দেড় যুগ পার হচ্ছে। সেই লাল পতাকা, লাখো মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ সমাবেশের। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-র মহাসমাবেশ। চারদিক থেকে পল্টন ময়দানে আসছে শ্রমজীবীদের মিছিল, আসছে সমাজতন্ত্র কায়েমের শ্লোগান নিয়ে। দশককাল আগে যে সমাজতন্ত্রের পতনের রব তুলে বিলোপবাদীরা নিজেরাই বিলোপের পথে এগিয়ে গিয়েছিল; শত বছরের অগ্রযাত্রায় খানিক থমকে গেলেও ঘুরে দাঁড়িয়ে কমিউনিস্ট পার্টি যে আবারও সামনে বাড়ছে তার প্রদর্শন যেন বাংলাদেশকে নতুন করে জানান দিচ্ছিল।
সেই লাল পতাকার সমাবেশ, নতুন স্বপ্নের আচ্ছাদন। হঠাৎ বিস্ফোরণ, বোমা। ছিন্নভিন্ন মানুষ, রক্ত, হাতের মুঠোয় পতাকা নিয়ে লাল সাগরে শায়িত হিমাংশু, মজিদ, হাশেম, মোক্তার। কদিন পর একই পথের সাথী হলেন বিপ্রদাশও। বাংলাদেশে লাল পতাকার অগ্রযাত্রাকে আরও পোক্ত করতে দিলেন আত্মবলিদান। সমাবেশে এসেছিলেন হাতে লাল পতাকা হাতে, সেই রিলে হস্তান্তর করলেন মিছিলের সাথীদের, ফিরলেনও লাল পতাকা মুড়ে।
সেদিনের চার দশক আগে বাংলাদেশ ফুটছিল নতুন স্বদেশ বিনির্মাণের উত্তেজনায়। নতুন সমাজ, দ্বিজাতিতত্ত্ব আর শোষণ বৈষম্যের পাতা উল্টে বাংলাদেশ পৌঁছাবে সমতার বন্দরে- যে স্বপ্নে হাতের লাঙল ফেলে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল পা ফাটা কৃষক, কলের শ্রমিকের হাতে ছিল এলএমজি; মুক্তির স্বপ্ন স্পন্দিত হয়েছে ছাত্র-যুবক, সাধারণ মানুষের মধ্যেও।
সেই পথে যে বাংলাদেশ হাঁটেনি, তার চিত্র যেন ২০০১ এর ২০ জানুয়ারি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো। শোষণ-বঞ্ছনা আর মৌলবাদ তোষণের স্পষ্ট চিত্রের খতিয়ান ফুটে উঠলো পল্টন ময়দানে। এ হামলার ড্রেস রিহার্সাল হয়েছিল উদীচীর সমাবেশে হামলার মধ্য দিয়ে। সিপিবির মহাসমাবেশে হামলার পর তা যেন রূপ নিল ধারাবাহিতায়। একে একে রমনার বটমূল, আওয়ামী লীগের সমাবেশ, দেশজুড়ে একসঙ্গে বোমা হামলা, আদালত চত্বরে হামলা, জেএমবির উত্থান, লেখক-শিল্পী-মুক্তচিন্তার মানুষদের ওপর একের পর এক চাপাতির কোপ। গত কয়েক বছরে বিশ্বের সঙ্গে তালমিলিয়ে আমাদের নগর বন্দরেও দেখা মিলেছে সন্ত্রাসবাদের, যার ভিত্তি গড়ে উঠেছিল আগের কয়েক দশকে। ভোট আর ক্ষমতার আশ্নাইয়ে সবাই কোলে তুলে নিয়েছিল মৌলবাদকে।

আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি কে ছিল না সেই লাইনে। সবারই লক্ষ্য তাদের সমর্থন, পীরের আশীর্বাদ আর বেহেস্তের মুলা। সব ক্ষমতাসীনের পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলেফেঁপে ওঠে উগ্রবাদ, যার মূল লক্ষ্যই দাঁড়ায় বাংলাদেশ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর বাঙালি জাতীয়তাবাদের অপসারণ; মোদ্দা কথা মুক্তিযুদ্ধকে পরাজিত করে দেওয়া।
লুটপাট আর ক্ষমতাসীনদের অবাধ শোষণ ও অত্যাচারও মৌলবাদকে বাড়তে সাহায্য করেছিল। বাধা ছিল সিপিবি আর কিছু প্রগতিশীল গণসংগঠন ও ব্যক্তি, তাই তাদেরই লক্ষ্য বানিয়েছিল মৌলবাদীরা। ২০ জানুয়ারি ছিল সেই পরিকল্পনারই প্রয়োগ।
ঘটনার পরপরই সিপিবির তখনকার সভাপতি মনজুরুল আহসান খান মামলা করেন। অথচ দুই বছর পর ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন তখনকার তদন্ত কর্মকর্তা সৈয়দ মোমিন হোসেন। সিপিবির নারাজি এবং পরে বিভিন্ন জঙ্গি হামলার সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়ে ২০০৫ সালে ফের মামলার তদন্ত শুরু হয়। সাত কর্মকর্তার হাত ঘুরে ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের কর্মকর্তা মৃণাল কান্তি সাহা ১৩ আসামির বিরুদ্ধে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগ জমা দেন। সেই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণও চলছে কয়েক বছর ধরে।
পল্টন হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় দিতে এই রাষ্ট্রের সময় লেগেছে দুই যুগেরও বেশি সময়। বোমা হামলার ১৯ বছর পর ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি ১০ জন জঙ্গির মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ২ জনকে খালাস করে দেয় আদালত। আসামিরা জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের সদস্য ছিল। মামলার অন্যতম আসামী জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানের ফাঁসি হওয়ায় তাকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
কমিউনিস্ট পার্টির সংগ্রাম আরও ধারাল, আরও জোরদার হয়েছে। বাম গণতান্ত্রিক ঐক্যের লক্ষ্যে পার্টি পাড়ি দিয়েছে দীর্ঘপথ। শ্রেণি সংগ্রামের মধ্যে নিয়োজিত থেকে ক্ষমতাসীনদের লুটপাট আর শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই তীব্রতর করেছে।
টঙ্ক আন্দোলনের মহানায়ক, সিপিবির সাবেক সভাপতি মণি সিংহ একটা কথা প্রায়ই বলতেন। কমিউনিস্ট পার্টিকে যে বা যারা ধ্বংস করতে চেয়েছে, তারাই ধ্বংস হয়ে গেছে। দশকের পর দশক সেই কথা তীরের ফলার মতো বিঁধেছে শত্রুদের; কিন্তু ঠিকই ফিরে ফিরে এসেছে। ২০ জানুয়ারির মতো। এই সেই দিন, যেদিন নতুন করে রক্তশপথে বলিয়ান হয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা।
হিমাংশু, মজিদ, বিপ্রদাস, হাশেম, মোক্তারদের মুঠিতে থাকা রক্তপতাকা একদিন সারা বাংলায় উড়বে, কায়েম হবে শোষণ বৈষম্যহীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ, সাম্যের বিশ্ব।
লেখক:

*প্রকাশিত এ লেখার তথ্য, মতামত, ভাষা ও বানানরীতি লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই প্রকাশিত এ লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক