বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি: একটি আত্মসমীক্ষা । রণেশ দাশগুপ্ত

Comments

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বে-আইনি ঘোষিত হয় ১৯৫৪ সনে। তবে ’৪৮ থেকে ৫৩ পর্যন্ত পার্টির পক্ষে পার্টির নামে খোলাখুলি কোন কাজ করার উপায় ছিল না। করাচি লাহোর রাওয়ালপিণ্ডির কায়েমি স্বার্থবাদী চক্র বাংলাদেশকে উপনিবেশে পরিণত করার প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে প্রধানত নিম্নোক্ত তিন দফা দমননীতি প্রয়োগ করে:

১) শ্রমিক শ্রেণীর সমস্ত সংগ্রামী সংগঠনকে নষ্ট করে দেওয়া,
২) কোন বিরোধী রাজনৈতিক দলকে মাথা তুলতে না দেওয়া,
৩) কমিউনিস্ট পার্টিকে ভেঙে তছনছ করে দেওয়া,

তদানীন্তন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের স্বৈরশাসনের চামুণ্ডাদের বেশি ঝোঁক ছিল তিন নম্বরের দফার ওপরেই। বস্তুতপক্ষে বিভিন্ন উপলক্ষে যুক্তি খাড়া করে তারা এই ঝোঁকটার ব্যাখ্যা দেবারও চেষ্টা করেছিল। তাদের বক্তব্য ছিল এই যে, কমিউনিস্ট পার্টিকে বাড়তে দিলে শ্রমিক শ্রেণী এবং বিরোধী দলের শক্তি বাড়বে এবং কমিউনিস্ট পার্টিকে দমন করতে পারলে শ্রমিক শ্রেণী এবং বিরোধী দল দমন হবে। সুতরাং কমিউনিস্ট পার্টিকে বে-আইনি করার জন্যে তাঁরা অপেক্ষা করে নি। মুসলিম লীগ সরকারি দলের গুণ্ডাবাহিনী যেখানে যেখানে পেরেছিল কমিউনিস্ট পার্টির দপ্তর ভেঙে দিয়েছিল যেমন ঢাকা এবং চট্টগ্রামে। সঙ্গে সঙ্গে সরকারি-নিরাপত্তা বিভাগীয় আমলারা কমিউনিস্ট পেলেই তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়েছিল। এই দ্বিমুখী হামলা দ্বারা কমিউনিস্ট পার্টিকে খতম করা হবে, এ ধারণাটা শাসকচক্র পোষণ করতো। কোন কোন কমিউনিস্ট কর্মীকে গ্রেপ্তার করে নিরাপত্তা বিভাগীয় লোকেরা বলেছিল, জেলখানায় বসে যত খুশি ডিসি সিসি করুন। জেলের বাইরে কমিউনিস্ট পার্টি করতে দেওয়া হবে না। পার্টির তরফ থেকে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি নাম দিয়ে রাজনৈতিক সাহিত্যের যে দোকান খোলা হয়েছিল তাও তালাবন্ধ করে দিয়ে গিয়েছিল নিরাপত্তা বিভাগীয় লোকেরা। চট্টগ্রামের গ্রন্থাগারিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ঢাকার বইয়ের দোকানটির সমস্ত বই থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ১৯৪৯ সালের মধ্যে অধিকাংশ জেলা কমিটি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। এই বছরেরই শেষের দিকে প্রাদেশিক কমিটির আশ্রয়স্থলটিকেও নিরাপত্তা বিভাগীয় লোকেরা আবিষ্কার করে ফেলে এবং এখানে অনেকে ধরা পড়েন। আত্মগোপনে ছিলেন এমন অনেক নেতৃস্থানীয় কমিউনিস্ট ১৯৫০-৫১ সালের মধ্যে ধরা পড়ে যান। শ্রমিক ভিত্তিগুলো ১৯৪৯ সালেই ভেঙে গিয়েছিল। ১৯৫০-৫১ সালের মধ্যে কৃষক ভিত্তিগুলোও ভেঙে যায়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব করছিলেন, সেই ছাত্র নেতারা ঝাঁকে ঝাঁকে গ্রেপ্তার হওয়ার ফলে পার্টির দিক থেকে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, যদিও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ব্যাপক গণভিত্তি তৈরির জন্যে প্রয়োজনীয় প্রভাব তৈরির আবহাওয়া যথেষ্ট উপযোগী হয়ে ওঠে। খোলাখুলি কোন কাজে কমিউনিস্ট পার্টির কোন সদস্যকে নিয়োজিত করার অর্থ ছিল তাকে সত্যাগ্রহীর মতো জেলবরণ করতে বলা।

এ অবস্থায় ৪৮ সাল থেকে ৫৩ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি খোলাখুলিভাবে দপ্তর নিয়ে বাংলাদেশের কোথাও কাজ করার কথা ভাবতে পারেনি। এখানে ৫৩ সালের উল্লেখের একটা অর্থ রয়েছে সেটা বলা দরকার। বস্তুত ’৫৩ সালের মাঝামাঝি থেকে ৫৪ সালের এপ্রিল মাসে সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি পর্যন্ত সময়টা ছিল ব্যতিক্রম।

’৫৪ সালে বাংলাদেশে যে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তার প্রস্তুতি পর্বে ’৫৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে অন্যান্য সরকারবিরোধী দলের সঙ্গে সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টিও কিছুটা খোলাখুলি কাজ করার পথ পায় এবং সেটা কাজে লাগায়। কমিউনিস্ট পার্টির চারজন প্রার্থী তদানীন্তন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন আত্মগোপনে, আরেকজন জেলখানায়।

কিন্তু এ সুযোগটা ছিল ক্ষণস্থায়ী। নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরোধী যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ জয়লাভে বিচলিত রাওয়ালপিণ্ডি চক্র বাংলাদেশে গভর্নরের সামরিক শাসন জারি করে সদ্য গঠিত বিরোধী দলীয় মন্ত্রীসভাকে অপসারিত করে এবং কমিউনিস্ট পার্টিকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে।

’৪৮ সালে সাইনবোর্ড সমেত পার্টি দপ্তর উঠে যাবার পরে পাঁচ বছর বাদে ’৫৩ সালে আসন্ন নির্বাচনকে উপলক্ষ্য করে ঢাকা শহরে কয়েকজন তরুণ কমিউনিস্টকে দিয়ে যে ছোটখাট একটা সদর দপ্তর খোলা হয়েছিল, সেটা উঠে যায় ১৯৫৪ সালে গভর্নর হিসেবে জেনারেল ইস্কান্দর মীর্জার সহুঙ্কার নিষেধাজ্ঞার পরে।

এরপরেও আরেকটা সুযোগ এসেছিল খোলাখুলি পার্টি করার। তবে এটা আরো বেশি ক্ষণস্থায়ী, যাকে সত্য সত্যই একটা বুদ্ধদেবের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।

১৯৫৫ সালে যুক্তফ্রন্টের একাংশের সঙ্গে আপস করে রাওয়ালপিণ্ডির ঔপনিবেশিক চক্র গভর্নরের সামরিক শাসন তুলে নেয়। যুক্তফ্রন্টের এই অংশ বাংলাদেশে প্রাদেশিক সরকার গঠন করেন এবং জনপ্রিয়তা অর্জনের উদ্দেশ্যে সমস্ত রাজবন্দিকে ছেড়ে দেন। গভর্নরের শাসন জারি হবার পরে যে হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী এবং তাদের নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাদের মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ সাত বছর ধরে আটক কমিউনিস্ট বন্দিরাও জেলখানার বাইরে বেরিয়ে আসেন। কমিউনিস্ট পার্টির ওপর জেনারেল ইস্কান্দর মীর্জার নিষেধাজ্ঞাটাও কার্যত দেরাজে ঢোকে। কমিউনিস্ট পার্টির যেসব নেতা আত্মগোপনে ছিলেন তাঁরা বেরিয়ে আসেন। আবার ঢাকায় প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট পার্টির সদর দপ্তর খোলা হয় প্রবীণ নেতাদের উপস্থিতিতে। কিন্তু এ সুযোগটা মাটিতে পা দিতে না দিতে ১৯৫৫ সালের নভেম্বরে পুলিশ ধর্মঘট হয়। ৪৮ সালে যে পুলিশ ধর্মঘটকে রাওয়ালপিণ্ডির বাহিনী দমন করেছিল মেশিন গানের জোরে, তারই পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা এই ধর্মঘট। ঘটনাটা ঘটেছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ পাওয়া গিয়েছে এই ধারণার ভিত্তিতে। কিন্তু ধর্মঘটের পেছনে কমিউনিস্ট পার্টি রয়েছে, এইটেই ধরে নিয়েছিল রাওয়ালপিণ্ডির কর্তারা। হুকুম হলো কমিউনিস্ট ধরার। হুকুম তামিল করার সিদ্ধান্ত নিলেন প্রাদেশিক সরকার। যেসব কমিউনিস্ট রাজবন্দিকে দু’মাস আগে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের গ্রেপ্তারের জন্য ওয়ারেন্ট জারি হলো। অনেকে গ্রেপ্তার হলেন, অনেকে হলেন না। কারণ পুলিশ ধর্মঘট বজায় থাকার দরুন ওয়ারেন্ট অনুযায়ী- কাজ হতে দুয়েকদিন দেরি হয়ে গিয়েছিল। ঢাকার কমিউনিস্ট পার্টির সদর দপ্তরে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা আত্মগোপন করতে সক্ষম হলেন অধিকাংশই। এছাড়াও আরো কয়েকজনকে আত্মগোপন করতে হলো। বাংলাদেশের তথাকথিত মফঃস্বল অঞ্চলে অনেকে আবার ধরা পড়লেন।

শেষ হলো খোলা পার্টি করার দ্বিতীয় সুযোগ কাজে লাগাবার চেষ্টা। এরপরে ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রে জনাব সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন প্রাদেশিক সরকার গঠিত হলো। আবার সমস্ত কমিউনিস্ট রাজবন্দি মুক্ত হলেন। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি আর খোলাখুলি পার্টির নামে দপ্তর নিয়ে কাজ করলো না। ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত শেষ ১৫ বছর এভাবেই গিয়েছে। উপরোক্ত অবস্থায় বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন অবস্থায় এবং বিশেষ করে প্রথম আট নয় বছরে জনগণের কাছে হাজির হবার এবং থাকার প্রশ্নে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিম্নোক্ত বিভিন্ন প্রকল্প ও বিকল্প ব্যবস্থার কথা চিন্তা করতে হয়েছিল:

১) রাওয়ালপিণ্ডির সামন্তবাদী পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী আমলা সামরিক ঔপনিবেশিক চক্রের কব্জা থেকে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে জনগণকে এবং বিশেষভাবে মেহনতি সমাজকে সংগঠিত করার ব্যাপারে কমিউনিস্ট পার্টি খোলাখুলি কাজ করার যে সামান্য সুযোগ পেয়েছে, তাকে কাজে লাগাতে গিয়ে কোন লাভ হয়েছে কি? না, ক্ষতিই হয়েছে শুধু শুধু?

২) যদি খোলাখুলি কাজ করার সামান্য সুযোগগুলোকে ব্যবহার করার মধ্যে দিয়ে জনগণের কাছে প্রত্যক্ষভাবে হাজির হবার পদ্ধতিটা নিরর্থক হয়ে থাকে, তবে কমিউনিস্টরা জনগণের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রম নিয়ে কিভাবে এগিয়ে যাবে?

৩) কমিউনিস্ট পার্টি কি অন্য সম-নিকট লক্ষ্য সম্পন্ন পার্টির মারফত জনগণের মধ্যে পার্টির কার্যক্রমকে নিয়ে এগোবে, অথবা বেনামিতে নিজস্ব সংস্থা গড়ে তুলবে?

৪) অন্যের সংস্থার মারফত কাজ করতে গেলে তাদের সঙ্গে সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়াবে? দুটো বিপত্তি। প্রথমত, এই ধরনের সংস্থার নেতৃত্ব কমিউনিস্টদের কাছ থেকে কার্যকরীভাবে সহায়তা পেলেও ভাবগতভাবে নিজেদের বিপন্ন মনে করে কমিউনিস্ট বিতাড়নের দিকে এমনভাবে ঝুঁকে পড়তে পারেন যাতে মুক্তিসংগ্রামের সাধারণ লক্ষ্য বিভ্রান্তি আসবে এই ধরনের সংস্থায়। দ্বিতীয়ত, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরাই অপরের সংস্থার গৃহীত নীতির মধ্যে আবদ্ধ থাকতে থাকতে কমিউনিস্ট পার্টির গৃহীত মূলনীতি ও কার্যক্রম থেকে সরে যেতে পারেন।

৫) বেনামিতে নিজস্ব সংস্থা গড়ে তুলে তাকে স্বনামে ফিরিয়ে নেবার জন্যে আগে থেকেই কি ধরনের ব্যবস্থা করে রাখতে হবে? এই সব ব্যবস্থা কি আগে থেকে বেনামি সংস্থার মধ্যে রাখা সম্ভব অথবা বিধেয়?

৬) এত সব জটিলতার মধ্যে না গিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির কি উচিত নয় গোপনভাবেই জনগণের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের ব্যাপক ব্যবস্থা করে গোপন কমিউনিস্ট পার্টিকেই গণপার্টিতে পরিণত করা?

৭) আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে সংযোগ রক্ষার পদ্ধতি কিরূপ হবে? গোপন অথবা প্রকাশ্য?

উপরোক্ত বিভিন্ন প্রকল্প ও বিকল্পের পরীক্ষা-নিরীক্ষা কমিউনিস্ট পার্টিকে ’৪৮ থেকে ’৭১ পর্যন্তই করে আসতে হয়েছে। কারণ প্রত্যক্ষভাবে কমিউনিস্ট পার্টির কাজ করার স্বল্পস্থায়ী সুযোগ ব্যবহারের সময়েও এসব কথা সম্বন্ধে ভাবতে হয়েছিল।

বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে এই সব পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি বাস্তবে কি করতে পেরেছে, সেটা বিশেষভাবে আত্মসমীক্ষার মধ্যে দিয়েই বেরিয়ে আসতে পারে।

বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি কোন রকম পর্দা না রেখে মতামত আদানপ্রদান করতে বাধ্য। কমিউনিস্ট পার্টি কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে জনগণের জীবনে ও চিন্তায় কতখানি প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে নিজ উদ্যোগে ও চেষ্টায়, তার কষ্টিপাথর হচ্ছে বাংলাদেশের ক্রমসচেতন অবিশ্রান্ত বৈপ্লবিক মুক্তি সংগ্রামী স্বাধীনতাকামী জনগণের নিরীক্ষা। কমিউনিস্ট পার্টির কাছে শ্রমিকশ্রেণী তথা শ্রমিক কৃষক তথা জনগণের বাইরে কোন বিকল্প সর্বোচ্চ নিরীক্ষাকার নেই। এই পারস্পরিক নিরীক্ষাই কমিউনিস্ট পার্টি সম্বন্ধে আন্তর্জাতিক জনগণের নিরীক্ষার ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। তবে ’৭১ সাল পর্যন্ত অনেক কথা বলা সম্ভবও ছিল না, সঙ্গতও ছিল না। ’৭১ সালে সে সময় এসেছে। কমিউনিস্ট পার্টি বলবে, জনগণও বলবেন।

পড়ুন
সাম্যের ঋষি রণেশ দাশগুপ্ত

প্রতিরোধের ভিত্তি

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সেই শক্তির উৎস কোথায় যার দ্বারা পার্টির পক্ষে সম্ভব হয়েছে রাওয়ালপিণ্ডির ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী চক্রের সমস্ত হামলাকে ব্যর্থ করে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে পার্টির শিকড়কে শক্ত করে রেখে দেওয়া? পার্টি তার আত্মরক্ষার উপাদান পেল কি করে এবং কোথায়? এখানে এ কথাটা বলে রাখা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, শুধু রাওয়ালপিণ্ডির চামুণ্ডাদের আক্রমণের ফলেই যে কমিউনিস্ট পার্টির মশাল জ্বালাবার নির্দিষ্ট লোকের অভাব মাঝে মাঝে দেখা দিয়েছিল তা নয়, অভ্যন্তরীণ মতদ্বৈততার দরুনও বিশেষ করে ১৯৪৯-৫০ সালে সে অভাব দেখা দিয়েছিল। তবু কমিউনিস্ট পার্টির মশাল কোনদিন নেভেনি। এর কারণ জনগণের মধ্যে অনির্দিষ্টভাবেও যে সব মশাল জ্বালার লোক রয়ে গিয়েছে, তারা সামনে কাউকে দেখতে না পেলে নিজেরাই এগিয়ে এসেছে।

এর অর্থ এই যে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির গণভিত্তির কোনদিন অভাব হয় নি, যদিও সেই গণভিত্তিকে পার্টি কতখানি প্রসারিত করতে পেরেছে সে সম্বন্ধে প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি কিংবা তার সহযাত্রীরা কি এই গণভিত্তি সম্বন্ধে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল?

