বাংলাদেশের নাট্যজগৎ: বর্তমান সঙ্কট ও উত্তরণ । রাহমান চৌধুরী

Comments

কিছু কথা কিছু প্রশ্ন

মামুনুর রশীদ ভাইকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম যে, বাংলাদেশের নাট্যজগতের রুচির অবস্থাটা কেমন? কারণ মামুন ভাই শিল্প সাহিত্য জগতের বা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের রুচি নিয়ে মন্তব্য করে থাকেন। সেজন্য তাঁর কাছেই জানতে ইচ্ছা হয়েছিল, নাট্যজগতের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের রুচির অবস্থাটা এখন কীরূপ ধারণ করেছে? নাট্য আন্দোলনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের রুচি নিয়ে তিনি কতোটা সন্তুষ্ট? যাহোক, মামুন ভাই সুযোগ সুবিধামতো উত্তর দেবেন কিংবা দেবেন না।

বাংলাদেশের নাট্যজগতে রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসি মজুমদার, মামুনুর রশীদ, আসাদুজ্জামান নূর, ম. হামিদ, সারা যাকের, নাসির উদ্দীন ইউসুফ উল্লেখযোগ্য নাম। যতোই তাঁদের দোষত্রুটি থাক, স্বাধীনতা পরবর্তী নাট্য আন্দোলনে এঁদের যে অবদান তা কি অস্বীকার করা যাবে? প্রশ্নই ওঠে না। রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসি মজুমদার পূর্ব পাকিস্তানের সময় থেকে নাট্যচর্চা এবং অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন দুজনেই নাটকের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত ছিলেন। ম.হামিদ ভাই হলেন স্বাধীনতার পরপর যে নতুন নাট্যধারার জন্ম হয়, তার পথিকৃত। তাঁর গঠিত নাট্যচক্রের মাধ্যমে এদেশে খ্যাতিমান অনেক নাট্যব্যক্তিত্বের  হাতেখড়ি। যখন ম হামিদ ভাই নাট্যচক্র শুরু করেন তখন শেখ কামালের মতো গুণী মানুষ তাঁর দলে নিয়মিত অভিনয় করতেন। কিন্তু পরে নানা ঘটনায় নাট্যচক্র প্রথমদিকের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু নাট্য আন্দোলনের বা নাট্যচর্চার শুরুতে দলটির যে অবদান তা বাদ দিয়ে বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাস লেখা যাবে না। বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দল হিসেবে আলোচনায় আসবে নাগরিক, থিয়েটার, ঢাকা থিয়েটার এবং আরণ্যকের নাম। সেই সঙ্গে চট্টগ্রামের থিয়েটার’৭৩। চট্টগ্রামের আরো দু একটি দলের নাম আসবে তার মধ্যে তির্যক-এর নাম থাকবে।  ঢাকার বেশ কয়েকটি দলের নাম আসবে। মামুনুর রশীদ আরণ্যকের মাধ্যমে প্রথম ভিন্ন অবস্থান থেকে নাট্যচর্চা শুরু করেন। বাংলাদেশের নাট্যচর্চার দলিলপত্র ঘাঁটলে যা কিছু এ লেখায় আমি বলছি, তা সত্য বলে প্রমাণিত হবে।

বাংলাদেশে রামেন্দু মজুমদার নাট্য পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন যদিও তিনি ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেননি। কিন্তু তাঁর সম্পাদিত “থিয়েটার” পত্রিকা প্রথমদিকের নাট্যচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেই মানের পত্রিকা আর বাংলাদেশে প্রকাশিত হতে দেখা যায়নি। পরে দু-একটা সম্ভাবনাময় পত্রিকা বের হয়েছিল, কিন্তু টিকে থাকতে পারেনি। থিয়েটার বর্তমানে দুর্বল একটি প্রকাশনা হলেও টিমটিম করে জ্বলছে। কিন্তু বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ইতিহাস নিয়ে লিখতে গেলে, গবেষণা করতে গেলে থিয়েটারের প্রথম দিকের সংখ্যাগুলো বাদ দিয়ে তা সম্ভব হবে না। থিয়েটার পত্রিকার সম্পাদক বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। বিশ্ব নাট্যচর্চার আইটিআই এর সর্বময় কর্তার পদে বসেছিলেন।

