বৃহস্পতিবার, ২ আগষ্ট, ২০১৮
জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসের চাপায় ২৯ জুলাই, ২০১৮ কুর্মিটোলায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর শুরু হওয়া স্কুল শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবীতে আন্দোলন পঞ্চম দিনেও অব্যাহত থাকে। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘উই আর স্টুডেন্ট, নট টেরোরিস্ট’— এরকম বিভিন্ন স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড আর কাগজ নিয়ে বৃহস্পতিবার দিনভর রাজপথে ছিল হাজারো শিক্ষার্থী।
আগেই সারাদেশের স্কুল ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। তারপরও কোন শিক্ষার্থীকেই ঘরে আটকে রাখা যায়নি। স্বত:স্ফুর্ত শিক্ষার্থীরা রাজধানীর প্রতিটি রাস্তায় নেমে আসে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী বৃষ্টির মধ্যে রাজপথে বসে মিছিল শ্লোগান দিতে থাকে। পাশাপাশি রাস্তায় চলাচল করা প্রতিটি গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা করে তবেই ছাড়ে। যেসব গাড়ি বা চালকের বৈধ কাগজপত্র ছিল না তাদের পুলিশ সার্জেন্টের কাছে নিয়ে মামলা দিতে বাধ্য করে এই শিক্ষার্থীরা। তারা সবাইকে দেখিয়ে দেয় কিভাবে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে।
তবে বৃহস্পতিবার কোন সহিংসতা ছিল না। শুধুমাত্র সায়েন্স ল্যাবটেররি মোড়ে ছাত্রদের সঙ্গে এক সার্জেন্টের তর্কাতর্কির জেরে তার মটরসাইকেলটি পুড়িয়ে দেয়া হয়। কিল ঘুষিতে আহত হয়েছেন ওই সার্জেন্ট। অপরদিকে মিরপুরে পুলিশের সঙ্গে লাঠি হাতে কিছু যুবক ছাত্রদের নির্দয়ভাবে পেটায়।
স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেছেন সাংস্কৃতিক কর্মী, শিল্পীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। অনেক এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও স্কুল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রাজপথে বসে ছিলেন। ছিলেন বহু অভিভাবকও। তারা কোমলমতি এসব শিক্ষার্থীকে খাবার-পানি কিনে দেন। সাধারণ মানুষও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে বলেন, এদের দাবি যৌক্তিক।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় নিহত দুই শিক্ষার্থীর পরিবারকে সান্ত্বনা প্রদানকালে বলেন, আপনাদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই। আপনাদের কষ্টটা আমি বুঝি। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বাস চাপায় নিহত শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিম রাজীবের পরিবারের সদস্যরা। এ সময় প্রধানমন্ত্রী দুই পরিবারকে ২০ লাখ টাকা করে পারিবারিক সঞ্চয়পত্র অনুদান প্রদান করেন।

সরকার সূত্র জানায়, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সব দাবি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বিষয়টি তদারকি করছেন। ইতিমধ্যে ঘাতক বাসের চালক ও মালিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই দুই বাসের রুট পারমিট বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া সব স্কুলের সামনে স্পিড ব্রেকার স্থাপন, প্ল্যাকার্ডধারী বিশেষ ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন, শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজসংলগ্ন বিমানবন্দর সড়কে আন্ডারপাস নির্মাণ এবং ওই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের যাতায়াতের জন্য পাঁচটি বাস প্রদান করতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সড়ক পরিবহন আইন দুই মাসের মধ্যে পাস করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর অবস্থানে যাবে সরকার। শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি দ্রুত বাস্তবায়নে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে গতকাল প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, একটি মহল আন্দোলনের মধ্যে নাশকতা তৈরির চেষ্টা করছে। যেকোনও সময় যেকোনও কিছু ঘটে যেতে পারে। তাই প্রধানমন্ত্রী আহ্বান জানিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে ফেরত যাওয়ার। বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজ বাসভবনে আয়োজিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, দুই সহপাঠী হারিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যে প্রতিবাদ জানিয়েছে তা যৌক্তিক। কিন্তু এর ফলে সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়ছে। পুলিশ চরম ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছে। কিছু বলছে না। কিছু একটা হয়ে গেলে এর দায় নিরাপত্তাবাহিনী নিতে পারবে না। তাই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাছে আমার অনুরোধ, ‘যথেষ্ট হয়েছে, তোমরা ক্লাসে ফিরে যাও, বাসায় ফিরে যাও। তিনি শিক্ষার্থীদের বোঝানোর জন্য মা-বাবা ও প্রতিবেশিদের প্রতিও আহবান জানান।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, শিশুদের থেকে অনেক সময় শিক্ষা নিতে হয়। শিক্ষার্থীরা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কী করতে হবে। আমরা তাদের দাবি বাস্তবায়নে কাজ করছি। তাদের ঘরে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করছি। বৃহস্পতিবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, নিহত পরিবারের প্রতি আমি সমবেদনা জানাই। আমরা তাদের সন্তান ফিরিয়ে দিতে পারব না, তবে সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব। শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার অনুরোধ, তারা যেন ঘরে ফিরে যায়। অভিভাবক ও শিক্ষকদের প্রতি আমি একই অনুরোধ জানাচ্ছি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন জানাই। পরিবহনখাতে ভয়াবহ কাণ্ড চলছে, পাশবিক অত্যাচার নির্যাতন চলছে। সে কারণেই যার যা খুশি করছে। মনে হচ্ছে সরকার বলে কোনো কিছু নেই, এটা একটা পুরোপুরি ব্যর্থ সরকার। সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আমরা শুধু নৌ-পরিবহন মন্ত্রী ও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর পদত্যাগই দাবি করছি না; আমরা এই সরকারের পদত্যাগ দাবি করছি। সড়ক দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে দেশে একের পর এক অঘটন ঘটলেও এ সরকার তা নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তাই জনগণকে এই সরকারের পতন আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। বৃহস্পতিবার নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপির আন্দোলন করার মতো শক্তি, সাহস ও সক্ষমতা নেই। এ জন্যই তারা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ওপর ভর করছে। বৃহস্পতিবার সকালে সচিবালয়ের নিজ কক্ষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, ‘তাদের (বিএনপি) এখন আর কোনো উপায় নেই। তাই তারা এখন ছাত্রদের আন্দোলনের ওপর ভর করবে-এটাই স্বাভাবিক। কাদের বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের তীব্রতা কমে এসেছে। বিআরটিসির গাড়ি রাস্তায় চলছে। এরপরও রাস্তায় গাড়ি কম। গাড়ির ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কায় তাঁরা গাড়ি বের করছেন না। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। মানুষের যাতে ভোগান্তি না হয়, সে ব্যাপারে মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দাবি প্রসঙ্গে সেতুমন্ত্রী বলেন, তাদের সব দাবি প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইনে রয়েছে। এ আইন হলে সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজটের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। এ আইনে পথচারীদের জন্যও বিধান থাকবে। তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, আইনটি জনস্বার্থে ক্যাবিনেটে অনুমোদিত হবে এবং তারপর তা সংসদেও পাস হবে।’
রাস্তায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা বজায় রাখতে ও দুর্ঘটনা কমাতে মহাসড়কে ট্রাক ও বাসের গতি নির্ধারন করা হয়। মহাসড়কে বাসের সর্বোচ্চ গতি হবে ৮০ এবং ট্রাকের গতি ৬০ কিলোমিটার। এ জন্য প্রত্যেক গাড়িতে গতিনিয়ন্ত্রক যন্ত্র বাধ্যতামূলক করা হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানী এলেনবাড়িতে বিআরটিএ’র প্রধান দপ্তরে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ সক্রান্ত এক বৈঠকে এ সিন্ধান্ত নেয়া হয়। বিআরটিএ-র চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পরিবহন মালিক ও শ্রকিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
এ কয়েকদিনের বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে সরকার দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃহস্পতিবার বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। স্কুল বন্ধ থাকলেও বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই রাজধানীর অন্তত ২৫টি পয়েন্টে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে বিক্ষোভ করে। ফলে অন্যান্য দিনের মত ঢাকার বিভিন্ন সড়কে পাবলিক পরিবহন রাস্তায় নামাননি মালিকরা। বিআরটিসির কিছু বাস চলাচল করে। প্রাইভেট যানবাহন স্বাভাবিকভাবে চলাচল করলেও পরিমানে ছিল কিছুটা কম। পায়ে হেঁটে চলা মানুষও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে গেছেন। অনেকেই রাজপথে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বেশ কিছু সময় কাটান, সমর্থন দেন।
বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে অনান্য শহরেও। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বাইরে বহু এলাকায় সড়কে নেমে আসে শিক্ষার্থীরা। বেশিরভাগ জায়গায় দুর পাল্লার বাসও চলাচল করেনি। বিক্ষোভে গেলে টিসি দিয়ে দেওয়া হবে- স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এমন এসএমএস পাওয়ার কথাও জানান কয়েকজন অভিভাবক। এসব হুমকি আমলে না নিয়েই সকাল ১০টার পর থেকে বিভিন্ন এলাকার ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নামতে থাকে।
রাজধানীর উত্তরা, মহাখালী, মগবাজার, শাহবাগ, রামপুরা, ফার্মগেইট, মানিক মিয়া এভিনিউ, আসাদগেইট, ধানমন্ডি, মিরপুর রোড, খিলগাঁও, মালিবাগ, শান্তিনগর, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীরা আগের দিনের মতই মিছিল করে এবং গাড়ি থামিয়ে চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা করে। পুলিশের ভূমিকায় তাদের এই পরীক্ষা থেকে পুলিশের গাড়িও ছাড় পায়নি। সরকারের উর্ধ্বতন ব্যক্তিদের গাড়ির কাগজও তারা পরীক্ষা করেন। সাত রাস্তার দিক থেকে সচিবালয়ে যাওয়ার সময় মগবাজারে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মধ্যে পড়ে সরকারি একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার গাড়ি। তিনি বেরিয়ে এসে বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়গুলো তিনি মন্ত্রিসভায় তুলবেন। তখন হাততালি দিয়ে তাকে যেতে দেয় শিক্ষার্থীরা।

বিক্ষোভকারীদের অধিকাংশের পরনে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইউনিফর্ম দেখা গেছে। তবে স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় অনেকে সাধারণ পোশাকেও উপস্থিত হয়। পুলিশের গাড়ি আটকানোর চেষ্টার সময় কারও কারও মুখে কাপড় পেঁচিয়ে রাখতেও দেখা যায়। বিক্ষোভকারীদের হাতে দেখা গেছে- ‘নিরাপদ সড়ক চাই’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘উই আর স্টুডেন্ট, নট টেরোরিস্ট’— এরকম বিভিন্ন স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড ও টুকরো কাগজ। রাস্তায় গোল হয়ে বসে সুরে সুরে স্লোগান দিতেও দেখা যায় কাউকে কাউকে। তাদের অনেকে পোশাক ঘামে-বৃষ্টিতে ভিজে একাকার কিন্তু এদিকে ভ্রুপক্ষেপ নেই, মুুখে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকার প্রত্যয়।
সকালে টঙ্গী কলেজগেট এলাকায় ময়মনসিংহ রুটের দু’টি বাস ভাঙচুরের শিকার হয়। মাইলস্টোন কলেজ, উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রমিজউদ্দিন কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্ম পড়া শিক্ষার্থীরা অল্প সময়ের মধ্যে উত্তরা এলাকার রাস্তার দখল নেয়। উত্তরার জসিমউদ্দিন মোড়ে একটি পিক-আপ ভ্যান ভাংচুরের শিকার হলে ওই এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বেলা ১১টার দিকে খিলক্ষেত আর ঢাকা রিজেন্সি হোটেলের সামনের রাস্তাও ছিল শিক্ষার্থীদের দখলে। পুরো এলাকা চলে যায় শিক্ষার্থীদের দখলে। কুড়িল বিশ্বরোড, খিলক্ষেত দিয়ে বহু মানুষ তখন হালকা বৃষ্টির মধ্যে পায়ে হেঁটেই গন্তব্যের দিকে যেতে দেখা যায়।
শাহবাগে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে শুরু করে সকাল সাড়ে ১০টার পর থেকেই। হাতে হাত বেঁধে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে শাহবাগ মোড়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। ধীরে ধীরে ছাতা হাতে জমায়েত বাড়তে থাকে। চলতে থাকে স্লোগান। মুন্সী আবদুর রউফ রাইফেলস কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজ, নটরডেম কলেজ, ক্যামব্রিয়ান কলেজের পোশাক পরা শিক্ষার্থীদের দেখা যায় শাহবাগে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মাইক নিয়ে আসে আন্দোলনকারীরা। সেখানে ঘোষণা দেওয়া হয়— ‘আমরা সিঙ্গেল লাইনে গাড়িগুলো ছাড়ব। গাড়ির লাইসেন্স থাকলে তারপর যেতে দেব।’
ইমপেরিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা বেলা সাড়ে ১০টার দিকে রামপুরায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে বিভিন্ন যানবাহন থামিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করতে শুরু করলে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মেরুল বাড্ডা থেকেই যানবাহন ঘুরিয়ে দেয় পুলিশ। খিলগাঁও রেলগেইট থেকে মালিবাগ রেলগেইট পর্যন্ত বাস আটকাতে দেখা যায় খিলগাঁও ন্যাশনাল আইডিয়াল, খিলগাঁও গভার্মমেন্ট বয়েজ হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের মালিবাগ মোড় থেকে শান্তিনগর মোড় পর্যন্ত জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে দেখা যায় বেলা ১১টার দিকে। ফলে কাকরাইল থেকে শান্তিনগর হয়ে মালিবাগ পর্যন্ত পুরো রাস্তা অচল হয়ে যায়। ফ্লাইওভারের ওপরে গাড়ি আটকে থাকতে দেখা যায়। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামে বেলা ১২টার দিকে।
রহিমা খাতুন নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা কোনো কথা বলব না। আমাদের কোনো নেতা নাই। আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব। আমরা ন্যায় বিচার চাই।’ মহাখালীর রেলগেইট এলাকায় বিএফ শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। তারা রেল লাইনের দুইপাশে এবং সাতরাস্তা থেকে আমতলী যাওয়ার দুই দিকের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে গাড়ি আটকে চালক ও গাড়ির লাইসেন্স পরীক্ষা করে। কাগজ দেখাতে না পারলে গাড়ি পাঠান পুলিশের কাছে। অনেক গাড়ির বনেটে বা গায়ে মার্কার কলম দিয়ে তাদের ‘উই ওয়ান্ট জার্স্টিস’ লিখে দিতে দেখা যায়।
মিরপুরে শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ ও যুবকের হামলা
নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঢাকাজুড়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে মিরপুরে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। এসময় একদল যুবককেও লাঠি হাতে শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হতে দেখা গেছে। বিকাল ৪টার দিকে মিরপুর-১৩ ও ১৪ নম্বরের মধ্যে বিআরটিএ থেকে কাফরুল থানা হয়ে পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টের গেইট পর্যন্ত সড়কে এই ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলে। সংঘর্ষে অনেক শিক্ষার্থী আহত হন। আহত শিক্ষার্থীরা বলেছেন, মিরপুর-১৪ নম্বর এলাকায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে তাদের মানবন্ধন কর্মসূচি চলছিল। পুলিশ লাঠিপেটা করে তাদের সরিয়ে দেয়।
সার্জেন্টের উপর হামলা ও মোটরবাইকে আগুন
ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখতে চাওয়াকে কেন্দ্র করে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে পুলিশের ট্রাফিক সার্জেন্টের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। ধানমন্ডির সায়েন্স ল্যাবরেটরি সিগন্যালে বৃহস্পতিবার দুপুরে এই ঘটনা ঘটে। সার্জেন্ট বায়েজিদ মোটরসাইকেলে চড়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরি সিগন্যালে এলে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা তার গতিরোধ করে লাইসেন্স দেখতে চায়। সার্জেন্ট বায়েজিদ তখন উত্তেজিত হয়ে যান। এতে শিক্ষার্থীদের রোষানলে পড়েন তিনি। কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে সার্জেন্টের ওপরে হামলা হয়। তার মাথা এবং শরীরে কিল-ঘুষি মারা হয়। তবে অন্য শিক্ষার্থীরা ওই সার্জেন্টকে উদ্ধার করে সায়েন্স ল্যাবরেটরি পুলিশ বক্সে নিয়ে যায়। সেখান থেকে শিক্ষার্থীরাই আবার অ্যাম্বুলেন্সে তাকে পপুলার হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের ওপরে হাত তোলার খবর ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজিত হয়ে ওঠে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা দু’টি বাস ভাঙচুর করে এবং সার্জেন্ট বায়েজিদের সরকারি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দিলে সেটি ভষ্মিভূত হয়।
খাবার নিয়ে অভিভাবকরা রাজপথে
বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের সুষ্ঠু বিচার ও নিরাপদ সড়কের দাবিসহ ৯ দফা দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে রাস্তায় নেমেছেন অনেক অভিভাবকও। দুপুরে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে খাবার, পানি, স্যালাইন এবং বিস্কুট বিতরণ করতে দেখা গেছে অনেক অভিভাবককে।
খাবার ও পানি নিয়ে আসা অভিভাবকদের একজন নার্গিস আক্তার। ধানমন্ডিতে থাকেন তিনি। তার সন্তানও নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় আন্দোলন করছে। তিনি বলেন, ‘শুধু আমার ছেলেই না, আরও অনেক মায়ের সন্তান ন্যায্য দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। আমি তাদের দাবির সঙ্গে একমত। আমি আশা করি, অন্য অভিভাবকরাও তাদের সন্তানের জন্য নিরাপদ সড়ক চান। এই ভ্যাপসা গরমে অসুস্থ হয়েও পড়তে পারে তারা। তাই নিজেই চলে আসলাম। তাদের পানির ব্যবস্থা অন্তত করা গেলো। অন্যদের উচিৎ বাচ্চাদের খাবার দেয়া।’
পুলিশের গাড়িতে লাইসেন্স রাখার নির্দেশ
পুলিশের গাড়িগুলোয় লাইসেন্সসহ অন্যান্য কাগজপত্র সঙ্গে রাখতে চালকদের নির্দেশ দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা তিন দিন ধরে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় গাড়িচালকের লাইসেন্স পরীক্ষা করে দেখছে। লাইসেন্সবিহীন চালকের গাড়ি আটকে দিচ্ছে তারা। এই পরিস্থিতিতে ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয় থেকে এ নির্দেশনা আসে।
শুটিং ফেলে রাস্তায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা
শুটিং ফেলে উত্তরার রাস্তায় বসে পড়েন অভিনয় শিল্পী ও কলাকুশলীরা। পরিচালক-প্রযোজকেরাও ঢাকার রাস্তায় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দেখে নিজেদের শুটিংয়ে আটকে রাখতে পারেননি। কিশোর-কিশোরী এসব শিক্ষার্থীর ডাকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে সাড়া দিয়ে তারা রাস্তায় বসে পড়েন। উত্তরায় মাসকট প্লাজার সামনে অবস্থান নেয় পরিচালক, প্রযোজক ও শিল্পীরা।
পরিচালকদের পক্ষে সকাল আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছে, এটা আমাদের সবার চাওয়া। এ দেশের সাধারণ জনগণের চাওয়া। দেশের নাগরিক হিসেবে আমরাও এসবের বাস্তবায়ন চাই। আমরা হয়তো রাস্তায় নেমে এত দিন বলতে পারিনি, এই তরুণ শিক্ষার্থীরাই আমাদের করে তা দেখিয়ে দিয়েছে। এসব শিক্ষার্থীকে স্যালুট।’ অভিনেতা লুত্ফর রহমান জর্জ, রওনক হাসান, মিশু সাব্বির, অভিনেত্রী নাদিয়া আহমেদ, সাবেরী আলম, মনিরা মিঠু, অর্ষা, পরিচালক অরণ্য আনোয়ার, সকাল আহমেদ, সাগর জাহান, চয়নিকা চৌধুরী, সাফায়েত মনসুর রানাসহ অনেকেই সকাল থেকে রাস্তায় বসে ছিলেন। এর আগে বুধবারও শুটিং বন্ধ রেখে উত্তরায় আন্দোলন করতে দেখা যায় সকাল আহমেদ, জাকিয়া বারী মম, নাদিয়া আহমেদ, নওশীন, অর্ষা, তৌসিফ মাহবুবকে। শাহবাগে অংশ নিতে দেখা যায় জ্যোতিকা জ্যোতি ও নওশাবাকেও।
ঢাকা থেকে আন্তজেলা সড়কপথে বাস বন্ধ
ঢাকা থেকে আন্তজেলা পথে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কোনো বাস চলেনি। গাবতলী বাস টার্মিনালে বাস চলাচল বন্ধ করে বাস ভাঙচুরের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকেরা। তারা বলছেন, নিরাপত্তাহীনতার কারণে কোনো বাস ছাড়া হচ্ছে না। পুলিশ সূত্র জানায়, ঢাকার আন্তজেলা বাস টার্মিনাল গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী থেকে সকালে কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। আবার কোনো বাস এসব টার্মিনালে আসেনি। এতে ঢাকা থেকে প্রায় সব সড়কপথে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
রেললাইনে অবরোধ
কমলাপুর রেলওয়ে সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া দুই থেকে চারটা পর্যন্ত আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মালিবাগ রেলগেইট এলাকায় রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। ফলে চট্টগ্রাম, সিলেট ও জামালপুরগামী তিনটি ট্রেন কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে ছেড়ে যেতে বিলম্ব হয়।
মন্তব্য করুন (Comments)
comments