পূর্ববঙ্গের প্রতিরোধ লড়াই এবং রবীন্দ্রনাথ – পর্ব ০২

Comments

।। কামাল লোহানী ।।

১৯৬১ সাল এলো, কবিগুরুর জন্মশতবর্ষ। কবিগুরুকে আশ্রয় করে মার্শাল ল’র মাত্র আড়াই বছরের মাথায় রবীন্দ্রপ্রেমী সংস্কৃতিজন সকলে উদ্যোগ গ্রহণ করলেন এই মহতী দিন-কবিগুরুর জন্মউৎসবকে ব্যাপক ভাবে উদযাপনের। বাঙালি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সামরিক রক্তচক্ষুর শাসনকে অগ্রাহ্য করে একের পর এক রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করলো। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন এলাকায়তো বটেই খোদ ঢাকা শহরে-রাজধানীর বুকে তিনতিনটি উদযাপন পরিষদ দাঁড়িয়ে গেল। প্রধান হয়ে দেখা দিল ‘রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন পরিষদ (ঢাকা পূর্ব)’। সেখানে দেশের বরেন্য শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব একত্রিত হয়েছিলেন। এই কমিটির প্রধান ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল, তা সত্বেও প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন, কবি জসিমউদ্দিন, অধ্যাপক মনসুরউদ্দিন, এম.এ.বারী, মোখলেসুর রহমান (সিধু ভাই), সাংবাদিক ওয়াহিদুল হক, আহমেদুর রহমান, ডক্টর সনজীদা খাতুন, জাহিরুল ইসলাম, জাহিদুর রহিম, রাজনৈতিক কর্মী মিজানুর রহমান ছানা, ছাত্রনেতা সাইফুদ্দিন আহমদ মানিকসহ বহুজন সংশ্লিষ্ট ছিলেন।

পূর্ববঙ্গের প্রতিরোধ লড়াই এবং রবীন্দ্রনাথ -এর চারটি পর্ব পড়ুন

পর্ব ০১
পর্ব ০২
পর্ব ০৩
শেষ পর্ব

অন্য একটি কমিটি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর খান সরোয়ার মুরশিদকে প্রধান করে। এছাড়া ঢাকা প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের উদ্যোগে একটি কমিটি হয়েছিল তার যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন দৈনিক মিল্লাতের চিফ রিপোর্টার সৈয়দ আসাদুজ্জামান (বাচ্চুভাই) এবং আমি। প্রত্যেকটি কমিটির বিস্তারিত এবং তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন ছিল। ঢাকা পূর্ব কমিটি বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, তরুণ কর্মী এবং প্রথিতযশা শিল্পী সমবায়ে গঠিত ছিল বলে তাদের কর্মসূচী ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং ব্যাপক- গান, কবিতা, নাটক ও আবৃত্তিতে। এদের অনুষ্ঠানমালা জননন্দিত এবং বহুল প্রচার লাভ করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রশতবর্ষ উদযাপন কমিটি ক্যাম্পাসেই সীমাবদ্ধ ছিল। আর আমাদের কমিটি ছিল সংস্কৃতিমনা সাংবাদিক আর শিল্পী-সাহিত্যিকদের নিয়ে গঠিত। যেহেতু আমি এই কমিটির সাথে জড়িত ছিলাম, আমি, সৈয়দ আসাদুজ্জামান, তোফাজ্জল হোসেন সবাই মিলে বুলবুল একাডেমীর রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষক ভক্তিময় দাসগুপ্তের সাথে যোগাযোগ করলাম। তিনি গানের অনুষ্ঠান ছাড়াও নৃত্যনাট্য ‘শ্যামা’ করার পরামর্শ দিলেন এবং বাফা’র নৃত্যশিল্পী মন্দিরা নন্দীর সাথে দেখা করে তাকে এই উদ্যোগের কথা জানাতে বললেন। তিনি নিজেও বললেন কারণ মন্দিরার বড় বোন ইন্দিরা রবীন্দ্রসঙ্গীতে তারই ছাত্রী ছিলেন। সেই সুবাদে ডা. এম.এন.নন্দী পরিবারের সাথে তার সম্পর্ক্য খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল। কিন্তু আমার মনে দ্বিধা ছিল, তিনি কি দেবেন তাঁর মেয়েকে আমাদের কমিটির জন্যে কাজ করতে? বাচ্চুভাই উদ্ধারকর্তা হিসেবে নন্দী পরিবারের সাথে কথা বললেন এবং তারা রাজীও হলেন। কমিটি প্রস্তাব দিল ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যটি মঞ্চায়নের। ভক্তিদা সঙ্গীত পরিচালনাতো করবেনই প্রয়োজনে মন্দিরাকেও নাচ কম্পোজিশনে সহায়তাও করবেন। ভক্তিদাই নাম ভূমিকায় মন্দিরাকে ঠিক করে বাফার ছাত্র অজিত দে’কে বাছাই করলেন ‘বজ্রসেন’ চরিত্রে। র‌্যাঙ্কিন স্ট্রীটে ডা. নন্দীর বাসায় রিহার্সেলের ব্যবস্থা হয়েছিল কারণ ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্য রিহার্সেল করতে যে পরিসর দরকার সেটা ছিল ঐ বাড়ীতে আর মন্দিরা এই বাড়ীরই মেয়ে। দোতলা বাড়ীটার নিচতলার আঙ্গিনাটা সমবেত বা কোরাস নাচের জন্য বেশ প্রশস্তই ছিল। সেখানেই রিহার্সেল করছিলেন ভক্তিময়দা আর অজিত দে। প্রথমে বজ্রসেন খুঁজে বের করার চেষ্টায় ভক্তিদার নিরন্তর প্রয়াস ছিল চোখে পড়ার মত। সময় ও শ্রম দিয়ে তিনি যেভাবে নৃত্যনাট্যকে গুছিয়ে আনতে চেষ্টা করছিলেন মন্দিরাকে নিয়ে, তা সত্যিই কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধার প্রবল বহিঃপ্রকাশ বলতেই পারি। মন্দিরা নন্দী নাচের দিকটা নজরদারি করছিলেন আর তাতে ভক্তিময়দার উপরি অভিভাবকত্ব চলছিল বেশ। এদের দুজনের আন্তরিক সহযোগিতায় আমাদের আস্থা ছিল বলে এদিকটায় আমরা কেউই চিন্তিত ছিলাম না এবং নিজেরা উৎসব ব্যবস্থাপনায় ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ একদিন ভক্তিদা আমায় ডেকে পাঠালেন। বললেন,“অজিত ‘বজ্রসেন’ করতে পারবে না, আমি বিকল্প হিসেবে তোমাকেই ভাবছি, মন্দিরাও বলেছে।” শুনে বললাম, “রবীন্দ্রশতবর্ষ উপলক্ষ্যে যে আয়োজন তাতে আমাকে সরাসরি কাজকর্ম করতে হচ্ছে, ওদিকে তো সমস্যা দেখা দেবে, আমি যদি এদিকে ব্যস্ত হয়ে যাই। তাছাড়া, আমি কি পারব”? আমাদের নাচের তেমন কোন প্রশিক্ষণ ছিল না কেবল ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ নৃত্যনাট্যে একজন অংশগ্রহণকারী হওয়া ছাড়া। একেবারে সরাসরি ‘বজ্রসেন’ চরিত্রে নাচবার মতন শিক্ষা কি আছে? এই নৃত্যনাট্যের নায়িকা হলো মন্দিরা সেখানে আমি কি করে বজ্রসেন হই। মন্দিরা নাচে অভিজ্ঞ বহুদিন থেকে, বুলবুল একডেমীতে প্রশিক্ষণ নেয়া। ভয় পাচ্ছিলাম খুব, পারবো কি? ভক্তিদা সহায়। তিনি ভরসা দিলেন, “তোমায় ভাবতে হবেনা, প্রয়োজনে যত সময় লাগে রিহার্স করবো, এটা তোমাকে করতেই হবে।” আমি তো কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক, অনুষ্ঠানমালা সুষ্ঠুভাবে পরিবেশনার দায়িত্বও তো আমাদের হাতে, কি করি। অবশেষে দায়বদ্ধতার কারণে এ প্রস্তাবে আমাকে রাজি হতে হলো। শুরু হলো রিহার্সেল। শ্যামা নৃত্যনাট্যের গানে নানা ছন্দ ও তাল ব্যবহার করেছেন কবি। এর মধ্যে কাহারবা, দাদরা কিংবা ডবল দাদরা, তেওড়া খুব একটা ভয়ের নয়, বাদ সাধলো দশমাত্রার ঝাপতাল। বেশ কটা গান আমার বজ্রসেন চরিত্রেই রয়েছে, একে রপ্ত করা আমার জন্য দুরূহ। ভক্তিদা বললেন, “একবার না পারিলে দেখো শতবার। আমি আছি চিন্তা কোরো না”। দরকার হলে একশোবার গাইবো। অবশেষে ভক্তিদার ভরসায় রাজি হয়ে গেলাম। শেষ পর্য্যন্ত আমিই হয়ে গেলাম ‘বজ্রসেন’। মন্দিরা হলেন ‘শ্যামা’। আমার বজ্রসেন চরিত্রে নাচার কৃতিত্ব নৃত্য পরিচালক হিসেবে মন্দিরা নন্দী আর সঠিক তত্ত্বাবধান ও সঙ্গীত পরিচালক ভক্তিময় দাশগুপ্তের।

এতো গেল আমাদের কমিটির আয়োজন । কিন্তু অন্য দুটি কমিটি আর ঢাকা শহরের বাইরেও মফস্বল এলাকায় ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপনে। এর মধ্যে ঢাকা পূর্ব উদযাপন কমিটি ছিল বরেণ্যজন যেমন সমৃদ্ধ, তেমনি প্রগতিশীল রাজনীতির তরুণ কর্মীরাও প্রবল প্রাণশক্তিতে ভরপুর। ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই’- কবিগুরুর এই মন্ত্রে দীক্ষিত বাহিনীও কাজ করছিল। ওদেরও তিনদিনের ব্যাপক অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল। বিপুল সে আয়োজনে কমিটির বয়োজ্যেষ্ঠরা ছাড়াও তরুণ বাহিনী অনুষ্ঠানমালা আয়োজনে ব্যস্ত ছিলেন। আর এর ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ঢাকা পূর্ব কমিটি ‘পুরনো বাংলা গানের আসর’ আয়োজন করলেন পরবর্তি সময়ে। অভাবিতপূর্ব সফলতা অর্জনে আবেগে আপ্লুত এই শক্তি বিশাল কর্মকান্ড শেষে বিনোদনের উদ্যোগ নিয়ে ঢাকার অদুরে বনভোজনে বেরুলো একদিন। আর এই পরিবেশেই ঢাকা পূর্ব কমিটির সকল সদস্য সিদ্ধান্ত নিলেন- এরপর এই সমন্বিত শক্তিকে ধরে রাখার জন্য একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা হবে। এর ধারাবাহিকতাকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত করতে কমিউনিস্ট পার্টির একটা ভূমিকা ছিল তা অস্বীকার করা যাবেনা। সত্যি কথা বলতে কি, সবার গোপনেই পার্টির উদ্যোগেই গড়ে উঠলো ‘ছায়ানট’। ‘ছায়ানট’ শব্দটা নিয়েও পার্টিতে বিতর্ক হয়েছিল। কিন্তু পরে এই নামই থেকে গিয়েছিল। ওঁরা ভাবলেন, এই নামের ছদ্মাবরণে পার্টির কাজ করা সহজ হবে। এক্ষেত্রে সাংবাদিক ও সঙ্গীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন। সর্বজনশ্রদ্ধেয় বেগম সুফিয়া কামালকে সভানেত্রী এবং ফরিদা হাসানকে সম্পাদক করে প্রথম নির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। …. চলবে

 লেখক:
কামাল লোহানী: শব্দসৈনিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

Kamal Lohani

 

 

 

 

পূর্ববঙ্গের প্রতিরোধ লড়াই এবং রবীন্দ্রনাথ -এর চারটি পর্ব পড়ুন

পর্ব ০১
পর্ব ০২
পর্ব ০৩
শেষ পর্ব

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.