ফাগুনের পূর্ণিমা ‘দোল’ হয়ে যেভাবে এলো

Comments

ফাগুনের পূর্ণিমার সঙ্গে বাঙালীর সংস্কৃতি নানা টানে জড়িয়ে গেছে। সারা ভারতের বিশেষ করে উত্তরের হোলির থেকে এই বসন্তোৎসবের তফাৎ অনেকটাই।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখব, সংস্কৃত সাহিত্যের পাতায় ধরা পড়েছে এই বসন্তেই অনুষ্ঠিত মদনোৎসবের ছবি। কামদেবতা মদনের পূজা সে উৎসবের অনুষঙ্গ। আর বসন্ত ঋতু মদনের প্রিয় সখা, তাই উৎসব তাকে ঘিরে। সে প্রায় কার্নিভালের মতো এক উৎসব, নৃত্য, গীত, বাদ্য, নরনারীর স্বতস্ফূর্ত অংশ গ্রহণে জমজমাট। নৈতিক অনুশাসন সেদিন শিথিল। সেখানে আবির, কুঙ্কুম, অলক্তক (আলতা), সুগন্ধি মাখিয়ে সবাই রাঙিয়ে তোলে পরস্পরকে। পূজার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হয় অশোক ফুল, আমের মুকুল। খ্রিস্ট জন্মের অন্তত কয়েকশো বছর আগে থেকেই এ উৎসব উদযাপিত হয়ে আসছে। এর উল্লেখ পাওয়া যায় প্রায় ৩০০ খৃষ্টাব্দের রামগড় অঞ্চলেঅ পাথরে খোদাই করা এক ভাস্কর্যে। এই উৎসবের উল্লেখ রয়েছে বেদ এবং পুরাণেও। পরে বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে খোদাই করা চিত্রকর্মেও নারী পুরুষের রঙ খেলার নমুনা ফুটে উঠেছে।

অন্যদিকে বৈষ্ণব ঐতিহ্য অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন কৃষ্ণ আবির, গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপিনীদের সঙ্গে রং খেলায় মেতেছিলেন। তাদের মতে সেই থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি। উত্তর ভারতের দোলের গানে তাই এই রাধা কৃৃষ্ণের খেলার কথা। আবার মুঘল আমলের মিনিয়েচার ছবির বিষয় হিসেবে ও জনপ্রিয় ছিল দোল। সাধারণত দোলের দিন সকালে তাই রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহ আবিরে ফুলে সাজিয়ে পূজা হয়, কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রা বের করা হয়। এরপর ভক্তেরা রং খেলেন। আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য দেবের জন্ম, একে তাই গৌরপূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়। লালন ফকিরের জন্ম ও একই দিনে। এখানে মূলধারার উৎসব লোক জীীবনের সাথে মিলে গেছে।

দোলের আগের দিন সন্ধ্যায় ঝরাপাতা কাঠকুটো দিয়ে তৈরি একটি ঘর পোড়ানো হয়। এটি কে নেড়া পোড়া বলা হয়। এর মধ্যে হয়ত হিন্দু দের বৌদ্ধ ও পরে বাউল (যাদের নেড়ানেড়ী বলা হত) বিরোধী অ্যাগ্রেশনের কোন সূত্র লুকিয়ে আছে।

দোলযাত্রা উৎসবের একটি ধর্মনিরপেক্ষ দিকও রয়েছে। এই দিন সকাল থেকেই নারীপুরুষ নির্বিশেষে আবির, গুলাল ও বিভিন্ন প্রকার রং নিয়ে খেলায় মাতে। শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালনের রীতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই চলে আসছে। এখনো সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। এই উৎসব অবশ্য ঋতুরাজ বসন্তকে স্বাগত জানানোর উৎসব। শান্তিনিকেতনে ১৯২৫ সালে সম্ভবত প্রথম পথ চলা শুরু হয় এই বসন্ত উৎসবের। উৎসবের মূল সুর তখন থেকেই বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। মতান্তরে, আরেকটি সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯০৭ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুরু করেছিলেন ঋতুরঙ্গ উৎসব। সেই ঋতুরঙ্গ উৎসবই আজকের বসন্ত উৎসব। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে দোল উৎসব যাপনের একটি বিশিষ্ট ধরণ বরাবরই ছিল। দোলপূর্ণিমার একটি বিশেষ সাজ ছিল। সে হল হালকা মসলিনের শাড়ি, ফুলের গয়না আর আতর গোলাপের গন্ধমাখা মালা। দোলের দিন সাদা মসলিন পরার উদ্দেশ্য ছিল যে, আবিরের লাল রং সাদা ফুরফুরে শাড়িতে রঙিন বুটি ছড়িয়ে দেবে। হয়ত এরই প্রভাব পড়েছে শান্তিনিকেতনের উৎসবে।

আশ্রমের আদি পর্বে দেশ-‌বিদেশের নানা অতিথির পাশাপাশি উৎসবে সামিল করা হতো আদিবাসীদেরও। আজও সকাল থেকেই শান্তিনিকেতনের রাস্তা রাঙ্গা হয়ে ওঠে আবিরে। বিশ্বভারতী চত্বরই মূলত এই মূল অনুষ্ঠানের অঙ্গ। সেখানে নৃত্যনাট্যের পাশাপাশি চলে নানা উৎসব। আশ্রমের ছাত্র‌ছাত্রীরা তো থাকেই। ভোর থেকে পাঠভবনের ছাত্র ছাত্রীরা, এমনকি শিশু বিভাগের ছাত্ররাও, ‘ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল’, গানের সঙ্গে নাচের ছন্দে শোভাযাত্রা করে আশ্রম প্রাঙ্গণ প্রদক্ষিণ করে। থাকেন সংগীত ভবন, কলা ভবন ও অন্যান্য বিভাগের ছাত্ররা, থাকেন ভিনদেশি ছাত্র‌ছাত্রীরাও। এদের তালে তালে নেচে ওঠে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকরাও। এমনকী বিদেশিরাও। ছাত্র ছাত্রীদের পরনে থাকে বাসন্তী রঙের শাড়ি ও পাঞ্জাবি। সবাই পলাশের সাজে সেজে আসেন। প্রতি বারের মতো এবারেও ‘ওরে গৃহবাসী’ গানটির মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। এরপরে নৃত্যগীত পরিবেশন করেন ছাত্রছাত্রীরা। ঐতিহ্য বাহী রাবীন্দ্রিক শৈলী ছাড়া ও মন কেড়ে নেয় ছেলেদের নাচে মনিপুরী মার্শাল আর্টের ব্যবহার। সন্ধ্যায় গৌরপ্রাঙ্গনে রবীন্দ্রনাথের নাটক অভিনয়ের মধ্য দিয়ে আজকের অনুষ্ঠানের সমাপ্তি।

এবার আবহাওয়া কিছুটা প্রতিকূল, গরমের মাত্রা একটু বেশিই। চারিদিকে পলাশের আর রক্তকরবীর লাল রং তো আছেই। এবার সরকারি ছুটির কারণে টানা চার দিন অবকাশের সুযোগ নিতে কলকাতা ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে দলে দলে মানুষ এসেছেন বসন্তোৎসবে অংশ নিতে। প্রতিবারের মত এবারও দুই-‌তিন দিন আগে থেকেই বিভিন্ন হোটেলে ‘ঠাঁই হবে না’ রব উঠেছিল। হোটেল ও গেস্ট হাউসগুলো সুযোগ বুঝে তিনদিনের জন্য ঘর প্রতি ২৫-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করছে। প্রশাসনিক আন্দাজকে ছাপিয়ে প্রায় তিন লাখের মতো পর্যটক এবার এখানে এসেছেন। শান্তিনিকেতনের মতো ছোট শহরে এই বিপুল জনসমাগম নাগরিক পরিষেবার উপর বিরাট বোঝা। ফলে স্থায়ী বাসিন্দাদের অসুবিধা বিশেষত যানবাহন নিয়ে অবর্ণনীয়। নিরাপত্তা নিয়ে অবশ্য প্রশাসন সতর্কই আছে। এবার বিভিন্ন এলাকায় লাগানো হয়েছে বিশেষ নজরদারি ক্যামেরা। বিভিন্ন হোটেলেও চলছে নজরদারি। পর্যটকদের যেন কোনো রকম হয়রানির শিকার না হতে হয়, সে বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন। এখন পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুসারে মানুষ যথেষ্ট আনন্দের সঙ্গে উৎসবে অংশ নিয়েছেন, কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে নি।

বাঙালীয়ানা/এসসি

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.