বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তুলতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্য চাই । কামাল লোহানী

Comments

বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এই আজ ইতিহাসের কলঙ্কিত দিনে ন্যাক্কারজনক হত্যাযজ্ঞে সপরিবারে মেরে ফেলেছিল, মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর এই বাংলার সেনাবাহিনীর বিশ্বাসঘাতক, ভাড়াটে সেনা অফিসারেরা। নাটের গুরু ছিলেন আওয়ামী লীগেরই প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধকালীন তাজউদ্দীন মন্ত্রিসভার অন্যতম খন্দকার মোশতাক আহমদ। আন্তর্জাতিক মদদ ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ পরাশক্তির।

পূর্ববঙ্গে প্রথম মুসলিম লীগ শাসনবিরোধী আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সে সময় শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানীর বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সংগঠক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মিনিয়ালস্ স্ট্রাইকে’ নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন, যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে তাঁর নাম প্রথম বা এক নম্বরে লেখায় মোশতাক যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, আমার ধারনা সেদিনই খন্দকার মোশতাক আহমদের চক্রান্তের সূচনা হয়েছিল। যতই বন্ধুত্ব থাকুক না কেন একই সংগঠনের দ্বিতীয় যুগ্ম-সম্পাদক হিসেবে কাজ করা মোশতাক তখন থেকেই যে বিদ্বেষ-হিংসা পোষণ করে আসছিলেন তার মনের মধ্যে, সেই অন্তর্বিরোধের নারকীয় প্রকাশ ঘটিয়ে দেশ ও জাতির যে ক্ষতি জেনেশুনে করেছিলেন এই ১৫ আগস্ট, তা ২২ বছর পুষে রাখা হিংস্র লোভের পাশবিক প্রকাশ। এই মোশতাক এত বছর মানসিক যে বিভেদ পুষে রেখেছিলেন, তারই বাস্তবায়ন ঘটালেন স্থির মস্তিষ্কে কেবল বন্ধু নয় দেশ ও জাতির কর্ণধারের বিরুদ্ধে। এই চক্রান্তের কুশীলবদের মধ্যে মাহবুবুল আলম চাষী আর তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের নাম সমানভাবেই উচ্চারিত হয়। নবগঠিত সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান-এর সংশ্লিষ্টতাও চিহ্নিত হয়েছে তার সম্মতি ও চক্রান্তে সমর্থন জানানোর কারণে। এই মর্মান্তিক নৃশংসতার কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধুর বাবা’র মৃত্যুতে ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়ীতে মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্নাকাটি’র দৃশ্য অনেকেরই দেখা। সেই মোশতাক যখন হত্যাকারী ফারুক-রশিদ, ডালিম-নূর, শাহরিয়ার- মহিউদ্দিনদের নেতারূপে আবির্ভূত হন তখন জাতি কি বুঝতে পারেনি, কী কঠিন ‘কৌটিল্য’ দীর্ঘকাল কত দক্ষতার সাথে কপট বন্ধুত্ব বজায় রেখেছিলেন নির্বিবাদে!

যখন বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ করে চক্রান্তকারী মোশতাককে রেখে দিলেন তাঁর মন্ত্রিসভায় তখন আমরা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়ে কথা প্রসঙ্গে বিষয়টি উত্থাপন হলে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, “লিডার, আপনি মুক্তিযুুদ্ধ যিনি পরিচালনা করলেন ন’মাস এবং বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করলেন, তাঁকেই সরিয়ে দিলেন অথচ সারা মুক্তিযুদ্ধকালে চক্রান্তকারী খন্দকার মোশতাককে রেখে দিলেন? তিনি হেসে বললেন, “বুঝলি না, ওটা একটা শয়তান, তাই কাছে রেখে দিলাম”। তাহলে আজ মনে প্রশ্ন জাগে তবে কি বঙ্গবন্ধু বিশ্বাসযোগ্য তাজউদ্দীনকে জানতেন তিনি ‘রা’ও করবেন না, তাই তাঁকে সরালেও মোশতাককে সত্যিই ‘শত্রু’ ভেবেই কাছে রেখে দিয়েছিলেন? অথচ সেই কাছের মানুষটি ‘হন্তারক’ হয়ে ইতিহাসে চিহ্নিত হলেন।