স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের জন্যে সংগ্রামীদের মধ্যেও যারা পার্টির বিরোধিতা করেছে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূত্রে অথবা ভাবগত বৈরিতা অথবা ভিন্নতার দরুন, তারা কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে একটা সস্তা অস্ত্র প্রয়োগ করছে অনেক সময়। সেটা এই যে, কমিউনিস্ট পার্টি হয় মস্কো নয়তো পিকিংয়ের পার্টি; বাংলাদেশকে এ পার্টি জানে না, বোঝে না, চেনে না, কারণ বাংলাদেশের ভিতর থেকে উঠে আসেনি পার্টি, চেপে বসেছে বাইরে থেকে এসে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টিকে ঘায়েল করার জন্যে তাদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মুক্তি সংগ্রাম থেকে তাদের বিছিন্ন করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে রাওয়ালপিণ্ডি চক্র এবং তাদের সাম্রাজ্যবাদী মুরুব্বিরা তো এই অনুপ্রবেশের অভিযোগ এনেছেই, যারা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের কার্যক্রমে হাত মিলিয়েছে, তারাও মতভিন্নতা ঘটলে একই অভিযোগ এনে কমিউনিস্ট পার্টিকে অপদস্থ করতে চেয়েছে। কমিউনিজমকে ঠেকানোর কথাটা এরাও এমনভাবে বলেছে যে, আলগা মনে কমিউনিজম এবং কমিউনিস্ট পার্টি বাইরে থেকে এসেছে এ সংশয়ের সৃষ্টি হওয়াটা আশ্চর্যের কিছু নয়।

শত্রুকে সত্যের সন্ধান দেবার জন্যে কষ্ট করে লাভ নেই। কিন্তু সহযাত্রীদের বুঝিয়ে দেয়া যেতে পারে যে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির গণভিত্তি একটা ঐতিহাসিক সত্য এবং এই সত্যের ইতিহাস একটা সজীব গতিমান ইতিহাস। কমিউনিস্ট পার্টির নিজের কাছে যেমন এ সত্যকে পরিষ্কার করে রাখা দরকার, তেমনি যে বিপ্লবী জনগণকে নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে এগিয়ে চলতে হয়েছে এবং হবে, তাকেও এ সত্য সম্বন্ধে দৃঢ়ভাবে প্রত্যয়শীল করে তুলতে হবে।

ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদীদের হামলার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি যে প্রতিরোধ খাড়া করেছে তার মূল বাংলাদেশেরই সেই ব্যাপকতম নিপীড়িত মানুষের স্তরে, যারা বাংলাদেশের মাটির মতোই একান্তভাবে বাংলাদেশের। এই ভিত্তি একটাই প্রবহমান প্রাণধারা। তবে একে দুইভাবে ভাগ করে দেখানো যেতে পারে। একটা ১৯৪৭ সালের আগে, আরেকটা ১৯৪৭ সালের পরে। অর্থাৎ দুটো অধ্যায়।

১৯৪৭ সালের আগে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বৈদেশিক শৃঙ্খল মোচনের উদ্দেশ্যে পর্যায়ের পর পর্যায়ে সংগ্রাম করার সময় স্বাধীনতা সংগ্রাম যাদের স্বার্থে এবং যাদের জোরে ফলপ্রসূ হতে পারে বলে নির্দিষ্ট করতে পেরেছিল, সেই মেহনতি জনগণকে নিয়েই নিজে বেড়েছিল এবং সকলে মিলে বেড়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামে মন্থিত বাংলাদেশের জনগণের বিভিন্ন নিপীড়িত শ্রেণী এবং স্তরের মধ্যে থেকে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সদস্যরা বেরিয়ে এসেছিলেন এবং তাঁদের প্রাথমিক বা কোদালির কাজের মাধ্যমে জনগণের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে থেকে কমিউনিস্ট পার্টির বিস্তারণের পথ খুলেছিলেন।

যে অঞ্চল নিয়ে বাংলাদেশ বা পূর্ব বাংলা গঠিত, সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠেছিল শুধু বাংলাদেশের নাম নিয়ে নয়। তখন সর্বভারতীয় অথবা পশ্চিম বা পূর্ব বাংলার সম্মিলিত বঙ্গীয় পার্টির অংশ হিসেবেই বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু তিনটি কারণে যে কোন মুহূর্তে বাংলাদেশ বা পূর্ববাংলার একান্ত নিজস্ব পার্টি হিসেবে কাজ করার সিদ্ধান্ত করতে পারার অবস্থা নিয়ে সে গড়ে উঠতে পেরেছিল। এর একটা কারণ এই যে, কমিউনিস্ট পার্টির কাজ করার কথা জনগণের গভীরে। এতে আঞ্চলিক কাজের বৈপ্লবিক সম্ভাবনা নিহিত। দ্বিতীয় কারণ এই যে, কমিউনিস্ট পার্টিকে ইংরেজ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় পার্টি গড়ে উঠেছিল সেল বা স্বনির্ভর স্থানীয় খুদে সংগঠনের ভিত্তিতে। তৃতীয় কারণ এই যে, বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণী স্বাদেশিকতা এবং আন্তর্জাতিকতাকে এমনভাবে মেলাতে পারে যে পৃথক হলেও আন্তর্জাতিকতাকে বৈপ্লবিক সম্পর্কের কোন হানি হতে পারে না। উপরোক্ত পরিপ্রেক্ষিতে সামনে রেখেই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে যে পার্টি ১৯৪৭সালের পরে নিখিল বঙ্গীয় পার্টি থেকে আলাদা সংগঠনের কাঠামো নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে, তার আদিতে যেতে হলে যেতে হবে ১৯৪৭ সালের অনেক আগে কোদালির কাজের সময়ে।

কমিউনিস্ট পার্টি যে প্রথমেই কাজ শুরু করেছিল জনগণের সবচেয়ে নিপীড়িত শ্রেণী তথা শ্রমিক শ্রেণী ও গরিব ও ভূমিহীন চাষীদের মধ্যে, তার পেছনে ছিল সচেতন মার্কসীয় লেনিনীয় তাগিদ। এই সচেতনতার দুটো দিক ছিল। ১) কমিউনিস্ট হওয়ার অপরিহার্য শর্ত ছিল জনগণের কোন একটি অংশের মধ্যে অবশ্যই সংযোগ থাকতে হবে। ২) প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে সমগ্র উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গণঅভ্যুত্থানগুলো স্তিমিত হয়ে যাবার পরে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একাংশের মধ্যে এ কথাটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, স্বাধীনতার একটা সারবস্তু থাকতে হবে যে সর্বহারা জনগণকে প্রতিনিয়ত স্বাধীনতা সংগ্রামে নিয়োজিত রাখবে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শ্রমিক শ্রেণীকে তার নিজ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই সেই সচেতনতা অর্জন করতে হবে যার দ্বারা সে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব করতে সক্ষম হতে পারে।

এর পরেই অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে নিবেদিত প্রাণ মধ্যবিত্তশ্রেণীর ছেলেমেয়েদের জন্যে জায়গা করতে হয়। ১৯৩০’র পর থেকেই সন্ত্রাসবাদী বিপ্লববাদের চূড়ান্ত ত্যাগতিতিক্ষা ও উৎসর্গ সত্বেও জনগণকে সংগঠিতভাবে এর সঙ্গে নিয়ে চলার ব্যাপারে সীমাবদ্ধতার দরুন হাজার হাজার ছেলেমেয়ে মার্কসীয় লেনিনীয় পথে কমিউনিস্ট গণবিপ্লবের পথে স্বাধীনতা সংগ্রামের কার্যক্রমের দিকে ঝুঁকে পড়ে। গণবিপ্লবের পতাকাবাহী কমিউনিস্ট পার্টিকে নিজেকে আভিধানিক অর্থে নিছক সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণীর গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রাখার সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। জেলখানার ভিতরে অথবা বাইরে হাজার হাজার সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী।

শ্রমিক কৃষকদের মধ্যে কাজ করার জন্যে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ প্রার্থী হতে থাকেন। এদিক দিয়েও কমিউনিস্ট পার্টির কাজ বাংলাদেশে পার্টির গণভিত্তিকে স্বাদেশিকতার ধারার মধ্যে দিয়েই প্রসারিত করে এগিয়ে আসে।

যে তৃতীয় স্রোত প্রায় একই সময়ে এসে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির গণভিত্তিকে প্রসারিত করে, সেটি হচ্ছে কৃষি প্রধান বাংলাদেশের অপরিমেয় অধিকাংশ শোষিত ও নিপীড়িত মানুষ তথা চাষী এবং অন্যান্য গ্রামীণ মেহনতি মানুষের মুক্তি আন্দোলন। বিশের দশকে ওয়ার্কার্স এন্ড প্রেজেন্টস পার্টি কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, পাবনা প্রভৃতি জেলায় কৃষকদের নাড়া দিয়েছিল। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে পরবর্তীকালে সাধারণ কৃষকদের এবং গ্রামীণ নিপীড়িত স্তরের মানুষের কমিউনিস্ট সদস্য হিসেবে যোগদান পার্টিকে সেই গণভিত্তির শক্তি জোগায় যার জোরে ১৯৪৭-র পরে পার্টি রাওয়ালপিণ্ডির মুসলিম লীগশাহীর হামলা প্রতিহত করে আত্মরক্ষা করতে পেরেছে।

প্রতিরোধের ভিত্তি (ক)

১৯২৯ সালের মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি ঢাকার কমরেড গোপাল বসাক তাঁর মেয়ের নাম রেখেছিলেন প্রলেতারিয়েতা। এ নাম খেয়ালের বশে আসেনি। কমিউনিস্ট পার্টি হচ্ছে প্রলেটারিয়েট বা সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণীর পার্টি। কমিউনিস্ট বিপ্লব শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে গণবিপ্লব। উপমহাদেশের মুক্তি আসবে এ ধরনের গণবিপ্লবের মারফত। মধ্যবিত্ত এবং জাতীয় বুর্জোয়ারা সহযোগী হিসেবে সঙ্গে থাকবে। বিশ এবং তিরিশের দশকের কমিউনিস্টদের এটাই ছিল চিন্তা ভাবনার মূলসূত্র। সুতরাং কমিউনিস্ট নেতার মেয়ের নাম হয়েছিল প্রলেতারিয়েতা।

সে সময়ে অবশ্য বাংলাদেশে কলকারখানা অতি সামান্যই ছিল। কয়েকটা ডক যেখানে স্টিমার সারাই হতো। কয়েকটা পাটের গাঁট তৈরির বড় বড় ডিপো। কিছু চা বাগিচা। কয়েকটা সূতাকল বা কাপড়ের কল। আর রেল আর স্টিমারের পরিবহন। কয়েকটা শহর বন্দর এলাকায় ছোট ছোট বিজলি কেন্দ্র। ছাপাখানা, স্টিল ট্রাঙ্ক তৈরির ছোট ছোট কারখানা, মিউনিসিপ্যালিটি, হাসপাতাল, জলের কল আর বিড়ির ফ্যাক্টরি। দিন মজুরদের ডেরা। ঘোড়ার গাড়ির আরগারা। এরাই ছিল বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণীর আঁতুড় ঘর। বিশের দশকের শেষের দিকে এবং তিরিশের দশকের প্রথম দিকে এইসব খুঁদে শিল্পের সর্বহারা শ্রমিকদের মধ্যেই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির লাল পতাকা উড়তে শুরু করে। তখনও সে রকম কোন বিশেষ শিল্প এলাকা বা শ্রমিক এলাকা গড়ে উঠেনি, যেখানে পার্টির ব্যাপক প্রভাব নজরে আসতে পারতো। তবে তিরিশের দশকের সূচনাতেই কমিউনিস্ট পার্টি কথা বলতে শুরু করেছে। সে সময়ে চাঁদপুরের একটি ছেলের কাছে শুনেছিলাম, কমিউনিস্ট নেতা কমরেড বঙ্কিম মুখার্জি চাঁদপুরে একটি রাজনৈতিক সভায় বলেছিলেন, চাঁদপুরই হচ্ছে বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের মুখ। এ কথাটা থেকে এ রকমের একটা সিদ্ধান্তে হয়তো আসা যায় যে, কমিউনিস্ট পার্টি সে সময়েই বাংলাদেশে পার্টির মূল গণভিত্তি সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণীর মধ্য থেকে একটা শক্তি হিসেবে উঠে আসবার সম্ভাবনা পেয়েছিল নিজের মধ্যে। যেটুকু সম্ভাবনা পাওয়া গিয়েছিল, কমিউনিস্ট পার্টির তদানীন্তন মুষ্টিমেয় সদস্যেরা তাকে চূড়ান্তভাবেই বাস্তবায়িত করার জন্যে চেষ্টা করেছিলেন। এটা ঠিক যে, এই কমরেডদের টেবিলে কিংবা বগলে মোটা মোটা মার্কসীয় তত্ত্বের বই থাকতো এবং এইসব কমরেডের মুখে তত্ত্বের খই ফুটতো। কিন্তু একথাও সত্য যে, তাঁদের পায়ে যে টায়ারের স্যান্ডেল ছিল সেগুলো শ্রমিক বস্তিতে বস্তিতে হাঁটতে হাঁটতে খাওয়া খাওয়া দেখাতো। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি হওয়ার ওপর চলাফেরা করে নি তার আদিকাণ্ডেও।

তিরিশের দশকের শুরুতে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের যে অন্তরঙ্গতা ছিল অবহেলিত আর উপেক্ষিত ঝুলকালিমাখা খেটে খাওয়া বস্তিবাসী মানুষগুলোর সঙ্গে, সে ব্যাপারটাও সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের কম আকৃষ্ট করে নি। এই সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা অধিকাংশই জেলখানায় কমিউনিস্ট সংহতি সংস্থায় যোগ দিয়েছিলেন এবং ১৯৩৮ সালে যখন জেলখানা খালি করে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা অধিকাংশ কমিউনিস্ট হয় বেরিয়ে আসেন, তখন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি গম গম করতে থাকে। দেশপ্রেমের অপর নাম হয়ে কমিউনিজম। পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশই ছিল অগ্নিযুগের বাংলার সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের মর্মকেন্দ্র। কমিউনিস্ট পার্টি এই মর্মকেন্দ্র থেকে পেয়েছিল প্রচণ্ড শক্তি। এ তথ্য কিছুটা জানা। যেটা জানা নয় সেটা এই যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় যেসব সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী শেষ পর্যন্ত জেলার বাইরে থেকে গিয়েছিলেন তারা ছোট ছোট গ্রুপ গঠন করে নিজেদের কমিউনিস্ট বলে আখ্যা দিতে শুরু করেন। এঁরা তত্ত্বের বই পেতেন সামান্যই। এঁরা শ্রমিক এবং কৃষকদের মধ্যে মিশতে চেষ্টা করতেন বেশি। তবে তখনও হয়তো এঁরা খুব তাড়াতাড়ি খণ্ড খণ্ড বিদ্রোহের কথা ভাবতেন কিংবা নিজেদের গ্রুপের বাইরে কিংবা নিজেদের প্রিয় সাথীদের বাইরে পা বাড়াবার কথা ভাবতে পারতেন না। কমিউনিস্ট পার্টির কোন কোন কমরেড এঁদের সে সময়ে নাম দিয়েছিলেন, ‘সন্ত্রাসী কমিউনিস্ট।’ কিন্তু কমিউনিজমে দীক্ষিত এইসব স্থানীয় সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের গ্রুপ নীরবে নিভৃতে আশেপাশের শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে তাদের সুখ দুঃখ ও দৈনন্দিন সংগ্রামে আপন হবার চেষ্টায় ছড়িয়ে পড়ায় যে গণভিত্তিগুলো টুকরো টুকরোভাবে তৈরি হতে থাকে, সেগুলি পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টির তত্ত্বাবধানে জোড়া লেগে কমিউনিস্ট পার্টির ইতিপূর্বেকার গণভিত্তিকে বাংলাদেশের এমন সব জায়গায় ছড়িয়ে দেয় যেখানে মার্কসবাদের বই থেকে হয়তো বাঁধা ধরা কোন সূত্র নিয়ে কাজে নামা হয়নি এর আগে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের ট্রাইবাল এলাকাগুলোর কথা বলা যেতে পারে। এদের সামাজিক ব্যবস্থা আদিম ব্যবস্থাতেই রয়ে গিয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী সামন্তবাদী ও পুঁজিবাদী শোষণব্যবস্থা এদের মধ্যে শ্রেণীভেদ সৃষ্টি না করে এদের সবাইকে সমগ্রভাবে শোষণ করার ব্যবস্থা করে আসছিল।

যেসব সন্ত্রাসবাদী থানায় থানায় অন্তরীণ ছিলেন তাঁরাও সে সময়ে কোদালির কাজ করেছিলেন। বিপ্লবী গ্রুপগুলো থেকে কমিউনিস্ট পার্টিণ্ডএটা ছিল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার একটা বিশেষ প্রক্রিয়া।

চট্টগ্রামের যেসব সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী কমিউনিজমের দিকে প্রথম দিকেই ঝোঁকেন, তাঁরা নিজেদের গ্রুপের নাম ‘সুর্য কমিউনিস্ট পার্টি’ দিয়েছিলেন বলে একটা কথা তখন শোনা গিয়েছিল।

এবার কৃষকদের কথায় আসা যেতে পারে

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি যাঁদের মারফত শোষিত ও নিপীড়িত কৃষকদের পার্টি হয়ে উঠে, তাঁদের একজন কুমিল্লার কমরেড ইয়াকুব মিয়া ওরফে বড়মিয়া। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এদিক দিয়েও এসেছে একেবারে দেশের মাটি থেকে। যে পার্টির অন্যতম পুরোধা কুমিল্লার কমরেড ইয়াকুব মিয়া সে পার্টি উঠে এসেছে গণভিত্তি থেকে।

তিরিশের দশকের শেষের দিকে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা জেল থেকে কমিউনিস্ট কার্যক্রম নিয়ে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে যে কৃষক সংগঠন গড়ে তোলেন এবং সংগ্রামের অগ্নিপরীক্ষায় কৃষক সমাজ যেভাবে উত্তীর্ণ হতে থাকেন, তাতে কমিউনিস্ট পার্টির সেই ছড়িয়ে পড়া গণভিত্তি অঞ্চলে অঞ্চলে পাকাপোক্ত হয়ে উঠে, যেগুলো ভবিষ্যতে কাজে এসেছে অত্যন্ত সঙ্গীন সময়ে।

বাংলাদেশের পার্টি চল্লিশের দশকে শ্রমিক-কৃষক এবং মধ্যবিত্তদের মধ্যে গণভিত্তিকে বিভিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রসারিত করে নিতে পেরেছিল বলেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দিনগুলোতে গণবিদ্রোহে পুরোভাগে এসে দাঁড়াতে পেরেছিল। চল্লিশের দশকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি কৃষকদের মধ্যে লালঝাণ্ডাকে ব্যাপকভাবে প্রিয় করতে পেরেছিল বলেই বেশিরভাগের পূর্বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে পেরেছিল নোয়াখালি কুমিল্লা জেলার সীমান্ত ঐতিহাসিক ‘হাসনাবাদ’ গ্রামে।

পড়ুন
সাম্যের ঋষি রণেশ দাশগুপ্ত

প্রতিরোধের ভিত্তি (খ)

’৪৭ সালের পরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে রাওয়ালপিন্ডির ঔপনিবেশিক চক্রের অবিশ্রান্ত হামলার বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চালিয়ে আসতে হয়েছে, তার শক্তি সে কি পুরোপুরি আদায় করতে পেরেছে ’৪৭ সালের আগে বিশ বছরে গড়ে তোলা গণভিত্তি থেকে? এই প্রশ্নেরই আরেকটা দিক আছে। কমিউনিস্ট পার্টি কি ’৪৭ সালের আগে গড়ে তোলা গণভিত্তির শক্তি খরচ করেই কাজ করে এসেছে? এর পরেই আসে দ্বিতীয় মৌলিক প্রশ্ন। কমিউনিস্ট পার্টি কি তার গণভিত্তিকে ৪৭ সালের পরে প্রসারিত করতে পেরেছে? যদি পেরে থাকে, তবে জনগণের কোন কোন স্তরে সাধিত হয়েছে এই প্রসার? ’৪৭ সালের পরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির গণভিত্তি সম্পর্কিত অবস্থাকে নিম্নলিখিত কয়েকটি সূত্রে বুঝবার চেষ্টা করা যেতে পারে :

(১) করাচী-লাহোরে রাওয়ালপিণ্ডির ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী চক্র বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে নির্মূল করার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারী না করেও কমিউনিস্টদের ওপর যে নির্যাতন ও নিপীড়ন চালায়, তারই আরেকটি দিক ছিল পার্টির গণভিত্তিগুলোকে নষ্ট করে দেওয়া। কমিউনিস্ট পার্টির গণভিত্তি ১৯৪৭ সালের আগে গঠিত হয়েছিল বৈপ্লবিক শ্রেণী সংগ্রাম ও শ্রেণী সংগঠন ভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক ধারায়। রাওয়ালপিণ্ডি চক্রের মুসলিম লীগ শাহী সাম্প্রদায়িক অস্ত্র প্রয়োগ করে এই গণভিত্তিকে নষ্ট করে দিতে চেষ্টা করে। প্রথমত, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্র তৈরি হওয়ায় রাষ্ট্রের তরফ থেকে ভাবগতভাবে সাম্প্রদায়িক আবহাওয়া সৃষ্টির পক্ষে সুবিধা হয় এই চক্রের। দ্বিতীয়ত, সমগ্র উপমহাদেশে ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত বিভাগকালীন যে হানাহানি ও চরম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা চলতে থাকে, তাকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে শ্রমিক ও কৃষক এলাকাগুলোতে দাঙ্গা বাঁধিয়ে এলাকা-কে এলাকা উজাড় করে দেয় মুসলিম লীগ শাহীর লোকেরা। এখানে উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, খুলনায় কমরেড বিষ্ণু চাটার্জীকে খতম করার উদ্দেশ্য নিয়ে মুসলিম লীগ শাহী খুলনার সংগ্রামী কমিউনিস্ট কৃষক এলাকাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধিয়ে তছনছ করে দেয়।

(২) দেশ বিভাগ কালে ‘অপশন’ ব্যবস্থায় ব্যাপকভাবে শ্রমিক ও কর্মচারীরা বাংলাদেশ ছাড়েন। এতে বিশেষভাবে রেলে কমিউনিস্ট পার্টিকে অর্ন্তবর্তীকালীন রদবদল সামলাতে বিশেষ বেগ পেতে হয়।

‘অপশন’ নিয়ে যে শ্রমিক ও কর্মচারীরা বাংলাদেশে আসেন, তাঁরাও কলিকাতা এবং অন্যত্র সাধারণভাবে লালঝাণ্ডার সঙ্গে ছিলেন।

‘কমিউনিস্ট পার্টি বিশেষ করে এঁদের মধ্যেকার জঙ্গী কর্মীদের পেয়েছিলেন দেশ বিভাগের সঙ্গে সঙ্গে অন্তবর্তীকালীন রদবদলের ধাক্কা সামলাবার কাজে। কিন্তু বিশেষ করে শ্রমিক ভিত্তিতে একটা সাময়িক ওলটপালট কমিউনিস্ট পার্টিকে মুসলিম লীগ শাহীর আক্রমণের মুখে বিপন্ন করেছিল।

(৩) বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও তার গণভিত্তি যেমন রাওয়ালপিণ্ডি চক্রের আক্রমণের মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়, তেমনি দেশ বিভাগের সঙ্গে সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি তদানীন্তন পাকিস্তানকে জনগণের গণতান্ত্রিক পাকিস্তানে এবং সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবমুক্ত সার্বভৌম ও স্বাধীন পাকিস্তানে পরিণত করার জন্যে সংগ্রাম শুরু করে। এই সংগ্রামের এক পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই সংঘর্ষগুলোর মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি সাধারণভাবে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংগ্রামকে একটা সময়ে প্রায় একক দায়িত্বে সচল রাখলেও ক্ষয়ক্ষতির গুলির সমস্ত ধাক্কাই এসে পড়ে পার্টির কর্মীদের ওপর এবং বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টির গণ এলাকাগুলির ওপর। রাজশাহীর নাচোল, ময়মনসিংহের হাজং এলাকা, যশোরের নড়াইল এবং সিলেটের সুনামগঞ্জ, দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও প্রভৃতি এলাকার গণভিত্তি কোথাও সাময়িকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যায়, কোথাও বিপর্যয় শেষ পর্যন্ত স্থায়ী বিপর্যয়ে পরিণত হয় সেগুলোকে সামলাবার জন্য কমিউনিটি পার্টি কিছু করে উঠতে পারেনি। নতুন এলাকার ওপরেই জোর পড়েছে। ভাঙ্গা এলাকা নিয়ে মাথা ঘামানো সম্ভব পর হয়নি।

কমিউনিস্ট পার্টির অধিকাংশ স্থানীয় কর্মী গ্রেফতার হয়ে যাওয়ায় এবং দীর্ঘ একটানা সাতবছর জেলে আটক থাকায় অনেকগুলি ছোটছোট কমিউনিস্ট প্রভাবাধীন এলাকায় অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলের দিকে ঝুঁকে পড়ে। রাজনৈতিক শূন্যতা বলে কোন কিছু থাকতে পারে কি? আত্মগোপনে অবস্থানকারী নেতৃত্ব সংগঠনের শূন্যতা মোচনে সচেষ্ট ছিলেন এবং সংগঠনকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু সাধারণভাবে যে গণভিত্তিগুলি বেঁচে বর্তে গিয়েছিল সেগুলির রাজনৈতিক শূন্যতা দূর করার জন্য সর্বত্র কাজ করতে পারেননি। হয়তো সেন্টার এবং জেল সেলগুলিকে বাঁচিয়ে রাখাই সেই সময়ে তাঁরা সচেষ্ট মনে করেছিলেন। এই জন্যে ’৪৭ সালের পরের দু তিন বছরে ’৪৭ সালের আগেকার জমানো শক্তি খরচ করতে গিয়ে গণভিত্তিগুলি বিশেষভাবে রাজনৈতিক দিক দিয়ে সক্রিয় থাকলেও, স্থানীয় কর্মীর অভাবে পরবর্তীকালে বেশ কিছু স্থানীয় গণভিত্তি কমিউনিস্ট পার্টির আওতা থেকে খসে খসে ঝরে গিয়েছে।

এ রকমের অভিজ্ঞতা রয়েছে যে, ঢাকা শহরে এক জন রিক্সাওয়ালা মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে কমিউনিস্ট কায়দায় অভিবাদন জানাচ্ছে। দেখা দিয়েছে সে একটি ভিন্ন গণতান্ত্রিক দলের সদস্য। অতীতের ডাকটি ভুলে যায়নিণ্ড ‘কমরেড’ বলে হেসে চলে গিয়েছে।

উপরের সূত্রগুলি থেকে একটা সিদ্ধান্ত নিশ্চয় বেরিয়ে আসে যে, বাংলা দেশের কমিউনিস্ট পার্টি ’৪৭ সনের আগে গড়ে ওঠা গণশক্তি খরচ করে আত্মরক্ষা করেছে।’ কিন্তু এই খরচ কি আরেক দিক দিয়ে জমা হয়নি? পার্টি কি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে পুরোভাগে স্থান নিতে গিয়ে নব-অধ্যায়ের শ্রমিক ও কৃষক ভিত্তিক তৈরি করে নিতে পারেনি জনগণের অবিশ্রান্ত তরঙ্গ রাশির মধ্য থেকে যে সব গণভিত্তি আগে ছিল এবং যে সব গণভিত্তি আংশিকভাবে ধ্বসে যেতে কিংবা বসে যেতে কিছুটা সময় লেগেছে, তাদের সজীব অংশগুলিকে সাময়িকভাবে “নিউক্লিয়াস” বা সমাবেশকেন্দ্র করে কমিউনিস্ট পার্টি কি পারেনি এমন সব গণভিত্তি গড়ে তুলতে যেগুলিকে ভিত্তি করে পার্টি শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামকে তার নিকট লক্ষ্যেই পৌঁছে দেবে না, দূর লক্ষ্যেও সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা হবে? এর উত্তরের প্রথম দিকটা নিঃসন্দেহে অস্তিবাচক। কিন্তু এর দ্বিতীয় দিকটাতে এমন কয়েকটা বিষয় মিমাংসার দাবিদার রয়ে গিয়েছে যেগুলির হিল্লে করতে না পারলে, ঐতিহাসিক দিক দিয়েই কমিউনিস্ট পার্টির জন্মে যে সব শ্রমিক কৃষিক ভিত্তি তৈরি হয়েছে, সেগুলি কমিউনিস্ট পার্টিকে বৈপ্লবিক শ্রেণীগত শক্তি কিভাবে এবং কতখানি জোগাতে পেরেছে কিংবা জোগাতে পারবে সে সম্বন্ধে সংশয় থাকবে। অস্তিবাচক উত্তরে যাবার আগে দ্বিতীয় দিকের জটিলতা কিছুটা সরিয়ে নেয়া যেতে পারে। এই দ্বিতীয় দিকটিকে বুঝবার জন্যে একটি বিষয় সম্বন্ধে একটা দৃষ্টান্তও দাখিল করা যেতে পারে। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত বিশেষভাবে তথ্য সমৃদ্ধ একটি আন্তর্জাতিক দলিলে দেখা গেল, সেখানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রধানত মধ্যবিত্ত ভিত্তিক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রশ্ন এই যে, যেখানে তথ্য দাখিল করে বলা হয়েছে যে, শ্রমিক এবং কৃষকদের মুক্তিসংগ্রামে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে সেখানে পার্টি কেন মধ্যবিত্ত ভিত্তিক বলে নির্ণীত হলো?

এর কারণ হিসেবে যেটা প্রথমেই মনে আসতে পারে সেটা এই যে, পার্টির নেতৃত্ব ১৯৬০ সালে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের নিয়েই গঠিত বলে দলিল প্রণেতা স্বচক্ষে দেখেছেন অথবা খবর পেয়েছেন। এ খবর সত্য খবর। যদিও যে সব বুদ্ধিজীবী নিয়ে পার্টির নেতৃত্ব গঠিত, শ্রমিক কৃষকদের সংগ্রাম করতে গিয়ে তাঁদের গায়ে শ্রমিক কৃষকের গন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। তবু এসেছেন তাঁরা মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে। হয়তো দলিল প্রণেতা কোন শ্রমিক কিংবা কৃষক থেকে উঠে আসা নেতৃস্থানীয় কমিউনিস্টকেই দেখেননি।

দ্বিতীয় কারণ সম্ভবত এই যে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী সমন্বিত হলেও পার্টির সাধারণ সদস্যদের মধ্যে শ্রমিক কৃষক এবং মধ্যবিত্ত থেকে আসা কমরেডরা সকলেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রয়েছেন এ তথ্য আন্তর্জাতিক দলিল প্রণেতার কাছে পৌঁছোয়নি। তারা খবরই পাননি। সুতরাং এদিক দিয়ে বিষয়টা সঠিক হতে পারেনি। এ প্রসঙ্গেই নিম্নোক্ত তথ্য পেলে তাঁরা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে দেখতে পারতেন নিশ্চয়।

