জন্মাষ্টমীর রাতে জন্ম, আদর করে তাই দত্ত পরিবার ছেলের নাম রেখেছিল কানাইলাল। ১৮৮৮ সালে‚ সাবেক চন্দরনগরে (চন্দননগর)। তখনও সেখানে ফরাসি আধিপত্য। বাবা চুনীলাল দত্ত কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী। শৈশবে বম্বে চলে যেতে হয় কানাইলালকে, সেখানে কর্মরত ছিলেন তাঁর বাবা। ষোল বছর বয়সে ফিরে আসেন জন্মস্থানে। ভর্তি হন দুপ্লে কলেজে। বিএ পরীক্ষা দেন হুগলি মহসিন কলেজ থেকে। তখন এই কলেজ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে।
কলেজে পড়ার সময় প্রখ্যাত বিপ্লবী চারুচন্দ্র রায়ের সান্নিধ্যে আসেন কানাইলাল। পেয়েছিলেন বিপ্লববাদে দীক্ষিত অধ্যাপক জ্যোতিষ চন্দ্র ঘোষকে। স্বাধীনতার যুদ্ধে শরিক হতে কলকাতায় চলে আসেন কানাইলাল। যোগ দেন অনুশীলন সমিতিতে।

নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী হত্যার দায়ে গ্রেফতারকৃত কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু।
১৯০৮ সালে কিংসফোর্ড হত্যার জেরে গ্রেফতার করা হয় বহু বিপ্লবীকে। বন্দিদের মধ্যে ছিলেন কানাইলাল দত্তও আলিপুর জেলে । সারা দেশ তখন উত্তাল স্বাধীনতা আন্দোলনে । সংবাদের শিরোনামে আলিপুর বোমা মামলা, বন্দি স্বয়ং বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ এবং আরও অনেকে । মামলায় রাজসাক্ষী হয়েছিলেন নরেন গোঁসাই বা নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী, শ্রীরামপুর জমিদারবাড়ির ছেলে সহ্য করতে পারেনি নির্যাতন। কিন্তু তিনি সাক্ষ্য দিলে তো সমূহ বিপদ! তাঁকে সরানোর ভার পড়ল কানাইলাল দত্ত এবং সত্যেন্দ্রনাথ বোসের উপর, দুজনেই বন্দি আলিপুর জেলে । সম্পর্কে সত্যেন্দ্রনাথ মামা হন অরবিন্দ ঘোষের যদিও তিনি ভাগ্নের থেকে বয়সে ছোট ।
জেলের মধ্যেই সন্তর্পণে কানাইলাল-সত্যেন্দ্রনাথের হাতে পিস্তল পৌঁছে দিলেন মতিলাল রায়। হাঁপানি রোগী সত্যেন্দ্রনাথ ভর্তি ছিলেন জেল হাসপাতালে। পেটে অসহ্য ব্যথা করছে বলে ভর্তি হয়ে গেলেন কানাইলালও। হাঁপানির কষ্ট ভুগতে ভুগতে সত্যেন্দ্রনাথের ‘মনে হল‘ তিনিও রাজসাক্ষী হবেন। দেখা করতে চাইলেন নরেন গোসাঁইয়ের সঙ্গে, কিছু গোপন কথা আছে। কাজ হল এতে, টোপ গিললেন নরেন। বিশ্বাস করল ব্রিটিশ সরকার। ১৯০৮-এর ৩১ অগাস্ট .…..জেল হাসপাতালের সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন নরেন গোস্বামী, পাহারা ঢিলেঢালা দুই অসুস্থ বন্দি কী আর করবে!

এই রিভলবারেই কানাইলাল নরেনের জীবন নিয়েছিল।
সিঁড়ির বাঁক ঘুরলেন নরেন গোসাঁই ……
এক‚ দুই‚ তিন …
গর্জে উঠল দুটি পিস্তল, বুলেট ফুঁড়ে দিল বিশ্বাসঘাতক সহযোদ্ধার পিঠ। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পালাতে গিয়ে পড়ে গেলেন নর্দমায়। ঘটনার আকস্মিকতায় বেঞ্চের নিচে লুকিয়ে পড়েছিল ব্রিটিশ পুলিশ।
লুকোলেন না কানাই বা সত্যেন, কর্তব্য সমাধা করে স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিলেন দুজনে। ঘটনাচক্রে দিনটা ছিল কানাইলালের জন্মদিনের ঠিক পরের দিন।
নরেন ঘাতক দুই বিপ্লবীকে ফাঁসির শাস্তি শোনাতে ব্রিটিশ সরকার সময় নিয়েছিল আড়াই মাস। কিন্তু এতটাই প্রত্যয়ী ছিলেন কানাইলাল‚ কোনও আইনি সাহায্য নেননি। পরিশীলিত ইংরেজিতে স্পষ্ট নিষেধ করেছিলেন উচ্চতর আবেদনেও …… লিখেছিলেন “There shall be no appeal”| শুনে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বলেছিলেন, Shall আর will এর ব্যাবহারটা কানাই আমাদের ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে গেল হে!
শেষ কদিন একমাত্র ভাই ছাড়া কারও সঙ্গে দেখা করেননি। তাঁকেই বলে গিয়েছিলেন শেষকৃত্যে যেন কোনও পুরোহিত আচার অনুষ্ঠান না করে।
শিবনাথ শাস্ত্রী মশাই কে ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য হিসেবে ব্রাহ্ম ধর্মী সত্যেন বসুর সাথে জেলের কন্ডেম সেলে যাবার অনুমতি দেয়া হয়। তিনি যাতে তাকে শেষ আশির্বাদ করতে পারেন। সাক্ষাৎকার অন্তে জেলের বাইরে এলে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল কানাইকেও তিনি আশির্বাদ করে এলেন কিনা?
উত্তরে বলেছিলেন সে যেন পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহ। বহু তপস্যা করলে তবে যদি কেউ তাকে আশির্বাদ করার যোগ্যতা লাভ করতে পারে!
১০ নভেম্বর ১৯০৮…..
নো নো, ডোন্ট ব্ল্যাকেন মাই ফেস, প্লীজ!
ফাঁসির মঞ্চে উঠে আসতে আসতে মাথা থেকে গলা পর্যন্ত ঢাকবার কালো কাপড় হাতে ধরে রাখা লোকটির দিকে চেয়ে অনুরোধের সঙ্গে একটা ভুবনভোলানো হাসি ছুঁড়ে দেয় কানাইলাল দত্ত। সদ্য স্নান সেরে এসে তাকে আরও নির্মল, আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে কি?
মঞ্চের পিছনে দাঁড়িয়ে এ-হেন শেষ অনুরোধ শুনে কিছুটা বিব্রতই হয় ইংরেজ জেলার ইথান প্রাইস। নাতিদীর্ঘ কর্মজীবনে এর আগে যে ফাঁসি দেখেনি সে, তেমনটা নয়। তবে এবারকার সবকিছুই যেন নতুন ঠেকছে, তার একটা প্রমাণ সে অনুভব করছে নিজের স্নায়ুতে। কমিশনার হ্যালিডে ইঙ্গিত করেন, আসামীর ইচ্ছাকে মান্যতা দেওয়ার।
ফাঁসুড়ে তার হাতের দড়িটা মুখ-না-ঢাকা কানাইলালের গলায় দিতে এগিয়ে আসে।
ইট ডাজন্ট ফীল রাইট!
হ্যালিডে চমকে তাকান। ম্যানিলা রজ্জুটা কেমন করে যেন মাথা দিয়ে ঠিকঠাক গলানো হয়নি। সহাস্য আসামী ডান হাতের দুই আঙুলে সেটাকেই ঠিক করে নিজের গলায় পরে নিচ্ছে এবার!
মিস্টার প্রাইস, য়ু দেয়ার?
পরিচিত হাসির সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নটা ভেসে আসতে মাথা আর সোজা রাখতে পারে না ইথান।
ইউ ওয়ান্টেড টু সী মি, রাইট? হাউ ডু আই লুক নাউ?
লিভার টানার চেনা শব্দটা ফুরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ইথান প্রাইস এক মনে ভাববার চেষ্টা করছিল, ওই কালো কাপড়টা দিয়ে তারই মাথা-মুখ ঢেকে দেওয়া হল না কেন! কুয়ো থেকে বের করা দেহটার দিকে না তাকিয়েই হাঁটা দিলেন জেল অফিসের দিকে……
আর তারপর……..
জেলগেট দিয়ে দাদা আশুতোষ দত্ত ভাইয়ের মৃতদেহ নিয়ে বাইরে এসে দেখেন অত সকালেও সেখানে বহু মানুষ হাজির। দেহ তারাই কাঁধে তুলে নিল। শবযাত্রা যত এগোতে লাগলো তত বাড়তে লাগলো ভীড় ।
সে দিন তাঁর শবদেহ নিয়ে কলকাতা শহরের বুকে এক জনপ্লাবনের সাক্ষী থেকেছে পুলিশ ও প্রশাসন। লক্ষ লক্ষ মানুষ…..তারা একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে একবারের জন্য হলেও শববাহী খাটটি ছুঁতে চায়। সর্বত্র ‘জয় কানাই’ ধ্বনিতে আন্দোলিত। শহীদের শেষ যাত্রায় এতো জনসমাগম আগে কোনদিন দেখেনি কলকাতা । কেওড়াতলা শ্মশানে দাহকার্যের পর কানাইলালের ‘চিতাভস্ম’ কেনার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু হয়। আধ ছটাক চিতাভস্মের জন্য কোনও কোনও অত্যুৎসাহী সেই আমলে পাঁচ টাকা পর্যন্ত দিয়েছিলেন !
কলকাতা পুলিশের এক পদস্থ কর্মচারী এফ সি ড্যালি পরে বলেছিলেন “কানাইলাল দত্তের চিতাভস্ম বলে শহরে ঐদিন যা বিক্রি হয়েছিল, অনুমান করা হচ্ছে তা চিতাভস্মের প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে অন্তত পঞ্চাশ গুণ বেশি!”
মহান বিপ্লবীর প্রয়াণ হয়েছে ঠিকই কিন্তু মরণ যে কেড়ে নিতে পারেনি তাদের আপামর বাঙালির হৃদয় থেকে। তাঁরা যে অমর… তাঁরা অমৃতের সন্তান..
লেখক:
স্বপন সেন, কলকাতা
সৌজন্য: এই মুহূর্তে