মহাকাশ বার্তা প্রকাশ করা হবে, বিশেষ সংখ্যা। বাংলাদেশের জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার অগ্রদূত অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল জব্বার এর স্বরণে। সম্ভাব্য লেখক এর খোঁজে জব্বার স্যার এর আত্মীয় পরিজন, বন্ধুবান্ধবের একটি লিস্ট করে ফেললাম। সঙ্গে যারা জব্বার স্যারকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন অথবা যারা সহকর্মী ছিলেন। এমন সব ব্যক্তিবৃন্দের তালিকা। তালিকাকৃতদের সাথে যোগাযোগ, জব্বার স্যারকে নিয়ে স্মৃতি থেকে লেখা দেবার অনুরোধ করি।
এই প্রকাশনার সূত্রেই পরিচয় হয় ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী এর সঙ্গে।
পড়ুন
বর্ণাঢ্য জামিলুর রেজা চৌধুরী
এটা ১৯৯৩ সালের কথা বলছি। সে সময় আমাদের মহাকাশ বার্তা ছিলো ১৬ পৃষ্ঠার, অর্থাৎ এক ফর্মা। খুব সাদা মাটা একটা প্রকাশনা। তারপরও ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীসহ অনেকেই লেখা দিয়েছিলেন।
ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বসতেন বুয়েটের সিভিল বিল্ডিং এর ৩য় তলায়। সেই যে উনার কাছে কাজের সূত্রে যাওয়া, সেটা উনার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো।
সব সময় হাসি মুখে এবং চোখে চোখ রেখে মনোযোগ দিয়ে কথা বলতেন। ফলে যে কেউই উনার সাথে কথা বলতে খুবই সাচ্ছন্দ বোধ করবেন। যেমনটা হয়েছিলো আমার ক্ষেত্রে।

বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন এর পক্ষ থেকে ড. জিয়াউদ্দিন কে দেয়া ঘরোয়া সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে বাঁ থেকে লেখক মশহুরুল আমিন, প্রকৌশলী এম আবু তাহের, ড. আবু আবদুল্লা জিয়াউদ্দিন আহমেদ, মিসেস জিয়াউদ্দিন এবং ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী।
এমন একজন বিখ্যাত মানুষ, হাসিখুশি। এ কারণেই মহাকাশ বার্তা প্রকাশ হবার পরও একধরণের যোগাযোগ অব্যাহত ছিলো। আরেকটা কারণ ছিলো, বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশনের সে সময়কার প্রেসিডেন্ট সৈয়দ সামিউল ইসলাম।
সামিউল ভাই ছিলেন ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর সরাসরি ছাত্র। সামিউল ভাই তার অসম্ভব ভালো রেজাল্ট এর জন্য বুয়েটের সে সময়কার সবার পরিচিত এবং প্রিয় ছিলেন। ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রায়ই বলতেন, আমাদের সামিউল কেমন আছে?
১৯৯৪ সালে উদ্যোগ নেই একটা মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র এবং একটি মহাকাশ সেন্টার প্রতিষ্ঠার। সে চিন্তা থেকে প্রথম কার্যক্রম, একটা মহাকাশ উৎসবের আয়োজন। ভাবনা ছিলো সেই উৎসবে মহাকাশ সম্পর্কিত বিভিন্ন রকম জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রজেক্ট থাকবে। পরবর্তিতে সেই প্রজেক্টগুলো নিয়ে মহাকাশ সেন্টারটির যাত্রা শুরু হবে।
বাংলাদেশের প্রথম মহাকাশ উৎসব ‘স্পেসফেস্ট’ এর কার্যক্রমের সাথে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী যুক্ত হয়ে যান। সে সময়টাতে উনি নিজের একাডেমিক কাজ এবং কারিগরি বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত রাষ্ট্রিয় উন্নয়নমূলক কাজগুলোর সাথে যুক্ত থাকতেন। আমাদের মত সাধারণ একটা বিজ্ঞান ক্লাবের সাথে এভাবে যুক্ত হওয়া সে সময় দ্বিতীয়টি আর দেখা যায়নি।
যা বলছিলাম। স্পেসফেস্ট আয়োজনের জন্য কোন স্থানটি উপযুক্ত হবে? সে বিবেচনা থেকে জানালাম, বুয়েট খেলার মাঠে এর আয়োজন করতে চাই। তখন বুয়েটের ছাত্র কল্যাণ পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক শামীমুজ্জামান বসুনিয়া। ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, অধ্যাপক বসুনিয়ার কাছে আমাদের পাঠালেন। বুয়েটের খেলার মাঠে বিনে ভাড়ায় ৪দিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করবার জন্য বুয়েট কর্তৃপক্ষ অনুমোদন পেলাম। কথা ছিলো স্পেসফেস্টটি উদ্বোধন করবেন ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উনি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসেননি। পরে জানালেন,
: স্পেসফেস্ট এর স্পনসর বেক্সিমকো হওয়াতে আমি যাইনি।
: বিষয়টা একটু বিস্তারিত বলবেন কি?
: ঋণ খেলাপি বেক্সিমকো-র পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে যাওয়া মানে ঋণ খেলাপি বিষয়টাকে আড়াল করা। এজন্যে যাইনি।
বলতে হয়, প্রথম বাংলাদেশ মহাকাশ উৎসব ‘স্পেসফেস্ট’-টির সার্বিক স্পনসর ছিলো বেক্সিমকো। যার কারণে অনুষ্ঠানটির নাম ছিলো ‘বেক্সিমকো স্পেসফেস্ট’।
১৯৯৬ সালের একটা বিজ্ঞান ক্লাবের অনুষ্ঠানে বেক্সিমকো দিয়েছিলো ৪ লক্ষ টাকা। টাকার হিসেবে সে সময় এটা বিশাল অংকের টাকা। টাকাটা পেয়েছিলাম অনুষ্ঠান শুরু হবার এক সপ্তাহ আগে। দেখা গেল একসপ্তাহ সময়ের মধ্যে সর্বমোট ২লক্ষ টাকা খরচ করতে সমর্থ হলাম। স্পেসফেস্ট এর একটি প্রজেক্ট, ক্লাসরুম প্ল্যানেটোরিয়াম তৈরীর জন্য বাকি ২ লক্ষ টাকা তখনো রয়ে গেছে। পরবর্তিতে স্পেসফেস্ট শেষ হবার পর প্ল্যানেটোরিয়ামটি তৈরী করতে সক্ষম হই।
অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশনের সদস্য আজাদ রহমান এবং তার সহকারী হিসেবে প্রকৌশলী সুকল্যাণ বাছাড়, এ দুজন প্ল্যানেটোরিয়ামটি তৈরী করেন। প্রকৌশলী সুকল্যাণ বাছাড় এর ড্রয়িং নিয়ে দীর্ঘ ৮মাসের পরিশ্রমে আজাদ রহমান তৈরী করে ফেললেন, বাংলাদেশে প্রথম ক্লাস রুম প্ল্যানেটোরিয়াম।
প্ল্যানেটোরিয়ামটির নাম দেয়া হলো অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল জব্বার প্ল্যানেটোরিয়াম। বুয়েট মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্ল্যানেটোরিয়ামটির উদ্বোধন করা হয়।
প্ল্যানেটোরিয়াম উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, ড. ইকবাল মাহমুদ, ড. আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন, মোশারফ হোসেন সহ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশনের সদস্যবৃন্দ।
প্ল্যানেটোরিয়ামটির সফল নির্মাণ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশনকে অনেকদূর এগিয়ে নেয়। পরদিন সমস্ত প্রধান পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়। আর এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশনের কাছ থেকে প্ল্যানেটোরিয়ামটি কিনে নেয়। এর চাইতে ভালো আর কি হতে পারে।

লেখকের সাথে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী
ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বুঝে গেলেন, অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশনের সক্ষমতা আছে বড় কিছু করবার। সেই থেকে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশনের প্রতিটি ছোট-বড় সব ধরণের কাজের সাথে যুক্ত হয়ে গেলেন। এমন হলো স্পেসফেস্ট এর প্রজেক্ট রাখবার জন্য উনার এলিফেন্ট রোডের বাড়ির উঠোন বরাদ্ধ দিয়ে দিলেন।
পড়ুন
বর্ণাঢ্য জামিলুর রেজা চৌধুরী
ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে পরবর্তিতে ১৯৯৯ সালে ২য় স্পেসফেস্ট আয়োজন করা হয়। আয়োজনের সময় স্পনসর এর কথা আসতে, বললেন বেক্সিমকো থেকে স্পনসর নিবো না। উপায়?
ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী একটা ছোট চিরকুটে পাঁচটি নাম লিখে দিলেন। বললেন উনাদের সাথে যোগাযোগ করতে এবং গিয়ে যেন বলি, ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার পাঠিয়েছেন। আরো বললেন, কোথাও কোন প্রয়োজন হলে যেন বলি ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার পাঠিয়েছেন। এতোটাই বিশ্বাস এবং আন্তরিকতা ছিলো আমাদের অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশনের প্রতি। মাত্র দুই মাসের মধ্যে স্পেসফেস্ট আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় ৮ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম।
পরবর্তিতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য হবার পর সময় কম দিতে পারতেন। তবে মৃত্যুর মাসখানেক আগেও ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে উনার সভাপতিত্বে দিনব্যাপী কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিলো।
কর্মশালাটি ছিলো স্পেসফেস্ট ২০২০ নিয়ে। পরিকল্পনা হয়, বাংলাদেশ থেকে প্রথম নভোচারী মহাকাশে পাঠানো হবে, আগামী ২০২২ সালে।
বাংলাদেশের প্রথম নভোচারী মহাকাশে প্রেরণ কার্যক্রমটির জন্য পরিকল্পনা করা হয়, ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী এবং ড. ফরাসউদ্দীন সহ আমাদের একটি টিম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে মহাকাশে নভোচারী পাঠানোর বিষয়ে অবহিত করা হবে।
তার আগেই করোনা চলে এলো। ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী আমাদের একা করে দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন।
প্রিয় জামিলুর রেজা চৌধুরীর জন্য বিনম্রশ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।

মশহুরুল আমিন, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন
ফটো সৌজন্য: লেখক