প্রথম বঙ্গনারী ঢাকা থেকে জাপান পৌঁছল

Google+ Pinterest LinkedIn Tumblr +

শশীভূষণ বসু মল্লিকের আদি বাড়ী নদীয়ার শান্তিপুরে। সরকারী চাকরির সুবাদে তিনি ঊনিশ শতকের শেষার্ধে ঢাকায় চলে আসেন এবং খিলগাঁও গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। ১৮৮৪ সালে তিনি বিয়ে করেন নগেন্দ্র বালাকে।

একদিন শশীভূষণ শহরের অদূরে জঙ্গলে একটি শিশুকে কুড়িয়ে পেয়ে ঘরে নিয়ে আসেন এবং তাকে পালন করবেন বলে মনস্থির করেন। কিন্তু তাদের এ সিদ্ধান্তকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি হিন্দুসমাজ। ফলে তাদেরকে হিন্দুসমাজ থেকে পতিত হতে হয়। সমাজের এহেন আচরণে শশীভূষণ স্বধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন।

সেই কুড়িয়ে পাওয়া শিশুর সূত্র ধরে শশীভূষণ ১৮৯২ সালে ঢাকায় অনাথ শিশুদের জন্য ‘উদ্ধারাশ্রম’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে যার নাম হয় ‘মাতৃনিকেতন’।

শশীভূষণ দ্বিধাবিভক্ত ব্রাহ্মসমাজে কেশবচন্দ্রের ভক্ত হবার কারণে যোগ দেন নববিধানে। ঢাকার নববিধান তখন খুবই হীনবল। এসময়েই শশীভূষণ উপলব্ধি করেন দেশের উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার। মানুষের চেতনা জাগ্রত করতে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। শশীভূষণ বেশ কয়েকটি বইও রচনা করেন। শিল্পায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতেই ব্রতী হন।

তার এই দেশভাবনাই হয়তো তার প্রথম সন্তান হরিপ্রভা বসু মল্লিকের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

Hariprova Mullick_01
হরিপ্রভা বসু মল্লিক

হরিপ্রভা বসু মল্লিক। জন্ম ১৮৯০ সালে পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলার খিলগাঁও গ্রামে (বর্তমানে ঢাকা শহরের খিলগাঁও)। তিনি কোথায় পড়াশোনা করেছেন, আর কতদূরই বা পড়াশোনা করেছেন, সেসব প্রসঙ্গে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। তবে এটুকু নিশ্চিত যে তিনি স্কুলে পড়েছিলেন। ধারণা করা হয়, হয়তো ইডেন স্কুলেই তিনি পড়েছিলেন, এন্ট্রান্স পর্যন্ত।

৩ নভেম্বর, ১৯১২, পূর্ববঙ্গের নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাট সেদিন লোকে লোকারণ্য। বছর বাইশের এক তরুণী বিয়ের পর প্রথম শ্বশুরবাড়ী যাচ্ছে। কিন্তু এতে দেখার কি আছে? কারণটা হলো পাত্রটি জাপানি আর শ্বশুরবাড়ি কয়েক হাজার মাইল দূরে টোকিও! কৌতুহলী ঢাকাবাসী এমন অদ্ভুত ঘটনা সাতজন্মেও শোনেনি, তাই এতো ভীড়।

হরিপ্রভা ও তার স্বামী ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে নারায়ণগঞ্জ থেকে স্টীমারে গোয়ালন্দ। এরপর গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনে কলকাতা। আর ৫ নভেম্বর শুরু হয় কলকাতা থেকে জাহাজে করে জাপানের উদ্দেশে যাত্রা। ১০ নভেম্বর তারা পৌঁছোন রেঙ্গুনে। সেখানে যাত্রাবিরতিতে একজন পরিচিতের বাসায় থাকেন। ১৩ তারিখ রেঙ্গুন থেকে ফের যাত্রা শুরু। ১৭ তারিখ পৌঁছোন পেনাং। ২০ তারিখ সিঙ্গাপুর। ৩১ তারিখ হংকং। ডিসেম্বরের ৯ তারিখ সাংহাই। অবশেষে ১৩ ডিসেম্বর সকালে তারা পৌঁছোন জাপানের প্রথম বন্দর ‘পোর্ট মোজি’-তে।

এক বাঙালী ঘরের তরুণী আজ থেকে শতবর্ষ আগে ঠিক কতটা সাহসী আর আত্মবিশ্বাসী হলে নিজের দেশ নিজের পরিবার-পরিজন ছেড়ে অজানা-অচেনা এক দেশে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন ভাবুন একবার! সে দেশের মানুষ বা তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে তিনি কেন, তার দেশের মানুষও বলতে গেলে তখন কিছুই জানতো না। আবার কখনও নিজের দেশে ফিরে আসতে পারবেন কিনা তারও কোন নিশ্চয়তা ছিলো না সেদিন।

উয়েমন তাকেদা ও হরিপ্রভা তাকেদা

হরিপ্রভা বাবা শশীভূষণ বসু মল্লিক প্রতিষ্ঠিত ঢাকায় নিরাশ্রয় নারী, শিশু কল্যাণে ‘মাতৃনিকেতন’-এ কাজ করার সুবাদে পরিচিত হন জাপানী যুবক উয়েমন তাকেদার সাথে। উয়েমন তখন পূর্ববাংলার খ্যাতনামা ‘ঢাকা বুলবুল সোপ ফ্যাক্টরী’-তে হেড মিস্ত্রী হিসেবে কাজ করতেন। পরিচয়ের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাদের পরস্পরকে ভালো লেগে গেল।

দু’পরিবারের সম্মতিতে ১৯০৭ সালে ১৭ বছর বয়সে উয়েমেন তাকেদার সাথে হরিপ্রভা মল্লিকের বিয়ে হল। তবে বিয়েটি ঠিক কোন বছর হয়, এ নিয়ে মতান্তর রয়েছে। কোথাও দেখা যায়, বিয়ের সাল বলা হচ্ছে ১৯০৪, আবার কোথাও ১৯০৬ বা ১৯০৭। যাই হোক, এই বিয়ে ছিল সেসময়ের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ভারতবর্ষের ইতিহাসে সেই প্রথম কোন বাঙালী মেয়ে বিয়ে করলো এক জাপানীকে। যে গোঁড়া ধার্মিক দেশে নয় বছর বয়সে মেয়ের বিয়ে না হলে পরিবারের মুখে চুনকালি পড়তো, হতে হতো সমাজচ্যুত, সেখানে মেয়ের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে এক ভিনদেশীর সাথে ১৭ বছর বয়সী মেয়ের বিয়ে, সত্যিই ছিলো সে আমলের এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা। বিয়ের পর স্বামীর উপাধি নিয়ে তার নাম হলো হরিপ্রভা তাকেদা। শশীভূষণ মেয়ে-জামাইকে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করলেন। ওনার সহযোগিতায় জাপানি জামাই ঢাকায় গড়ে তুললেন ‘ইন্দো-জাপানীজ সোপ ফ্যাক্টরী’ নামে একটি সাবানের কারখানা। কিন্তু বছর খানেক চলার বন্ধ হয়ে গেল কারখানাটি। ব্যবসা গুটিয়ে উয়েমন সস্ত্রীক তখন জাপান চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাই হরিপ্রভা-উয়েমন দম্পতির জাপান যাত্রার খবরে চারদিকে রীতিমত হৈ চৈ পরে গেছিল। দিনাজপুরের মহারাজা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ২৫ টাকা পাঠিয়ে দেন। এছাড়াও ঢাকাস্থিত জনৈক জাপানী ব্যবসায়ী কোহারা তাকেদা দম্পতিকে ৫০ টাকা উপহার দেন। ঢাকার নববিধান ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে তাদের যাত্রার শুভকামনা করে প্রার্থনার আয়োজন করা হয়।

জাপানে পা রাখার পর থেকেই অনেক জাপানী ব্যগ্রভরে দেখতে শুরু করে হরিপ্রভাকে। সাংবাদিকরাও এসে ছবি তুলতে থাকেন তাদের। এরপর তাকেদা দম্পতি ট্রেনে করে যাত্রা শুরু করেন গ্রামের উদ্দেশে। উয়েমনের বাড়ির বা গ্রামের নাম অবশ্য জানা যায়নি। ধারণা করা হয়, গ্রামটি বর্তমান কোওনান শহরের অন্তর্গত বা তার আশেপাশে কোথাও।

গ্রামের স্টেশনে পৌঁছেই হরিপ্রভা দেখতে পান, তাদেরকে নিতে এসেছেন তার দুই দেবর। কিন্তু শুধু তারাই নন। গোটা স্টেশনই লোকে লোকারণ্য। সকলেই এসেছে ‘ইন্দোজিন’ দেখতে। স্টেশন থেকে বাড়ীতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও উপচে পড়া ভিড়। একে তো ঘরের ছেলে বহুদিন বাদে ফিরেছে, তার উপর আবার সঙ্গে ভারতীয় স্ত্রী। ফলে সকলেই যেন ফেটে পড়ছিল কৌতূহলে। যতদিন হরিপ্রভা সেখানে ছিলেন, প্রতিদিনই ছেলেবুড়ো অসংখ্য মানুষ দেখতে আসত তাকে। তবে সবচেয়ে স্বস্তির কথা, হরিপ্রভার শ্বশুর-শাশুড়ি তাকে খুবই আপন করে নেন। তাদের মমতা ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে যান হরিপ্রভা।

তাকেদা দম্পতি জাপানে থাকেন চারমাস। ১৯১৩ সালের ১২ এপ্রিল তারা জাপান থেকে ভারতের উদ্দেশে ফিরতি যাত্রা শুরু করেন। হরিপ্রভার শাশুড়ি, ননদ আসেন তাদেরকে কোবে পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। এরপর ২৫ দিনের মাথায় তারা ভারতে পা রাখেন।

চার মাস জাপানে কাটিয়ে তারা দুজনে ঢাকায় ফিরলেন। দু’বছর পর ১৯১৫ সালে হরিপ্রভা তার জাপান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই প্রকাশ করলেন। নাম ‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা’। ৬১ পৃষ্ঠার বইটির দাম ছিল চার আনা! ছাগল-ভেড়া আর শুঁটকি মাছের সঙ্গে জাহাজের দিনগুলি, এসরাজ বাজানো, শ্বশুরবাড়ির আতিথেয়তা, ভালবাসা, ‘ইন্দোজেন'(ভারতীয় মহিলা)-কে নিয়ে জাপানীদের ঔৎসুক্য, সেখানকার জীবনযাত্রা –এ সব কিছুই তিনি তুলে ধরেন বইটিতে৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপান ভ্রমণে যান হরিপ্রভার চার বছর পর ১৯১৬ সালে। আর তার লেখা ‘জাপানযাত্রী’ বইটি প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে। সে হিসেবেও হরিপ্রভার বইটি গুরুত্বপূর্ণ।

এ বইটি লেখার জন্য পরবর্তীতে ‘প্রবাসী’সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়, কবি বুদ্ধদেব বসু ও লেখিকা প্রতিভা বসু হরিপ্রভা তাকেদার অনেক প্রশংসা করেছেন।

হরিপ্রভা তার বইটি শুরু করেছেন এভাবে,

“আমার যখন বিবাহ হয়, তখন কেহ মনে করে নাই যে আমি জাপান যাইব। কাহারও ইচ্ছাও ছিল না। কিন্তু আমার বড়ই ইচ্ছা হইত আমি একবার যাই। সে ইচ্ছা স্বপ্নেই পর্য্যবসিত হইত। বিবাহের পর শ্বশুর-শ্বাশুড়ির আশীর্ব্বাদ লাভ করিতে ইচ্ছা হইত। তাঁহাদের নিকট পত্র লিখিয়া যখন তাহাদের ফটোসহ আশীর্ব্বাদ পূর্ণ একখানি পত্র পাইলাম ও তাঁহারা আমাদের দেখিবার জন্য আগ্রহান্বিত হইয়া পত্র লিখিলেন, আমার প্রাণ তখন আনন্দে ভরিয়া গেল। তাঁহাদিগকে ও তাঁদের দেশ দেখিবার আকাঙ্ক্ষা প্রাণে জাগিয়া উঠিল। ঈশ্বরেচ্ছায় আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইতে চলিল…”

হরিপ্রভার সেই বইয়ের গুণগত মানও নিঃসন্দেহে অসামান্য। কেননা তিনি তো জাপানে শুধু শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সাথেই দেখা করেননি বরং সুযোগ পেয়েছেন জাপানের সমাজব্যবস্থাকে খুব কাছ থেকে দেখার ও অনুভব করার। এ কথাও অনস্বীকার্য যে তার পর্যবেক্ষণ শক্তি ছিল প্রখর। তাই তিনি খুবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জাপানের সামাজিক রীতিনীতি ও আদবকায়দাগুলো খেয়াল করেন এবং ভারতে দেখে যাওয়া সমাজের রীতি ও প্রথার সাথে তুলনা করতে থাকেন, যা পরবর্তী সময়ে উঠে আসে তার কলমে। রবি ঠাকুরের ‘জাপান যাত্রী’-তে হয়তো জাপানী নান্দনিকতা ও সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, কিন্তু হরিপ্রভার বইটিতে এক বাঙালী নারীর ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি এবং জীবনদর্শনও খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধরা দেয়।

হরিপ্রভা তার স্বামীর সাথে জাপানের বিভিন্ন শহর পরিভ্রমণ করে সেগুলোর যেমন বর্ণনা দিয়েছেন, তেমনই আবার মাঝেমধ্যে যোগ করেছেন তৎকালীন জাপানী সংস্কৃতি নিয়ে নিজের পর্যবেক্ষণ,

“মেয়েদের পতি, বাড়ির আত্মীয়-স্বজন ও শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা পরম ধর্ম। ইহার কোনোরূপ অন্যথা হইলে স্ত্রী অত্যন্ত লাঞ্ছিত হন। এমনকি শাশুড়ির অপছন্দ হইলে স্বামী অনায়াসে স্ত্রী পরিত্যাগ করিতে পারেন।”

কিন্তু আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, হরিপ্রভার সাথে তার শ্বশুর-শাশুড়ির সম্প্রীতির কথা। ফলে জাপান ছেড়ে আসার সময় হরিপ্রভার কিছুটা মন কেমনও করে উঠেছে তাদের জন্য। তিনি লিখেছেন,

“বিদেশে এমন সরলস্বভাব, স্নেহপরায়ণ শ্বশুর, শাশুড়ি ঠাকুরানীর মার মতো যত্ন-ভালোবাসা পাইয়া ইহার সহিত বসবাস করিতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু সে সম্ভাবনা কোথায়?”

প্রকাশের পর ‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা’ বইটি অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় এ বই সম্পর্কে লেখেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। অন্নদাশঙ্কর রায়, বুদ্ধদেব বসুদের মতো খ্যাতিমান সাহিত্যিকও কৈশোরে এই বই পড়ে মুগ্ধ হন। এরকম হয়তো তৎকালীন আরো অনেক পত্রপত্রিকাতেই এই বই সম্পর্কে ইতিবাচক কথা ছাপা হয়েছিল। যে জাপান সম্পর্কে তখনকার দিনে বাঙালীর তেমন কোনো ধারণাই ছিল না, সেখানে পূর্ববঙ্গের এক নারী পৌঁছে গেলে এবং নিজের চোখ দিয়ে দেখা এক নতুন সমাজ-সংস্কৃতিকে সাবলীল ভাষায় বইয়ের পাতায় উঠিয়ে আনলে, সে বইয়ের একটি আলাদা কদর তো থাকবেই!

অবশ্য, সাহিত্যিক হিসেবে কেবল এই একটি বই লিখেই থেমে যাননি হরিপ্রভা। এছাড়াও তিনি লেখেন ‘সাধ্বী জ্ঞানদেবী’ এবং ‘আশানন্দ ব্রহ্মনন্দ কেশবচন্দ্র সেন’ নামে আরো দু’টি বই। ‘জাপানে সন্তান পালন ও নারীশিক্ষা’ শিরোনামে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় তার একটি নিবন্ধও ছাপা হয়। তবে একথাও সত্য যে, প্রথম বইটি লিখে তিনি যতটা আলোড়ন তুলেছিলেন, সে তুলনায় পরের বই বা নিবন্ধের মাধ্যমে তিনি খুব বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেননি। তাই তো এক পর্যায়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান হরিপ্রভা।

কিন্তু হরিপ্রভার জীবনে নতুন এক অধ্যায়ের শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সেসব অভিজ্ঞতার আখ্যান তিনি লিখেছেন ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপানে’ নামক অন্য এক আত্মকথায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জাপান সরকার ভারত থেকে সব জাপানীকে দেশে ফিরিয়ে নেয়। স্বামী উয়েমন তাকেদার সাথে হরিপ্রভাও তখন দ্বিতীয়বারের মত জাপান চলে যান। সেটা ১৯৪১ সাল। যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপানে গিয়ে হরিপ্রভা পড়লেন অথৈ সাগরে! স্বামীর দিকের আত্মীয়-স্বজন সব ছন্নছাড়া, ঘরবাড়ী ভেঙে গেছে বোমায়। না আছে থাকার জায়গা না কোন রোজগার। তার উপর স্বামী উয়েমেন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরলেন।

কিন্তু ঠিক এ সময়ই হরিপ্রভা পাশে পান বিপ্লবী রাসবিহারী বসুকে। তার মাধ্যমে হরিপ্রভার পরিচয় হয় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সাথেও। এই দুই কীর্তিমান ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীর কল্যাণে হরিপ্রভা উদ্বুদ্ধ হন দেশপ্রেমে। তার মনে জাগে দেশকে স্বাধীন করার আকাংখা। সেই সাথে তার একটি চাকরিও জুটে যায়, টোকিও রেডিওতে আজাদ হিন্দ ফৌজের হয়ে বাংলায় সংবাদ পাঠিকার চাকরি। আর এসুবাদে হরিপ্রভা হয়ে গেলেন বিশ্বের প্রথম বাঙালী নারী সংবাদ পাঠক।

হরিপ্রভা নেতাজির পাশে বসা ডান দিক থেকে দ্বিতীয়।

নেতাজি সুভাষচন্দ্রের সাথে তার এই সাক্ষাৎকার ঘুরিয়ে দেয় তার জীবনের মোড়। যে চাকরী একদিন নিয়েছিলেন জীবন বাঁচানোর তাগিদে, সেই চাকুরীই পরে করেছেন প্রবল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে, জীবনের তোয়াক্কা না করে। জাপানের অন্যান্য শহরের মত টোকিও শহরও তখন মিত্র বাহিনীর মূহুর্মুহু বোমা বর্ষণে কেঁপেকেঁপে উঠছে, যখন-তখন যেখানে-সেখানে বোমা পড়ছে। বোমা হামলার ভয়ে রাতে কেউ আলো জ্বালাতো না। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। তারমধ্যে সেই বিধ্বস্ত টোকিও শহরের রাস্তা দিয়ে দুঃসাহসী এই বাঙালী বধূ হেঁটে হেঁটে রেডিও স্টেশনে যেতেন। আঘাত থেকে বাঁচার জন্য মাথায় থাকতো শুধু একটা হেলমেট। শুরুর দিকে পরনে শাড়িই থাকত। কিন্তু ঠিকমতো যে বাড়িতে ফিরতে পারবেন, তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই পেটিকোটে একটি পকেট বানিয়ে সেটির ভেতর পাসপোর্ট, টাকাপয়সা, গয়নাগাটি বহন করতেন তিনি। পরের দিকে অবশ্য শাড়ি পরে চলাচলে অসুবিধা হওয়ায়, তিনি স্বামীর প্যান্ট পরেই চলাফেরায় অভ্যস্ত হয়ে যান। এভাবেই এই বীর নারী নিজের জীবন বিপন্ন করে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত নিয়মিত টোকিও রেডিও-তে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’-এর সৈনিকদের জন্য বাংলায় খবর পাঠ করে গেছেন।

পরাজিত ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত জাপান ছেড়ে স্বামীকে নিয়ে ১৯৪৭-এ কোলকাতা ফিরলেন হরিপ্রভা। কিন্তু তার জন্মস্থান পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তিনি পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে বোন অশ্রুবালা মল্লিকের বাড়িতে উঠলেন। পরের বছরই তার স্বামী মারা যান জলপাইগুড়িতেই। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পরও ভেঙে পড়েননি হরিপ্রভা। থেকেছেন বরাবরের মতোই দৃঢ়চেতা। স্বামীর প্রতি ভালোবাসায় কোনো কমতি ছিল না তার।

স্বামীর মৃত্যুর পর বোনপোর সাথে চলে এলেন কলকাতায়। নিজের পরিচয় দিয়ে সরকারী সাহায্যের প্রত্যাশী হননি কোনদিন। আজাদ হিন্দ ফৌজের সাথে প্রত্যক্ষ যোগ থাকায় কোন সরকারও সেদিন বাড়ায়নি সাহায্যের হাত।

১৯৬৭ সালে, জীবন সায়াহ্নে হরিপ্রভাকে সম্মুখীন হতে হয় এক নতুন বিপর্যয়ের। গীতা নামের বাড়ির পরিচারিকা যে কিনা ছিল একটি দুর্বৃত্ত দলের সদস্য, হরিপ্রভার মাথায় আঘাতে সংজ্ঞাহীন করে যাবতীয় মূল্যবান সম্পদ চুরি করে পালিয়ে যায়। প্রায় আশি ছোঁয়া হরিপ্রভা তাকেদা হাসপাতালে ভর্তি হন। শেষ পর্যন্ত তিনি আর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। ১৯৭২ সালে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

২০১২ সালে হরিপ্রভার প্রথম জাপান যাত্রার শতবর্ষে বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল জাপান ফাউন্ডেশনের সহায়তায় হরিপ্রভার জীবনের উপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। সেটির শিরোনাম ‘জাপানি বধূ’। ইংরেজিতে ‘দ্য জাপানিজ ওয়াইফ’। সেই তথ্যচিত্রের শেষাংশে বলা হয়,

“হরিপ্রভাকে আমরা খুঁজে পাইনি। খুঁজে পাইনি জাপানে হরিপ্রভাদের গ্রামটিও। তবে যেসব নারীরা আজো ভালোবাসা ও স্বামী-সংসারের টানে ভিনদেশের এক প্রবাসী জীবন বেছে নিতে দ্বিধা করেন না, সেসব সাহসী নারীদের মাঝেই যেন খুঁজে পাই হরিপ্রভার প্রতিচ্ছায়া। না-ই বা তোমায় খুঁজে পেলাম, হরিপ্রভা!”

তথ্যসূত্র সৌজন্য:
* হরিপ্রভা তাকেদা: ঢাকার প্রথম আধুনিক নারী – জান্নাতুল নাইম পিয়াল
* সূর্যোদয়ের দেশে এক বাঙালি বউ – স্বপন সেন

লেখক: সাগর লোহানী, সম্পাদক, বাঙালীয়ানা

বাঙালীয়ানা/এসএল

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.