প্রতিষ্ঠান-বিরোধী এক একাকী প্রতিষ্ঠান

Comments

সাহিত্য যদি জীবনের বিম্ব হয় তো ব্যক্তি তার কেন্দ্র, সমাজ পরিধি। বীক্ষণের বিবেচনাসমূহ প্রকাশ প্রেক্ষিত। প্রতিপার্শ কাচের ভিতর দিয়ে আলোকের অভিগমন কেউ জানে পদার্থবিজ্ঞানের ব্যবহারিক শিক্ষাক্রম থেকে, কেউ আপন উদ্ভাবনী দৃষ্টিসক্ষমতা থেকে আবিষ্কার করে ফেলে তারও বহুকাল আগে। কেউ কেউ আলোকের প্রতিসরণ উপচে সাত রঙের খেলাও আবিষ্কার করে নিয়ে দৃষ্টিসীমায় বন্দি করতে সক্ষম হয়ে ওঠে আপন অভীক্ষায়। এভাবে সমাজ সমষ্টি জীবন বোধের উপলব্ধি পূর্ণতা পেলে আসে সেইসব ঘিরে প্রকাশের প্রসঙ্গ, তারও পর প্রকরণ। প্রকরণে দক্ষ কুশীলব প্রজ্ঞায় মার্গ অতিক্রম করার পর রপ্ত করেন গতানুগতিক নির্মাণ ভাঙার কৌশল। ইমারতকে সরল ও নিখুঁত করতে ব্রতী হতে হতে নির্মাণপর্বে একসময় পালা আসলো বিনির্মাণের। গতানুগতিকের একঘেয়েমি থেকে পরিত্রাণের সূত্র হয়ে বাস্তবের পালাবদল মানুষকে চেনালো পরাবাস্তব, জাদুবাস্তব। হিরোইজমের ঘোরগ্রস্ত মানুষের তেষ্টা জাগলো এন্টি-হিরোর। এই যে পালাবদল, অগ্রণী হবার দৌড়ে গতি বাড়াও গতি বাড়াও খেলায় নতুন প্রাণের সন্ধান জোগালো বাঁক, আকস্মিক বাঁকের ধাক্কা। এলএসডি, কোকেন, মেথামফেটামাইনের মতো নেশারু সাহিত্যমোদীরা সাধারণের মতো অগণন না হলেও এদের হাত ধরেই বাঁক বদলের উন্মাদনা, বিনির্মাণের শিল্পতেষ্টা পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠে বিবর্তন সূত্রের। বিবর্তনের রথ কিংবা অক্ষ নির্মাণের সকল কুশীলব সকলেই মাইলফলক হতে পারেন না, সাফল্যের মুখ দেখেন না কিংবা কালোত্তীর্ণ সৃষ্টির নির্মাতা হয়ে উঠতে পারেন না।

গতানুগতিক মানব প্রবৃত্তির যশ, খ্যাতি, স্বীকৃতি, সম্মাননা চক্রের লোভাতুর কাঙ্ক্ষা বলয়ের বাইরে এসে সায়ানাইডের স্বাদ চাখবার মতো পাগলা বিজ্ঞানী হয়ে উঠবার মতো ঘোরগ্রস্ত সাহিত্য নির্মাতা যতটা মুষ্টিমেয়, তাদের মধ্যে চড়াই-উতরাই সামলে গন্তব্যে পৌঁছুবার মতো সাহিত্য নির্মাতা আরো মুষ্টিমেয়। তার উপর সচরাচর এমনটা দেখা যায় কদাচিৎ যে—যিনি লেখেন তিনিই আঁকেন কিংবা সম্পাদনা করেন কিংবা প্রকাশক হন। ইঁদুর দৌড়ের বিশ্বসভ্যতা আমাদের সেরকম কিছু শেখায় না, শেখায় কে কত বেশি লিখলো, কে কত বেশি বিকালো, কে কত বেশি পুরস্কার-সম্মাননা পেলো। জনপ্রিয় আর সফল হওয়ার দৌড়ে কালোত্তীর্ণদের খুঁজতে আমাদের তাই অণুবীক্ষণ দৃষ্টি সহায়তার ভরসায় থাকা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।

আমাদের তাই অবাক বিস্ময়ে থমকে দাঁড়াতে হয় যখন দেখি কোনো লেখক বইয়ের গায়ে দাম হাঁকানোর বদলে বলে ওঠেন—আমাদের যেন কেউ দাম ঠিক করে কিনে নিতে না পারে। পণ্য বাজারের প্রচলিত প্রথা অনুসরণ করে বই প্রকাশ করার বদলে বই গড়েন। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে বই গড়েন আবার আগ্রহী ক্রেতাকে খামোখা তাঁর বই কিনে টাকা নষ্ট না করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করে যাচাই করেন আসলেই তাঁর বই কেনার জন্য আগ্রহী পাঠক কী-না। হাল সময়ের এই বাজারে বইও যখন পরিপূর্ণ ভাবে একটা পণ্য বৈ আর কিছুই নয় তখন একজন সুবিমল মিশ্রই পারেন বইয়ের বিপণন রীতি উপেক্ষা করতে। লেখাকে বইয়ের শরীরে প্রাণ দিতে গিয়ে সাজিয়েছেন গতানুগতিক বর্ণ-বিন্যাসের খেলায় মেতেছেন। প্রসঙ্গ বিবেচনায় তাঁর বইতে বক্তব্যের অনুকূল বিন্যস্ত করেছেন বিবিধভাবে।

বক্তব্যের প্রশ্নে প্রতিটি বইয়ের প্রতিটি গল্প কিংবা প্রসঙ্গে বিবিধ বিষয় যে রকম অকপট ধাক্কায় পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন, তা কখনো ধারালো ছুরি, কখনো জ্বলন্ত কয়লার মতো নিরেট বিপজ্জনক ও খাপখোলা স্পষ্ট। তাঁর প্রতিটি গ্রন্থের নামকরণ, গল্প বা প্রবন্ধ বা আলোচনার শিরোনামেই আঁধার আকাশের গায়ে তারকাপুঞ্জের মতো আলোকিত রকম দৃশ্যমান।

হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া বা সোনার গান্ধীমূর্তি, দু-তিনটে উদোম বাচ্চা ছুটোছুটি করছে লেবেল ক্রসিং বরাবর, রঙ যখন সতর্কীকরণের চিহ্ন, ভাইটো পাঁঠার ইসটু, আর পাইপ-গান এত গরম হয়ে যায় যে এর ব্যবহার ক্রমশ কমে আসছে, আসলে এটি রামায়ন চামারের গল্প হয়ে উঠতে পারতো—এইসব গ্রন্থ নামকরণ বলে দেয় তার স্বকীয় ঢঙ আর প্রকাশের তীব্রতার মাত্রাটি কোথায়।

উপমা রূপক উৎপ্রেক্ষা কতটা ষাঁড়ের চোখে অব্যর্থ তীর তার প্রমাণ উদ্ধৃতি উপস্থাপনে উঠে আসবে তাঁর লেখালেখির সিংহভাগই। আগাগোড়া এমনটাই ভিন্নধারার অভিন্ন এক তীরন্দাজ লিখিয়ের নামই সুবিমল মিশ্র। যাঁর আক্রমণটা প্রকৃত অর্থেই শানানো ছিল সব রকম ক্ষমতার প্রথার দিকে। প্রতিষ্ঠান-বিরোধী আর প্রথাবিরোধী প্রবচন দুটোর একবেমাদ্বিতীয়ম প্রবক্তা তিনিই। এমন একরোখা আর অবিচল আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাঠে রচনায় সৃষ্টিতে আচারে এমনকি জীবনযাপনে আগাগোড়া প্রথাবিরোধী ও প্রতিষ্ঠান-বিরোধী সুবিমল মিশ্র লক্ষ্য পাল্টাননি। আদ্যোপান্ত অবিচল সুবিমল তাই একাই একটি ধারা, যার অনুরাগী অগণন, অনুসারী অনেক, তবে তাঁর সহযাত্রী হবার মতো মেধা যোগ্যতা প্রজ্ঞা ও প্রতিজ্ঞার সমান আর কেউ নেই, থাকবে বলেও ধারণা করা সুবিবেচনার আওতায় পড়বে না।

না, এসবের জন্য তিনি কোন মোর্চা গড়েননি, দল পাকাননি, ভাই-বেরাদারের ঠিকুজি মিলিয়ে প্রোপাগাণ্ডা করেননি। তাঁর কলমই ছিল একচ্ছত্র অস্ত্র ও মঞ্চ। নিজের কথা নিজেই বলেছেন, ‘প্রত্যেকেই সফলতা খোঁজ করে, আমি খোঁজ করি অন্য কিছুর। …নিজেকে ভাগ্যবান, ভাগ্য কিংবা এ ধরনের কারো হাতে তুলে দেওয়া এক ধরনের কাপুরুষতা বলে আমি মনে করি। আর কাপুরুষতা আমি আদৌ পছন্দ করি না। সফলতা এলে আমি ভয় পাই। কারণ নতুন কিছু করলে সফলতা সংগে সংগে আসে না। আমি যদি সফলতা পাই তার মানে হল আমি এমন কিছু করছি যা তত নতুন নয়।’ প্রথাগত গল্পের সীমানা না মাড়িয়ে যা লিখেছেন, তা আদ্যোপান্ত প্রতিষ্ঠান-বিরোধী; যাকে তিনি নিজে বলতেন ‘এন্টি-গল্প’। লিটল ম্যাগাজিন ছাড়া আর কোথাও কোনোদিন এক অক্ষরও লেখেননি। তাও হাতে গোনা কয়েকটা লিটল ম্যাগাজিন। এই অঙ্গনেও ম্যাগাজিনের সংখ্যা বাড়েনি, কেননা অনেক লিটল ম্যাগাজিনও তাঁর লেখা ছাপতে ভয় পেত। দাগ কেটে, লাইন ভেঙে, লেখার মধ্যে গণিত এনে, লেখার অংশকে বাকসোবন্দি করে বই প্রকাশের খোলনলচে পালটে দিয়ে নিজের লেখাকে নিজস্ব ধারায় বিন্যস্ত করে যখন তিনি উপন্যাস প্রকাশ করেন—লোকে তাকে সঙ্গত ভাবেই নাম দেয় ‘এন্টি-উপন্যাস’। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী একাধিকবার বলেছেন, আমরা যেখানে শেষ করেছি, সুবিমল সেখান থেকে শুরু করেছে।

‘এখন পর্যন্ত এমন বন্দুক মানুষ / বানাতে পারেনি / যা কেবল একদিকেই গুলি ছোঁড়ে / এবং অন্যদিকগুলো / এড়িয়ে যায়’ কিংবা ‘গুলিটা তোমাকেই প্রথম করতে হয় / ও পক্ষ কি করবে তার জন্য অপেক্ষা / করা চলে না’ —এমন লাইনগুলোকে কখনো সাজিয়েছেন পাতার বাম সীমানায়, কখনো মধ্যে সীমানায়। লেখার পাশাপাশি বইয়ের মধ্যে দেখার একটা ব্যাপারও তৈরি করেছেন কেবল শৈল্পিক সন্নিবেশের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নয়, বক্তব্য উপস্থাপনের ও লক্ষ্য নির্ধারণের তফাত তৈরির ভিতর দিয়ে পাঠকের চোখে আঙুল ঠেকাবার এক রকম তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকেও।

‘শহরটা বেড়ে উঠেছে উত্তর দক্ষিণে পুবে পশ্চিমে। মাঝখানে এক গোলাকার পেচ্ছাবখানা। মনে হয় এটাকে কেন্দ্র করেই যেন শহরটা বড় হয়েছে। চোখ-জ্বালানো এমোনিয়ার গন্ধের ভেতর সে প্রথম আবিষ্কার করে, দালাল সাধু, অধ্যাপক মূর্খ, বাবু ভিখারী—সব একাকার এখানে’

‘ময়নার-মার ঘরে এখন বাবু এসেছে। ময়নার বাপ রাস্তায় দাড়িয়ে মেয়ের কান্না থামাচ্ছে। উপরে,

ডায়াসে ন্যাতারা রয়েছেন। বাইনোকুলার লাগিয়ে জনতাদের হাবভাব দেখছেন। মাঝে মাঝে ঘাড় নাড়ছেন উত্তমকুমারের স্টাইলে। জনতা, গাদা গাদা, আণ্ডাবাচ্চা নিয়ে ঘুর ঘুর করছে।

আপাতত তাদের রিজার্ভ করে রাখা হয়েছে, বিপ্লবের সময় ব্যবহার করা হবে।’

‘সৈন্যবাহিনী রাজকীয় মর্যাদায় দাঁড়িয়ে আছে। রাষ্ট্রীয় পাতাকা, সিল্কের তৈরি, পত পত উড়ছে। ড্রাম বাজছে তালে তালে। অনেক ফালতু লোক ব্যাপার কি দেখার জন্য দূর থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে, তাদের ঘেঁষতে দেওয়া হচ্ছে না। একসময় বাক্সটার ডালা খোলা হলো, এবং সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত জনবর্গ সবিস্ময়ে দেখলেন বাক্সটার ওপরে হারাণ মাঝির বৌয়ের গলিত মড়াটি শোয়ানো রয়েছে। সকলে সমবেত চমকালেন, নাকে রুমাল দিলেন এবং বুঝতে পারলেন হারাণ মাঝির বৌয়ের মড়া না সরালে সোনার গান্ধীমূর্তির নাগাল পাওয়া যাবে না।’

‘রানির স্বাস্থ্যের ওপর আমাদের লক্ষ ছিল। রানির পোশাকের ওপর আমাদের লক্ষ ছিল। কারণ আমরা জানতাম পরীর মতো এই শরীর খারাপ হয়ে গেলে রানি আমাদের কোনো কাজে লাগবে না। খারাপ দেখতে হয়ে গেলে রানিকে আমাদের দরকার থাকবে না। গরু বুড়ো ও অকর্মণ্য হয়ে গেলে মানুষরা যেমন কশাইয়ের কাছে বিক্রি করে দেয়, আমাদের সেই রকম অন্য জায়গায় রানিকে বেচে দিতে হবে।…

রানি আমাদের সঙ্গে নেমকহারামি করল। আমরা তাকে এই সমুদ্রতীরের শহরে নিয়ে এসেছিলাম সকলে মিলে একটু সাধ-আহ্লাদ করব বলে। তাকে ন্যাংটো করে স্নান করাব, সারারাত তার শরীরের গরম নিয়ে উত্তেজিত থাকব। কিন্তু সে মরে গেল। আমরা যে এত টাকা-পয়সা খরচ করে তাকে পুষেছি তা সে একবারও ভাবল না। একবারও কৃতজ্ঞ হল না আমাদের প্রতি।…

যদি নেমকহারামি হয়, তবে সভ্য জগতের নিয়মে এর ভয়ানক শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা ভদ্র মানুষ। আমরা গণতন্ত্র মানি। পরস্পর পরস্পরের প্রতি সমঝোতার ভেতর দিয়ে আমরা বিবাদ-বিসম্বাদ মেটাই। আমরা হঠাৎ করে বিশ্বাস হারাতে পারি না। কারণ আমরা শিখে নিয়েছি মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। রানি আমাদের কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ মরে গিয়ে আমাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বলে আমরা অভদ্র হতে পারি না। আমরা রানির বাবার কাছে রানির জন্য ক্ষতিপূরণ চাইতে পারি না। আমরা ভদ্র মানুষ। তাতে আমাদের বাধে।

কিন্তু অন্যায়ের শাস্তি হওয়া উচিত। না হলে গণতন্ত্র চলে না, পৃথিবী চলে না, চন্দ্র সূর্য চলে না।… আমরা রানিকে রেখেছিলাম, তাকে রোজ রোজ ঠিকঠাক খাওয়া-পরা দিতাম। সেই সূত্রে আমরা রানির কাছে অল্পস্বল্প কিছু দাবিও করতে পারি। আমরা সেই দাবির সূত্রে শাস্তিটা দিতে চাই।

কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই তিনটে শরীর লাফিয়ে উঠল। এক ঝটকায় তারা মৃতদেহ থেকে খুলে ফেলল সাদা চাদরটা। মোমবাতির আলোয় তাদের হাতে ছুরির ফলা ঝলসে উঠেছিল। তারা দ্রুত সেই শবদেহ থেকে বিশেষ বিশেষ স্থানের মাংস কেটে নিতে ব্যস্ত হল, মোমের আলোটা জ্বলছিল তখন সারা ঘরে।’

এইসব উপস্থাপনার পাশাপাশি সহজ সংলাপে গভীর কথাও উঠে এসেছে অভিন্ন ব্যঞ্জনায়।

‘সমুদ্রের ধারে ঢেউয়ের সেই প্রচণ্ড শব্দ, আমাদের এতদিনের সঞ্চিত সব আলাপ ভেসে যাচ্ছিল। বৃষ্টি নামল তারপর, বাতাস নামল। আমরা সেই দুর্যোগের মধ্যেও পায়ে পায়ে অনেক দূর হেঁটে গেলাম।’

‘কোন মৃত্যুই পাথরের মত ভারী নয় / সব মৃত্যুই পালকের মত হালকা’

নিজের লেখালেখি নিয়ে নিজেই অনেকবার অনেক কথা বলেছেন। সেরকম একটা ছোট্ট অংশে লেখালেখি প্রসঙ্গে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদ্দেশ্য একেবারে স্পষ্ট হয়ে যায়।

‘আমি তেমন কোন লেখা লিখতে চাই না যা পড়ে লোকে আমার পিঠ চাপড়ে বলবে, বাহা বেড়ে সাহিত্য করেছো তো হে ছোকরা, আমি চাই লোকে আমার লেখা পড়ে আমার মুখে থুথু দিক, আঙুল দেখিয়ে বলুক, এই সেই লোক যে উপদংশসর্বস্ব এই সভ্যতার ঘাগুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দিনের আলোর মত খোলাখুলি করে দিয়েছে। লোকে দেখুক, নিজের অবস্থা নিজেরাই—দেখে শিউরে উঠুক, চিন্তা করুক তার সেই ভেক সামাজিক অবস্থানের কথা—সেখানে থেকে শুরু হবে ওলটপালট যা আসবে মানুষের চিন্তার ক্ষমতা দখল থেকে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল থেকে নয়। আমি চাই মানুষকে উপলব্ধির সেই স্তরে পৌঁছে দিতে যখন সে নিজেই নিজের অবস্থানকে ভাঙতে শুরু করবে। এতদিনে প্রকাশ-পদ্ধতির একটা ছাঁদ তৈরি হয়ে গেছে যা আমার কাছে অত্যন্ত জলো, সেন্টিমেন্টাল এবং নাকি সুরের প্যানপ্যানানির মতো লাগে; আমি কলম দিয়ে মানুষকে বিদ্ধ করতে চাই, বিদ্ধ করার ভংগি আমাকে খুঁজে নিতে হয় নিজের মতন করে, ব্যাপারটা সাহিত্যটাহিত্য গোছের কিছু হয়ে উঠছে কিনা এ নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই।’ —বিজ্ঞাপন, ৪র্থ সংকলন [ ‘এখন এই রকম ভাবছি থেকে ]

প্রতিষ্ঠান-বিরোধী সুবিমল ব্যক্তি ও বোধের গভীরে তাঁর লেখার বাইরে কারো প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাবাপন্ন ছিলেন না। তাঁর প্রতি কট্টর নেতিবাচক সমালোচনাকেও তিনি নেতিবাচক বিবেচনায় আমলে নিয়ে সেসবের বিরোধিতা করেননি। নিজের অবস্থান ও প্রকাশ লক্ষ্যে সমঝোতা করেননি কখনো, এটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল তার একগুঁয়েমি।

যে অনন্য শৈলীতে কখনো কুঠারাঘাতের মতো কখনো ধারালো ছুরিতে নিঃশব্দে দ্বিখণ্ডিত করেছেন বোধের প্রাচীর। পাঠক এমন লেখার সন্ধান পেলে আলোড়িত হবে আরো বহুকাল। এমন কালোত্তীর্ণতাই একজন প্রতিষ্ঠান-বিরোধী লেখককে নিয়ে প্রতিষ্ঠানেরও মাতামাতি জুড়ে দিয়েছে জীবনভর তার লেখার পিঠে। তাতে সেসবের কিছুই তার স্বীকৃতি ও সময় ডিঙিয়ে আপন অস্তিত্ব শিকড় দীর্ঘায়ু করার পথটায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

লেখক:
Lutful Hossain
লুৎফুল হোসেন, কথাসাহিত্যিক

*এই বিভাগে প্রকাশিত লেখার মতামত ও বানানরীতি লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই এখানে প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট