তরুণ সাহিত্যিক ও রেল শ্রমিকনেতা সোমেন চন্দকে হত্যা করেছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। কী নির্মমভাবে হত্যা করেছিল তার বর্ণনা – প্রামাণ্য বর্ণনায় পড়ে আসছি। সোমেনের বয়স তখন মাত্র ২১ পেরিয়ে বাইশে পড়েছে। তার নিষ্ঠা, দক্ষতা ও পরিশ্রমী মানসিকতাই তাকে নিয়ে গেছে সর্বহারা মানুষের নেতৃত্বের কাতারে। তাকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রতিরোধ লড়াইয়ের প্রথম শহীদ লেখক বলে ইতিহাস চিহ্নিত করেছে।
এই দিন ৮ মার্চ ১৯৪২ সাল। ঢাকায় যে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সম্মেলন ডাকা হয়েছিল তাতে পশ্চিম বাংলার বামফ্রন্ট সরকারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড জ্যোতি বসু, প্রখ্যাত কমিউনিস্ট শ্রমিকনেতা কমরেড শামসুল হুদা, অধ্যাপক সুরেণ গোস্বামী, সাধন গুপ্ত, কমরেড বঙ্কিম মুখার্জী, স্নেহাংশু আচার্য প্রমুখ উপস্থিত হয়েছিলেন। এছাড়া এসেছিলেন তৎকালীন বাংলার এ অঞ্চলের বহু মার্কসবাদী লেখক, সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী। ফ্যাসিবাদের একদল উন্মাদ সমর্থক কৌশলে এই সমাবেশ প্যান্ডেলে ঢুকে পড়ে। গুণ্ডাবাহিনীর এই দলটি আরএসপি ও ফরোয়ার্ড ব্লকের কর্মী নিয়ে গঠিত ছিল। এদের হাতে ছিল ধারালো অস্ত্র। এরা সুত্রাপুর সেবাশ্রমের বাইরে সম্মেলনে যাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট ছিল। কিন্তু এতে যুথবদ্ধ শত শত কমিউনিস্ট কর্মীর ফ্যাসিবাদ বিরোধী অঙ্গীকারকে অদম্য করে তোলে। যাহোক, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সেবাশ্রম এলাকা পরিপূর্ণ লোকারণ্যে পরিণত হয়। ফলে এই গুণ্ডাবাহিনী ভেতরে গোলযোগ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেও বিফল হয়।
বেলা তিনটার দিকে বিশাল কর্মী জমায়েতে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সম্মেলন শুরু হয়েছে। এই সময়েই কমরেড সোমেন চন্দের নেতৃত্বে লাল পতাকা হাতে রেলশ্রমিকদের একটি বিশাল মিছিল সম্মেলনের পথে লক্ষ্মীবাজার হয়ে হৃষিকেশ দাস রোডের মাথায় এসে পৌঁছায়। তখনই আরএসপি ও ফারোয়ার্ড ব্লকের সশস্ত্র বাহিনী ছোরা, ভোজালি, লোহার রড় নিয়ে অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে। এবং তাদের লক্ষ্য একজনই, সে হলো সোমেন চন্দ। শোভাযাত্রা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে ওরা হায়েনার নৃশংসতায় সোমেন চন্দকে আঘাত করে এবং ছোরার প্রথম আঘাতে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে মাটিতে ফেলে দেয়। তারপর তার চোখ উপড়ে ফেলে, জিভ টেনে বের করে নেয়। তারপর হিংস্র দানবের পৈশাচিক তৃষ্ণা না মেটায় সশস্ত্র গুণ্ডারা তার পেট চিড়ে নাড়িভুড়ি বের করে ফেলে এবং দেহের উপর নাচতে থাকে কিন্তু সাহসী, আদর্শবাদী প্রত্যয়ে দৃঢ় কমরেড হাতের লাল নিশানা ছাড়েননি একবারও। রক্ত নিশানকে সমুন্নত রেখে সোমেন ফ্যাসিবাদ বিরোধী শ্লোগান দিতে দিতে শহীদের মৃত্যুবরণ করেন। তার দুর্লভ রক্ত মিশে যায় বিশ্ববিপ্লবের আঁকা নিবেদিত প্রাণ কমরেডদের শহীদী রক্তের সাথে। ঢাকার সংগ্রামী ও প্রগতিশীল সাহিত্যিকদের অহংকার স্ফীত হয়।
