবে লড়াই” আমাদের মুক্তিকামী জাতিত্ববোধকে প্রবল প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত করেছিল, আজও করছে এবং শত শত বর্ষ পরেও অনুপ্রেরণার আশ্রয়স্থল হবে। কবিগুরু রাজনীতি করতেন না কোন দলীয়ভাবে কিন্তু জাতীয়তাবাদী প্রেরণার উৎস ছিলেন। কারণ তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার ভুবন ছড়ানো ছিল বিশ্বময় ও মানুষকে নিয়ে, তার অধিকার আর মুক্তির লড়াইয়ে। তিনি জালিয়ানওয়ালাবাগের ন্যাক্কারজনক হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে যে সাহস ও প্রত্যয়দৃপ্ত ভূমিকা নিয়ে বৃটিশের দেয়া ‘নাইট’ উপাধি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তেমনি বেনিয়া ভেদবুদ্ধির ‘বঙ্গভঙ্গ’ কে রোধ করতেও বাংলার সাধারণ মানুষকে জাগ্রত করেছিলেন, এক নয়, একাধিক গান রচনা করে জাতীয়তাবোধকে শাণিত করেছিলেন বিশ্বাসঘাতকদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে। আবার বাঙালীয়ানা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং মানুষের ঐক্যকে সুদৃঢ় করার প্রয়াসে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন ‘রাখিবন্ধন’ উৎসব প্রবর্তন করে। কবিগুরু বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভেতর যে নবচেতনার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ লক্ষ্য করে ছিলেন, সেই উপলব্ধিতে বাংলার সাহিত্যে, লড়াইয়ের মাঠে তাঁর যে প্রয়োজন, তাই তাঁকে ধরে রাখার প্রয়োজনে আশীর্বাদ করে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ঝান্ডা উড়িয়ে চলার ডাক দিয়েছিলেন।

কবিগুরুর পৈত্রিক জমিদারী এই পূর্ববঙ্গেও বিস্তর ছিল আর তাই কুষ্টিয়ার শিলাইদহে কুঠিবাড়ী, সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুরে কাছাড়িবাড়ী আর নওগাঁর পতিসরে ছিল তাঁর কৃষি পদ্ধতিকে আধুনিকীকরণের উদ্যোগ। তার সমবায়-চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল এইখানেই। ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার পত্তন রবীন্দ্রনাথই করেছিলেন প্রথম এই পতিসরে। শাহজাদপুরের অন্য জমিদারের প্রজা-নিপীড়নকে রুখতে শুনেছি কবি লাঠিয়াল পাঠিয়ে তাদের প্রতিহত করতেন। পূর্ববঙ্গের এই এলাকাগুলো তিনি নৌকায় করে চলাচল করতেন আর এর মধ্যেই চলতো তাঁর সাহিত্যচর্চা।

এহেন মানুষটি নিজে যেমন বশ্যতাকে অস্বীকার করে আত্মমর্যাদাকে রক্ষা করেছেন, তেমনি জাতিত্ববোধ আর মানবিকতাকেও উর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন।

Rabindranath_Tagore 01

আর তাই বৃটিশ বেনিয়া ভেদবুদ্ধি আর সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের কারণে মানুষকে শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তাঁর রচনাবলী আমাদেরও সঞ্জীবিত করেছিল। মুসলিম লীগ সরকার বিমাতাসুলভ আচরণই নয় কেবল পূর্ববঙ্গকে উপেক্ষা-অবহেলা করেছে নির্দ্বিধায়। দ্বিজাতিতত্ত্বে দেশ বিভক্তির বদৌলতে মতলববাজ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হাতে শাসনভার চলে যাওয়ায় তাদের আগ্রাসী উপনিবেশিক মনোভাব পূর্ববঙ্গের মানুষকে ক্ষুব্ধ এবং ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল। তাই পাকিস্তানী ঘৃণ্য জমানায় এই অঞ্চলের মানুষ যে অধিকারহীনতা ও উপেক্ষার অপঘাতে জর্জরিত হচ্ছিল, তার বিরুদ্ধে যে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তাতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিলেন গানে, কবিতায়, নাটকে। তাই বুঝি শাসকচক্র  বাংলাভাষা এবং তার অধিকার হরণে যখন তৎপর, তখন সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠী বাংলা সাহিত্যকেই ‘হিন্দুয়ানী’ সংস্কৃতি আখ্যায়িত করে দমন-পীড়নের কৌশল আটছিল। কিন্তু ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র পার্লামেন্টে গৃহীত হলেও দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতা দেখিয়ে প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল আইউব খান মার্শাল ল জারির মাধ্যমে দেশের অর্থাৎ তৎকালীন পাকিস্তানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন ১৯৫৮ সালে। প্রাথমিক সময়ে মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জাকে রাষ্ট্রের শীর্ষাসনে বহালের মাত্র সাতদিন পর আইয়ুব খান স্বমূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করে মীর্জাকে অপসারণ করে নিজেই প্রধান সামরিক শাসকের আসনে চড়ে বসলেন। এই সেনাবাহিনী যখনই ক্ষমতায় আসে, তখন দেশের সাধারণ মানুষের জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য বাজারে পণ্যের দাম কমায়, গাছে গাছে সাদা রঙ লাগায়, তাছাড়া দোকানপাটের সকল পণ্যের দামকে এমন পর্যায়ে নামিয়ে আনতে বাধ্য করে যে গরীব মানুষমাত্রেই ঐসব পণ্য কিনে নিজেদের ঘরবাড়ি সাজায়। সে সময়ও তাই হলো। মেয়েদের পোষাকে ঘাটতি দেখলে পেটে-পিঠে আলকাতরা মেরে শাস্তি দিত। ছেলেদের লম্বা চুল দেখলেই ছেটে ফেলতো- এমন সব সহজে চোখে পড়ার মতন কাজের নমুনা দেখিয়ে রাস্তাঘাট পরিষ্কার রেখে নাগরিক-মন জয় করতে চাইতো। আসলে সামরিক বাহিনীর ভয়ে সবাই সোজা হয়ে চলতো। কিন্তু ভয়ভীতি দিয়ে কি সত্যিই সাধারণ মানুষকে জয় করা যায়? তবু তারা দূর্নীতিবাজ, ঘুষখোর লোকদের শাস্তি দিয়ে নিজেদের সাফসুতরা প্রমাণের চেষ্টা করছিল। অন্যদিকে দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে নেতা-কর্মী ও সংগঠকদের দেদার গ্রেফতার করে জেল ভর্তি করে ফেলল। এতে মানুষ তাদের আখেরী মতলব বুঝে ফেলতে পারলেন। এমনি শাসনের নমুনা দেখিয়ে মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে দেশ শাসনের শক্তবাঁধনে জনগণকে বেঁধে ফেলতে চাইল। এমনকি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার যে স্বীকৃতি মিলেছিল ১৯৫৬ সালে গৃহীত শাসনতন্ত্রে, তাও উধাও হয়ে গেল কারণ নিপীড়ন ও উপেক্ষার একই মনোভাব এদের মধ্যেও ছিল। পরে যা প্রবলভাবে বাঙালীয়ানাতে প্রকাশ পেয়েছিল। মুসলিম লীগ সরকারের মতন সামরিক শাসনচক্রও একই ভাবে বরং হিংস্রতার সাথে সংস্কৃতিকেও আঘাত করার কৌশল প্রথম দফায় প্রকটভাবে প্রকাশ করল। কিন্তু ১৯৫৯ সালের একুশে ফেব্রুয়ারীতে আদৌ কোন অনুষ্ঠান করা যাবে কিনা এই দোদুল্যমানতার মধ্যে ভাষাসৈনিক গাজীউল হক’সহ আমরা মাত্র কয়েকজন কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটি গেয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলাম। অনেকেই ভয়ে শহীদমিনারেও আসেননি। ফলে শহীদ স্মরণে পূর্ণাঙ্গ অনুষ্ঠান আয়োজিত হতে পারেনি। এই অবস্থা প্রত্যক্ষ করে সামরিক শাসকচক্র  বঙ্গসংস্কৃতির উপর কিভাবে হামলা চালাবে, তারই মতলব এঁটে ফেলল এবং প্রাথমিক পর্যায়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপর চড়াও হয়ে বেতারে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার হ্রাস ও নারী শিল্পীদের কপালে টিপ পরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। কিন্তু মহিলা শিল্পী যারা রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করতেন, তাঁরা কপালে টিপ পরে বেতার ভবনে যাওয়াটা আরও বেশী করে বাড়িয়ে দিলেন। আর রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচারও বন্ধ করতে পারলো না।

…. চলবে

 লেখক:
কামাল লোহানী: শব্দসৈনিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

Kamal Lohani

পূর্ববঙ্গের প্রতিরোধ লড়াই এবং রবীন্দ্রনাথ -এর চারটি পর্ব পড়ুন

পর্ব ০১
পর্ব ০২
পর্ব ০৩
শেষ পর্ব

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.