ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার কবিতা

Comments

নিউ ইয়র্কে ভোর

নিউ ইয়র্কে ভোর
চারটে জলার স্তম্ভে ভর করে
এবং বাসি জলে স্নান সারা পায়রাদের ডানায় ঝড় তুলে
ভোর নেমে আসছে নিউ ইয়র্কে।

নিউ ইয়র্কে ভোর নামছে
ফায়ারপ্লেসের অতিকায় চিমনিতে আর্তনাদ তুলে
ছাদকে স্কন্ধ দেওয়া লোহার কাঠামোর ফাঁকে ফাঁকে
ব্যথাকে ভুলিয়ে রাখা জড়িবুটি মলমের খোঁজে।

ভোর নেমে আসছে অথচ কেউ তা দাঁতেও কাটছে না
কেননা সকাল নেই এ শহরে, প্রত্যাশা বলেও কিছু নেই
কখনও কখনও মুদ্রার ভয়ংকর ঝংকার
ড্রিলের মত সেঁধিয়ে যায় পরিত্যক্ত শিশুদের হাঁ করা মাথায়।

ভোরবেলা যারা বেরিয়েছে কাজের সন্ধানে তারা হাড়ে হাড়ে জানে
প্রেম বা স্বর্গ জন্ম নেবে না এইখানে, অতএব মরতেও পারে নি যারা, তারা
এও জানে, সংখ্যা ও আইনের এঁদোজলে ডুবে যেতে যেতে
দিন কেটে যাবে নির্মম ক্রীড়া আর ফলহীন শ্রমের মায়ায়।

সে আলো লুকিয়েছে শিকল ও শব্দের ছায়ায়
শিকড়বিহীন এক অমোঘকে বেপরোয়া ভর্ৎসনা করে
এবং মানুষ, তীরে ভেড়া জলযান থেকে নিদ্রাহীন অনর্গল, যেন
ডুবন্ত জাহাজের খোল থেকে জীবিত ফিরেছে কোনমতে, বিনা রক্তপাতে।

Dawn কবিতার অনুবাদ: স্বপন ভট্টাচার্য

অন্ধকার মৃত্যুর হরিণ

এই আপেলগুলোর স্বপ্নে আমি ঘুমুতে চাই,
সমাধিক্ষেত্রের কোলাহল থেকে উঠে এসে।
ওই শিশুটির স্বপ্নে আমি ঘুমুতে চাই
যে উত্তাল সমুদ্রে ছিন্ন করতে চেয়েছিল তার হৃদয়।

মৃতদের রক্তক্ষরণ হয়না একথাটি আর শুনতে চাইনা,
ওই যে গলিত মুখগুলো যায় জলের সন্ধানে,
আমি শিখতে চাইনা ঘাসের এই নির্যাতন,
দেখতে চাইনা ভোরের আগে কর্মচঞ্চল চাঁদের সর্পাকৃতি মুখ।

কিছুক্ষণ ঘুমুতে চাই
কিছুক্ষণ, এক মিনিট, এক শতাব্দী;
কিন্তু সবাইকে অবশ্যই তা জানতে হবে আমি মরে যাইনি।
যেহেতু আমার ঠোঁটগুলোতে স্বর্ণখণ্ড
যেহেতু আমি ওয়েস্ট উইংয়ের এক ক্ষুদে বন্ধু
যেহেতু আমি আমার কান্নার তীব্র ছায়া।

ভোরে আমাকে ঢেকে রেখো একটি আচ্ছাদনে
কারণ ভোর আমার দিকে ছুড়ে দেবে মুঠোভর্তি পিপীলিকা,
এবং আমার জুতোগুলো ভিজিয়ে দিও খর জলে
যেন পিছলে যেতে পারে বৃশ্চিকের চিমটিগুলো।

যেহেতু আমি আপেলগুলোর স্বপ্নে ঘুমুতে চাই
শিখতে চাই সেই আর্তনাদ যা আমাকে শুচি করে দেবে মৃত্তিকার সাথে;
যেহেতু আমি থাকতে চাই ওই তমসাচ্ছন্ন শিশুটির সাথে
যে তার হৃদয় ছিন্ন করতে চেয়েছিল উত্তাল সমুদ্রে।

Gacela of the Dark Death কবিতার অনুবাদ: নাজনীন খলিল

নিদ্রাহীন শহর
(ব্রুকলিন ব্রিজে রাত্রি)

আকাশে তাকাও সকলেই, কেউ যেন ঘুমোতে না পারে
ঘুম নয়, ঘুম নয়, কেউ যেন ঘুমোতে না পারে।
চাঁদের বাসিন্দারা ঘ্রাণে বুঝে নেয় কোন কোন বৃত্তে ঘর বাঁধা যাবে।
জ্যান্ত ইগুয়ানার দল মাংস খুবলে খাবে মানুষের
রাতচরা যারা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছে, আর
ভাঙা মন পলাতক মানুষের দল মোড়ে মোড়ে জটলা বসাবে
তারাদের ভর্ৎসনা তুচ্ছ করে এক অনুপম কুমীর, কিঞ্চিৎ জিরিয়ে নিচ্ছে আজ।

ঘুম নয়। এখানে ঘুমোবে না কেউ
ঘুমহীন চোখ এলায়িত এই পৃথিবীতে।
দূরের গোরস্থান থেকে একটা শব
অনুযোগ করে আসছে তিন বছর ধরে
কেননা পতিত নিসর্গে তার হাঁটু ডুবে যাচ্ছে ক্রমাগত; তদুপরি
আজ সকালেই মাটিচাপা পড়বার আগে একটি বালক কাঁদছিল
সেটা চাপা দিতে অবশেষে কুকুর লেলাতে হয়েছিল।

জীবন স্বপ্ন নয় তত। দেখ, দেখতে থাকো, আমাদের অবরোহণ দেখ
দেখ নামতে নামতে আমরা কাদা ও মাটির পথ্যে নৈশাহার সেরে নিচ্ছি
অথবা হয়ত উঠছি, মরা ডালিয়ার অর্কেস্ট্রা শুনতে শুনতে আরোহণ আমাদের
বরফস্তূপের কিনারায়। কিন্তু এখানে কোন অবলুপ্তি নেই, স্বপ্ন নেই;
কাঁচা মাংস শুধু। আছে আশ্লেষ চুম্বন, ঠোঁটের ভিতরে থাকা ঠোঁটে
শিরা আর ধমনীর জট ।
এবং তারাও আছে যারা নিজেরা আহত বলে সতত আঘাত করে থাকে
এবং তারাও, যারা মরে যেতে পারে ভেবে মৃত্যুকে কাঁধে বয়ে জীবন কাটায়।

একদিন শুঁড়িখানাগুলো ঘোড়াশালে পরিণত হবে
আর প্রতিটি গাভীর চোখে গোপনে লুকিয়ে থাকা হলুদ আকাশ
হিংস্র পিঁপড়ের দল খুঁটে খুঁটে বার করে নেবে।
অন্য কোনদিন
আমরা দেখতে পাব স্টাফ করে রাখা প্রজাপতি পুনরায় উড়ে যেতে পারে
তথাপি ধূসর স্পঞ্জ আর স্থাণু জাহাজের পটভূমিকায় চলতেই হবে আমাদের
তখনো দেখব আমাদের অঙ্গুরীয় থেকে ঠিকরে পড়ছে আলো
আর আমাদের জিভ থেকে অনর্গল উদ্‌গীরিত হচ্ছে যাবতীয় সুগন্ধা গোলাপ।

দেখ, যদি দেখতে পাও, দেখে নাও
মেঘভাঙা বাদল আর থাবার আঁচড় দেখে শনাক্ত হবে যে বালক,
সেতু আবিষ্কারের গল্প শোনা নেই তার তাই কেঁদেই চলেছে
অথবা সেই মৃতদেহ খুলি আর একপাটি জুতো ছাড়া যার কিছু পড়ে থাকলো না
তাদের খাড়া কর সরীসৃপ আর ইগুয়ানাদের সামনে প্রতীক্ষাপ্রাচীরের গায়ে,
যেখানে ভালুকের শ্বদন্ত প্রহর গুনছে,
যেখানে শিশুর মমি বাড়িয়ে রেখেছে ততোধিক ছোট মমি হাত
ক্রুর নীল শীত সেইখানে, উটের গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়।

ওই যে আকাশ, সেখানেও ঘুমোয় নি কেউ
দেখো, সেখানেও ঘুমোয় না কেউ যেন আজ।
তবু যদি দেখ ঘুমে কারো চোখ বুজে এলো
বাচ্চারা শোনো, চাবকাতে হবে, চাবকে জাগাতে হবে তাকে।
পটভূমি হোক সারি সারি বিনিদ্র চোখ
আর বিষিয়ে যাওয়া তিক্ত ক্ষতস্থান।
এলায়িত এই পৃথিবীতে কেউ যেন ঘুমোতে না পারে
কেউ নয়। এ তো আমি আগেই বলেছি
কেউ যেন ঘুমোয় না রাতে।
কিন্তু অন্ধকার হলে, যদি কারো কপালে শ্যাওলা জন্ম নিতে পারে
গুপ্ত কুঠুরির দ্বার তার জন্য খোলো, চাঁদও আসুক সেই পথে
বিষে ভরে আছে মেকি পানপাত্র আর মঞ্চের করোটি কপাল।

Brooklyn Bridge Nocturne কবিতার অনুবাদ: স্বপন ভট্টাচার্য

কলহ

মধ্য গিরিখাতে
একটি স্বচ্ছ ধারালো ছুরি
শত্রুর রক্তে রঞ্জিত হয়ে
উজ্জ্বল মাছের মতো সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে,
একটি দূর্গম আলো যেন
তাসের চালের মতো দোল খাচ্ছে
আর উজ্জ্বল সবুজের বুকে মসীবর্ণ ছায়া ফেলছে
গিরিখাতে ডেকে যাচ্ছে যেন
ক্ষীপ্র অশ্বপাল আর অশ্বারোহীর রেখাচিত্র।
একটি জলপাই বৃক্ষের হৃদয় থেকে
ভেসে আসছে দুজন বৃদ্ধার আহাজারি,
ক্ষ্যাপা ষাড়টি গিরিখাতের প্রাচীর মাড়িয়ে উঠতে চাচ্ছে উপরে।
কালো দেবদূত বয়ে বেড়াচ্ছে শিশিরে ভেজা স্নিগ্ধ রূমাল ,
দেবদূত তার মস্তকায় ডানা ঝাপটাচ্ছে
সেই স্বচ্ছ ছুরির মতো।
স্কার্ফ পরিহিত এন্টিনিও
আর কিছু মৃত সুড়ঙ্গ দিয়ে পড়ছে গড়িয়ে নিচে
তার মৃতদেহটি মোড়ানো পদ্মফুলে
এবং কয়েকটি বেদানাফল ঝুলছে তার কপালের ওপরে
এখন সে অগ্নিকে মাড়িয়ে
হেঁটে যাবে মৃত্যুর পথ ধরে।

জলপাই বন পেরিয়ে এদিকেই আসছেন
একজন বিচারক তার সঙ্গে আছেন সাধারণ রক্ষী,
পিচ্ছিল রক্তবিন্দু টগবগ করে
গাইছে শব্দহীন শুনশান সর্প সঙ্গীত।
ভদ্র মহোদয়গণ ও সাধারণ রক্ষীরা
এখানেই থাকেন সব সময়।
এখানে আরো আছে চারজন মৃত রোমান
আর পাঁচজন রাখাল শ্রেণির যুবক,
বিকেল বেলায় গিরিপথ
উন্মাদ হয়ে ওঠে অসম্ভব কাল্পনিকতায়
সে নির্গত করে উত্তপ্ত কলকল বুদবুদ
অচেতন অশ্বারোহীদের উরুতে
আঘাত করে কতল করা হয়,
তারপর পশ্চিম দিকের বাতাসে ভর করে
দেবদূতেরা উড়ে যায়,
বাতাসে উড়ে বেড়ায় দেবদূতেদের দীর্ঘকায় চুলগুচ্ছ
আর চুলে মাখানো জলপাই তেলের হৃদয়।

The Quarrel কবিতার অনুবাদ: স্বপঞ্জয় চৌধুরী

বাকহীন ছোট্ট বালক

ছোট্ট বালকটি খুঁজে বেড়াচ্ছিল তার কণ্ঠস্বর
(যা আছে ঝিঁঝিঁ রাজার কব্জায়)
এক ফোটা জলের শব্দের ভেতর
ছোট্ট বালকটি খুঁজে বেড়াচ্ছিল তার কণ্ঠস্বর।

আমি কথা বলার জন্য চাচ্ছি না এ স্বর
আমি একে করে রাখবো আমার অঙ্গুরি
যা আমার ছোট্ট আঙুলকে আচ্ছাদিত করে
মিলিয়ে যাবে আমার নীরবতায়।

এক ফোটা জলের শব্দের ভেতর
ছোট বালকটি খুঁজে বেড়াচ্ছিল তার কণ্ঠস্বর।

বন্দী সে কণ্ঠস্বর, ভেসে চলেছে দূরে
যেনবা ঝিঁঝিঁর অঙ্গে জড়িয়ে আছে নীরব পরিচ্ছদে ।

The Little Mute Boy কবিতার অনুবাদ: স্বপঞ্জয় চৌধুরী

লেখক:
Federico García Lorca_02
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা (১৮৯৮-১৯৩৬), কবি, নাট্যকার, স্পেন

ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ুন
মৃত্যুঞ্জয়ী লোরকা

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট