ফারহানা নীলার কবিতা

Comments

বন্ধু

কতটুকু আর আমি দিয়েছি তোমাকে
কতটুকু বলো নিয়েছি তোমার থেকে
এই যে দূরত্ব মাপি অথচ জেনেছি দিনশেষে মেঘ ওড়ে রিক্ত মনে 
বিদিশায় চলে যায় গোলার্ধ হাঁকিয়ে দূরে
কত কথা জমে বিন্দু বিন্দু স্বেদজলে

হেঁটে যায় পথ; হেঁটে যায় জীবনটা অচেনা গন্তব্যে 
গ্যালারির সেই দিন করিডোরে খোঁজে ব্রাত্য চাঁদ 
সবুজ মাঠের মাঝে দুটো হাত কেঁপে ওঠে স্পর্শে 
চিবুকের পাশে বয় নদী
বেশুমার; বৃষ্টি হয় মনের বন্দরে
নোঙরের কথা বলে ক্লান্ত পথিক

তবে কি সে বন্ধু 
বন্ধু কি আমার!
বন্ধু হও!বন্ধু হও! বলে গেল চোখগেলো পাখি
তন্তুজ সুখের দিন পাকিয়েছে ব্যথা
বন্ধু শব্দটা গভীর, ভীষণ গভীর-
অতদূর যায়নি দড়িটা
সম্পর্কের তবু নাম থাকে; দিতে হয় কোনো পরিচয়!

বন্ধু তবে কি সম্পর্ক!  
নাকি হেলান দেওয়ার একটি পাহাড়,  অথবা আকাশ-
মেঘজলে লুটোপুটি, অকারণ অভিমান, হাসাহাসি, কাঁদাকাটি… ধরে থাকা হাত!

০২/০৯/২০২২

লুকোনো গল্পের আমি

হারানো গল্পের আমি নতুন গল্পের পসরা সাজাই
কৃষ্ণচূড়া লাল নাকি অন্য কোনো রং
মেঘ ছোঁয়া জল নাকি জল ছোঁয়া মেঘ
অযুত-নিযুত প্রশ্ন আটকে দেয় পথ

গল্পের মতন আমি নাকি গল্পটা আমার
চিবুকের তিল নকুল দানার মতো বাড়ে
বয়সের ভাঁজ গেড়ে বসে খাঁজে খাঁজে 
যৌবনবতী নদীটা জানে কখন শুকোয় জল! কেন রেখা আঁকে স্মৃতি!

ছুঁড়ে দিই দিঘিতে রোদ্দুর 
আংটিতে জমানো কথা জলে হারিয়েছে 
জ্বলজ্বল করে জল 
হীরকচূর্ণ খুঁজছে ঝিনুক ঝিলিক  
পা কেটেছে আমাদের অথবা কেটেছি আমরাই আমাদের জানাশোনা 

অপরিচিত জোছনা ছলছল চোখে ডাকে
চাঁদের বুটিক আমাদের নেই
নেই তারাদের ছবি
তালাশে তল্লাশি চলে
গোপন তল্লাটে 
লুকোনো গল্পের আমি নুইয়ে পড়ি অচেনা সে বাঁকে

৩১/০৮/২০২২

এসো একবার

বলেছ আসছি
আমিও বিশ্বাস করে বসে আছি বোকার মতন!
এবার তোমাকে বলে দেবো ঠিকঠাক কতবার কেঁদেছি বিরহে

সাগরের নীল মেখে নীলাঞ্জন চেয়ে আছে
ঢেউয়ের জলে ঝিকিমিকি জোছনার কাঁপন লেগেছে 
ভিজে যাই ভরা চাঁদে
লুকোনো প্রেমের গিরিখাতে

এসো আজ এসো-ডেকেছি আকুল 
নিরেট পাথর জানে জলের ছোঁয়ায় বাড়ে বিষ
সবুজের উঁকি-জানি ভণিতা ছিল না

তোমাকে না বলা কথা আজ ভীষণ বেয়াড়া 
জল ভাঙছে কাছেই, ভাঙছি আমিও তো 
জল বুকে নিয়ে অভিমান ডিঙিয়ে দাঁড়িয়ে আছি
একবার এসো-
এই শরতের দিন শেষ হয়ে যাবার আগেই এসো

ভালো না বেসেও এসো 
কপর্দকহীন মানুষ; চিনেছি তোমাকে যতটুকু 
বাকিটুকু শুনে যেয়ো
পৌষের সকালে মখমল সূর্য ঘিরে নেবে এই শীতলতা 
যা কিছু উষ্ণতা নিয়ে যেয়ো
বালিয়াড়ি নিঃস্ব হোক
নিঃস্ব হোক সব তিথি 

তবু প্রয়োজন আছে সব জানাবার।

২৯/০৮/২০২২

নিত্য অপলাপ

পূর্ণাঙ্গ জীবন পেতে বারবার জন্মেছি এখানে 
অনেক তিতিক্ষা জমা রেখে গেছে ভাঙনের তীর 
খণ্ডে খণ্ডে জোড়া লাগে, থেকে যায় চিলতে কত দাগ

ভূমিষ্ঠ ভুলের জন্য পোয়াতি সময় কুঁকড়ে কাঁদে
আতুড়ঘরটা ভাসে বেহুলার ভেলায় বেলায় অবেলায় 
পূর্ণ চাঁদে নিয়তির গ্রহণ, গ্রাসের থাবা দিয়ে চলে গেছে 
পূর্ণ-সূর্য ঘিরে নেয়, গিলে খায় নেশাগ্রস্ত মন
মনে পড়ে মহুয়ার কথা, বকুলের কথা…

পূর্ণাঙ্গ ছবিটি আঁকা হয়নি তো আজও
ক্যানভাসে ঝরা পালকের গুমোট জীবন নিয়ে বন্দীদশায় অলীক মাতমের শব্দ 
কিছুই তো পূর্ণ নয়; 
এই বেঁচে থাকা, এই চলে যাওয়া, অনর্থক ঘটা সাজানো আলাপে সচলের অচল হওয়ার কিচ্ছা!

তবে কি পূর্ণতা এমন অধরা ছিল? 
সব আছে- অথচ থেকেও নেই কিছু 
করতলে রেখা বাঁকে; মনে পড়ে নদী ফুঁড়ে জেগেছিল বোধ 

পাপ বাড়ে, পূণ্য গোনে কেউ 
আঙুলের কড়ে 
তবে কি পূর্ণতা ছিল তার!  
কেন জানি খণ্ড খণ্ড ভাঙে চাঁদ সুরুজের বরজটা
নুইয়ে পড়ে থাকে আলোর নামতা সময়ের ধারাপাতে

সকাল হয়েছে-বলে গেছে সেই পাখি কিচিরমিচির 
মোরগের ডাক শুনে ভুল হয় নামতার সুর
আজানের ধ্বনি বলে, পূর্ণ হও হে মানব

পূর্ণ নই বলে মানুষ চিনিনি
পূর্ণ হব বলে মানুষের মাঝে ঘুরি-ফিরি 
পূর্ণাঙ্গ হবার জন্য ঈশ্বরের কৃপার অপেক্ষা করি 
খণ্ডিত তাণ্ডব বয়ে যায় হৃদয়ের অন্তঃপুরে 
দ্বিখণ্ডিত মন বহু খণ্ডনের চিহ্ন আড়ালের সাক্ষ্য দেয় 
নিত্য অপলাপে

২৮/০৮/২০২২

আয়নায় মুখ 

তমাল দেখিস একদিন ছেড়ে দেব পুরনো অভ্যেস
ছাইপাঁশ আর গিলব না 
ধুঁয়ো উড়বে না চারিপাশে কুণ্ডলি পাকাতে পাকাতে বাতাস নেবে না সে গন্ধ 
চুরুটের টান আটকে দেবে ফুসফুস 
তমাল দেখিস 
একদিন সব ছেড়ে দেব
গুলের মাজন, তামাকের গুড়ো, হাকিমপুরি রতন জর্দা সব ছেড়ে দেব
পুরোনো অভ্যেস সে তো পুরোনো ব্যামোর মতো
বয়স হলেই বাড়ে
যেমন বেড়েছে গেঁটে-বাত
বেড়েছে অনিদ্রা আর মায়া
ভালোবাসা-মায়া এইসব ছেড়ে দেব 
তোকে আগলে ধরে আর ঝুলতে চাই না রে!
তমাল দেখিস-
পকেটে অতীত পোড়া 
বিড়িতে একটা টান আর বিচ্ছিরি দাঁতের হাসি
সব ফেলে দেব ছুঁড়ে 
টানাপোড়েন নিয়ে লাল চোখে ফিরব না আমি
জলের দাগের ক্ষত মুছে দেব জন্মের মতন
তমাল জানিস!
সেদিন তো দূরে নয়
বদভ্যাস নিয়ে অভিযোগ তুলে আঙুলের কড় গুনে বলে দিস সব একে একে 
কতটা সময় টেনেছিস এই জীবনটা কষ্টের মোড়কে-বলে দিস
তোর অপচয়ের সময় হিসেবে গুনে সেদিনে জানিয়ে দিস
যে সময় দোলে জলের ছায়ায়
গিলে খায় নীল তিমি সময় আদলে
সে সময় আর জানিস ফেরে না
ফেরেনি কখনও কারো ডাকে
ঝুলন্ত শরীর যেন পেণ্ডুলাম
দুলছে স্মৃতির বিমে বর্গায় ফানুস
তমাল ফানুস দেখেছিস!
ফানুসের উৎসবে কত মচ্ছবের কথা
আটকে দিয়েছে দম শ্বাসের আশ্বাস 
তমাল! তমাল! এইবেলা তবে যাই
এইবেলা যাবার সময়
ব্যথার দহনে যত ছাই 
চিতায় পুড়েছে তারও বেশি 
সিঁদুর রঙের সিঁথি-কাটা পথে গোধূলি লুটিয়ে পড়ে 
বদভ্যাস আর বদ-স্বভাব এক তো নয়!
কুরুচির দিকে চোখ দিয়ে কতটা দেখিস অন্তর্গত বিষাদের দাগ!
ন্যায় অন্যায়ের ফয়সালা করতে কতবার পাল্টে দিতে গিয়েছিস বল?
মানুষ আয়না দেখে 
তমাল, সামনে তোর সেই আয়নাটা!
কাকে দেখা যায়-  
আয়নায় মুখ; ওটা কার আদল বল তো?

২৬/০৮/২০২২

ছোঁয়ার আশায়

দূর থেকে কতটুকু আর পারি ছুঁয়ে দিতে
কতটা দূরত্ব পেরিয়েছি এই ছায়াতলে
কাছে আছ তবু নেই ছোঁয়ার দূরত্বে
ঝরাপাতা পেরেছে কি গাছটাকে ছুঁয়ে দিতে
এই শহরের কোলাহলে 
রাত-দিন নিয়ম করেই চলে
তবু জানি কোনো দিন ছোঁয়নি রাতকে!
পাশাপাশি চলি, কত কথা বলি
অথবা হয়তো আগুপিছু হাঁটি
আমরা কেউই কাউকে ছুঁইনি
একটু আধটু ভালোবেসে
মেঘ জানে আকাশটা ছোঁয়া যায় না কখনও 
বাতাস জেনেছে উড়ে চলা
মেঘের নিষাদ 
নক্ষত্র পতনের পরও হয়নি তো জানা কতটুকু কাছে গেলে হয় ছোঁয়া?
সৈকতের বালি জানে ঢেউ এসে চলে যায় 
জল তো ফেরে না আর 
যে জল গিয়েছে চলে ছুঁয়ে দিতে আসেনি আবার
তবু এই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা
তবু এই ঘোর মোহ মাতিয়ে রেখেছে ছোঁয়ার আশায়

২৪/০৮/২০২২

লেখক:
Farhana Neela
ফারহানা নীলা, কবি, গল্পকার ও চিকিৎসক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট