বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০১৯, হোয়াইট হাউজে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু নিপীড়নের’ অভিযোগ করেছেন।
এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে তুমুল আলোচনা। লক্ষণীয়, এ আলোচনায় সর্বদলের, সর্বপেশার, সর্বমতের অর্থাৎ সকলেরই এক আওয়াজ, প্রিয়া সাহা অন্যায় করেছেন।
ট্রাম্পকে কী বলেছিলেন প্রিয়া?
প্রিয়া সাহা বলেছিলেন, “প্লিজ আমাদের সাহায্য করুন। আমরা আমাদের দেশে থাকতে চাই। এখনও সেখানে ১ কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘু মানুষ আছে। আমার অনুরোধ, আমাদের সাহায্য করুন। আমরা দেশ ছাড়তে চাই না। তারা আমার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, আমার জমি কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু বিচার হয়নি।”
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানতে চেয়েছিলেন- কারা তার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, জমি কেড়ে নিয়েছে।
উত্তরে প্রিয়া বলেছিলেন, তারা মুসলিম মৌলবাদী, তারা সব সময় রাজনৈতিক আশ্রয় পাচ্ছে।
এ বক্তব্যের অনানুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মাদ শাহরিয়ার আলম শুক্রবার, ১৯ জুলাই, ২০১৯, সন্ধ্যায় এক ফেইসবুক পোস্টে প্রিয়ার বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে বাংলাদেশকে ‘ধর্মীয় সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত’ হিসেবে বর্ণনা করে লেখেন,“অনেকেই ব্যক্তিস্বার্থে বা না বুঝে এটার ক্ষতি করে ফেলেন। সবার উচিত এই ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকা।”
বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, তাদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু নিপীড়নের’ যে অভিযোগ করেছেন তা একান্তই তার নিজস্ব বক্তব্য, সংগঠনের নয়।
সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় এক বিবৃতিতে বলেছেন, “প্রিয়া সাহা যেসব কথা বলেছেন, তা বাংলাদেশের হাজার বছরের চেতনা বিরোধী এবং মুক্তিযুদ্ধের দর্শনকে অস্বীকার ও অবজ্ঞা করার সামিল। প্রিয়া সাহার বক্তব্য দেশের শুভবোধসম্পন্ন সব মানুষের আবেগ ও অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে। সম্প্রীতি বাংলাদেশ প্রিয়া সাহার এই মিথ্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ করছে।”
মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার শুক্রবার রাজধানীর মেরুল বাড্ডা বৌদ্ধ বিহারে এক অনুষ্ঠানে গেলে সাংবাদিকরা তাকেও এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। তিনি প্রিয়ার বক্তব্য নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে মিলার বলেন, রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়ে আসার পর গত আট মাসে সবগুলো বিভাগ ঘুরে এবং প্রধান চার ধর্মের উপাসনালয়ে গিয়ে তার ধারণা হয়েছে, ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ‘উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি’ দেখিয়েছে।
প্রিয়া সাহা যা করেছেন তা অবশ্যই নিন্দনীয়। তার মতো সচেতন একজন মানুষ এমন একটি কাজ করবেন, নিজের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভিনদেশী প্রেসিডেন্টের কাছে অভিযোগ করে উদ্ধারে সাহায্য চাইবেন তা কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
কিন্তু “একজন” প্রিয়া সাহা ট্রাম্পের কাছে নিজ দেশ সম্পর্কে যে অভিযোগ করলেন সেটা কবীরা গুনাহ হিসেবে দেখা হচ্ছে কেন? এদেশের অন্তত ৩০ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস বলে ক্ষমতাহীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টি সকলেই ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে বিষোদগারের অন্যতম লক্ষ্যস্থল নির্ধারণ করেছে বিদেশী দূতাবাসকে। কেউ কেউ দলীয় স্বার্থে বিদেশী গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার, কলামও প্রকাশ করেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে লেখা দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অভিযোগের ইমেইলও পরবর্তীকালে ফাঁস হয়েছে। এর প্রতিটি কি দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন নয়? যা কিনা করা হয়েছে গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবেই। দুই দলের কাইজ্যা মেটাতে জিমি কার্টার, স্যার নিনিয়ান, তারানকো-দের সামনে বসে এদলগুলো দেশের সম্মান বাড়িয়েছিল? বলতেই পারেন সালিসি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রক্রিয়া, অস্বীকার করি না তা। সেই দেশবিভাগের আগে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ কাইজ্যা মেটাতে এই “সালিসি” উপমহাদেশে আসে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্লিফস, লরেন্সদের হাত ধরে। যথারীতি তখনও ছিল তা ফল শূন্য, সাম্প্রতিককালেও তথৈবচ।
এসবের ফলে দেশের সম্মান যা যাবার তা কিন্তু চলে গেছে অনেক আগেই। তা ব্যক্তির নামে হোক আর সমষ্টির নামে হোক। আজ প্রিয়া সাহার কর্মকান্ডে নিন্দার বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন কিন্তু অন্য সময়গুলোতে কেন তা দেখা যায়নি? তা কি কেবলই “ব্যক্তি” বলে, কেবলই “নারী” বলে নাকি একজন “অমুসলিম” বলে?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ রাখলে দেখা যায় এ ঘটনার সমালোচনায় কি ভাবে সাম্প্রদায়িক বক্তব্যে বিদ্ধ করা হচ্ছে প্রিয়াকে। এ থেকেই কি বোঝা যায় না বাংলাদেশের তথাকথিত “সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির” চিত্র?
হতেই পারে প্রিয়া কোন স্বার্থান্বেষী মহলের ইন্ধনে ঐ আয়োজনে উপস্থিত হয়েছিলেন। এছাড়া, প্রিয়া সাহার বক্তব্য উপস্থাপনার আংগিক যদি বাদ দেয়া হয় তবে কি কেউ বলতে পারবেন প্রিয়া যা বলেছেন তা ভুল, অসত্য, অন্যায়?
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে প্রথম ১৯৭৩ সালে নোয়াখালীতে মন্দির ভাঙ্গা হয়েছিল, এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা কি নেয়া হয়েছিল?
৭৫ পরবর্তী আজ পর্যন্ত কোটি কোটি অমুসলিম কি দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়নি? সংবিধানে “বিসমিল্লাহ” এবং “রাষ্ট্রধর্ম” সংযুক্তি কি অমুসলিমদের দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করেনি? তখন যে সব রাজনৈতিক দল এর প্রতিবাদ করেছিল তারা কি পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন থাকাকালে একে সংবিধানে টিকিয়ে রেখে রাজনৈতিক ফায়দা লোটেনি?
৪৮ বছরে কতশত মন্দির জ্বলেছে, বিগ্রহ ভেঙ্গেছে, অমুসলিমের ঘর পুড়েছে, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, হত্যা হয়েছে বলতে পারেন?
এদেশে পূর্ণিমা আর তাদের মায়েরা যখন বলে “আমার মেয়েটা ছোট, একজন একজন করে এসো” তখন কোথায় থাকে এমনতর “সম্প্রীতি”?
রাতারাতি রামুর প্যাগোডাগুলো ধুলিস্যাৎ হয়েছিল কোন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে? মনে কি নেই সে হামলায় জড়িত ছিল আওয়ামী, বিএনপি, জামাতের স্থানীয় হাজার হাজার নেতাকর্মী? বিগত ১০ বছরে “ধর্মনিরপেক্ষ” আওয়ামী লীগ আমলে রামু, নাসিরনগর, গড়েয়া, সাঁথিয়া, মালোপাড়াসহ শতশত অমুসলিম নির্যাতনের বিশালাকার ঘটনাগুলো কি ঘটেনি?
৪৮ বছরের বাংলাদেশে অমুসলিম নির্যাতনে যে হাজারো মামলা হয়েছে তার একটিরও কি বিচার হয়েছে?
কোন উত্তর পাওয়া যাবে কি রাষ্ট্র, সরকার বা ব্যক্তির কাছ থেকে? পাওয়া যাবে না, কেননা প্রশ্নগুলো আছে কিন্তু উত্তর দেয়ার নৈতিক দায় পালনে সকলেই ব্যর্থ।
“Disappeared” শব্দ এবং “৩৭ মিলিয়ন” সংখ্যা হয়তো প্রিয়া ভুল করেই ব্যবহার করেছেন, তার এই ভুল ব্যবহৃত শব্দ ও সংখ্যাকে তার অভিযোগের বুনিয়াদ বানিয়ে কাকে রক্ষা করতে চাচ্ছেন সকলে?
ভুলে যাবেন না যুদ্ধাপরাধের বিচার কাজ করা সরকারের আমলেই যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার অপরাধে দেশ ছাড়া হয়েছে ট্রাইবুনালের সাক্ষী।
প্রতিবাদ কিন্তু হয়নি তখন এভাবে। অমুসলিম নির্যাতনের জোড়ালো কোন প্রতিবাদ কখনই কি হয়েছিল ৪৮ বছরে? দলমত, গোত্র নির্বিশেষে সকলে পথে নেমেছি কি কখনও অমুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বার্থ, জান, মাল আর সম্মান রক্ষায়?
আসুন না আজ সকলে এককন্ঠ হয়ে বলি, প্রিয়া তুমি ভুল আদালতে আপিল করেছো, তোমার অভিযোগ এদেশের জনগণ আমলে নিয়েছে, তোমার প্রতি সকল অবিচার, অন্যায়, অনাচারের বিচার আমরাই করবো।
আসুন বলি, আজ থেকে আমাদের বাংলাদেশে রাজনৈতিক বুজরুগির “সম্প্রীতি” নয় হবে মুক্তিযুদ্ধের আরাধ্য ধর্মনিরপেক্ষ শোষণ মুক্তির সম্প্রীতি।
সম্পাদক, বাঙালীয়ানা