১৯৫০ সালে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে মুসলিম লীগশাহীর আমলে পাইকারী গুলিতে যে সাতজন কমিউনিস্ট রাজবন্দী মারা যান: তাঁরা হলেন কম্পরাম সিং (কৃষক), মোহাম্মদ হানিফ (শ্রমিক), দিলওয়ার হোসেন (শ্রমিক), আনোয়ার হোসেন (মধ্যবিত্ত ছাত্র), সুধীর ধর (মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী) বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৪৭ সালের পূর্বেকার যে গণভিত্তিক শক্তি খরচ করে শাসকশক্তির মোকাবেলা করেছে, এই কমরেডরা তারই প্রতীক। পরবর্তীকালেও কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সদস্যদের মধ্যে এ ধরনের শ্রমিক-কৃষক মধ্যবিত্তের সমাবেশ ঘটে এসেছে। অর্থাৎ এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশে ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৪৭ সালের পূর্বেকার মতোই কিংবা আরও বেশি গুণে পরিমাপে কৃষক-শ্রমিক মধ্যবিত্ত গণভিত্তিকে গড়ে তুলতে পেরেছে, যা এসেছে মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একেবারে দেশের ভিতর থেকে, তলা থেকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংগ্রামের অন্তর্লীন তাগিদে। পার্টির মধ্যে সাধারণ সদস্যদের মধ্যে শ্রমিক-কৃষক মধ্যবিত্ত গণভিত্তি প্রতিফলিত হয়েছে, যদিও এর মধ্যে একটা ‘তবে’ রয়েছে।

এই ‘তবে’টা হলো এই যে, ১৯৪৭ সালের পরে যে প্রায়শ: নিষিদ্ধ অবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টি কাজ করেছে এবং বিভিন্ন প্রকল্প ও বিকল্প উপায়ে জনগণের সঙ্গে পার্টি সংগ্রামী সংযোগ স্থাপনের যে জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তাতে কমিউনিস্ট পার্টি তার সংগঠনের মধ্যে আসার জন্যে আগ্রহী যত পরিমাণ শ্রমিক-কৃষক এবং মধ্যবিত্তকে পেয়েছিল, তত পরিমাণকে ভিতরে টেনে নিতে পারেনি। এই সূত্রটিকে ধরেই, কমিউনিস্ট পার্টিকেও যে কেন বারবার অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলের মতোই বিরাট বিরাট বৈপ্লবিক গণঅভ্যুত্থানের পরে পড়ে গিয়ে আবার শুরু থেকে উঠতে হয়েছে, তার কারণ পাওয়া যেতে পারে।

ভাবগত নেতৃত্বের প্রশ্নে

১৯৪৮-১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেকটি খণ্ড সংগ্রাম অথবা গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি কর্মসূচি দিয়েছে, সমর্থন দিয়েছে জনতার কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে বিপ্লবী অভ্যুদয়ে শরিক হয়েছে। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির সহযোগী ছাত্ররা প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, কমিউনিস্ট পার্টির মূল সদস্যরা বাংলাদেশ ব্যাপী অভ্যুত্থানে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নিয়েছিলেন অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলের সহযোগিতায়। হাজার হাজার সাধারণ মানুষ যখন এই অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে নিজেদের শক্তিকে আবিষ্কার করছিলেন, তখন কিন্তু তাঁরা কে কমিউনিস্ট আর কে কমিউনিস্ট নয় তা জানতে পারেননি। জেলখানায় এসে তাঁরা দেখলেন কমিউনিস্ট। ‘আপনারই কমিউনিস্ট’? এ প্রশ্ন তারা করেছিলেন জেলখানায় কমিউনিস্ট বন্দীদের আকস্মিকভাবে আবিষ্কার করার পরে। একই ব্যাপারে ঘটেছিল ১৯৫৫ সালে এবং ১৯৬২ সালে দলে দলে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে জেলে আসার পরে।

এতে প্রমাণিত হয়েছে যে, কমিউনিস্ট পার্টি সংগঠনগতভাবে কমিউনিস্ট হিসেবে গোপনে অথবা প্রকাশ্যে এমন কিছু সংখ্যক সদস্যকে জনগণের মধ্যে চুম্বক ক্ষেত্র হিসেবে রাখতে পারেনি যাঁরা নিজেদের কমিউনিস্ট নামে পরিচয় দিয়ে সংগ্রামী জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পারতেন। একটা কৈফিয়ত এসেছে পার্টির তরফ থেকে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে: “আমাদের ক্ষমতা সীমিত, সুতরাং আমরা পারিনি সংযোগ রাখতে।” প্রত্যক্ষ সংগ্রামী কর্মসূচির বাস্তবায়নের বিরাট দায়িত্বের কথা বিবেচনা করলে এই কৈফিয়ত গ্রহণ করতেই হবে। কিন্তু ভাবগত বা তত্ত্বগত কর্মসূচি সম্পর্কে কি এই কৈফিয়ত একই ভাবে আমরা নিজেরা নিজেদের তরফ থেকে দিতে পারি অথবা মেনে নিতে পারি।

আমর অবশ্য এ প্রশ্নের জবাবের জন্যে সবদিকই দেখার জন্যে থাকবো। পার্টির সদস্যদের কিংবা স্থানীয় গোপন কেন্দ্রগুলির সংস্পর্শে এসেছেন এমন যে শত শত কৃষক শ্রমিক মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মানুষ, তাঁরা মুক্তি আন্দোলনের কর্মসূচি বাস্তবায়নে কমিউনিস্ট পাটির সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে থাকলেও ভাবগত বা তত্ত্বাগতভাবে এক হওয়ার মতো আবহাওয়াই পেলেন না।

এই তত্ত্বগত ঘনিষ্ঠ সংযোগ সাধনে শাসকচক্রের তরফ থেকে যে বাধা এসেছে তাকে অবশ্য ছোট করে দেখার কোন প্রশ্নই ওঠে না।

বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশে কমিউনিস্ট চিন্তাধারার প্রচারকে ঠেকাতে গিয়ে রাওয়ালপিণ্ডির ঔপনিবেশিক কর্তারা চূড়ান্ত অবরোধের পথ নিয়েছিল। ১৯৬১ পর্যন্ত অবস্থা ছিল এই যে, সোভিয়েট ইউনিয়ন অথবা গণচীনের কোন প্রচার দপ্তরের মারফত পর্য্যন্ত কমিউনিস্ট তথা মার্কসীয় চিন্তাধারার সংস্পর্শে আসার উপায় ছিল না বাংলাদেশের জনগণের, কারণ এরকম কোন প্রচার দপ্তর বাংলাদেশে খুলতে দেয়নি রাওয়ালপিণ্ডি চক্র। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত বাইরে থেকে মার্কসীয় তত্ত্বের কাক পক্ষী ঢুকতে পারত না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ছিল নিষিদ্ধ দেশ। আর ভিতর থেকে বাংলাদেশের কোন প্রকাশকের পক্ষে মার্কসীয় চিন্তাধারার বই প্রকাশ করা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহ। ১৯৫৭-৫৮ সালে পার্লামেন্টারী আসনে যে কয়েকটা ছোটখাট জানালা খোলা হয়েছিল; সেগুলিকে আইয়ুবশাহী এসে শক্ত করে বন্ধ করে দেয়। সোভিয়েট ইউনিয়ন ইতিপূর্বে “জনমত পাবলিকেশনস্‌” নাম দিয়ে প্রচার ভবন খুলেছিল বাংলাদেশের জনৈক ব্যক্তির বরাত দিয়ে। আইয়ুবশাহীর প্রথম কাজগুলির অন্যতম ছিল সেটা তুলে দেওয়া। আইয়ুবশাহী এসেই আরেকটা কাজ করেছিল। ১৯৫৮ সালের প্রথম দিকে মাওসেতুং’এর ‘শত ফুল ফুটতে দাও’ বইটি প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্য এ বইটি অনুবাদ করেন। আইয়ুবশাহীর লোকেরা এই বই এর সমস্ত কপি প্রকাশকের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়। এই সময়েই আইয়ুবশাহী তথা রাওয়ালপিণ্ডি-চক্রের লোকেরা পাবনার একজন কমরেডকে সামরিক আইনে গ্রেপ্তার করার সময় আর্নেস্ট হেমিংওয়ের “হে যুদ্ধ বিদায়” বইটি বাজেয়াপ্ত করে। যুদ্ধবিরোধী বই মার্কসীয় তথা কমিউনিস্ট সাহিত্য হবে, এইটা রাওয়ালপিণ্ডি চক্রের প্রশাসনিক শিক্ষন। ১৯৬৩ সালের একটি ঘটনা। ঢাকার একটি নতুন প্রকাশনালয় থেকে কার্ল মার্কসের জীবনের ওপর ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের লেখা একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। এই পুস্তিকার ওপর কার্ল মার্কসের ছবি ছিল। রংপুরের একজন প্রখ্যাত যুব কমিউনিস্ট সদ্য কারামুক্তির পরে ঢাকা থেকে রংপুর স্টেশনে পৌঁছলে তাঁর কাছে কার্ল মার্কস পুস্তিকাটি পাওয়া যাওয়ায় তাঁকে নিষিদ্ধ বই রাখার দায়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এবং বলা হয়, পাকিস্তানে কার্ল মার্কস চলবে না। রাওয়ালপিণ্ডির কর্তারা বাংলাদেশকে যেহেতু পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসেবে বরাবর দেখে আসছিল, সেজন্য তারা বাংলাদেশকে মার্কসীয় বিপ্লবী চিন্তা ধারার সংস্পর্শ থেকে আরও বেশি করে আলাদা করে রাখতে চেয়েছিল। যে ছাপাখানা থেকে “কার্ল মার্কস” নামক বইটি প্রকাশিত হয়েছিল সেখানে নিরাপত্তা বিভাগীয় লোকেরা এমনভাবে আনাগোনা শুরু করে যে, ছাপাখানার মালিক ভবিষ্যতে আর এরূপ কাজ করবেন না বলে জানাতে বাধ্য হন। লাহোর -করাচি রাওয়ালপিণ্ডির ঔপনিবেশিক কর্তারা বৈদেশিক বাণিজ্যের মারফত বৈদেশিক মুদ্রা বৃদ্ধির তাগিদে রপ্তানি বৃদ্ধির জন্যই সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের সঙ্গে যে সম্পর্ক স্থাপন করে, তাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং গণচীন বাংলাদেশেও কিছু মার্কসীয় সাহিত্য ব্যবসায়িক ভিত্তিতে পাঠাবার সুবিধা পায়। কিন্তু রাওয়ালপিণ্ডি চক্রের চেলাচামুণ্ডারা কখনও তাদের বিরোধিতা গোপন করেনি। তাদের বক্তব্য ছিল, ব্যবসার ফাঁক দিয়ে কিছু কমিউনিস্ট বই আসতে দিতে বাধ্য হলেও জনসাধারণ যাতে সে বই পড়তে না পারে সে ব্যবস্থা তারা করবে। এই কারণেই তারা কমিউনিস্ট তথা মার্কসীয় সাহিত্যের কোন উদ্যোগ বা উৎসাহের দীপশিখা যাতে বাংলাদেশে না জ্বলে উঠতে পারে সেজন্য সর্বদাই মুদ্‌গর হস্তে দণ্ডায়মান থেকে এলোপাতাড়ি বাড়ি মেরেছে।

এহেন অবস্থায় যদি কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিক কৃষক ও ছাত্র এবং যুব আন্দোলন এবং সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে অবিশ্রান্তভাবে ওঠে আসা রাজনৈতিক প্রগতিশীল কর্মী বা ক্যাডারদের মার্কসীয় তত্ত্বগত খোরাক না দিয়ে থেকে থাকে, তবে কেউ কমিউনিস্ট পার্টিকে দুষবে না নিশ্চয়। এ অবস্থায় কৈফিয়তের কথা উঠতে পারে না।

তবু কৈফিয়তের কথা আসে দুদিক থেকে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এই দুটো দিক সম্বন্ধেই ভেবেছে কি সে রকম? এই দুটো দিকই কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ তত্ত্বগত ব্যাপার যার সমাধান রাওয়ালপিণ্ডি চক্রের চরমতম নির্যাতনের মধ্যেও সম্ভবপর ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির তত্ত্ব নির্ণয়ে কেউ কোন অবস্থাতেই বাধা সৃষ্টি ধরে রাখতে পেরেছে কি সাধারণভাবে অন্য কোন দেশে? যে দুটি ব্যাপারের কথা এখানে বলা হচ্ছে তাদের একটি হলো এই যে, মাঝখানে একটা সময়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক কর্মসূচিগত দিকটাকে যতটা ব্যাপকভাবে জনগ্রাহ্য করার চেষ্টা হয়েছে, এর তত্ত্বগত বা ভাবগত বৈপ্লবিক দিকটাকে প্রায় সেই পরিমাণেই পর্দায় ঢাকা দিয়ে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ যে মার্কসীয় তত্ত্বের নিরিখে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে শোষণমুক্ত সমাজের পথকে পরিষ্কারভাবে ব্যাপকতম গণচেতনায় জেগে উঠতে পারে, সেখানেই এসেছে সংকোচ অথবা সংকোচন।

কথাটাকে আরো পরিষ্কার করা যাক

বাংলাদেশকে উপনিবেশে পরিণত করার সুদূরপ্রসারি মতলব নিয়ে করাচি লাহোর রাওয়ালপিন্ডির সামন্তবাদী চক্র যে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের মারফত মধ্যযুগীয় সমাজব্যবস্থার অচলায়তনকে পবিত্র ইসলাম ধর্মের নামে বাংলাদেশের জনগণ মনে অবিশ্রান্তভাবে ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা করে, তাতে সাময়িকভাবে তারা সফল হয়। কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে এতে একটা চিন্তাধারার সৃষ্টি হয় যে, বাংলাদেশে মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা বিরাজ করছে, সুতরাং এখানে প্রথমে যদি বুর্জোয়াদের উদার মতামতগুলোর জায়গা করা যায় তবে তাই যথেষ্ট। অর্থাৎ কমিউনিজমের কথা দূরে থাক, আগে বুর্জোয়া মূল্যবোধই যদি জাগাতে পারা যায়, তবে তাই যথেষ্ট হবে। সুতরাং, মার্ক্সীয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ইত্যাদির জন্যে আগে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দর্শনের জমি তৈরি করাই হবে কমিউনিস্ট পার্টির কাজ। অর্থাৎ পরে সময় এবং অবস্থা বুঝে তিন পা এগোবার জন্য যদি দু’পা পিছোতে হয়, তবে তাও সই।

এই ধরনের প্রবণতা যেখানে প্রাধান্য পেয়েছে, সেখানে আন্দোলনের মধ্যে থেকে উঠে আসা শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের কাছে মার্কসীয় তত্ত্বের খোরাক দেওয়ার তাগিদ কিভাবে আসতে পারে? আসেনি।

একথার কি অর্থ এই যে, কমিউনিস্ট পার্টি তত্ত্বগত দিক দিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে ‘আপটুডেট’ ছিল না? তা নয় কমিউনিস্ট পার্টি তত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছে, আলোচনা করেছে। কিন্তু এ আলোচনা কিংবা পড়াশোনা যে অসংখ্য নবাগতকে কমিউনিস্ট করতে পারতো, তাদের কমিউনিস্ট করতে পারেনি।

বস্তুতপক্ষে পাছে খাঁটি দুধ খেলে পেট খারাপ হয় শিশুর, এই জন্যে দুধে পানি দিয়ে খাওয়াবার ব্যবস্থাপত্র দাখিল করার একটা প্রবণতাকে কমিউনিস্ট পার্টি যথাসময়ে রোধ করতে পারেনি। যারা ন্যায় এবং সত্যের জন্যে বিদ্রোহ করে বাংলাদেশের তথাকথিত দৃঢ়মূল মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণাকে অপসারিত করে বৈজ্ঞানিক বৈপ্লবিক চিন্তাধারার জন্যে আগ্রহী হয়েছে, তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলতে পারেনি কমিউনিস্ট পার্টি। সুতরাং বেশ কিছু শক্তির অপচয় হয়েছে এদিক দিয়ে, একথা বলা চলে।

লেখক:
Ranesh Dashgutta05
রণেশ দাশগুপ্ত, (১৫ জানুয়ারী ১৯১২ – ৪ নভেম্বর ১৯৯৭) বামপন্থী রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক নেতা।

পড়ুন
সাম্যের ঋষি রণেশ দাশগুপ্ত

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট