প্রফুল্লচন্দ্র রায়: বিজ্ঞানী বেশে  এক বিপ্লবীর কথা । ড. তপন বাগচী

Comments

‘বিজ্ঞানী বেশে বিপ্লবী’র নাম প্রফুল্লচন্দ্র রায়। বাঙালীর কাছে তিনি বিজ্ঞানী, ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের কাছে তিনি বিপ্লবী। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘আমি বৈজ্ঞানিক, গবেষণাগারেই আমার কাজ, কিন্তু এমন সময় আসে যখন বৈজ্ঞানিককেও দেশের আহ্বানে সাড়া দিতে হয়।’ সাধারণ বেশভূষায় ও সাদাসিধে জীবন-যাপনে অভ্যন্ত স্বদেশি দেশসেবক, বিদগ্ধ পণ্ডিত, ছাত্রবৎসল অধ্যাপক, আবিষ্কারক বিজ্ঞানী, অগ্রজ সমবায়ী, দরদি সমাজকর্মী এই ব্যক্তির নাম প্রফুল্লচন্দ্র রায়। বাংলাদেশের খুলনার মানুষ এই মনীষী তৎকালীন ভারতবর্ষের  সেরা রসায়নবিজ্ঞানী ও সার্থক শিল্পোদ্যোগী হিসেবে সম্মানিত।

Prafulla Chandra Ray05

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্ম বাংলাদেশের খুলনা জেলার (প্রাক্তন যশোহর জেলা) কপোতাক্ষ নদের তীরঘেঁষা রাড়–লীর কাটিপাড়ায় ২ আগস্ট ১৮৬১ সালে (১২৬৮ সন, ১৮ শ্রাবণ বঙ্গাব্দ)।  পিতা হরিশচন্দ্র রায় ও মাতা ভুবনমোহিনী দেবী। তাঁর ডাক নাম ছিল ফুলু। পিতা হরিশচন্দ্র ছিলেন পণ্ডিত ও বহুভাষাবিদ। মাতা ভুবনমোহনী দেবী সেবাপরায়ণা, উদারমনা, সংস্কারমুক্ত এবং নারীশিক্ষায় উৎসাহী একজন আদর্শ নারী ছিলেন। জ্ঞানসাধনা ও সংগীতচর্চার কেন্দ্র হিসেবে এ পরিবারের যথেষ্ট সুখ্যাতি ছিল। পিতা বাড়িতে একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।  সেখানে সাহিত্য, দর্শন, ইসলামী-কৃষ্টি, আরবি, ফার্সি ইতিহাস, ভূগোল এবং বিজ্ঞানের অসংখ্য উন্নত পুস্তকের বিশাল সংগ্রহ ছিল। ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’, ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ হিন্দু পত্রিকা’, ‘অমৃত প্রবাহিনী’ এবং ‘সোমপ্রকাশ পত্রিকা’ প্রভৃতি পত্রিকা নিয়মিত রাখা হত। হরিশচন্দ্র রায় ছিলেন এক কিংবদন্তী সুর ও সংগীত সাধক। আত্মকথায় প্রফুল্লচন্দ্র জানিয়েছেন, “প্রতিদিন সন্ধ্যায় বহির্বাটিতে সংগীতচর্চা হত। ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীর সুযোগ্য শিষ্য হরিশচন্দ্র রায় সংগীতসাধনা করতেন। যারা বাংলার সংগীত সাধনার অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর ও ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী তাদের মধ্যে অন্যতম।”

ছোটবেলাতেই প্রফুল্লচন্দ্রের মেধার বিকাশ ঘটে।  বইপড়ার নেশায় খাবারে অনিয়ম হতো এবং ছোটখাটো অসুখ-বিসুখকে তোয়াক্কা করতেন না। অসুস্থতার জন্যে স্কুলে যাওয়াও বন্ধ রাখতে হতো। সেই সুুযোগে শেক্সপিয়র, কার্লাইল, এমার্সন, ডিকেন্স প্রমুখের রচনা ও বাংলা সাহিত্য গভীর মনোনিবেশের সঙ্গে আচার্যদেব অধ্যয়নে ব্রতী হয়েছিলেন।

১৮৭৮ সালে প্রফুল্লচন্দ্র প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৮০ সালে দ্বিতীয় বিভাগে এফএ পাস করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বিএ (বি) ক্লাসে ভর্তি হন। এ সময় গিলক্রাইস্ট বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেন। এ বছর বাংলার প্রফুল্লচন্দ্র ও বোম্বাই-এর বাহাদুরজী নামে দুই ছাত্র গিলক্রাইস্ট বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। একমাস সমুদ্রযাত্রার পর তিনি ইংল্যান্ডে পৌঁছে ১৮৮২ সালে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র ও প্রাণিবিদ্যা নিয়ে বি.এসসি.-তে ভর্তি হন। ১৮৮৫ সালে বি.এসসি. পরীক্ষার কিছু দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সিপাহী বিদ্রোহের আগে ও পরে’ বিষয়ক রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। বৃত্তি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও তিনি ভারতের জনগণের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। প্রবন্ধটি ব্রিটিশ শিক্ষিত সমাজে প্রশংসিত হলেও প্রবন্ধের কারণে তিনি ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়েন। এটি এডিনবরায় পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়। পুস্তিকার ভূমিকায় প্রফুল্লচন্দ্র ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে আবেগময় আবেদন রাখেন।

প্রফুল্লচন্দ্র কৃতিত্বের সঙ্গে বিএসসি পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে ডিএসসি উপাধি অর্জনের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হতে নির্ধারিত “মৌলধর্মের পর্যায়বৃত্তি বিশেষ করে অন পিরিওডিক ক্লাসিফিকেশন অফ এলিমেন্টস” শীর্ষক গবেষণা আরম্ভ করেন। ২৭ বছর বয়সে উচ্চমানের প্রশংসনীয় গবেষণাকর্মের জন্য তিনি ডিএসসি উপাধি ও ‘হোপ প্রাইজে’ ভূষিত হন। রসায়নে ডিএসসি লাভে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় বাঙালী। বছরের শ্রেষ্ঠ গবেষণাকর্মে সন্তুষ্ট হয়ে ‘গিলক্রাইস্ট বৃত্তি’ পরিচালনা পর্ষদ তাঁর জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ দেন। পরবর্তীকালে তিনি আরো মূল্যবান গবেষণা চালিয়েছিলেন।

১৮৮৮ সালে দেশে ফিরে প্রায় এক বৎসর বেকারজীবনের স্বাদ গ্রহণ করতে হয় আচার্যদেবকে। অনেক চেষ্টা ও তদবিরের পর ১৮৮৯ সালে ব্রিটিশ শিক্ষা প্রশাসন তাঁকে প্রেসিডেন্সি কলেজে সহকারী অধ্যাপকের পদে নিয়োগ করায় আচার্যদেবের বেকারজীবনের অভিশাপ মোচন হয়। অধ্যাপনার পাশাপাশি এই কলেজের সাধারণ গবেষণাগারে তিনি গবেষণার কাজ চালিয়ে বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। ১৯১১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রধান অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। ১৯১৬ সালে ওই পদ থেকে অবসর গ্রহণ করে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান কলেজের ‘পালিত’ অধ্যাপক হন এবং ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ওই পদে থাকেন। প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর অধ্যাপনার নৈপুণ্যে ছাত্রদের আকৃষ্ট করে ভারতীয় রসায়নবিজ্ঞানী গোষ্ঠীর সৃষ্টি করেন ও ভারতে রসায়নচর্চা তথা গবেষণার পথ উন্মুক্ত ও প্রসারিত করেন।

Prafulla Chandra Ray02

আচার্যদেবের জীবন চরিত ছিল সত্যের অন্বেষা ও প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ ধর্মের প্রতিষ্ঠা, যে জীবন চিরস্থায়ী আলোকরূপে প্রকাশিত হবে মানবমনের আকাশে। বিজ্ঞান-গবেষণা, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা, দেশপ্রেম-মানবসেবার মধ্য দিয়ে চিরস্থায়ী একটি সত্যের প্রতিষ্ঠা করতে তিনি নিবিষ্ট ছিলেন। তিনি একনিষ্ঠ একজন বৈজ্ঞানিক হলেও বিজ্ঞানবুদ্ধি তাঁকে সত্যধর্মের পথ হতে বিচ্যুত করতে পারেনি, তাঁর প্রজ্ঞা, মেধা ভোগসর্বস্ব সাম্প্রতিকতার বাস্তবিক বিলাস তাঁকে টানতে পারেনি। তিনি অন্তরে-বাইরে পুরোপুরিই ছিলেন দেশপ্রেমিক। বিজ্ঞানি হিসেবে দেশ-বিদেশে মর্যাদা ও সম্মান অর্জন করলেও সংসারের কোনো মান বা মর্যাদাই তাঁর অন্তর্নিহিত সত্তাকে সম্মোহিত করতে পারেনি। সর্বত্যাগী এ মানুষটি আধ্যাত্মিক ধর্মের কোনো নিয়ম আনুষ্ঠানিকভাবে মানতেন না, কিন্তু আচরণে সর্বদা ও সর্বত্র ফুটিয়ে তুলতেন মানবধর্ম। এ জন্য ব্যক্তিগত ‘অহং’-এর সেবায় মুহূর্তকাল ব্যয় করেননি বরং আত্মার মহিমা প্রকাশেই থাকতেন সদা প্রতিজ্ঞ। তাঁর কথনে ধর্ম না থাকলেও ছিল আচরণের সারল্যে, চরিত্রে এবং ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্যে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে ধর্ম ছিল বলেই কর্মের প্রকাশ সাধনায় তাঁর তৎপরতা তৎকালীন বিদগ্ধজনের দৃষ্টি কেড়েছিল। এমন সন্যাসীসম মানবহিতৈষী মহামানবের মৃত্যু নেই। সে কারণেই হয়তো তাঁর সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, “যিনি এক তিনি বললেন, আমি বহু হব। সৃষ্টির মূলে এ আত্মবিসর্জনের ইচ্ছা। আচার্য প্রফুলচন্দ্রের সৃষ্টিও সে ইচ্ছার নিয়মে। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে তিনি বহু হয়েছেন, নিজের চিত্তকে সংহত করেছেন বহু চিত্তের মধ্যে। নিজেকে অকৃপণভাবে সম্পূর্ণ দান না করলে কখন তা সম্ভব হোত না। আচার্যের এই শক্তির মহিমা জরাগ্রস্থ হবে না। তারুণ্যের হৃদয়ে নবনবোন্মেষশালিনী বুদ্ধির মধ্যে নিয়ে তা দূরকালে প্রসারিত হবে। আচার্য নিজের জনকীর্তি নিজে স্থাপন করেছেন উদ্যমশীল জীবনের ক্ষেত্রে, পাথর দিয়ে নয়, প্রেম দিয়ে।”

আচার্যদেব সমাজের এ পিছিয়ে পড়া মানুষদের কল্যাণে স্থায়ী উন্নয়ন সাধন করার চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন অসহায়, নিরন্ন, ভাগ্যবিড়ম্বিতদের সাময়িকভাবে সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে কল্যাণের স্থায়ীরূপ দেওয়া সম্ভব নয়, এজন্য প্রয়োজন সঠিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি ও তার যথাযোগ্য বাস্তবায়ন। সাধারণ মানুষদের কর্মক্ষম করে গড়ে তোলার মানসে দেশীয় শ্রমজাত শিল্পভিত্তিক কল-কারখানা স্থাপন ও প্রসারের লক্ষ্যে তিনি শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিদেরও একাজে সামিল হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। বিলাতে পড়াশুনাকালীন সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পরিভ্রমণকালে ঐ দেশের সমবায় ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা নিয়েছিলেন। সমবায় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আচার্যদেবের অগাধ আস্থা গড়ে ওঠে। সমবায়কে তিনি মাটি ও মানুষের সেবা করার একটি মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। অসহায়, নিরন্ন, ভাগ্যবিড়ম্বিতদের অভাব মোচন ও আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলবার জন্য তিনি সমবায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। সমবায়ের আদর্শে জাত-পাত নির্বিশেষে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং বিংশ শতকের শুরুতে অর্থাৎ ১৯০৪ সালে প্রণীত সমবায় আইনের আলোকে তাঁর স্বগ্রামে স্থাপন করেন ‘রাড়–লী সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক’। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারী তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই সমবায় ব্যাংক ছিল অবিভক্ত ভারতের গ্রামাঞ্চলের দ্বিতীয় এবং অবিভক্ত বাংলায় প্রথম গ্রামীণ সমবায় ব্যাংক। সমবায় সম্পর্কে তাঁর ধারণা যে কতো গভীর ছিল তা তাঁর উক্তি থেকে বোঝা যায়- ‘ব্যক্তি স্বাধীনতাকে খর্ব না করে ব্যক্তি স্বাধীনতার ভিত্তির উপরেই যদি এমন সংঘ প্রতিষ্ঠা করা যায় যা গ্রাহক হিসেবে হোক বা উৎপাদন হিসেবেই হোক সভ্যদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহের ও সভ্যদের দ্বারা উৎপাদিত বা প্রস্তুতকৃত দ্রব্যের বিক্রয়ের ব্যবস্থা করে মধ্যবর্তীদেরও প্রয়োজন হলে ক্রমে ক্রমে কলওয়ালা বণিকদের প্রভুত্যের উচ্ছেদ সাধন করে নিজেরাই কারখানা চালিয়ে ও মধ্যবর্তীর কাজ করে সভ্যগণের সকল অভাব মেটাতে পারে তাহলেই সকল দ্বন্দের অবসান হয়। এই মতবাদই সমবায় মত নামে খ্যাত’।

বিজ্ঞানচর্চা বা মানবসেবা যে কারণেই হোক না কেন নিবেদিত প্রাণ আচার্যদেব ছিলেন চিরকুমার। স্বভাবতই শিক্ষার্থীরাই ছিল তাঁর সন্তানস্বরূপ। আচার্যদেব ছাত্রদের ভিতর সমবায়ের ধ্যান-ধারণা ও আদর্শ সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বঙ্গবাসী কলেজে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন “বঙ্গবাসী কলেজ কো-অপারেটিভ স্টোর এন্ড ক্যান্টিন’’। ১৯২টি কলেজের ছাত্রপ্রতিনিধি নিয়ে ১৯১৯ সালে তাঁর আয়োজিত “Student Co-operation Conference” এ তিনিই সভাপতিত্ব করেন এবং তাঁরই নেতৃত্বে একটা কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। সমবায় ঋণদান সমিতির কর্মপদ্ধতি এবং পরিচালনা ব্যবস্থাপনার আদলে দুর্দশাগ্রন্থ শিক্ষকদের চিকিৎসার জন্য বা তাদের অকালমৃত্যুতে অসহায় বিধবাদের সাহায্যার্থে “Teachers Benevolent Fund’’ গড়ে তোলেন।

Prafulla Chandra Ray03

ব্রিটিশ শিক্ষা, পণ্য প্রভৃতি বর্জন করে দেশীয় শিল্পউদ্যোগ বিকাশের যে চেষ্টা স্বদেশী যুগে শুরু হয়েছিল, ব্রিটিশ শিল্প-বাণিজ্যের বাইরে দেশীয় রসায়ন শিল্পকে দাঁড় করানো এবং অখণ্ড বাংলায় তথা ভারতবর্ষে বিভিন্ন শিল্পের উন্নতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের তাগিদবোধই আচার্যদেবের মাথায় চেপে বসে। এ তাগিদবোধই তাঁকে বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহ যুগিয়েছিল। ১৮৯২ সালে বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯০১ সালে বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিটিক্যালস ওয়ার্কস লিমিটেড নামে আত্মপ্রকাশ করে। এটাই ছিল ভারতবর্ষের প্রথম রাসায়নিক দ্রব্য ও ঔষধ প্রস্তুতের কারখানা। ১৯২৬ সালে বেঙ্গল কেমিক্যাল ১৪০০ দেশীয় শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। বেঙ্গল পটারি (কোলকাতা পটারি নামে শুরু হয়), বেঙ্গল এনামেল, ক্যালকাটা সোপ ওয়ার্কস, মার্কেনটাইল মেরিন, ন্যাশনাল ট্যানারিজসহ আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান তাঁর আনুকুল্য পেয়েছিল।

স্বদেশভাবনা এই মনীষীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিক যা তাঁর গবেষণাকর্মের সূচনাতেই স্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি প্রথমে যে গবেষণা কাজ হাতে নেন তা হল ঘি ও সরিষা তেলে ভেজাল পরীক্ষা। সে সঙ্গে ছিল বিভিন্ন প্রসাধনী ও ঔষধ এবং এসবের কাঁচামাল তৈরির অনুসন্ধানমূলক কাজ। দেশীয় উপাদানের সমন্বয়ে বিজ্ঞানের অবদানকে কাজে লাগানোর জন্য দেশীয় সাজিমাটির গবেষণায় নিবিষ্ট হলেন। গবেষণার এক পর্যায়ে তিনি স্বদেশি সোডা আবিষ্কার করলেন। ১৮৯৬ সালে ‘মারকিউরাস নাইট্রাইট’ আবিষ্কৃত হওয়ার পরবর্তী ১৫ বছর যাবত নাইট্রাইট ও হাইপোনাইট্রাইট শ্রেণীর বিভিন্ন যৌগ তৈরির উপর গবেষণা চালিয়ে আবিষ্কার করেন- (১) হাইপোনাইট্রাইট অফ মার্কারি এবং (২) অন দি ইন্টার একশন অফ মারকিউরিয়াস নাইট্রাইট এ্যান্ড ইথাইল আয়োডাইড, ইথিলিন ব্রোমাইড ও ডাইখায়োগ্রাইকলের মধ্যে বিক্রিয়া ঘটিয়ে দীর্ঘ শৃঙ্খলযুক্ত সালফার যৌগের অন্য এক ধরনের শ্রেণীগত দ্রব্যাদি তৈরি, মারকিউরিক হাইপোনাইট্রাইট তৈরি করার সহজ পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সমগ্র জীবনে ১২টি যৌগিক লবণ ও ৫টি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেছিলেন এই বিজ্ঞানী। এছাড়া আমোনিয়াম নাইট্রাইট Acid; সোনা, প্লাটিনাম ও ইরিডিয়ামের জটিল যৌগের বিভিন্ন যোজ্যতার (Valency) উপর; ফ্লোরো যৌগ (যেমন ইথাইল ও মিথাইল ফ্লোরোফরমেট Ethyl & Methyl Fluroformate) ফ্লোরোঅ্যাসিটোন (Fluoroacetone), তামা ও ম্যাগনেসিয়াম সালফেটের সাথে সালফোনিয়াম ক্ষারের দ্বৈত সালফেট এবং ফসফোনিয়াম ক্ষারের উপর গবেষণা করেছিলেন। গবেষক-বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সর্বমোট দেড়শত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। এসবের মধ্যে ৬০ টি ছিল নাইট্রাইট বিষয়ে।

রসায়নশাস্ত্র প্রফুল্লচন্দ্রের দীক্ষামন্ত্র ছিল। স্বার্থত্যাগী এই বিজ্ঞান সাধকের জীবনাদর্শ কতোটুকু উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছে বাঙালী ও বাংলার বিজ্ঞানচর্চায়, সেটি যদিও প্রশ্নবিদ্ধ কিন্তু সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়। কারণ, আমরা মহতী মানুষদের জীবনাদর্শে যেমন অনুপ্রাণিত হই না তেমনি তাঁদের প্রতি যথাযথ কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন ও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবার কষ্টটুকুও করি না। তারপরেও এঁরা চির জাগরুক হয়ে থাকবেন তাঁদের কর্মে। মার্কিউরাস নাইট্রাইট (Mercurous Nitrate) যৌগের আবিষ্কারক, ভারতবর্ষে স্কুল অব কেমেস্টির অনন্য সংগঠক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বিজ্ঞানে পাঠদান, বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালনা এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়া ও বিজ্ঞানসাহিত্য রচনার মধ্যে কেবল নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি বরং শিক্ষা, বাণিজ্য, অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজ সংস্কার প্রভৃতি নিয়েও ভেবেছেন। বিশেষ করে বাঙালীর আর্থিক দুর্দশা, বাঙালীর দীনতা, বাঙালী চরিত্রের দুর্বলতা কেন্দ্রিক তাঁর ভাবনা ছিল নিরন্তন। আচার্যদেবই একমাত্র বিজ্ঞানী যিনি গবেষণা ও বিজ্ঞানশিক্ষাদানের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে নানান সামাজিক কর্মকান্ডে নিজেকে ব্যাপৃত রাখতেন। মানুষটি দেখতে ছিল শীর্ণ দেহের কিন্তু তাঁর মধ্যে ছিল অফুরন্ত প্রাণশক্তি এবং মানুষকে আকর্ষণের অসাধারণ ক্ষমতা। যার দরুনই তিনি অনায়াসে অনেক বড় বড় কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন।

চিরন্তনের আকাংক্ষায় বিজ্ঞানি প্রফুল্লচন্দ্র রায় দেশের সকল মানুষের মনিকোঠায় আচার্যের স্বমহিমায় উন্নীত হয়েছিলেন। খ্যাতিমান অধ্যাপক ছিলেন সেজন্য নয় বরং জ্ঞান, গরিমা, কর্ম ও সেবার সামঞ্জস্য তৈরি করে মনুষ্যত্বের মহান মাহাত্মাটিকে বাস্তব চরিত্রকে উন্মোচিত করেছিলেন বলেই তিনি আচার্য হয়ে উঠেছিলেন। দেশবাসী তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরুপ তাঁকে আচার্য উপাধিতে ভূষিত করেছিল। বিশ্ব জ্ঞানভান্ডারে যা আদর্শ ভারত-ধর্মের যা মহত্ব, বাঙালী চরিত্রের যা মাধুর্য তা আমরা আচার্যদেবের চরিত্রে সম্যকভাবেই প্রস্ফুটিত হতে দেখেছি। স্বগুণে গুণান্বিত ছিলেন বলেই প্রকৃত বাঙালী হয়েও তিনি ছিলেন ভারতীয়, ভারতীয় পরিচয়ে পরিচিত হয়েও তিনি ছিলেন বিশ্বমানব। দেশ থেকে তিনি যা পেয়েছিলেন, দিয়েছেন তার থেকেও অনেক বেশি। তিনি মানুষের দুঃখ-দুর্দশায়, দুর্ভিক্ষে, বন্যায় সম্বলহীন মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রেও তাঁর মূখ্য ভূমিকা ছিল। বাল্যবিবাহ, জাতিভেদ প্রভৃতি হিন্দু সমাজের বহু কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন।

Prafulla Chandra Ray_Stamp

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র স্বদেশি আন্দোলনে প্রথম পর্যায় থেকেই যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে যখন বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন সক্রিয় হয়ে উঠে, তখন গোপনে বিপ্লবীদের অস্ত্র ক্রয়ে সাহায্য করতেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ না করলেও বিপ্লবীবীরদের প্রতি তাঁর ছিল গভীর সহানুভূতি। হাজতবাস হলে দেশীয় শিল্প ও বিজ্ঞানের ক্ষতি হতে পারে এমন ভাবনা থেকে পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে বিপ্লবীদের সাহায্য করতেন। তিনি বিজ্ঞানের সাধনা ছেড়ে পরাধীন মাতৃভূমির পরাধীনতার শৃঙ্খলভাঙ্গার জন্য উল্কাররূপ পরিগ্রহ করে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক সভা ও সমিতিতে সভাপতিত্ব করে বিপ্লবের অগ্নিশিখা ছড়িয়েছেন জনতার মাঝে। যদিও গান্ধীজির সাথে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশ নেননি কিন্তু ১৯১৬ সালে কলকাতায় তিনিই প্রথমবারের জন্য মহাত্মা গান্ধীর জনসভার আয়োজন করেছিলেন। এজন্য ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের ভাষ্য ছিল- তিনি ‘বিজ্ঞানী বেশে বিপ্লবী’। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ জানুয়ারী রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে কলকাতার টাউন হলে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সভাপতিত্বে এক অনুষ্ঠানে আচার্যদেব যে আবেগমথিত ও দেশের প্রতি দায়িত্বপালনের যে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন তা আজও ঐতিহাসিক দ্যোতনাকে অনুরণিত করে পলে পলে। এ বক্তৃতার দৃপ্ত আহ্বানে মানুষ এতই উদ্বুদ্ধ হয়েছিল যে আজও তা ঐতিহাসিক মাত্রই স্বীকার করেন। তাঁর এ বিখ্যাত ভাষণে অন্য অনেক দিক নির্দেশনার সাথে মানুষ এখনও যে আহ্বানের কথা ষ্মরণ করে থাকে তা হল, “Science can wait but Swaraj can’t – দেশের জন্য প্রয়োজন হলে বিজ্ঞানীকে টেস্ট টিউব ছেড়ে গবেষণাগারের বাইরে আসতে হবে। বিজ্ঞানের গবেষণা অপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু স্বরাজের জন্য সংগ্রাম অপেক্ষা করতে পারে না”। ১৯২১ সালে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের সময় ‘খদ্দর’ প্রচারে তিনি অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন।

আচার্যদেবের জীবনকথা ও অভিজ্ঞতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতির জীবনে একটা আদর্শবাদের সন্ধান মিলবে। তাঁর অভিজ্ঞতালব্দ জীবননাট্যের বৈচিত্র্যময় কাহিনী আমাদেরকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হতে, সংকীর্ণতা পরিত্যাগ করতে, উদারচেতা হতে, বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হতে, অসাম্প্রদায়িকতার একতাবদ্ধ সমাজের ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত করতে তাঁর অনুসৃত পথ ও আদর্শ জাতীয় জীবনকে সুসংবদ্ধ ও শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন-যাপন পথের সন্ধান দেবে। তিনি বাঙালী জাতীয়তাবাদের জন্যে ঔদার্য, মানবতা আর ভ্রাতৃত্ববোধের আদর্শ অনুসরণ করেছেন। সাম্প্রদায়িকতাকে পরিহার করে, মহান মানবপ্রেমের এক স্মরণীয় দৃষ্টান্ত আচার্যদেবের জীবনীতে খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি সারাজীবন আদর্শের অনুসারী ছিলেন।

আচার্যদেব অর্জিত অর্থের সিংহভাগই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দাতব্যপ্রতিষ্ঠান এবং ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্পোদ্যোগের জন্য মুক্ত হস্তে বিলিয়েছেন আজীবন। মানব কল্যাণে অর্জিত অর্থের অকাতর বিতরণ তাঁকে অতি বিশিষ্ট করে তুলেছিল তৎকালীন সমাজে। বাংলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বহুবার অর্থ ও ত্রাণ সাহায্য পরিচালনা করার স্বাভাবিক ক্ষমতা তাঁর মধ্যে দেখা গেছে। জীবনব্যাপী দুর্ভিক্ষ, বন্যা, ভূমিকম্প, এরকম বহু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে তাঁর ত্রাণকাজ চিরস্মরণীয়। দেশবাসীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার চিহ্ন হিসেবে তাঁকে ‘আচার্য’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত তহবিলে বাগেরহাট পিসি কলেজ, চাম্পা ফুল সাইহাটি পিসি ইনস্টিটিউট, খুলনা; খুলনা পিসি কটন মিলস এবং খুলনা প্রফুল্লচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। এছাড়া প্রায় ৪৯ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উদার হস্তে দান করেছিলেন।

কথিত আছে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। শিক্ষার প্রসারকল্পে আচার্যদেব মাতৃভাষাকে শিক্ষার প্রধান বাহন করতে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে মাতৃভাষা প্রচলনে তিনি আন্তরিকভাবে কাজ করেছেন এবং রসায়নবিদ্যার পরিভাষায় তিনি বাংলায় গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর উক্তিই প্রণিধানযোগ্য- “জাপানীরা জার্মানীর ও রুশিয়ার ন্যায় যাবতীয় বৈজ্ঞানিক তথ্য মাতৃভাষায় প্রচার করিতে সক্ষম হন নাই। তাহারা মধ্যপথ অবলম্বন করিয়াছেন অর্থাৎ মৌলিক গবেষণাসমূহ ইংরাজি ও জার্মান ভাষায় প্রকাশিত করেন, কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে যাহাতে বিজ্ঞানের নানাবিধ মূলতত্ত্ব প্রচার হইতে পারে তজ্জন্য মাতৃভাষা অবলম্বন করিয়াছেন”।

শিক্ষাগুরু হিসেবে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল অসাধারণ। অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ক্লাসে ছাত্ররা মগ্ন থাকতেন। ছাত্রদের গবেষণায় উৎসাহিত করায় এবং কৃতি গবেষক তৈরি করায় ব্যাপৃত থাকতেন তিনি। ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল বন্ধু ও পিতার। তাঁর বেতনের বেশির ভাগই দরিদ্র ছাত্রদের জন্য ব্যয় করতেন। তিনি অনেক ছাত্রকে নিজের বাসস্থানে মাথা গোজার ঠাঁই এবং তাদের আহারের ব্যবস্থা করতেন। তাঁর ছাত্রদের নিয়েই তিনি দেশের আনাচে-কানাচে বন্যা, ঝড় ও মড়কে বিধ্বস্ত, বিপন্ন মানুষের সেবায় ছুটে যেতেন। তিনি বলতেন,“আমার ছাত্ররা সর্বদাই আমার প্রিয় বন্ধু ও সঙ্গী। আমি তাদের সুখ ও দুঃখের ভার নিই এবং তাদেরই একজন মনে করি। তারাও আজকের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবনা প্রসঙ্গে আমার মতামতের অংশীদার হয়”। তাঁর গুণী ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই বিজ্ঞানজগতে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের দ্বীপ্তি ছড়িয়েছিলেন এবং তৎকালীন ভারতবর্ষকে পৃথিবীর বিজ্ঞান আসরে গৌরবের আসনে বসিয়েছিলেন। ভারতবর্ষের বিজ্ঞান গবেষণা ও বিজ্ঞানচর্চার আন্দোলনে এঁরা যথেষ্ট অবদানও রাখেন। যাদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, ডাক্তার নীলরতন ধর এর নাম উল্লেখ করা যায়।

১৯০৮ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে পিএইচডি উপাধি, ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার অধ্যাপক আচার্যদেবকে ‘কম্প্যানিয়ন অব দ্য অর্ডার অব দ্য ইন্ডিয়ান এমপ্যায়ার (সি আই ই) উপাধি, ১৯১২ সালে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিএসসি উপাধি, ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁর বিশেষ কৃতিত্বের জন্য ‘নাইট’ উপাধি, ১৯৩৬ সালে ঢাকা, বেনারস ও মহীশুর বিশ্ববিদ্যালয় ডিএসসি উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। ১৯২০ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতির পদে নির্বাচিত হন। প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করে ২ নভেম্বর ১৯১৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে ‘পালিত’ অধ্যাপকের পদে যোগদান করেন। তিনি ১৯৩৬ সালে সক্রিয় কর্মজীবন শেষ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুরোধে তিনি প্রফেসর ইমেরিটাস পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। ১৯২১ সালে আচার্যদেবের বয়স যখন ৬০ বছর তখন চাকুরির বেতন বাবদ প্রাপ্য সব টাকা তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন গবেষণাগারের উন্নয়নকল্পে দান করেন। তিনি রসায়নে সর্বশ্রেষ্ঠ গবেষণাকর্মের জন্য ১৯২২ সালে নাগার্জুন পুরস্কার এবং ১৯৩৭ সালে প্রাণিবিজ্ঞান ও উদ্ভিদবিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠ গবেষণার জন্য আশুতোষ মুখার্জী পুরস্কার প্রবর্তন করেন।

Prafulla Chandra Ray04

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপনা ও গবেষণার কাজে নিয়োজিত থেকে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিজ্ঞান কলেজের মূল ভবনের দ্বিতলে ৩৬ নম্বর কক্ষে বসবাস করেছেন। আমৃত্যু তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপকের পদে নিয়োজিত ছিলেন। শেষ জীবনে তাঁর স্মৃতিশক্তি কিছুটা লোপ পায়। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুন বিজ্ঞান কলেজেই প্রায় ৮৪ বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান হয়। তাঁর তিরোধানের সংবাদে সারাবিশ্ব শোকে মুহ্যমান হয়। বিজ্ঞান কলেজে সর্বস্তরের মানুষ ছুটে আসে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে, আসে দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য শোকবার্তা, আসে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিভিন্ন জেলের বন্দিদের আবেগমথিত পত্র আমরা হয়তো অনেক বড় বিজ্ঞানী পাব, পাব অনেক বড় মাপের নেতা কিন্তু আচার্যদেব যেভাবে মানুষকে ভালবেসেছেন যেভাবে মানুষকে সর্বস্ব উজার করে দিয়ে সেবা করেছেন, এ রকম ত্যাগ-তিতিক্ষা নিয়ে আমাদের মধ্যে আর কবে তাঁর মতো ক্ষণজন্মা মনীষী জন্মগ্রহণ করবে তা একমাত্র সেই মহান সৃষ্টিকর্তাই জানেন। তবে তাঁর মতো এমন উজ্জ্বল নক্ষত্র বর্তমানে আমাদের অনেক অনেক বেশি প্রয়োজন একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাঁর এমন কীর্তিগাথা ভাবলে আমাদেরকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবনত করে দেয়, মানুষকে নতুন করে ভালোবাসতে শেখায়।

মাতৃভাষায়  শিক্ষাদানের পথিকৃৎ  ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা ছিল। বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা হিসেবেও তাঁর অবদানকে চিহ্নিত করা যায়। বাংলা প্রবন্ধ-সাহিত্যের চর্চায় তাঁর অবদান কম নয়। বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি লন্ডন কেমিক্যাল সোসাইটির সহসভাপতি নির্বাচিত ও সভায় সভাপতিত্ব করার গৌরব অর্জন করেন। তিনিই প্রথম প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের জন্য ‘নেচার ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেন। বাঙালীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। প্রতিকূল পরিবেশে তিনি গবেষণা ও বিজ্ঞান-সাধনা চালিয়ে গেছেন। গাছ-গাছড়া, ফল ও ফলের নির্জাস নিয়ে আয়ুর্বেদ  গবেষণায়ও তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। হোমিওপ্যাথিক ঔষধের ব্যাপারেও তাঁর আগ্রহ ছিল।

সম্প্রাদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি যেমন সক্রিয় ছিলেন, তেমনি পণপ্রথার বিরোধিতায় তাঁর ব্যাপক ভূমিকা ছিল। দুর্ভিক্ষ ও বন্যা কবলিত মানুষের পাশে কাণ্ডারিরূপে তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন। খুলনা জেলায় ১৯২১ সালের দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ১৯২২ সালে দেশের উত্তরবঙ্গে যে বন্যা হয়, তার মোকাবেলায়ও তিনি ছিলেন সক্রিয় ত্রাণকর্মী।

শিক্ষাবিস্তারেও তাঁর ব্যাপক ভূমিকার কথা আমরা জানি। বাগেরহাটে কলেজ স্থাপনে তিনি ভূমিকা রাখেন। তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কলেজের নাম করা হয় ‘প্রফুল্লচন্দ্র রায় মহাবিদ্যালয়’। যা পিসি কলেজ নামেই পরিচিত। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের অনুরূপ নিজের গ্রাম রাড়–লীতে আরকেবিকে হরিশচন্দ্র ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠা করেন, পরে এটি কলেজে রূপান্তরিত হয়। এ ছাড়া তিনি যেসব প্রতিষ্ঠান নির্মাণে অবদান রাখেন, তা হলো, চাম্পাফুল সাইহাটি পি সি ইনস্টিটিউশন, খুলনা; খুলনা পি সি কটন মিলস এবং খুলনা প্রফুল্লচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়। বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আচার্য পি সি রায় তাঁর উদার হস্তে যে সব প্রতিষ্ঠানে দান করেছিলেন সেগুলো হল, রাড়–লী সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক;  রাড়–লী এডুকেশন সোসাইটি; বড়দল মাগুরা রোড রাড়–লী ও বাঁকা রাস্তা ইট দ্বারা পাকাকরণ, পাইকগাছা, আশাশুনি, তালা থানার প্রাইমারি স্কুলসমূহ নির্মাণ, খাদি প্রতিষ্ঠান চালু,  কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজ; বুধহাটা হাই স্কুল, খুলনা; আনন্দআশ্রম, ঢাকা; সাহেবখালি হাই স্কুল, খুলনা; টাউন শ্রীপুর হাই স্কুল, খুলনা; আজুগড় হাই স্কুল, খুলনা; নৈহাটী হাই স্কুল, খুলনা; রাড়–লী বি এম গার্লস হাই স্কুল, খুলনা; আর কে বি কে হরিশচন্দ্র কলেজিয়েট ইনস্টিটিউশন, খুলনা; নারীশিক্ষা সমিতি, খুলনা; দৌলতপুর বি এল কলেজ, খুলনা; দেবহাটা হাই স্কুল, খুলনা; সার্বজনীন শিশু বিদ্যালয়, খুলনা; খুলনা প্রফুল্লচন্দ্র কেমিক্যাল ওয়ার্কস; গণশিক্ষা পরিষদ, ঢাকা; গণশিক্ষা পরিষদ, ঢাকা; বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা; অশ্বীনীকুমার ইনস্টিটিউশন, বরিশাল; ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন; বেঙ্গল সোস্যাল সার্ভিস লীগ;  বেঙ্গল কেমিক্যাল; সাধারণ ব্রাক্ষসমাজ; কলকাতা এতিমখানা; নারী নিরাপত্তা রক্ষা লীগ; চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতাল; নারী কল্যাণ আশ্রম; ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়; রামমোহন লাইব্রেরি কলকাতা; কলকাতার মেডিক্যাল স্কুল; কলকাতা মুক ও বধির বিদ্যালয়; কলকাতা সেবিকা ইনস্টিটিউট; সানডে মরাল স্কুল;  সাহেবনগর কৃষি ফার্ম নদীয়া; ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট ফর মেডিক্যাল রিসার্স; ইন্ডিয়ান সায়েন্স নির্ভজ এ্যাসোসিয়েশান; ইন্ডিয়ান রিসার্স ইনস্টিটিউট; ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি, যাদবপুর যক্ষ্মা হাসপাতাল; গ্রেটার ইন্ডিয়া সোসাইটি প্রভৃতি। এছাড়া বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়; কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (এককালীন দুই লক্ষ টাকা); ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নারী বিশ্ববিদ্যালয় বোম্বে; নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানেও তাঁর অবদান রয়েছে।

প্রফুল্লচন্দ্র রায় যে সকল বাংলা গ্রন্থ রচনা করেছেন, তা হলো: মিথ্যার সহিত আপোষ ও শান্তিক্রয় (গ্রন্থ); খাদ্য বিজ্ঞান (গ্রন্থ); জাতিগঠনে বাধা ভিতরে ও বাহিরে (গ্রন্থ); জাতিভেদ ও পাতিত্য সমস্যা (গ্রন্থ); প্রাচীন ভারতে রসায়ন চর্চা (গ্রন্থ); রাসায়নিক পরিভাষা (গ্রন্থ) (বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ১৯১৯ সালে পরিভাষা গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়), অধ্যয়ন ও সাধনা (গ্রন্থ); অন্নসমস্যা (গ্রন্থ); অন্নসমস্যায় বাঙালির পরাজয় ও তাহার প্রতিকার (গ্রন্থ); আচার্য বাণীচয়ন (গ্রন্থ); জাতীয় মুক্তির পথে অন্তরায় (১৯৩৬ সালে প্রকাশিত), বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট ও শিল্প ব্যবসায়ে কৃতিত্ব লাভ (গ্রন্থ); মিথ্যার সহিত আপোষ ও শান্তিক্রয় (১৯২৫ গ্রন্থ); সমাজ সংস্কার সমস্যা (গ্রন্থ), হিন্দু রসায়নী বিদ্যা (গ্রন্থ); সরল প্রাণিবিজ্ঞান; বাঙালীর মস্তিস্ক ও তাহার অপব্যবহার (১৯১০) (গ্রন্থ)  প্রভৃতি। এছাড়া তিনি বেশ কিছু ইংরেজি গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তা হলো: Life and experience of a Bangali chemist vol. I and vol. II, London; India before and after the Sepoy Mutiny, Edinburgh University; Essays on India Published in 1885 (Published in London); A History of Hundu Chemistry. Vol I & vol II (Published by Bangal Chemical in 1909); Elementary Inorganic chemistry (1910); Essays and Discoveries. (1918); The Discovery of oxygen (1910); Bengali Brain and its Misuse (Published in the year 1910, Calcutta Book Society); Chemical Research at the presidency college (Published in 1895 & 1897); Makers of Modern chemistry (Published in 1925) প্রভৃতি।

এমন মনীষী বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সামাজিক উদ্যোক্তা ও কর্মবীরের আত্মজীবনী তাই কেবল পাঠের আনন্দই দেয় না, তা থেকে শিক্ষাগ্রহণের উপকরণ যোগায়। তাঁর সকল গ্রন্থ হতে পারে আমাদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক।

লেখক:
তপন বাগচী, উপপরিচালক, বাংলা একাডেমী, ঢাকা

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.