ঢাকা শহর থেকে প্রকাশিত প্রথম খবরের কাগজ—দ্য ঢাকা নিউজ। প্রকাশিত হয় ১৮৫৬ সালের ১৮ই এপ্রিল। মাত্র এক পৃষ্ঠার ইংরেজি সাপ্তাহিক। দাম দুই আনা। বের হতো প্রতি শনিবার। ত্রয়োদশ সংখ্যার পর পৃষ্ঠাসংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় চার। আরো কিছু পরে (সম্ভবত ২য় বর্ষ থেকে) এটাকে আট পৃষ্ঠার করা হয়। ছাপা হতো ঢাকা প্রেসে। ঢাকা প্রেসই ছিল সম্ভবত ঢাকা শহরের প্রথম মুদ্রণ যন্ত্র। অবশ্য এ নিয়ে ভিন্ন মতও আছে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর ‘উনিশ শতকে ঢাকার মুদ্রণ ও প্রকাশনা’ বইতে ইস্ট বেঙ্গল মিশনারি সোসাইটির একটি রিপোর্টের ছবি ছেপেছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে সেটি ১৮৪৯ সালে বড় কাটরা ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত। এ থেকে অধ্যাপক মামুন মনে করেন, ১৮৫৬ সালের আগেও ঢাকাতে ছাপাখানা ছিল। অবিভক্ত বাংলায় প্রথম মুদ্রণ যন্ত্র বসে কলকাতায়। পূর্ব বাংলায় প্রথম মুদ্রণ যন্ত্রটি কিন্তু ঢাকায় বসেনি। যতদূর জানা যায়, ১৮৪৭ সালের আগস্টে রংপুরে একটি মুদ্রণ যন্ত্র বসানো হয়েছিল এবং সেখান থেকে ‘রংপুর বার্তাবহ’ নামে একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ করা হতো।
ঢাকা প্রেস এবং একই সঙ্গে ঢাকা নিউজের মালিক ছিলেন পাঁচ জন। এঁরা হলেন এ.এম. ক্যামেরন, এন. পি. পোগজ, জে. এ. গ্রেগ, জে. পি. ওয়াইজ এবং একমাত্র স্থানীয় বাসিন্দা কে. এ. গনি। পোগজ ছিলেন আর্মেনীয় এবং গনি ছিলেন কাশ্মীরি। বাকিরা সম্ভবত ইংরেজ। প্রথম সম্পাদক ছিলেন আলেক্সান্ডার ফোর্বস। ঢাকা নিউজের সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব নেয়ার আগে তিনি কাজ করতেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের রেশম কুঠিতে। প্রথম দিকে ঢাকা প্রেসের সমস্ত মালিক ও সম্পাদক মিলে নিজেদের হাতে সীসার হরফ দিয়ে কম্পোজ করতেন। পরে তারা লোকজনকে শিখিয়ে পড়িয়ে কম্পোজিটর তৈরি করে নেন। সীসার হরফেরও অভাব ছিল। হরফের অভাবে ১৮৬৫ সালে ঢাকা নিউজের এক সংখ্যায় একটি রিপোর্ট ছাপা সম্ভব হয়নি বলে ফোর্বসের লেখায় উল্লেখ আছে। ১৮৬৯ সালের দিকে ঢাকা নিউজ বন্ধ করে একই ব্যবস্থাপনার অধীনে বেঙ্গল টাইমস নামে আরেকটি প্রত্রিকা প্রকাশ করা হয়। ঢাকা নিউজ মূলত নীলকর সাহেবদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতো। তবে সমাজে অনেক অন্যায় অবিচারের কথাও এতে প্রকাশ পেতো।
১৮৪৮ সাল থেকে ১৮৫৭ সালের মধ্যে আরো দুটি ছাপাখানা বসানো হয় ঢাকায়। তবে বাঙালিদের নিজস্ব ছাপাখানা বসলো ১৮৬০ সালে। ব্রজসুন্দর মিত্র, ভগবান চন্দ্র বসু ও কশিকান্ত মুখোপাধ্যায় নামে তিন বাঙালি মিলে বাবুবাজারে ‘বাঙ্গালা যন্ত্র’ নামে এই ছাপাখানা চালু করেন। ‘বাঙ্গালা যন্ত্র’ পূর্ববঙ্গের প্রকাশনা শিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করলো। কারণ এখান থেকে বাংলা বই ও পত্র-পত্রিকা মুদ্রণের এক অভাবনীয় সুযোগ পেল ঢাকাবাসী। ঢাকার প্রথম বাংলা সংবাদপত্র ‘ঢাকা প্রকাশ’ ছাপা হয় এখান থেকেই। তারিখটা ছিল ১৮৬১ সালের ৭ই মার্চ। বের হতো প্রতি বৃহস্পতিবার। ডাক মাশুলসহ বার্ষিক চাঁদা ৫ টাকা। প্রথমদিকে পত্রিকার বামদিকে ছাপা হতো বিজ্ঞাপন। ডানদিকে সম্পাদকীয়, গুরুত্বপূর্ণ কোন খবর, কোন বিষয়ে পত্রিকার নিজস্ব মতামত। এর পর ‘সম্বাদাবলী’ নামে একটি বিভাগ থাকতো। তাতে বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সংগৃহীত বা নিজেদের সংগ্রহ করা খবর থাকতো। পত্রিকার তৃতীয় পৃষ্ঠায় বা শেষ পৃষ্ঠায় ছাপা হতো পাঠকদের চিঠিপত্র। ‘চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন, ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে? কি যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে…..’ এই বাক্যগুচ্ছ মনে নেই এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া কঠিন। যিনি এই কবিতার কবি, সেই কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ছিলেন ঢাকা প্রকাশের প্রথম সম্পাদক। কৃষ্ণচন্দ্রের পর দীননাথ সেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো। দীননাথের সময় ঢাকা প্রকাশ প্রকাশিত হতো বৃহস্পতিবারের পরিবর্তে শুক্রবার। দীননাথ মাত্র ১৩টি সংখ্যা প্রকাশ করেন। পঞ্চম বর্ষ থেকে পত্রিকাটি প্রতি রবিবার বের হতে থাকে। ঢাকা প্রকাশ প্রথমে ব্রাহ্ম সমাজের মুখপত্র হিসাবে প্রকাশিত হলেও বহুবার এর মালিকানা বদল হওয়ায় এর দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটতো। ফলে তা কখনো ব্রাহ্মদের সমর্থন করতো, কখনো গোড়া হিন্দুদের কখনো উদার। তবে রাজনীতির ব্যাপারে ছিল মধ্যপন্থি। ‘এটাও ভালো সেটাও ভালো’ নীতি মেনে চলতো। ফলে তাদের বিপাকে পড়তে হতো মাঝে মাঝে। যেমন বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলনের সময় প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল তাদের। প্রচার সংখ্যা শুরুতে ছিল আড়াইশ’। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এই সংখ্যা ৫ হাজারে পৌঁছায়। ঢাকা প্রকাশ ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম বাংলা পত্রিকাতো বটেই পূর্ববঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে এতো দীর্ঘকালেও আর কোন পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি। প্রায় একশ’ বছর টিকেছিল পত্রিকাটি।
ঢাকা প্রকাশ একটি প্রভাবশালী পত্রিকা ছিল, যার মতামতকে সরকার গুরুত্ব দিত। উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গ থেকে যেসব সংবাদপত্র ও সাময়িকী প্রকাশিত হতো সেসবের মধ্যে প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঢাকা প্রকাশের সংবাদ এবং মতামতকেই রিপোর্ট অন দ্য নেটিভ পেপারস গুরুত্বসহকারে উদ্ধৃত করত।
প্রথম প্রকাশের সময় পত্রিকার প্রচারসংখ্যা ছিল ২৫০; উনিশ শতকের নববইয়ের দশকে হিন্দু পুনরুত্থানবাদীদের আন্দোলনের সময় এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৫০০০। এ থেকে তৎকালে পত্রিকাটির জনপ্রিয়তা প্রমাণিত হয়। ঢাকা প্রকাশ প্রায় ১০০ বছর টিকে ছিল; পূর্ববঙ্গের আর কোনো পত্রিকার আয়ুষ্কাল এত দীর্ঘ ছিল না। ঢাকাসহ পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ঢাকা প্রকাশ ছাড়া রচনা করা সম্ভব নয়।
সৌজন্য: ইত্তেফাক