মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহীর পুঠিয়ায় হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের মত মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকার অপরাধে মো. আব্দুস সামাদ (মুসা) ওরফে ফিরোজ খাঁকে ফাঁসির রায় দিয়েছে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মঙ্গলবার আসামির উপস্থিতিতে এ রায় ঘোষণা করে।

যুদ্ধাপরাধী মো. আব্দুস সামাদ (মুসা) ওরফে ফিরোজ খাঁ
মুসলিম লিগ কর্মী সামাদ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেয় এবং স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর সদস্য হিসেবে পুঠিয়ার গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত হয়, যা বিচারে প্রমাণিত হয়।
১৭৪ পৃষ্ঠার রায়ে আদালত বলেছে, আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা চারটি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিটি অভিযোগেই তাকে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। যে ধরনের অপরাধ আসামি আব্দুস সামাদ ঘটিয়েছেন, তাতে তাকে ‘এনিমি অব দ্য অল হিউম্যান রাইটস’ হিসেবে বর্ণনা করা হয় রায়ে।
তবে এই রায়ে সন্তুষ্ট নন জানিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান বলেন, তারা সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করবেন।
অন্যদিকে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রসিকিউটর জাহিদ ইমাম তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আসামি যে অপরাধ করেছে, সন্দেহাতীতভাবে সেসব অপরাধ আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সামাদ পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ নিয়ে পুঠিয়ার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটায় এবং চারজন সাঁওতালসহ ১৫ জনকে হত্যা, ২১ জনকে নির্যাতন, ৮ থেকে ১০টি বাড়িঘরে লুণ্ঠন এবং ৫০ থেকে ৬০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগে অংশ নেয় বলে অভিযোগ করা হয় মামলায়।
অভিযোগ ১: একাত্তরের ১৯ এপ্রিল পুঠিয়ার ভালুকগাছী ইউনিয়নের দমদমা, সুখদেবপুর, বাঁশবাড়ি ও গতিয়া গ্রামে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা।
অভিযোগ ২: একাত্তরের ১৯ এপ্রিল পুঠিয়ার গণ্ডগোহালী, চকপলাশী, বৈরাগীবাজার ও বাঁশবাড়ি গ্রামে ছয়জনকে অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা।
অভিযোগ ৩: একাত্তরের ১৯ এপ্রিল পুঠিয়ার ভালুকগাছী ইউনিয়নের পশ্চিমবাগ গ্রামের সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন, হত্যা ও গণহত্যা।
অভিযোগ ৪: একাত্তরের ২০ এপ্রিল পুঠিয়ার ভালুকগাছী ইউনিয়নের ঢোকরাকুল গ্রামে একজনকে আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা।
তদন্ত কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনলেও যাচাই-বাছাই শেষে চারটি অভিযোগের ভিত্তিতে আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দাখিল করে প্রসিকিউশন। মানবতাবিরোধী এই চার ঘটনাতেই আসামি আব্দুস সামাদ (মুসা) ওরফে ফিরোজ খাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
প্রসিকিউশনের তদন্ত দল ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর যখন এ মামলার তদন্ত শুরু করে, তখন আসামি করা হয়েছিল ৬ জনকে। কিন্তু তদন্ত চলার সময়ই বাকি পাঁচ আসামির মৃত্যু হলে একমাত্র আসমি হিসেবে থাকে মো. আব্দুস সামাদ (মুসা) ওরফে ফিরোজ খাঁ।
তদন্ত চলার মধ্যেই নাশকতার একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় সামাদকে। পরে ২০১৭ সালের ২৪ জানুয়া্রী তাকে যুদ্ধাপরাধের এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
তার ওপর শুনানি করে আদালত ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। এরপর ১০ অক্টোবর প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ।
উল্লেখ্য. আব্দুস সামাদ (মুসা) ওরফে ফিরোজ খাঁর বাড়ি রাজশাহীর পুঠিয়ার ত্রিমোহিনী বাজারের কাঁঠালবাড়িয়া গ্রামে। ১৯৭১ সালে দেশে যখন স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়, সময় তার বয়স ২০ বছরের মত। মামলা সূত্রে জানা যায়, চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করা সামাদের পূর্বপুরুষ এদেশে এসেছিল ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে। মুক্তিযুদ্ধের পর সামাদ বেশ কিছুদিন পলাতক ছিল।
বাঙালীয়ানা/এসএল