ফারহানা রহমানের কবিতা

Comments

দৃশ্য

কুণ্ঠিত প্রেমের মত্ততায়
প্রতিটি প্রহর জুড়ে থাকে নীরবতা
সমস্ত শেকড় ছুঁয়ে
নিখোঁজ এখন অতীতের
মসৃণ বিস্ময়!
রিপু করে সেলাই দেওয়া
ছেঁড়া ছেঁড়া পেঁজা তুলো;
হেমন্তের সবুজ পাতারা,
ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে
কেন যে অচেনা পতনে উম্মুল হয়ে
ওঠে তারা? তবু দিগন্তের
রেখায় স্নিগ্ধতা আর
তটিনীর মতো অভিজাত অট্টহাসি
গভীর রজনী চোখে
ফিরে ফিরে আসে
শীতল মুগ্ধতা নিয়ে;
অভাব ছিল না মহিমার
অথচ দৃশ্যটি প্রতিবার
বদলে বদলে যায় শুধু…

বৃষ্টির শাসনে

নির্জন বিষাদময়
কোনো এক মেদুর সন্ধ্যায়,
তোমার হাসিতে ঘোর লেগে ছিল!
পাথুরে রাস্তায় হেঁটে যাই
একা একা কথা বলি নিজের সাথেই
কোথা থেকে এল অনাহূত বৃষ্টিপাত!
হঠাৎ স্বেচ্ছাচারীর মতো
নিমগ্ন হাঁটতে থাকা
আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়,
ভেসে যাই অনন্ত বিস্তারে
উচ্ছ্বসিত অভিমানে;
অতঃপর বিহ্বলতা নিয়ে
শূন্যতা ও পূর্ণতার বোধের মতোই
স্মৃতির বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দূর
থেকে শুনি অ্যাকর্ডিয়ানের সুর
বুঝে যাই মহুল জলের
বৃষ্টি ফোঁটা প্রকৃত অর্থেই
দেহের চেয়ে মনের
প্রশান্তিই বেশি বয়ে আনে…

যতিচিহ্ন

যে পানসি ভিড়েছিল শূন্য
ফেরিঘাটে, জোড়াসাঁকো
একদিন ভেঙে দেয় সেই
যে গহনে থাকে
অনাকাঙ্ক্ষিত রাতের কুহক,
অন্তিম আমন্ত্রণে
সে হারায় সুরের মূর্ছনা
অঝোর বৃষ্টির অনুষঙ্গে
যার মিশে থাকে
ভেজা মাটি, ঝরাপাতা;
হারাবার আর কিছু নেই তার!
যে ফেরারি জলের বিথারে
অজস্র ঝিনুক খোঁজে ভোররাতে!
সেকি জানে কতটা লুকানো থাকে ক্ষত
মুক্তোর বুকের মাঝে?
বিস্ময় ফুরিয়ে গেলে
কথারা হারিয়ে যায়,
বিষণ্ণতা আনন্দের মতো লাগে,
আর তখনই নৈঃশব্দ্য ঝুলে থাকে
অনাদি লুপ্তিতে যতিচিহ্ন হয়ে…

মেঘের সাঁকো

মুক্তো ঝরা সেই রাতে,
বৃষ্টির চাদরে ওম
মেঘের ফনায় মাথা
ঠেকিয়ে সুখের অন্তহীন সংক্রান্তিতে
ভেজা ভেজা উষ্ণ আদর
তৃপ্তির অনুপম মাধুর্যে;
যেমন করে বয়ে আনে
বৃষ্টির প্লাবন,
মাটিকে জড়িয়ে ধরে পলি;
মনে আসে নতুন অঙ্কুর
মহুয়ার ঘ্রাণ!
তখন না বলা কথারা গোপনে দিঘি হয়,
এমনই সে দিঘি যে
জ্যো‌ৎস্নায় প্লাবন বয়ে আনে,
ঝর্ণাজলে ক্রমশ লুণ্ঠিত হয়
অবগাহনের কাল;
আঁকাবাঁকা পাহাড়ের সানুদেশ
আদুল হৃদয় ভেসে যায়
অন্ধকার রাত কেটে আসে
বৃষ্টিভেজা ভোর
আকাশে অপূর্ব এক
আলোর অসহ্য বন্যা,
অজানাকে ছোঁয়ার আশায়
আমার উড়ন্ত চুল যেন
ঝাঁকেঝাঁকে ধূসর রঙের মেঘ;
উড়ে উড়ে ক্লান্ত; দূরে
কোথাও মাঠের পর মাঠ;
সমুদ্র, পর্বতমালা আর
মরুভূমি, সূর্য-দিগন্ত পেরিয়ে
অজস্র নক্ষত্রভরা রাত,
সোনালি হ্যালোজিনের মতো!
নদী থেকে নদী আর
সাগরে কেবলই ভেসে
বেড়াতো তখন তারা
তারপর কোনো একদিন
শান্ত ঘুমন্ত ঘুঙুর হই
আর তখনই তুমিও খুঁজে পেয়ে যাও
মাতামুহুরীর সেই মেঘজীর্ণ সাঁকোটিকে…

সিসিফাস

এখানেও শ্রাবণের স্নিগ্ধতা জাগায়
আমার অরণ্য মনে, তোমার চোখের
নিঃসীম নৈঃশব্দ্য, সিসিফাস! অবিরাম,
পাইনবনের গহিনে পাতার শব্দ
শুনি, ব্যাকুল-মর্মর ঝরে ঝরে পড়ে।
আকাশের তারার মতোন ফুটে থাকে
শ্যামতরু, থোকা থোকা নীল ক্যামেলিয়া;
স্তব্ধ ছায়া ফেলে গ্ল্যাসিয়ারে, দিনগুলি;
পূর্বজন্মের স্মৃতিফলক ফেলে গেছি
তোমার দুয়ারে, কার্নিশে, শাশ্বত শ্বাসে!
সময়ের মুগ্ধ অবকাশে, সিসিফাস!
নিষ্ঠুর পর্বতচূড়া থেকে সন্ধ্যারাতে
নিষ্ফল গড়িয়ে পড় তুমি অন্ধকারে
আশা জাগানিয়া নিদারুণ স্বপ্নচারী;
লুপ্ত পাথর খণ্ডটি কাঁধে তুলে নিয়ে,
আর আমি অযুত বৎসর ধরে বয়ে
চলি এক বিচিত্র আঁধার ভবিষ্যৎ!

লেখক:
Farhana Rahman
ফারহানা রহমান, কবি, গদ্যকার, অনুবাদ সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট