চট্টগ্রামের উত্তর উপকূলে অবস্থিত দীর্ঘ ১১ কিলোমিটার ব্যাপী পৃথিবীর বৃহত্তম জাহাজভাঙ্গা শিল্প। পুরনো, বিকল, পরিবহনে অক্ষম, অকেজো, মেরামতের অযোগ্য কার্গো শীপ বা তেলবাহী ট্যাঙ্কারগুলোর শেষ ঠিকানা শীপ ব্রেকিং ইয়ার্ড। আর পুরো পৃথিবীর চার ভাগের একভাগ বিকল জাহাজ ভাঙার কাজটি করা হয় বৃহত্তম এই শীপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে। মূলত আশির দশকে বাংলাদেশে পথচলা শুরু হয় এই শিল্পের। শ্রমমূল্য কম হওয়ায় এবং দেশের শিল্প কারখানাগুলোতে লোহার চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় ধীরে ধীরে চারাগাছ থেকে মহীরুহে পরিণত হয় এই শিল্প।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের শিল্প-কারখানাগুলোর প্রয়োজনীয় লোহার ৮০-৯০ শতাংশই আসে ফৌজদারহাট ও সীতাকুন্ডে অবস্থিত শীপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে। সাধারণত একটি জাহাজের ৯৫ শতাংশই মাইল্ড স্টিল দিয়ে তৈরি হয়। ২ শতাংশ স্টেনলেস স্টিল এবং বাকি ৩ শতাংশ থাকে বিভিন্ন ধাতবের মিশ্রণ, যা রডশিল্প সহ অন্যান্য শিল্পের মূল কাঁচামাল। নির্মাণকার্যে ব্যবহৃত রড উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের প্রায় পুরোটাই আসে এই শিল্প থেকে। ২০১৭ সালের এক তথ্য অনুযায়ী প্রায় বাংলাদেশে দুই লক্ষাধিক শ্রমিক ১২০টি শীপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে নিয়োজিত আছে।
তবে শ্রমিক এবং পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হওয়ায় অনেক দেশ এই শিল্প থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের দিকে ঝুঁকেছে। তাইওয়ান, চীন, স্পেন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালী, ক্রোয়েশিয়া প্রভৃতি দেশ এর ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে এই শিল্প থেকে সরে গেছে। ২০০৮ সাল নাগাদ এসব দেশের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে কমেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মতো উপকূলবর্তী স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে উৎপাদন বেড়েছে। একটা ছোট উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। ১৯৭৭ সালে তাইওয়ানে এই শিল্প থেকে উৎপাদিত ধাতুর পরিমাণ ছিলো ৩৩৯১ টন, স্পেনের ৮৭৩ টন, ইতালির ২৯৯ টন। ২০০৮ সাল নাগাদ তাইওয়ান ও ইতালি এই শিল্প বন্ধ করে দিয়েছে আর স্পেনে তা কমে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ৬ টনে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে ১৯৮০ সালের দিকে শুরু হওয়া এই শিল্পের উৎপাদন বেড়ে ২০০৮ সালে এসে দাঁড়ায় ৪১৭৬ টনে। পাকিস্তান এবং ভারতেও এই শিল্পে উৎপাদন বেড়েছে।
বাংলাদেশে এই শিল্পের প্রসার বাড়লেও নিশ্চিত হয়নি কাজের সঠিক পরিবেশ। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কোনরকম সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা (ভারি বুট, হার্ড হ্যাট, গ্যাস মাস্ক ইত্যাদি) ছাড়া কাজ করার কারণে প্রতি মাসে গড়ে ২ জন শ্রমিক মারা যায় দুর্ঘটনায়। জাহাজ কাটার সময় বিষাক্ত গ্যাসের উপস্থিতির কারণে প্রায়ই বিস্ফোরণ ঘটে। এ শিল্পের শ্রমিকদের কাজের ঝুঁকি অনেক বেশি। মূলত দুইটি ভাগে শ্রমিকরা কাজ করে। শ্রমিকদের একাংশ জাহাজ ভাঙ্গা-কাটার কাজ করে, আরেকদল জাহাজের সেই কাটা অংশ বয়ে নিয়ে আসে তীরে। সেখানে জাহাজের ঐ অংশটাকে আবার ছোট ছোট অংশে কেটে কারখানায় পাঠানো হয়।
অধিকন্তু, এ কাজের সাথে জড়িত শ্রমিকদের Asbestos, PCB এর মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসতে হয় প্রায়ই। এসব বিষাক্ত রাসায়নিক শুধু যে মানবদেহে দীর্ঘস্থায়ী অসুখের জন্ম দেয় তা নয়, পানিকেও মারাত্মকভাবে দূষিত করে। এছাড়াও ওজোন স্তরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পলিইউরাথেন ফোমও উৎপাদিত হয় এই শিল্পের বাই প্রোডাক্ট হিসেবে। যা পরিবেশ এবং শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। অথচ, এই দূষণ ও উপযুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে নেই কোন কার্যকর উদ্যোগ। ২০০৯ সালের মার্চে হাইকোর্ট থেকে দেওয়া এক রায়ে এই শিল্পের শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা আর উপযুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু কর্মপরিবেশ নিরীক্ষণ ও নিশ্চিত করার জন্য কোনো সরকারী কর্তৃপক্ষ না থাকায় শেষপর্যন্ত পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব হয় নি। এই শিল্প স্থাপনের জন্যে বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হলেও পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই সাগরের কূলবর্তী অঞ্চলে চলছে একের পর এক ইয়ার্ড স্থাপন। এছাড়াও, গ্রীনপিস সহ আন্তর্জাতিকভাবে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন বাংলাদেশের জাহাজভাঙ্গা শিল্পের বর্জ্য নিষ্কাশন নিয়ে বরাবরই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। কারণ এই শিল্পের বর্জ্য হিসাবে ভারি ধাতু, তেল সহ ক্ষতিকারক সব রাসায়নিক সরাসরি সাগরে নিষ্কাশিত হয় বলে সাগরের জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা আছে।
অন্যদিকে ২০১৭ সাল নাগাদ এই শিল্পে কাজ করা শ্রমিকদের মজুরিও ছিলো অত্যন্ত কম। ২০১৭ সাল পর্যন্ত শ্রমিকরা নূন্যতম ৪৬২৫ টাকা মজুরীতে কাজ করতো। পরবর্তীতে সংবাদ মাধ্যম, শ্রমিক সংগঠন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘ তৎপরতায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারীতে শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরী বৃদ্ধি করে বাংলাদেশ সরকার। ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে জাহাজ ভাঙা শ্রমিকদের নতুন ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করে আদেশ জারি করা হয়েছে। চারটি গ্রেডের মধ্যে অদক্ষ বা চতুর্থ গ্রেডের শ্রমিকদের মূল মজুরি নির্ধারণ হয়েছে ৮ হাজার টাকা। মূল মজুরির ৫০ শতাংশ হিসাবে শ্রমিকরা বাড়ি ভাড়া ভাতা পাবেন ৪ হাজার টাকা। ২ হাজার ৫০০ টাকা চিকিৎসা ও ১ হাজার ৫০০ টাকা যাতায়াত ভাতাসহ একজন শ্রমিকের মোট মাসিক মজুরি ১৬ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। দৈনিক হিসাবে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দাঁড়াবে ৬১৫ টাকা। যা দীর্ঘসময় পর শ্রমিকদের জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিয়েছে। কিন্তু কাজের পরিবেশ রয়ে গেছে আগের মতোই বিপজ্জনক ও অস্বাস্থ্যকর।
বাংলাদেশে এই শিল্পের সঠিক বিস্তারের এবং পরিবেশের কথা মাথায় রেখে সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন ও কার্যকর করা অত্যন্ত জরুরী। দরকার সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। অন্যথায়, এই শিল্পের অগ্রগতির সাথে সাথে বঙ্গোপসাগর পরিণত হবে উন্নত দেশে তৈরি ভাঙ্গা জাহাজের আস্তাকুঁড়ে। সম্ভাবনাময় এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে দরকার আধুনিক প্রযুক্তি আর দক্ষ শ্রমশক্তির মিশেল। তাই এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের দক্ষতা উন্নয়নের পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় হতে হবে আরও মনোযোগী।
বাংগালীয়ানা/এএ/এজে