‘যে জাতির যত বেশি লোক যত বেশি বই পড়ে, সে জাতি তত সভ্য।’
হীরকদ্যুতিময় এমন বাক্যে সমৃদ্ধ তাঁর রচনা। আবেগনির্ভর নয়, তাঁর প্রবন্ধ যুক্তিনির্ভর। যিনি বলেছেন, ‘জ্ঞানের প্রদীপ যেখানেই জ্বালো না কেন, তাহার আলোক চারিদিক ছড়াইয়া পড়িবে। মনোজগতে বাতি জ্বালানোর জন্যে সাহিত্যচর্চার বিশেষ প্রয়োজন।’ স্বদেশপ্রীতি সম্পর্কে যিনি বলেন, ‘আমরা স্বদেশে যাতে বিদেশি না হই, সে বিষয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে।’ যিনি কাব্যসাধনা যেন কখনো ‘জোর-করা ভাব, আর ধার-করা ভাষা’য় পরিণত না হয়, সে বিষয়ে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, তিনি প্রমথ চৌধুরী।
কবি, গল্পকার, প্রবন্ধকার, সম্পাদক এবং বাংলা সাহিত্যে চলিতভাষার প্রতিষ্ঠাতা প্রমথ চৌধুরী, বাংলাদেশের পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার হরিপুর গ্রামের জমিদার পরিবারের সন্তান। ১৮৬৮ সালের ৭ আগস্ট যশোরে তাঁর জন্ম। পিতা দুর্গাদাস চৌধুরী ছিলেন জমিদার। মা মগ্নময়ী দেবীর ষষ্ঠ সন্তান তিনি। কৃষ্ণনগরে লেখাপড়া শুরু করে প্রমথ চৌধুরী কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৮৯ সালে দর্শনে প্রথম শ্রেণীতে বিএ পাস এবং ১৮৯০ সালে ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণীতে এমএ পাস করেন। ১৮৯৩ সালে প্রমথ চৌধুরী বিলেত যান এবং ব্যারিস্টারি পাস করে দেশে ফিরে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায়ে যোগদান করেন। অবশ্য এ ব্যবসায়ে তিনি বেশিদিন যুক্ত থাকেননি। বৈবাহিক সূত্রে তিনি আবার ছিলেন শিলাইদহের জমিদার ঠাকুর পরিবারের জামাতা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ইন্দিরাদেবী তাঁর স্ত্রী।

স্ত্রী ইন্দিরা দেবীর সাথে
তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজে কিছুকাল অধ্যাপনা করেন। কিছুকাল ঠাকুর এস্টেটের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পরে তিনি সাহিত্যচর্চায় পরিপূর্ণভাবে মনোনিবেশ করেন।
তার প্রথম প্রবন্ধ “জয়দেব” প্রকাশিত হয় “সাধনা” (১৮৯৩) পত্রিকায়। তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো বাংলা সাহিত্যে চলিত ভাষার পূর্ণ প্রতিষ্ঠা। তিনি যখন “সবুজ পত্র” (১৯১৪) নামের একটি উচ্চাঙ্গের সাহিত্য পত্র প্রকাশ করেন তখন থেকেই চলিত ভাষা সাহিত্যক্ষেত্রে এক বিদ্রোহী এবং আধুনিক মাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে “সবুজ পত্র”। নন্দলাল বসু প্রচ্ছদে এঁকে দেন একটি সবুজ তালপাতা। এই সবুজপত্রই বাংলার প্রথম লিটল ম্যাগাজিন বলে অনেকে মনে করেন। বুদ্ধি, কৌতুক, শ্লেষ, শাণিত যুক্তি— সবমিলিয়ে প্রমথ চৌধুরীর ধারালো ও রসালো গদ্যে, গল্প–প্রবন্ধে মাত্র কয়েক বছরের আয়ু আর তাতেই সবুজপত্রের গভীর প্রভাব বাংলা সাহিত্যে। এই পত্রিকার মাধ্যমে বাংলা চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। একে কেন্দ্র করে তখন একটি শক্তিশালী লেখকগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
প্রমথ চৌধুরী সাময়িকীটিকে বাণিজ্যিকভাবে আকর্ষনীয় রূপদানের জন্যে কোনো চেষ্টা করেননি বরং তিনি এর মান এবং আদর্শ সমুন্নত রাখার প্রতি অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। তাই সবুজ পত্র সাধারণ পাঠক ও লেখকদের কাছে জনপ্রিয় হতে পারেনি। প্রথম পর্যায়ে এটি ১৩২৯ বঙ্গাব্দ (১৯১৪ – ১৯২২ সাল) পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে সবুজ পত্রের প্রকাশনা শুরু হয় ১৩৩২ বঙ্গাব্দ (১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে। সাময়িকীটি শেষ পর্যন্ত ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে (১৯২৭ সালে) বন্ধ হয়ে যায়। মাঝখানে থেমে থাকা তিন বছর বাদ দিলে সবুজ পত্র’র মোট যাত্রা পথ ছিল দশ বছরের।

সবুজ পত্র
প্রমথ চৌধুরী ‘বীরবল’ ছদ্মনামে এ পত্রিকায় ব্যঙ্গরসাত্মক প্রবন্ধ ও নানা গল্প প্রকাশ করেন। তাঁর এ ছদ্মনাম থেকে তখন বাংলা সাহিত্যে বীরবলী ধারা প্রবর্তিত হয়। তার সম্পাদিত অন্যান্য পত্রিকা হলো বিশ্বভারতী (১৩৪৯-৫০), রূপ ও রীতি (১৩৪৭-৪৯) এবং অলকা। এসব কারণে বলা হয়ে থাকে প্রকৃতপক্ষে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের তিনি একজন প্রধান স্থপতি।
সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রমথ চৌধুরীর প্রধান খ্যাতি মননশীল প্রবন্ধলেখক হিসেবে। তবে তিনি উচ্চমানের গল্প ও কবিতাও রচনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম বিদ্রূপাত্মক প্রবন্ধ রচনা করেন। বুদ্ধিদীপ্ত তির্যকভঙ্গি তার গদ্য-পদ্য সব রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। শাণিত যুক্তি ও আলঙ্কারিক ভাষা প্রয়োগেও তিনি দক্ষ ছিলেন। তিনি ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্যে সুপন্ডিত ছিলেন। ফরাসি সনেটরীতি ট্রিয়লেট, তের্জারিমা ইত্যাদি বিদেশি কাব্যবন্ধ বাংলা কাব্যে তিনিই প্রবর্তন করেন।
তাঁর রচিত গ্রন্থ
কাব্য
সনেট পঞ্চাশৎ (১৯১৯)
পদচারণ (১৯২০);গল্প
চার ইয়ারি কথা (১৯১৬)
আহুতি (১৯১৯)
ঘোষালের ত্রিকথা (১৯৩৭)
নীল লোহিত (১৯৩৯)
অনুকথা সপ্তক (১৯৩৯)
সেকালের গল্প (১৯৩৯)
ট্র্যাজেডির সূত্রপাত (১৯৪০)
গল্পসংগ্রহ (১৯৪১)
নীল লোহিতের আদি প্রেম (১৯৪৪)
দুই বা এক (১৯৪০)প্রবন্ধ
তেল-নুন-লাকড়ি (১৯০৬)
নানাকথা (১৯১১)
বীরবলের হালখাতা (১৯১৭)
আমাদের শিক্ষা (১৯২০)
দুই ইয়ারির কথা (১৯২১)
বীরবলের টিপ্পনী (১৯২৪)
রায়তের কথা (১৯২৬)
নানাচর্চা (১৯৩২)
ঘরে বাইরে (১৯৩৬)
প্রাচীন হিন্দুস্থান (১৯৪০)
বঙ্গ সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় (১৯৪০)
প্রবন্ধ সংগ্রহ ১ম ও ২য় খণ্ড (১৯৫২-১৯৫৩)
সাহিত্য ছাড়াও সঙ্গীতে তাঁর পদচারণা সম্ভব হতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। তাই নিয়ে প্রমথ চৌধুরী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন:
“আমাদের পরিবারের আদি পূর্বপুরুষের নাম হচ্ছে যাদু-কীর্তনীয়া, অরফে যাদবানন্দ চৌধুরী। যাদু-কীর্তনীয়ার পুত্র জমিদার হয়ে ওঠেন। সেই সময় থেকেই চৌধুরী আমাদের পারিবারিক উপাধি হয়ে উঠল। আমাদের পরিবারে গান বাজনার রেওয়াজ একেবারে উঠে গেল। মুর্শিদকুলি খাঁ যখন বাঙলার নবাব ছিলেন তখন আমাদের জমিদারীর ভিতপত্তন হয়। এবং অদ্যাবধি (বিংশ শতাব্দীর গোড়ায়) এ পরিবার বেঁচে আছে। কিন্তু দীর্ঘকালের মধ্যে চৌধুরীবাবুদের কেউ গাইয়ে-বাজিয়ে হয়েছেন বলে শুনিনি।”
কিন্তু বিলেত থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতে আকৃষ্ট হন। তিনি স্মৃতিকথায় লিখছেন, “বিলেত থেকে ফিরে আসবার পর রবীন্দ্রনাথের নব-পর্যায়ের গানের রসগ্রহণ করতে সমর্থ হই কারণ, বুঝতে পারি যে, সে সব গানের সুর ক্লাসিকাল রাগরাগিণী থেকেই উদ্ভূত। এবং তার ২/৪টি গান আমি নিজেও গাইতে পারতুম – যথা “আহা জাগি পোহাইল বিভাবরী” (ভৈঁরো), ও “তুমি যেও না এখনি” (ভৈরবী)।”
প্রমথ চৌধুরী সম্পর্কে গল্পগুচ্ছের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন এমন করে-
‘আমার এই নিভৃত কক্ষের মধ্যে সংবাদ এসে পৌঁছল যে প্রমথর জয়ন্তী উৎসবের উদ্যোগ চলেছে– দেশের যশস্বীরা তাতে যোগ দিয়েছেন। প্রমথ চৌধুরীর এই জয়ন্তী অনুষ্ঠানের কর্তৃত্বপদ নেবার অধিকার স্বভাবতই আমারই ছিল। যখন তিনি সাহিত্যক্ষেত্রে অপরিচিত ছিলেন তাঁর পরিচয় আমার কাছে ছিল সমুজ্জ্বল। যখন থেকে তিনি সাহিত্যপথে যাত্রা আরম্ভ করেছেন আমি পেয়েছি তাঁর সাহচর্য এবং উপলব্ধি করেছি তাঁর বুদ্ধিপ্রদীপ্ত প্রতিভা। আমি যখন সাময়িকপত্র চালনায় ক্লান্ত এবং বীতরাগ, তখন প্রমথর আহ্বানমাত্রে “সবুজপত্র’ বাহকতায় আমি তাঁর পার্শ্বে এসে দাঁড়িয়েছিলুম। প্রমথনাথ এই পত্রকে যে একটি বিশিষ্টতা দিয়েছিলেন তাতে আমার তখনকার রচনাগুলি সাহিত্য-সাধনায় একটি নূতন পথে প্রবেশ করতে পেরেছিল। প্রচলিত অন্য কোনো পরিপ্রেক্ষিণীর মধ্যে তা সম্ভবপর হতে পারত না। সবুজপত্রে সাহিত্যের এই একটি নূতন ভূমিকা রচনা প্রমথর প্রধান কৃতিত্ব। আমি তাঁর কাছে ঋণ স্বীকার করতে কখনো কুণ্ঠিত হইনি।
প্রমথের গল্পগুলিকে একত্র বার করা হচ্ছে এতে আমি বিশেষ আনন্দিত, কেননা, গল্পসাহিত্যে তিনি ঐশ্বর্য দান করেছেন। অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যে মিলেছে তাঁর অভিজাত মনের অনন্যতা, গাঁথা হয়েছে উজ্জ্বল ভাষার শিল্পে। বাংলা দেশে তাঁর গল্প সমাদর পেয়েছে, এই সংগ্রহ প্রতিষ্ঠার কাজে সহায়তা করবে।
অনেকদিন পর্যন্ত আমাদের দেশ তাঁর সৃষ্টিশক্তিকে যথোচিত গৌরব দেয়নি সেজন্য আমি বিস্ময় বোধ করেছি। আজ ক্রমশ যখন দেশের দৃষ্টির সম্মুখে তাঁর কীর্তির অবরোধ উন্মোচিত হল তখন আমি নিস্তেজ এবং জরার অন্তরালে তাঁর সঙ্গ থেকে দূরে পড়ে গেছি। তাই তাঁর সম্মাননাসভায় দুর্বল স্বাস্থ্যের জন্য যথাযোগ্য আসন গ্রহণ করতে পারলেম না। বাহির থেকে তার কোনো প্রয়োজন নেই অন্তরেই অভিনন্দনের আসন প্রসারিত করে রাখলুম, দলপুষ্টির জন্য নয় আমার মালা এতকাল একাকী তাঁর কাছে সর্বলোকের অগোচরে অর্পিত হয়েছে আজও একাকীই হবে। আজ বিরলেই না-হয় তাঁকে আশীর্বাদ করে বন্ধুকৃত্য সমাপন করে যাব।’
প্রমথ চৌধুরী ১৯৩৭ সালে কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত একবিংশ বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষ-বক্তারূপে বঙ্গ সাহিত্যের পরিচয় তুলে ধরেন। ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক জগত্তারিণী স্বর্ণপদকে ভূষিত হন।
রবীন্দ্র যুগে আবির্ভূত হয়েও আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল বাংলা সাহিত্যের এই বিখ্যাত দিকপাল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অভাবনীয় অবদান রেখে বাংলা রেনেসাঁর শেষ সেনানী প্রমথ চৌধুরী ১৯৪৬ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বাঙালীয়ানা/এসএল