জেনারেল জিয়াউর রহমান হলেন কুৎসিত এই কলঙ্কের ভিলেন, রয়ে যেতে চাইছিলেন পর্দার অন্তরালে। কিন্তু রাজনীতিমনস্ক অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের চোখে তার সম্পৃৃক্ততাও স্পষ্ট হয়ে উঠল। যখন পর্দা ছিঁড়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে পাগলপ্রায় বেরিয়ে এলেন, দেশবাসী বুঝলেন- কেমন এই জেনারেল জিয়া। লোভ চরিতার্থ না হওয়ায় কত বড় ‘প্রতিনায়ক’ তিনি হতে পারেন তাও সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল।

মাহবুুবুল আলম চাষী সচিব ছিলেন ক্ষুরধার বুদ্ধিদীপ্ত, তিনিও মোশতাক আহমদের সাথে যুক্ত হলেন এই কলঙ্কিত ইতিহাস রচনার একজন দক্ষ পরিকল্পক হিসেবে। প্রভূভক্ত ছিলেন বড়। তবে বিস্ময়কর ঘটনা হলো যে তরুণ রিপোর্টার তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে বঙ্গবন্ধু নিজে দৈনিক ইত্তেফাক থেকে তুলে নিয়ে পাকিস্তান পার্লামেন্টে রিপোর্টিং করার সুযোগ করে দিলেন এবং সেই তাহের ঠাকুর বঙ্গবন্ধুর সহযোগিতার ‘ঋন পরিশোধ’ করেছেন মুশতাকের নিকটতম সহযোগী হিসেবে। ঠাকুর ১৫ আগষ্টের আগের দিন গণভবনে ছিলেন সারাদিন। শুনেছি, তার দায়িত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুকে ছায়ার মতন অনুসরণ করা এবং হন্তারক চক্রকে প্রতিটি মুহুর্তের সংবাদ পৌঁছে দেয়া। তাই করেছিলেন তাহের ঠাকুর।

ইতিহাসের কলঙ্কিত এইসব এজিদ-সীমারেরা নৃশংসতার নিষ্ঠুরতায় এতদিনের যে চক্রান্ত ‘সফল’ করল, তাকে ধরে রাখতে পারল না। ক্ষমতার লোভ ওদের অন্ধ এবং অদক্ষ প্রমাণ করলো, যখন তাদের পতন ঘটলো জেনারেল খালেদ মোশাররফের পাল্টা আঘাতে। কিন্তু তাঁরও পরিকল্পনাহীন সে আঘাত কর্নেল (অব) তাহেরের গণ-সিপাহী অভূত্থানে ব্যর্থ হয়ে গেল। তাহেরকে ফাঁসিতে চড়িয়ে হত্যা করলেন এবার জিয়াউর রহমান, যাকে কর্ণেল তাহের সিপাহীদের হাতে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে ক্ষমতার কাঠিটা তুলে দিয়েছিলেন। কর্ণেল তাহের সফল অভ্যূত্থান ঘটালেন বটে কিন্তু জিয়া মনোবাসনা পূরণ করার জন্য এবং ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে তাঁর সময়কালে ন্যূনপক্ষে ১৭টি ক্যু দমন করেছেন সেনাবাহিনীতে বহু সেনাসদস্যকে হত্যা করে। এমনিভাবে রক্তাক্ত পথ পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তোলা স্তব্ধ হয়ে গেল এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির উত্থান ঘটলো তথাকথিত জাতীয়তাবাদী প্রথমে সামরিক পরে রাজনৈতিক ক্রীড়ানক শক্তির উত্থানে।এমনকি জেনারেল জিয়াতো বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের পুরষ্কৃত করে দেশে দেশে দূত কিংবা দূতাবাস কর্মকর্তা করে আর ইনডেমনিটি বিল পাশ করে হত্যাকারীদের বিচার বন্ধ করে দিলেন। হায় স্বদেশ, দেশনায়ককে হত্যার বিচারও করতে দিলেন না ক্ষমতাদখলকারী জেনারেল জিয়া।

মনে পড়ছে, ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫-এর আচানক কাহিনী। সূর্য তখনও ওঠেনি, প্রত্যুষে টেলিফোনটা বেজে উঠল অতি কর্কশ সুরে। রিসিভারটা ওঠাতেই ওপ্রান্ত থেকে গলা শুনলাম আমারই সহকর্মী খোরশেদ আলমের। ভারাক্রান্ত কন্ঠে কেবল বলল, “রেডিওটা খুলুন, শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে।” বলেই ত্বরিৎ ছেড়ে দিল। ট্রান্সজিসটারটা খুললাম, শুনতে পেলাম মেজর ডালিমের ঘোষণা, “শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে”, যেন কৃতিত্বের কাজ করেছে। রাজনৈতিক আদর্শগতভাবে আমি তাঁর অনুসারী নই, তা সত্বেও যে মানুষটিকে ‘লিডার’ বলে ডেকেছি, যিনি ৬দফা আন্দোলনে গ্রেফতার হয়েছেন, যাঁর দল নিরঙ্কুশ জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় বসতে পারেনি পশ্চিমা কুচক্রীদের চক্রান্ত আর মিথ্যাচারে। যিনি ৭ মার্চ রেসকোর্সে প্রদীপ্ত ঘোষণা দিলেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” সেই নেতাকে হত্যা করেছে হন্তারক বিপথগামী সেনাসদস্যরা। বুঝলাম, মার্কিনী মদদে যারা এতদিন মুক্তিযুদ্ধকে ‘কনফেডারেশন’-এ রূপ দিতে চেয়েছিল সেই কুস্মান্ডদেরই এই অপকীর্তি। ন্যাক্কারজনক ঘটনার কুশীলব তাহলে তারাই, যারা বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসাটা ভাল চোখে দেখেনি।

আমি তাঁর সাথে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ছিলাম, দেখেছি তাঁর সহবন্দীদের প্রতি মমত্ববোধ, বহুদিন থেকে জেলে থাকা কমিউনিস্ট নেতাদের প্রতি কী তাঁর শ্রদ্ধা। শুনেছি তাঁর জাতিত্ববোধের বলিষ্ঠ চিন্তা।…..এই মহানায়ক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ষড়যন্ত্রে ক্ষমতা হাতড়ে নিয়েও লোভ মেটেনি জিয়ার; অথচ তাঁর কীর্তিকে অবমানিত করতে রাজনৈতিক ‘এ্যাং ব্যাং এমনটি খলসেরাও” লম্ফ ঝম্ফ করে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শ্লোগান ধর্ম নিরপেক্ষতা আর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আমরা আজও পূরণতো করতে পারিইনি, তার উপর আবার ‘ভঙ্গ খটাঙ্গের চতুষ্পদের একপদ’এর মতন উগ্রজাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে, জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে না পারায় তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশটাকে যে ধর্মান্ধতার গহ্বরে ঠেলে দিয়েছে, তা বুঝেও বুঝতে চায় না। কারণ মুক্তিযুদ্ধের দেশটাকে অরাজকতা সৃষ্টির মাধ্যমে অস্থিরতার পথে ঠেলে দেয়া অথবা নিয়ে যাওয়াটাই ওদের উদ্দেশ্য ছিল।

ওদের কারণেই যুদ্ধাপরাধীরা মন্ত্রীত্ব পেয়ে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে গাড়িতে অথচ জাতীয় সঙ্গীত গায়নি। ওরা হিংস্রতা ছড়িয়ে জঙ্গীবাদের পয়দা করে দেশবাসীকে জিম্মি করে রেখে ফায়দা লুটতে চায়। আমরা মুক্তিযুদ্ধ যারা করেছি, যারা ছিলেন অবরুদ্ধ বাংলাদেশে, যাঁরা শহীদ হয়েছেন, মাতৃভূমিকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নপথে চলতে, আজ এই জাতীয় শোক দিবসে তাদের একটিই আবেদন এই মহাপুরুষের হত্যাক্ষণে – প্রতিশোধ চাই। আসুন না আমরা সতর্ক-সচেতন হই ঐক্যের গভীরে। শত্রুরা বুঝুক- বাংলার মাটি সত্যিই দূর্জয় ঘাঁটি। বাংলার তাবৎ মানুষ মাথা নোয়াবার নয়।

(আগস্ট, ২০১৮)

ফিচার ফটো: কিরীটী রঞ্জন বিশ্বাস

লেখক:
কামাল লোহানী
কামাল লোহানী, ভাষা সংগ্রামী, শব্দসৈনিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.