নাসির উদ্দীন ইউসুফ ঢাকা থিয়েটারের সংগঠক এবং নাট্য নির্দেশক হিসেবে সারাদেশের নাট্যাঙ্গনে  আলোচিত। তিনি গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন এর সেক্রেটারি জেনারেল এবং চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলাদেশের অনেকগুলো আলোচিত নাটকের তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি এ পর্যন্ত কতো নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন তা হঠাৎ করে গুনে বলা যাবে না। আসাদুজ্জামান নূর বাংলাদেশের মঞ্চের শ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের একজন। তিনি সেইসঙ্গে একজন নাট্যনির্দেশক এবং নাটকের আনুবাদক। শুরুর দিকে নাট্যসমালোচনা লিখতেন। ফেরদৌসি মজুমদার সম্মানিত এ কারণে যে, যখন সাধারণত মঞ্চে নারীরা অভিনয় করার অনুমতি পেতেন না, তিনি তখন মঞ্চে অভিনয় করতে আরম্ভ করেছিলেন। পরে তিনিই মঞ্চের প্রধান অভিনেত্রীদের একজন হয়ে ওঠেন। সারা যাকের স্বাধীনতার পরপর মঞ্চে অভিনয় করে সারা ফেলে দিয়েছিলেন। মামুনুর রশীদ বাংলাদেশের মঞ্চের প্রধান ব্যক্তিত্ব। কারণ তিনি নাটক লিখেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন, সেইসঙ্গে নিজে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন। মামুনুর রশীদের নাটক রচনা এবং নির্দেশনার সংখ্যা অনেক। তিনি অনেক অভিনেতা অভিনেত্রীকে গড়ে তুলেছেন। বাংলাদেশে মামুনুর রশীদকে চেনেন না এমন লোক বিরল। কারণ তাঁর নানা বিষয়ে কর্মযজ্ঞ তাঁর নাম বহু মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। তিনি হীরার চামচ নিয়ে জন্মাননি, বহুমাত্রিক কাজের ভিতর দিয়ে তাঁর আসন তৈরি করে নিয়েছেন।

যাঁদের নাম উল্লেখ করলাম, তাঁদের কি সমালোচনার জায়গা নেই? অবশ্যই আছে। সমালোচনার উর্ধ্বে কেউ নন। কিন্তু বাংলাদেশের গত পঞ্চাশ বা বায়ান্ন বছরের নাট্যজগতে তাঁদের অবদান কি অস্বীকার করার সুযোগ আছে? বাংলাদেশের মঞ্চনাট্য চর্চায় তাঁরাই যে অগ্রণী এটা বলা কি মিথ্যা হবে? নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে আরো তরুণকর্মীরা নানারকম অবদান রেখেছেন। নাট্য নির্দেশনা এবং নাট্য রচনায় এবং অভিনয়ে কেউ কেউ আগের প্রজন্মকে ছাড়িয়ে গেছেন এটাও সত্য । কিন্তু সেই প্রজন্মের গুণী নাট্যকর্মীরা আজও তাঁদের পথপ্রদর্শকদের সম্মান করে চলেন। সমালোচনা থাকতে পারে কিন্তু সম্মান করেন। বর্তমান রচনার শুরুতে যাঁদের নাম উল্লেখ করলাম তাঁদের বাদ দিয়ে বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ইতিহাস লেখা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশের নাট্যচর্চার সঙ্গে বহু মানুষ যুক্ত আছেন যাঁদের নাম বাদ নাট্য ইতিহাস লেখা যাবে। কারো কারো নাম ইতিহাসে থাকবে নাট্যচর্চার বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য ।

নাট্যচর্চার সঙ্গে পরের প্রজন্মে অনেক নাট্যব্যক্তিত্ব যুক্ত আছেন তাঁদের নাম এখানে উল্লেখ করলাম না। কিন্তু বাংলাদেশের মঞ্চ নাট্যচর্চার ভিতরে যে কিছু উটকো লোক ঢুকে পরেছে, সেটা মামুনর রশীদ এতদিন পরে হলেও স্বীকার করেছেন। যদি তিনি বা তাঁরা এটা আরো আগে দেখতে পেতেন বা বলতে পারতেন , তাহলে নাট্যচর্চার ধারাটা সঠিক পথে আরো বহুগুণ বেগবান হতো। মামুন ভাই যাদের এখন উটকো বলেছেন, এক সময়ে মামুন ভাইরা এইসব উটকোদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। মামুন ভাই নিজেও তাঁদের এই ভুল স্বীকার করেন। কারা এইসব উটকো লোক? যারা না নাট্যকার, না নির্দেশক, না অভিনেতা কিন্তু নাট্যাঙ্গনে আছেন। কিংবা যারা কিছু সস্তা নাটক মঞ্চে এনে নাট্যকর্মী সেজেছেন এবং নাট্যজগতের নেতা সেজে বসেছেন সেই মানুষগুলোই উটকো। কারণ সত্যিকারের নাট্যচর্চা কী সেটাই তাঁরা বোঝেন না। চল্লিশ বছর ধরে এদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে নাট্যজগতে। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন নামক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সবসময় এরা নাট্যজগতে স্থান করে নিয়েছে নাট্যবিষয়ে কোনোরকম পারদর্শিতা ছাড়া। চল্লিশ বছর আগে এই বীজ রোপিত হয়েছিল, এখন বাড়তে বাড়তে সেই বীজ মহীরুহ আকার নিয়ে আসল নাট্যব্যক্তিদের গিলে ফেলতে চাইছে। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন এর গঠনতন্ত্রের মধ্যেই এই বীজ বা দুর্বলতাগুলো লুকিয়ে ছিল।

গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন ছিল কতোগুলো নাট্যদলের প্রতিনিধিদের তৈরি, নাটকের গুণীজনদের সংগঠন ছিল না। সেই কারণে মামুন ভাই যা আজকে বলছেন, সেইরকম উটকো দলের উটকো সদস্যরা এর প্রতিনিধি হতে পেরেছিল। যদি কেউ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন এর ইতিহাসের দিকে তাকান দেখবেন, বহু দল বছরের পর বছর নাটক না করে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন এর সদস্য থেকে যাচ্ছে। নাট্য ব্যক্তিত্বরা অনেকে এদেরকে ভোট বাক্স মনে করে ফেডারেশন থেকে বাদ দেননি। শুধু তাই নয়, সেইসব অযোগ্যদের নিয়ে প্যানেল গড়েছেন নিজেরা ক্ষমতা লাভের জন্য। এভাবে নোনাজল ঢুকে পড়েছিল ফেডারেশন এ, আর নোনাজলের হাতেই ক্ষমতা চলে গিয়েছিল। মাথার উপর সর্বোচ্চ পদে কখনো কখনো গুণীজনরা থাকলেও, নীচের দিকে সবসময় নাট্যচর্চা বোঝেন তেমন লোকদের ঠাঁই হয়নি। সেটাই তো গত বহু বছর ধরে সঙ্কট হিসেবে সামনে আসছে।  মাথার উপরেও পরবর্তীতে আর তেমন গুণীজনরা ছিলেন না। যাঁরা দু চারজন ছিলেন তাঁদের মর্যাদা ছিল না উটকোদের কাছে। ফলে পরিস্থিতি এমন তৈরি করা হয়েছে এখন, রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, নাসির উদ্দীন ইউসুফ প্রমুখকে নাট্যকর্মী হবার সনদপত্র নিতে হবে গ্রুপ থিয়েটারে ফেডারেশনের চেয়ারম্যানসহ কিছু উটকো লোকের কাছ থেকে! সবাই যখন চেয়ারম্যানের বক্তব্যের পর হাততালি দিয়ে তা স্বাগত জানায় তখন ঘটনা দাঁড়ায় এই যে, রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, নাসির উদ্দীন ইউসুফ প্রমুখ নাটক বোঝেন না, নাটক বোঝেন কেবল ফেডারেশনর চেয়ারম্যানের ভক্ত বা অনুসারীরা।

