বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু: পিটার কাস্টার্স । সাগর লোহানী

Comments

রাজনৈতিক মতাদর্শের বিস্তর ব্যবধান থাকলেও তাঁর সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল নানা কারণে। সব চাইতে বড় কারণ ছিল তাঁর চরিত্রের একটি মহৎ গুণ “পরমতসহিষ্ণুতা”। আমাদের যত কথা হত তার মাঝে বেশীর ভাগ সময়ই কাটতো তর্কে। এ তর্ক আমাদের ঋদ্ধ করতো, দৃঢ় করতো। আমরা স্থিত হতাম আমাদের আদর্শের ছায়ায়।

১৯৪৯ সালে জন্মগ্রহণ করা ডাচ নাগরিক পিটার জোসেফ হুয়ান মারিয়া কাস্টার্স যিনি সকলের কাছে পিটার কাস্টার্স নামেই পরিচিত। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারী মাসে তিনি বাংলাদেশে আসেন প্রথমবারের মত। নেদারল্যান্ডসের দ্য নিউ আমস্টারডাম পত্রিকার বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়ে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে অবস্থান শুরু করেন পিটার ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে। তিনি তাঁর বাংলাদেশ পর্বে সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়েন সশস্ত্র মার্ক্সবাদী রাজনীতির সাথে। কাজ করেছেন নকশালবাদীদের সাথে, জাসদের সাথে, জাসদের বাইরে কর্নেল তাহেরের সাথে।

১৯৭৫ এর ৮ ডিসেম্বর গ্রেফতার হন পিটার। এদেশে প্রথম বিদেশী হিসেবে “সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র” এ লিপ্ত থাকার অভিযোগে বিমান বাহিনীর একজন পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারের নেতৃত্বে একটি মার্শাল ল ট্রাইব্যুনালে পিটারের তথাকথিত বিচার শুরু হয়। পিটারের পক্ষে দেশের প্রখ্যাত প্রগতিশীল আইনজীবী ভাষা সৈনিক এডভোকেট গাজিউল হক মামলা পরিচালনা করেন। শেষ পর্যন্ত প্রহসনের সেই বিচারে পিটার কাস্টারসের ১৪ বছরের সাজা দেয়া হয়। তবে ডাচ সরকারের হস্তক্ষেপে বহিস্কৃত হন বাংলাদেশ থেকে ৭৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। এরপরেও কিন্তু তিনি ৭ নভেম্বরের তথাকথিত বিপ্লবের পদ্ধতিগত ধারাকে মেনে নেননি।

একটি পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল মনে করলেও তিনি ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডকে মেনে নেননি। ২০০৭ সালের ২১ জুলাই কর্নেল তাহেরের ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে লন্ডনে কর্নেল আবু তাহের পরিষদের অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় তিনি স্বীকার করেন যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে সংবাদ সংগ্রহ করতে শাহবাগে ঢাকা বেতারে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাহেরের উপর বক্তৃতায় তিনি সে প্রসঙ্গে বলেন, “On the morning of August the 15th, I happened to be a silent witness to a confrontation, which took place at the Dhaka radio, between Colonel Taher and Mustaque Ahmed, leader of the proAmerican wing of the Awami League. As Taher realized immediately, sections of Mujibur Rahman’s own party were either directly involved in the coup, or were ready to act in league with the Young Turks.”

মেনে নেননি বাংলাদেশের সামরিক শাসনকেও। ১৯৭৯ সালে জিয়ার বেলজিয়াম সফরকালে প্ল্যাকার্ড হাতে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা যায় পিটারকে। সামরিক শাসক জিয়ার মুখোশ উন্মোচনে কবিতা লিখেছেন এবং তা ইউরোপিয়ান রাজনীতিকদের মাঝে বিতরণ করেছেন পিটার। আর তাই কখনই জিয়া, এরশাদ বা খালেদা এদেশে তাকে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি।

Peter Custers02

পিটার কাস্টার্স

এমন কি ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে সেনা সদস্যদের সাথে ছাত্রদের সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে শিক্ষক-ছাত্রদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন, সাজার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন পিটার কাস্টার্স। মূলত তার সক্রিয় তৎপরতার কারণেই ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বন্দী ছাত্র-শিক্ষকদের অবিলম্বে মুক্তির জন্য শক্ত প্রস্তাব পাশ হয়।

১৯৭০ সালে নেদারল্যান্ডসের লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন পিটার। যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হয়ে তিন বছর পড়াশোনা করেন। কিন্তু পিএইচডি শেষ না করেই তিনি বাংলাদেশে এসে জাসদের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পরে নেদারল্যান্ডসের নিজমেগানে ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজতত্ত্ব নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি শেষ করেন তিনি।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা ও গণহত্যা চালালে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত পিটার কাস্টার্স এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। যুদ্ধবিরোধী নেত্রী এনা টেইলরের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সভা ও সমাবেশ করেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে তার কার্যক্রমের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালে তাকে বাংলাদেশের বন্ধু সম্মাননা প্রদান করে।

তাঁর সাথে আমার প্রথম যোগাযোগ হয় ঢাকায় সম্ভবত ৯২ এর গণআদালতের পরে যখন জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে এদেশের মানুষ জেগে উঠেছিল। তিনি যে এই আন্দোলনের শুধুমাত্র একজন প্রত্যক্ষ সমর্থক ছিলেন তাইই নয় একজন কর্মীও ছিলেন তিনি। তিনিই প্রথম সে সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং পার্লামেন্টারিয়ানদের সাথে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিলেন বেশ জোরালো ভাবেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে এই সমর্থন শেষ দিন পর্যন্ত তিনি দিয়ে গেছেন। তাই শাহবাগের গণজাগরণে তিনি ছুটে এসেছিলেন।

২০০১ সালে বিএনপির ক্ষমতারোহনের পরে সারা দেশে যখন অমুসলিম নির্যাতনের এক মহোৎসব চলছিল তখন আমরা এর বিরুদ্ধে এবং নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াবার কিছু প্রয়াস গ্রহণ করেছিলাম। লালমাটিয়ায় আমার অফিসকে ঘিরে সেই কর্মকান্ডের সময়ও আমরা পাশে পেয়েছিলাম পিটারকে। তখনও তিনি অমুসলিম নির্যাতনের এই ভয়াবহ চিত্র ইউরোপে তুলে ধরে তদানিন্তন সরকারের উপর চাপ তৈরি করেছিলেন।

পিটারের এদেশ আর এর মানুষের জন্যে ভাবনার সাম্প্রতিক বিষয় ছিল জঙ্গীবাদ। তিনি সঠিকভাবেই জঙ্গীবাদের উত্থানকে চিহ্নিত করেছিলেন। বাংলার অসাম্প্রদায়িক চেতনার যে কৃষ্টি এবং ঐতিহ্য তা থেকে বিচ্যুতিই এদেশে জঙ্গীবাদের উত্থানের কারণ। এদেশের সুফি সাধকদের প্রচারিত পরধর্মসহিষ্ণু ইসলামের ধারা ক্ষয়িষ্ণু কেননা বিশ্বব্যাপী ওহাবীইজমের উত্থান যা এদেশে প্রাথমিক ভাবে মওদুদীবাদীরা আনয়ন করেছিল এবং নানাভাবে কওমি, খেলাফতি, ইত্যাদি নানা নামে ডালপালা বিস্তার করে চলেছে। পিটার এই জঙ্গীবাদের বিস্তার রোধে বিদ্রোহী কবি এবং লালনের জীবনাদর্শ এবং সাহিত্যকর্মের প্রসারের পক্ষে কাজ করেছেন, সুফিবাদের পরধর্মসহিষ্ণু ইসলামের ধারাকে সাধারণ মানুষের মাঝে ফিরিয়ে আনবার এবং বাংলার অসাম্প্রদায়িক চেতনার যে কৃষ্টি এবং ঐতিহ্য তাকে উর্ধ্বে তুলে ধরবার তাগিদ দিয়েছেন।

পিটার মনে করতেন বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হবে বাংলাদেশের আর তার কারণ হচ্ছে উন্নত বিশ্ব যারা কার্বণ নিঃসরণের গতিকে কমানোর চাইতে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দানেই বেশী আগ্রহী। আর এটাকে তিনি জুতো মেরে গরু দানের সমতুল্য বলেই ভেবেছেন। তাই বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে প্রকোপ থেকে বাংলাদেশ রক্ষার প্রয়োজনে তিনি ইউরোপে বেশ সোচ্চার ছিলেন জীবনের শেষ কয়েক বছর ধরেই।

ইউরোপে বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত পিটার কাস্টার্স আর নেই। ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নেদারল্যান্ডসের লেইডেনে নিজ বাসভবনে ৬৬ বছর বয়সে তিনি মারা যান।

তাঁর রাজনৈতিক মত ও পথের বিষয়ে অনেক সমালোচনার সুযোগ থাকলেও একটি বিষয়ে কিন্তু কোন দ্বিমত করবার কিছু নেই আর তা হলো এদেশের প্রতি এদেশের মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা। পিটার কাস্টার্স বাংলাদেশের একজন সত্যিকারের বন্ধু।

লেখক:
সাগর লোহানী, সম্পাদক, বাঙালীয়ানা

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.