পূজোর ছুটি নিয়ে কেন এ স্বেচ্ছাচারিতা? । রঞ্জন সরকার

Comments
“বৃষ্টি ভেজা শরৎ আকাশ, শিউলি ফুলের গন্ধ। মা আসছেন আবার ঘরে, দরজা কেন বন্ধ? পুজো এলো তাইতো আবার বাজনা বাজায় ঢাকী। গুনে দেখো পুজো আসতে আরো কিছুদিন বাকি”।

পঞ্চগড় জেলার অজপাড়া এক গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান নিলয়। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পরিবার পরিজন ছেড়ে ঢাকা শহরের নামকরা এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হয়েছে বছর চার হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশি ভাগ শিক্ষার্থীই ঢাকা শহরের বাহিরের মফস্বল থেকে আসা।

এখনও তার স্পষ্ট মনে আছে ভর্তির পর প্রথম দুর্গাপূজার কথা। যে পূজায় নিলয় এর মনে উৎসবের আমেজ ছিল না। পূজার কয়েক দিন শুধু ক্ষণে ক্ষণে চোখের কোনে জল জমেছে। হয়তো অনেকেই দেখেছি কিন্তু তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা ছিলো না কারো। কারণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয়া দুর্গাপূজা। ষষ্ঠী থেকে শুরু করে দশমী পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী এই উৎসব নানা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয় বাংলাদেশের প্রায় ৩১ হাজার পূজা মণ্ডপে। এর মধ্যে একটি সুপরিচিত মন্ডপ হলো তার নিজ গ্রামের। যেখানে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর তিথী অনুসারে অঞ্জলি নিতেন নিলয় এবং ধুমধাম করে পরিবার পরিজন নিয়ে নিলয় মেতে থাকেন পূজার পাঁচ দিন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ার পর সুযোগই হয়নি পূজায় অংশগ্রহণ করার। কারণ পূজা উপলক্ষে একদিনের বেশি ছুটি মেলে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ যে শুধু ক্লাস নেয় পুজোর মধ্যে তাই নয়, ল্যাব পরীক্ষা ও মিডট্রাম এর মত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাও দশমীর আগেরদিন পর্যন্ত নে্যা হয়। প্রতিবারই এমন কিছু না কিছু সমস্যায় পড়েছেন নিলয়। কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও এখন পর্যন্ত কোন সমাধান হয়নি। বরং পূজার মধ্যে তাকে বাধ্য হয়ে দিতে হয়েছে পরীক্ষা। তাই তার আর নাড়ির টানে বাড়ি যাওয়া হয়নি।

আজকাল নিজেকে কেমন জানি একা একা ভাবে নিলয়। কারণ, সে স্কুল-কলেজে পড়াকালিন কখনো এমন কোন বৈষম্যমূলক আচরণ লক্ষ করেনি। আর এটাও ভাবেনি যে সে তার ধর্মীয় উৎসবের অংশগ্রহণ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে। তখন প্রতিবারই সর্বনিম্ন ৭ দিনের ছুটি পেয়েছে দুর্গাপূজার উপলক্ষে।

‘দুর্গাপূজা উপলক্ষে একদিন রাষ্ট্রীয় ছুটি থাকে। তবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ কতৃক সরকারি/বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় সমূহ ২০২০ইং অনুযায়ী অন্যান্য ছুটির মত দুর্গাপূজার ছুটি ২২ অক্টোবর থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ৭ দিনের ছুটি ঘোষণা কথা হয়েছে’।

নিলয়ের মনে এখন খুব তাড়া দেয়, ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার রূপ রেখা কি এমন হওয়ার কথা ছিল? একজন শিক্ষার্থী তার নিজ ধর্মীয় উৎসবের অংশগ্রহণ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের ও দেশের সংবিধান এর অনুচ্ছেদ- ২(ক) এ সুস্পষ্ট লেখা আছে, “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান সহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন”।

অনুচ্ছেদ-১২ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা’ ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য, “সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা ও কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন, বিলোপ করা হইবে”।

অনুচ্ছেদ-৪১ ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’ “আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে”।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার পর নিলয় বারংবার তার ধর্মীয় অধিকার পালন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়মিত লঙ্ঘন করে যাচ্ছে এই মহান সংবিধান। দেখার ও বলার যেন কেউ নেই। এখন প্রশ্ন হলো যে অধিকার রাষ্ট্রের মহান সংবিধান অনুযায়ী প্রদত্ত, সেই অধিকার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি হরণ করার ক্ষমতা কি রাখে? উওর হলো না রাখে না। আরো প্রশ্ন নিলয়ের মনে জাগে যে ইউজিসিও কি এই বৈষম্যমূলক আচরণ সমর্থন করে? তবে কেন এমন হচ্ছে? মনপোকায় কুরে কুরে খায় এইসব প্রশ্ন গুলো নিলয়কে। পরে নিজে নিজে ভাবে হয়তো ইউজিসিও এগুলো সমর্থন করে বলেই তারা এমন অন্যায় অবিচার করে যাচ্ছে বছরের পর বছর।

আলোচ্য বিষয় হলো সরকারি/ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট কোন ছুটির  তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ইউজিসি কর্তৃক করা হয় না। তাই বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে দুর্গাপূজার ছুটি নিয়ে বছরের পর বছর অমানবিক ও বৈষম্যমূলক আচরণ খুব স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। ৫ দিনের দুর্গাপূজার তারা বেশির ভাগ একদিনের ছুটি ধার্য করে হয়তো রাষ্ট্রীয় ছুটির ক্যালেন্ডার দেখে। কিন্তু তারা কি অবগত নন যে রাষ্ট্রীয় ছুটির ক্যালেন্ডার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির ক্যালেন্ডার এক নয়?

এইতো গত বছরের কথা হলেও এটা নিলয়কে ভর্তির পর প্রতি বছরই দেখতে ও শুনতে হয়, পূজার আগেই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী মিলে কর্তৃপক্ষকে অবগত করেন ও লিখিত দেন। কিন্তু কোন প্রতিকার নেই, উওরে শুধু আশার আলো। তবে সেই আলো এখনো চোখে দেখেনি নিলয় ও তার সহপাঠীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন বৈষম্যমূলক আচরণে শিক্ষার্থীরা প্রায়ই ক্ষুব্ধ হন। তবে লাভ হয় না। কারণ, কর্তৃপক্ষ তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন।

নিলয় এর মাথায় শুধু একটা কথাই ঘোড়ে, “এই গুলো কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করেই করে কি আমাদের মানসিক চাপে রাখার জন্য, চোখে আঙ্গুল দিয়ে বোঝানোর জন্য আমি হিন্দু, তোমার পুজার সময় তুমি পরীক্ষা দেবে কারণ তোমার ধর্মীয় উৎসবের কোন গুরুত্ব নেই আমাদের কাছে। তোমার গুরুত্ব নেই”।

অপরদিকে যদি নিলয়ের ভাবনাকে তারা অস্বীকার করে থাকে, যে তারা খেয়াল করেনি, তবে এটা বড় ধরনের প্রশাসনিক ব্যর্থতা। কিন্তু এমন ব্যর্থ প্রশাসন দিয়ে বছরের পর বছর কিভাবে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলো চলছে? এমন প্রশ্ন জনমনে আসতেই পারে।

করোনা মহামারীর প্রকোপ এ পুরো বিশ্ব নত হয়ে রয়েছে। সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইউজিসি নির্দেশনা মোতাবেক ১ জুলাই থেকে অনলাইনে চলছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হয়। সেই অনুযায়ী নিলয়ও চালিয়ে যাচ্ছে পড়াশোনা বাসায় থেকে। দেখতে দেখতে অনেক মাস চলে গেছে এবং দেশের সব কিছুই চলছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে।

করোনা মহামারীর কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশের পূজা উদযাপন পরিষদ কর্তৃক ঘোষিত দিকনির্দেশনা মেনে যথাযথ ধর্মীয়  নিয়মনীতি অনুযায়ী শারদীয় দুর্গাপূজার প্রস্তুতিও  শুরু হয়েছে। আগামী ২২ অক্টোবর ষষ্ঠীর মধ্যে দিয়ে শুরু হবে পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গাপূজা ২৬ অক্টোবর দশমীর দিয়ে শেষ হবে।

কিন্তু নিলয়ের চোখে মুখে বিষণ্ণতা ছাপ ফুটে উঠেছে। তিনবছর পর নিলয় পূজার সময় বাসায়। তার মনে তবুও আনন্দ নেই। কারণ সেই বিশ্ববিদ্যালয় গল্পের রাক্ষসের মত সব আনন্দ কেড়ে নিয়েছে গত তিন বছর। করোনা সময়ে এসেও এই রাক্ষসের কবল থেকে মুক্তি নেই। হতাশাজনক হলেও সত্যি যে নিলয়ের মিডট্রাম পরীক্ষা ১৮ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর ২০২০ইং পর্যন্ত। মানে সবাই পূজার মজা করবে আর নিলয়ের বই খাতা নিয়ে বসে থাকতে হবে এবং পরীক্ষা দিতে হবে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপনি হয়তো নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন। আসলেই আপনি ভাগ্যবান। কারণ আপনার কখনো নিলয়ের জায়গায় নিজেকে ভাবার সুযোগ হয়নি। তবে আজ একটু হলেও আপনার সেই সহপাঠীদের কথা ভাবুন। এমন বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্তে যাদের আনন্দ মাটি হচ্ছে। এই বৈষম্যমূলক বাবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলুন। আপনি কথা না বললে নিলয়ের এর পাশে যে কেউ নেই। নিলয় আপনাদের সবার মাঝে বড্ড একা হয়ে যাবে। আপনারা আছেন বলেই হয়তো নিলয় সাহসের সাথে এমন বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে আজও।

আর এই যে, সুশীল, আপনাদের বলছি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টান। না হয় এই কলঙ্ক আপনার। কারণ, আপনাদের জন্য হাজারো নিলয় তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এর দায় ভার শুধু আপনার।

কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্যাডেমিক ক্যালেন্ডার এর বিবরণ দিচ্ছি যাতে আপনাদের ধারণাও স্পষ্ট হয় নিলয়দের অবস্থা সম্পর্কে,

  • Brac University, Year Planner 2020: অনুযায়ী দূর্গাপূজার ১ দিন ছুটি দিয়েছে ২৬ অক্টোবর।

  • Daffodil International University, Fall Semester 2020: অনুযায়ী দূর্গাপূজার ছুটি দিয়েছে ১ দিন ২৬ অক্টোবর।

  • European University Of Bangladesh, Fall Semester 2020: অনুযায়ী দুর্গাপূজার ছুটি দিয়েছে ১ দিন ২৬ অক্টোবর। কিন্তু মিডট্রাম পরীক্ষা ১৮ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত।

  • South East University, Revised Academic Calendar 2020: অনুযায়ী দুর্গাপূজার ছুটি দিয়েছে ২ দিন যথা: ২৫ ও ২৬ অক্টোবর।

  • Stamford University Of Bangladesh, Fall Semester 2020: অনুযায়ী দুর্গাপূজার ছুটি দিয়েছে ২ দিন যথা: ২৫ ও ২৬ অক্টোবর। কিন্তু মিড ট্রাম পরীক্ষা ১৭ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত।

  • University Of Asia Pacific, Spring Semester 2020: অনুযায়ী দুর্গাপূজার ছুটি দিয়েছে ১ দিন ২৬অক্টোবর।

  • University Of Liberal Arts Bangladesh, Revised Academic Calendar Fall 2020: অনুযায়ী দুর্গাপূজার ছুটি দিয়েছে ২ দিন যথা: ২৫ ও ২৬ অক্টোবর।

শারদীয়া দুর্গাপূজা ২০২০, ২২ অক্টোবর ষষ্ঠীর মধ্যে দিয়ে শুরু ২৬ অক্টোবর দশমী দিয়ে শেষ হবে। এখন ভাবুন আর ভাবুন। আপনার আমার আমাদের কি করা উচিত?

সবাইকে অগ্রিম শারদীয়া দুর্গাপূজার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

লেখক:
Ranjan Sarker
রঞ্জন সরকার, শিক্ষার্থী, চতুর্থ বর্ষ, আইন ও মানবাধিকার বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক (ইউএপি)
[email protected]

ফিচার ফটো: অজয় কুন্ডু

*প্রকাশিত লেখার মতামত ও বানানরীতি লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই এখানে প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.