পেন্ডুলাম
চোখ থেকে মুগ্ধতার পর্দা সরে গেলে
পড়ে থাকে কুৎসিত একদলা অন্ধকার
তড়িঘড়ি করে নটে গাছটি মুড়িয়ে ফেলবে-
জীবন তো রূপকথার কোনো গল্প নয়,
সোনারকাঠি রুপোরকাঠি আর জাদুর কৌটায়
ডাইনির প্রাণভোমরা লুকোনো থাকে না
এখানে জীবন সংঘর্ষময়-প্রতিনিয়ত সংশয়
বিশ্বাস অবিশ্বাসে দোদুল্যমান প্রতিটি ক্ষণ,
পাংশুটে সময়ের পেন্ডুলামে দুলতে থাকে
অমীমাংসিত গল্পের শেষ অধ্যায়
আর আমরা নিয়তির মতো ক্ষয়ে যাই যাপিত
জীবনের যাবতীয় সন্তাপ নিয়ে।

নিত্যপুরাণ
পড়ন্ত বেলায় ডানায় রোদ মেখে যে শালিক
নীড়ে ফেরে তার চোখে দিব্য খড়কুটো সংসার
শরীর থেকে চুঁইয়ে পড়া বিষাদের ঘাম
চেটোতে মুছে তুমিও হয়ে যাও দুরন্ত প্রেমিক
পথ ও পথিকের গল্প সে তো নিত্যপুরাণ
তোমাকে কাছে পাই, না পেয়েও বেশি
যেমন কোনো কোনো যাত্রী ট্রেনের জানালায়
মন রেখে চোখে গেঁথে নেয় ছেড়ে আসা প্ল্যাটফর্ম
সংগোপনে বুকে তুলে রাখে জলজ নিঃশ্বাস,
পৃথিবীর গায়ে জ্বর, পায়ে গ্যাংগ্রিন ধনুষ্টংকার
তবুও জোনাকিরা জরায়ুতে আগুন নিয়ে প্রেম
বুনে যায় নিথর রাত্রির গায়।

মাপজোখ
দুচোখ প্রসারিত করে যেটুকু আলো
কুড়িয়ে নিই
তাও ধুয়ে যায় ক্ষয়িষ্ণু বর্ষার অকাল প্লাবনে
সময়ের হাত ধরে এক পা দুপা করে
আমিও হারিয়ে যাই চুপিসারে দিকচিহ্নহীন প্রান্তরে
কানেকানে ঘাসফুলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
জ্যামিতি বোঝো?
বৃত্ত ত্রিকোণ চতুষ্কোণ রম্বস ব্যাসার্ধ ?
বুনোডুমুরের ঝাড় নুয়ে এসে বলেছিল
এখানে জ্যামিতিক মাপজোখ লেখা হয়
অরণ্যচারী পাখিদের ডানায় ডানায়,
হরিণশাবক লিকলিকে পায় যতদূর হেঁটে যায়,
পাহাড়ি নদীর ছুটে চলার ক্ষিপ্রতায়।
এখানে নাগরিক সভ্যতা আর গাণিতিক প্রেম
অচল পয়সার মতো পড়ে থাকে পথের ধূলোয়
এখানে ভাঁট আর কলমিরা জড়াজড়ি করে ভেজে কামুক জ্যোৎস্নায়।
এখানে আঁধারের আঁতুড়ঘরে জন্ম নেয় আলোর ফুলকি, নম্র কুসুম।
আমি চিরদিন সেই কুসুমের দিকে,
নম্রতার দিকেই হাত পেতে থাকি!

একটা তুই
তুই ছিলি বলে অমানিশা রাতে
আঁধারে পাইনি ভয়
তুই ছিলি বলে পুড়িনি দাহে
হইনি তো আজও ক্ষয়,
তুই ছিলি বলে বুকেতে এখনো
রক্ত গোলাপ ফোটে
শত ঝড়ে আমি হাসিটুকু তাই
জিইয়ে রেখেছি ঠোঁটে
তুই ছিলি বলে আশার প্রদীপ
আজও ধিকিধিকি জ্বলে
কত যামিনী ভোর হয়ে গেল
কত মোম গেল গলে!
তুই ছিলি বলে অমরাবতীও
গুনগুন করে গায়
কত অলিদল বিভাসে ব্যাকুল
লুটিয়ে পড়েছে পায়
তুই ছিলি বলে আকাশের চাঁদ
উঁকি দেয় জানালায়
তারার পালকি নেমে এসে বলে
চলো কোনো নিরালায়
তুই ছিলি বলে, তুইময় দিন
সবকিছু ভালো লাগে
তুই ছিলি বলে হাজার বছর
বাঁচবার সাধ জাগে।

বৃক্ষপাঠ
এসো চুপিসারে ঢুকে পড়ি পাতাদের পাঠশালায়
নির্জনে শিখে নিই বৃক্ষপাঠ-
অতঃপর,
প্লাবনের জল নেমে গেলে নতুন পলির বুকে
দুহাতে স্বপ্নবীজ বুনে দেবো পরম মমতায়।
লাঙলের ফলায় মাটির সোঁদা গন্ধ হব
কলমির ফুল হব,ডাহুকির বাসা হব নলখাগড়ায়।
বকফুলে হলুদ সরিষার ক্ষেতে প্রজাপতি হয়ে
উড়ে উড়ে পরাগরেণু ছড়াব বন বীথিকায়,
লাউয়ের মাচায়।
ঘাসফড়িংয়ের পাখায় পাখায় বুনোফুলে রোদ হব,
পাহাড়ি নদী হব
ডানকানা মাছ হব জোনাকির আলো হব
কৃষকের হাসি হব এই বাংলায়
ঠিক একদিন, পাতাকুড়ানি কিশোরীর
জাফরানি ওড়নায় সোনারঙ ভোর হব ভুবনডাঙায়।
লেখক:
পারভীন শাহনাজ, কবি