এই গুণ্ডাবাহিনী সোমেন চন্দকে হত্যা করেই চুপ হয়ে যায়নি। এরপর তারা দলবন্ধভাবে বারবার সশস্ত্র হামলা চালাতে থাকে সম্মেলনের উপর। কিন্তু সমবেত যুবক, শ্রমিক কমিউনিস্ট কর্মীরা সোমেন হত্যার কথা শুনে দ্বিগুণ তেজে যেন জ্বলে উঠেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাথে সম্মিলিত হয়ে ঐ সশস্ত্র গুণ্ডাদের তারা মণ্ডপ প্রাঙ্গণ থেকে বিতাড়িত করে দেন।
এরপর যারা বিভিন্ন জেলা থেকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সম্মেলনে যোগদান করতে এসেছিলেন তারা সমবেতভাবে সোমেন হত্যা ও হামলার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করলেন। এমনকি জেলা ও বিভিন্ন এলাকায় ফিরে গিয়েও পৃথক-পৃথকভাবে স্থানীয় জনসমাবেশে তাদের প্রতিবাদকে উচ্চারিত করলেন। এমনকি সারা ভারতবর্ষ সোমেন হত্যার ঘৃণা প্রকাশ করতে থাকে। তরুণ ও উদীয়মান লেখক হিসেবে তার লেখায় জনজীবনের বাস্তবধর্মী চিন্তা চৈতন্যের প্রতিফলন, সচেতন মানুষ মাত্রই সকলের চিত্তহরণ করেছিল। তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আর হিটলারী ফ্যাসিবাদের দোসর রাজনৈতিক শক্তি জাতীয়তাবাদী উগ্র বামদল আরএসপিও ফরোয়ার্ড ব্লকের কীর্তিতে নিন্দা প্রকাশ অব্যাহত থাকে ভারতের প্রায় প্রত্যেকটি শহর-নগরে। সেদিনের কলকাতার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ছাড়াও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আয়োজন করে প্রতিবাদী জমায়েত ও সমাবেশের। তাতে বাংলা সাহিত্যের কৃতী পুরুষদের প্রায় সবাই যোগ দেন এবং নিন্দা ও ঘৃণা প্রকাশ করেন।
দেশমাতৃকার সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে কমরেড সোমেন চন্দ লাল পতাকার এক অগ্রসৈনিক হিসেবে প্রতিপক্ষ পিশাচ বাহিনীর হাতে জীবন দিয়ে এটা প্রমাণ করেছেন, ঐ আরএসপি ও ফরোয়ার্ড ব্লক আর যাহোক সার্বিক গণমুক্তির সংগ্রাম, জনগণকে সমর্থন দেয় না। তারা কুপিত জাতীয়বাদী সংকীর্ণ মানসিকতাকেই ধারণ করে রাজনীতি করতে চায়।
উপমহাদেশের রাজনীতিতে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল তাতে জাতীয়তাবাদী ধারার ব্যাপক উন্মেষ ঘটেছিল বটে। কিন্তু এই স্রোতের বিপরীতে আরেকটি আদর্শ চিন্তার যে পত্তন হয়েছিল, তা ছিল সাম্যবাদী বা সমাজতান্ত্রিক চৈতন্য বিধৃত। ১৯১৭ সালের মহান অক্টোবর বিপ্লব সাধন এবং নিপীড়িত মানুষের প্রথম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমগ্র বিশ্বের সর্বহারা জনগণের কাণ্ডারী হিসেবে আবির্ভূত হলো। বাস্তব রাজনৈতিক অভিধায় চমৎকৃত করলো সারা পৃথিবীকে কিন্তু হতচকিত সাম্রাজ্য লোভী পরাশক্তি ভীত সন্ত্রস্ত হলো, ক্ষমতার কাঠামো পাল্টে গেল। জনগণ বলবান হলো। মেহনতী মানুষের রাজ কায়েম হলো। এর ঢেউ গিয়ে লাগলো দুনিয়ার প্রান্তে প্রান্তে; বৃটিশ বেনিয়া রাজত্বের ক্ষয়িষ্ণুকালকে ত্বরান্বিত করলো নতুন চিন্তাধারা, এই ভারতবর্ষে। ১৮৫৭ সালে প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের পত্তনে উৎসাহিত সাহসী জনগণ সংগঠিত হতে থাকলো নতুন পতাকাতলে। ১৯২১ সালে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা হলো। ২৫ বছর পেরুতেই লোলচর্ম বৃটিশ শাসকেরা ভারতের প্রধান দুই ধর্মাবলম্বী জনগণের দল ভারতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের বিরোধকে কৌশলে উত্তেজিত করে জিইয়ে রাখার চক্রান্ত সফল করে ভারতবর্ষকে দুজনার হাতে তিনখণ্ডে উপহার দিল। তার মধ্যে আমরা বাংলা ভাগ হওয়ার কারণে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল বলে পরিগণিত হলাম। যদিও দেশজ পরিচয়ে পাকিস্তান আরেক অংশ আমাদের থেকে বারশো মাইলের ব্যবধান। যা হোক, যে বিষয় নিয়ে শুরু করে ছিলাম সেখানে ফিরে আসি।
ভারত ভাগ হওয়ার মাত্র পাঁচ বছর আগে রাজনৈতিক বিরোধীদের হাতে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সমাবেশে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে রেলশ্রমিকদের মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া তরুণ সাহিত্যিক ও শ্রমিকনেতা সোমেন চন্দ খুন হলেন নির্মমভাবে। তার ধীশক্তি, সংগঠন গড়ার মুন্সিয়ানা, লেখায় প্রাসঙ্গিক বাস্তবকে উপস্থাপন করাই ছিল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে। তাই লেখায় ঘুণে ধরা সমাজের ব্যবচ্ছেদ আছে, আছে প্রয়োজনীয় নির্দেশ কি করতে হবে তার কথা।
খুনিরা ভোল পাল্টেছে
এই খুনিরা ভােল পাল্টাছে এশীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। কিন্তু যাদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে আজ সচেষ্ট তাদেরকেই তাক করছে নতুন আঘাত হানবার জন্য। কমিউনিস্টরা খানিকটা ভুল করেছিলেন নীতিগতভাবে। তাতো মেনেই নিয়েছেন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির আঙ্গিনায় নিজেদের অবস্থানকে ইতিমধ্যেই শুধরে নিয়েছেন। স্ট্যালিন যে সেদিন ভুল করেনি আজ বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অথচ এই মহান মাকর্সবাদী স্থপতি সংগঠককে কতনা ভাবেই হেনস্তা করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিল রাজনৈতিক বিরোধীদের অনেকেই। নিজ অস্তিত্ব বিলিয়ে দিয়ে সোভিয়েত রাজত্বকে ভেঙে সাময়িক আনন্দ পেয়েছে সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি প্রধান মার্কিনী শোষকগোষ্ঠী। কিন্তু দুনিয়ার মেহনতি মানুষ জান দিয়ে বুঝতে পেরেছে -এ আপন অস্তিত্বকে বিকিয়ে দেয়া ছাড়া আর কিছু নয়। তেমনি ঐ খুনীচক্রও দুনিয়ার মেহনতী মানুষের রাজনীতির বিবর্তনে আজ অনুধাবন করেছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে সোভিয়েত বিরোধীতা কিংবা ফ্যাসিবাদী হিটলার গোয়েবলসের প্রেতাত্মা বহন করে চলা, আর সম্ভব নয়। তাই সেদিন যাদের উপর চালিয়েছিল মরণ আঘাত, তাদেরকেই আজ বন্ধু হিসেবে জাপটে ধরতে দু’হাত বাড়িয়ে মুখ ব্যাদান করে হাসতে কসুর করছে না তারা। কী অদ্ভুত চরিত্র। এরা সুযোগে থাকে ছোবল মারার। বন্ধু বেশে শত্রুতাকে লালন করে। সুতরাং এদের চিনতে হবে, নতুন পরিবেশে। হত্যাকারীর সাথে কি বন্ধুত্ব হয়?
লেখক:

কামাল লোহানী, ভাষা সংগ্রামী, শব্দসৈনিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব