রবিবার, ৫ আগষ্ট, ২০১৮
রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় রবিবার শিক্ষার্থীদের বিশাল জমায়েতে এলোপাতাড়ি হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এই হামলা চালানো হয় পুলিশি পাহারায়। পুলিশ পেছন থেকে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। আর সামনে এগিয়ে এসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বেধড়ক পেটান ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ সময় তাঁদের হাতে ছিল লাঠি-রড-রামদা-চ্যালা কাঠ। পরিচয় লুকাতে মাথায় ছিল হেলমেট।
শিক্ষার্থী ছাড়াও কর্তব্যরত সাংবাদিকদেরও খুঁজে খুঁজে নির্মমভাবে পেটান তাঁরা। এমনকি নারী চিকিৎসক, বৃদ্ধ পথচারীও রেহাই পাননি। বিভিন্ন ভবনের ওপর বা ভেতর থেকে যাঁরাই মুঠোফোনে হামলাকারীদের ছবি তোলেন, দেখামাত্র তাঁরাও মারধরের শিকার হন।
রবিবার ধানমন্ডি এলাকায় পুলিশের পাহারায় করা এই হামলায় অংশ নেন ছাত্রলীগের কয়েক শ নেতা-কর্মী। এতে কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। তাঁদের মধ্যে ১৪ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাঁরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এই নিয়ে দুই দিনে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের হামলায় প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী আহত হন।
আন্দোলনরত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর শনিবারের হামলার প্রতিবাদে রবিবার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দুটি কর্মসূচি ছিল। ‘অপরাজেয় বাংলা’র নিচে ব্যবসায় অনুষদের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে একটি অংশ এবং রাজু ভাস্কর্যের সামনে নিপীড়নের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসা শিক্ষার্থী ও বামপন্থী কয়েকটি সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মানববন্ধনের কথা ছিল বেলা ১১টায়। ওই কর্মসূচি দুটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা নার্সিং কলেজের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেন। মানববন্ধন কর্মসূচি শেষে শিক্ষার্থীরা শাহবাগ থেকে জিগাতলা হয়ে আবারও শাহবাগে ফিরে প্রতিবাদ কর্মসূচি শেষ করার সিদ্ধান্ত নেন। দুপুর ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা সায়েন্স ল্যাব হয়ে জিগাতলার দিকে মিছিল নিয়ে এগোয়। স্লোগান ছিল মূলত ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। সকাল থেকেই সীমান্ত স্কয়ারের কাছে পুলিশ অবস্থান নেয়। শিক্ষার্থীদের একটি অংশ জিগাতলা মোড়ে জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের সামনে দিয়ে ফিরছিল, অন্য অংশটি দাঁড়িয়ে ছিল পুলিশের মুখোমুখি। আন্দোলনকারীরা পুলিশের উদ্দেশে চিৎকার করছিল। একপর্যায়ে পুলিশ শিক্ষার্থীদের দিকে টিয়ার গ্যাসের শেল ছুড়তে শুরু করে। শিক্ষার্থীরাও দূর থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছোড়ে ও আগুন জ্বালিয়ে টিয়ার শেলের ঝাঁজ থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা চালায়। বেলা দেড়টা নাগাদ পুলিশের উপর্যুপরি ধাওয়ার মুখে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে বের করে নিয়ে পুলিশ তাদের ধানমন্ডি ১ নম্বরের দিকে জড়ো করে। অন্য অংশটি পার্কের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ধানমন্ডি লেকের পাশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের একাংশ বেরিয়ে যাওয়ার সময় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে থেকে লাঠিসোঁটা নিয়ে যুবকেরা শিক্ষার্থীদের তাড়া করে।
এদিকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলমান শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাইন্সল্যাব এলাকায় সাংবাদিকদের ওপর হামলায় অন্তত ৫ সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফার গুরুতর আহত হন। ছাত্রলীগ ও যুবলীগকর্মীরা হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন আহত সংবাদকর্মী ও শিক্ষার্থীরা। তারা অভিযোগ করেন, হামলায় সাংবাদিকদের বেধড়ক পেটানো হয়েছে, ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে।
আহত সাংবাদিকরা অভিযোগ করেন, রবিবার, ৫ আগষ্ট, ২০১৮, বেলা ২ টায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সংবাদ সংগ্রহের সময় তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। আহত সাংবাদিকরা হলেন, এপি’র এম এ আহাদ, দৈনিক বনিক বার্তার পলাশ শিকদার, নিউজ পোর্টাল বিডি মর্নিং আবু সুফিয়ান জুয়েল, দৈনিক জনকণ্ঠের জাওয়াদ ও দৈনিক প্রথম আলোর সিনিয়র ফটোগ্রাফার সাজিদ হোসেন ও প্রতিবেদক আহম্মেদ দীপ্ত। এছাড়া পাঠশালার শিক্ষার্থী রাহাত করীম, এনামুল হাসান, মারজুক হাসান, হাসান জুবায়ের ও এন কায়ের হাসিন ও এসময় আহত হন। এরা সকলে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। তারা দাবী করেন, হামলাকারীরা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সদস্য এবং তারা মাথায় হেলমেট ও মুখে রুমাল বাঁধা অবস্থায় ছিলো। তারা আরোও অভিযোগ করেন, পুলিশ এ সময় কাছাকাছি থাকলেও কোন বাধা দেয়নি হামলাকারীদের।
গণভবনে রবিবার সকালে ১০ জেলায় ফাইবার অপটিক কানেকটিভিটি উদ্বোধন কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলন থেকে সরে এসে শিক্ষার্থীদের ঘরে ফেরার আহ্বান জানান। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ারও আহ্বান জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তোমরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আমরা দেশকে এগিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছি । আগামী দিনে তোমরা আসবে। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব তোমাদের ওপর পড়বে। শিক্ষা ছাড়া কোনও জাতি এগিয়ে যেতে পারে না।’
প্রধানমন্ত্রী চলমান ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে বলেন, ‘আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। যে কোনো মুহূর্তে কোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে। কোনো অঘটন ঘটে গেলে তার দায় কে নেবে? অভিভাবকদের অনুরোধ আপনারা আপনাদের সন্তানদের ঘরে ফিরিয়ে নিন। তাদের লেখাপড়ায় মনোযোগী করে তুলুন। তাদের রাস্তায় আর থাকার দরকার নেই। ট্রাফিক পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করবে। শিক্ষার্থী লেখাপড়া শিখুক, পড়াশোনা করুক।’
এদিকে রবিবার রাত পৌনে ১১ টার দিকে দৃক গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে বাসা থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে বলে তার পরিবার অভিযোগ করে। পুলিশের বিভিন্ন মহল এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলে, তাকে কে বা কারা তুলে নিয়ে গেছে তা তাদের জানা নেই।
শহিদুলের স্ত্রী রেহনুমা আহমেদ বলেন, “রাত পৌনে ১১টার দিকে তাকে ধানমণ্ডি থানায় নিয়ে যাওয়া হলেও ১২টার দিকে সেখানে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে ব্যক্তিগত সূত্রে জানতে পেরে ডিবি অফিসের সামনে সারারাত অপেক্ষা করলেও আমরা কিছু জানি না অফিসিয়ালি ।”

আলোকচিত্রী শহিদুল আলম
অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদকে ফেসবুকে গুজব ছাড়নোর দায়ে শনিবার রাতে গ্রেফতারের পর চারদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা রবিবার তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করেন।
এদিকে শনিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৮ রাতে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ এর সাধারণ সম্পাদক বাদী হয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত ও ষড়যন্ত্রের চেষ্টার অভিযোগে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ (২) ধারা ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫/৩ ধারায় চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল রবিবার দুপুরে রাজধানীর গুলিস্তানে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। অরাজকতা চলতে থাকবে আর পুলিশ চুপ করে বসে দৃশ্য দেখবে এটা হবে না। আমাদেরও ধৈর্যের সীমা আছে, সীমা অতিক্রম করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আপনারা দেখেছেন এগুলো সব মিথ্যাচার। আপনারা দেখেছেন সেই অভিনেত্রী কীভাবে কাঁদলেন, কীভাবে অভিনয় করলেন। এটাতো আর জনদুর্ভোগ কমানোর জন্য নয়, এটা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা। শুধু তিনি (ওই অভিনেত্রী) নন, আমাদের একজন দায়িত্বশীল নেতার কথোপকথনও আমরা শুনেছি। যারা ঢাকায় আসছে তাদের ব্যাগ থেকে বইয়ের বদলে মিলছে পাথর আর পাথর। আপনারা এও দেখেছেন হাজার হাজার স্কুল ড্রেস তৈরি হলো। হাজার হাজার আইডি কার্ড তৈরি হলো। একটাও স্কুলের ছাত্র নয়, সবাই প্রাপ্তবয়স্ক। এরা রাস্তায় নেমে কোমলমতি ছাত্রদের আন্দোলনকে অন্যখাতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তিনি আরও বলেন, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আন্দোলনের যে ছবি দেয়া হয়েছে তার অনেকগুলোই পাকিস্তানের ছবি। এর মধ্যে ২০১২-১৩ সালের ছবিও আছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর সহপাঠী শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে বিপুল আবেগ ও প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়, তা দেশের প্রতিটি মানুষকে স্পর্শ করে। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির প্রতিও সর্বস্তরের মানুষ একাত্মতা প্রকাশ করে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে মন্ত্রী-নেতারাও ছাত্রদের আন্দোলনকে ন্যায্য ও যৌক্তিক বলে অভিহিত করেন।
এদিকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সড়কে গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা করার উদ্যোগ নিলে জনগণ তাকেও সর্বতোভাবে স্বাগত জানায়। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও তাদের এই কাজে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেন, যা গণমাধ্যমের খবরেও আসে। কিন্তু ছাত্রদের তদারকিতে সড়ক পরিবহনের যে সীমাহীন বিশৃঙ্খলা ও অনিয়ম বেরিয়ে আসে, তা ভয়াবহ বললেও কম বলা হয়। বেসরকারি যানবাহনের পাশাপাশি অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানের যানবাহনেও বৈধ কাগজপত্র না পাওয়া খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
দেশবাসী আশা করেছিল শিক্ষার্থীদের এই কার্যক্রম শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা হয়নি।
বাঙালীয়ানা/এসএল