বর্তমানে যা খবরে দেখছি, তাতে বুঝতে পারছি অনেকে ফেডারেশন ছেড়ে এসে রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, মোহাম্মদ বারী প্রমুখের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। যাঁরা যোগ দিয়েছেন তাঁরা নাট্যচর্চার সঙ্গে বহুদিন যাবত জড়িত এবং নাটক রচনা, নির্দেশনা, আভিনয়ের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে অবদান রাখছেন। যেমন মলয় ভৌমিক এবং আহমেদ ইকবাল হায়দার। ফেডারেশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য বাংলাদেশের নাট্যচর্চা ধ্বংস করা। কথাটা সঠিক ধরে নিতে চাইলেও পারছি না। কারণ খোলা চোখে দেখতে পাচ্ছি, যাঁরা নাট্যচর্চা করেন তাঁরাই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। সেই কারণে জানতে ইচ্ছা করছে ফেডারেশনের ভিতরে কারা আছেন, যাঁদের নাট্যচর্চায় অবদান আন্দোলনকারীদের চেয়ে বেশি? ফেডারেশনের ভিতরে কারা আছেন যাঁরা আন্দোলনকারীদের চেয়ে  নাট্যজগতের বড় নাট্য ব্যক্তিত্ব? তাঁদের নামগুলো জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি ।

শুনতে পাচ্ছি ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত আছে নাকি তিনশো নাট্যদল। জানতে ইচ্ছে করে তাদের কোন্ দলের কয়টা নাটক আছে যা বাংলাদেশের নাট্যজগতের আলোচিত? তিনশো দলের কজন ব্যক্তি নাট্যব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃত? তিনশো সদস্য দলের কি একটা করে তিনশো আলোচিত নাট্য প্রযোজনা আছে? নামে নাট্যদল কিন্তু নাটকই নাই এমন নাট্যদল গ্রুপ থিয়েটারে সদস্য হতে পারে কি? গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন এর নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটা দলের বছরে তিনটি করে নাট্য প্রযোজনা থাকার কথা। প্রতিটা দলের গত চার বছরে ন্যূনতম বারোটা প্রযোজনা আছে কি? সেগুলো কি মানসম্মত? ভিন্ন দিকে যাঁরা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত তাঁদের দলের নাট্য প্রযোজনার একটা তুলনামূলক আলোচনা হতে পারে। গত দশ বছরে নাট্যাঙ্গনের কারা নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে দল এবং ব্যক্তি হিসেবে আলোচিত? গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের কমিটিতে এই মুহূর্তে যুক্ত কজন নাট্যব্যক্তিত্ব আছেন, যাঁরা নাটক রচনা, নির্দেশনা এবং অভিনয়ের ক্ষেত্রে বা নাট্যগবেষণায় অবদান রেখেছেন? দু পক্ষের পরিসংখ্যান কেউ দেবেন কি? যদি কারো কাছ পাই তাঁকে ধন্যবাদ জানাবো।

নাট্যচর্চার সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে হলে

বাংলাদেশের নাট্যজগতের বর্তমান সঙ্কট উত্তরণে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন এর সঙ্গে আর আলোচনার সুযোগ নেই। নানাভাবে আবেদন নিবেদন করা বন্ধ করতে হবে। যা করা দরকার তা হলো সার্বিকভাবে নাট্যচর্চার অগ্রগতির জন্য নতুন কর্মসূচী গ্রহণ। গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন, কর্মের মধ্যে দিয়েই মানুষের আসল পরিচয় ঘটে। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচীর পরিবর্তে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাটাই হবে বর্তমান সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার বাস্তবসম্মত ব্যবস্থাপত্র। শত্রু পক্ষকে ধরাশায়ী করতে সেজন্য উচিত হবে, বিপরীত পক্ষের মতো কিংবা অতীত দিনের মতো বড় বড় গলাবাজী না করে বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ মাথায় রেখে বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার পক্ষে নাটক করে যাওয়া। দুর্বোধ্য নয়, সহজবোধ্য মানবিক নাট্যমঞ্চায়ন দিয়ে মঞ্চগুলোকে প্রতিদিন ব্যস্ত রাখা। নাট্যচর্চার জোয়ারে নাট্যকর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করা। দর্শকের সামনে নতুন নতুন বুদ্ধিদীপ্ত নাটক উপস্থাপন করে তাঁদের চিন্তার জগতকে উদ্ভাসিত করা। কথার চেয়ে কর্মকাণ্ডের ব্যাপকতা চাই সেইজন্য। সেটা করা গেলেই শত্রুপক্ষ দুর্বল হয়ে পড়বে। বৃহত্তর দর্শকসমাজ মূলধারার নাট্যকর্মের সঙ্গে আরো বেশি যুক্ত হবে। নাটক প্রদর্শনের মাধ্যমে দর্শকের মাথায় চিন্তার খোরাক জোগাতে হবে, সেইসঙ্গে বিনোদন থাকবে। নাট্য প্রযোজনায় সস্তা বিনোদনের জায়গায় সৃষ্টিশীল বিনোদনকে স্থান দিতে হবে। বার্টোল্ট ব্রেখট বলেছিলেন, নতুনচিন্তা উপস্থাপন করতে পারার মধ্যেও থাকে বিনোদন। গ্রন্থপাঠে মানুষ সেভাবেই বিনোদন লাভ করে। সকলরকম সৃষ্টিশীলতার মধ্যেই থাকে সত্যিকারের বিনোদন। সৃষ্টির আনন্দই মানুষকে সবচেয়ে বেশি বিমোহিত করে। নতুন সন্তানের কান্নার ভিতর দিয়েই মানুষ সবচেয়ে বড় আনন্দ পেয়ে থাকে। ফলে জোর করে কাতুকুতু দিয়ে সত্যিকারের বিনোদন সৃষ্টি করা যায় না। বিনোদন সৃষ্টিশীলতা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।

নাটক রচনা এবং মঞ্চায়নের সময় প্রাচীন গ্রিক নাটক, প্রাচীন ভারতীয় নাটক, শেক্সপিয়ার, ইবসেন, লিও টলস্টয়, চার্লি চ্যাপলিন, রবীন্দ্রনাথ, পিসকাটর, ব্রেখট, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত প্রমুখ ব্যক্তিদের চিন্তাচেতনাকে মাথায় রাখা দরকার। ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন এভাবেই জ্বলে উঠুক। যারা নিজেদের খামখেয়াল আর স্বার্থান্ধ হয়ে চলতে চায় তাদের সঙ্গে অকারণ তর্কে লিপ্ত হওয়ার দরকার কী। তাতে অযথা সময় নষ্ট হবে। নিজেদের চলার পথ নিজেদের মতো করেই তৈরি করে নিতে হবে। নাট্যচর্চার জগতে যদি কেউ বিরোধ করতে চায়, হোক বিরোধ নাট্য মঞ্চায়ন দিয়ে। সামগ্রিক নাট্যচর্চার বিজয়ের মধ্য দিয়ে তাদের পরাজিত করতে হবে। সৎ নাট্যকর্মীদের নাট্যচর্চা আর নাট্যমঞ্চায়নের জোয়ারে কুচক্রীরা ভেসে যাবে। নতুন করে আর আপসরফায় বসার দরকার নেই। নিজেদের ঐক্য আর সার্বিক শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। কারো মুখাপেক্ষী থাকার দরকার নেই। স্মরণ রাখতে হবে, কবিয়াল মুকুন্দ দাশ কোনো সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের অনুদান নিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নিজের গানকে জনপ্রিয় করেননি। সারাদেশের মানুষের মধ্যে যখন তাঁর গান জাগরণ তৈরি করেছিল, তখন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বলে কিছু ছিল না। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের অনুদানের উপর নির্ভর করে পৃথিবীর প্রথম চলচ্চিত্রগুলো তৈরি হয়নি। গণনাট্য সংঘ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার উপর নির্ভর করে চলেনি, নির্ভর করেছে গণমানুষের উপর। মার্লো, শেক্সপিয়ার, ইবসেনের নাট্যচর্চা সাফল্য পেয়েছে দর্শকদের পৃষ্ঠপোষকতায়। যুক্তরাষ্ট্রের ‘গ্রুপ থিয়েটার’ নাটক মঞ্চায়নের জন্য সরকারের দয়াদাক্ষিণ্য নেয়নি। দর্শকের মন জয় করে টিকে থেকেছে। লালনের গান সৃষ্টিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজন হয়নি। মহৎ নাট্যব্যক্তিত্বরা নিজেদের প্রতিভার উপর নির্ভরশীল ছিলেন। প্রতিভা ছাড়া নাট্যচর্চা হবে না। শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতের জগতে চাই প্রতিভা প্রতিভা আর প্রতিভা, চাই বুদ্ধিমত্তা। চাই আন্তরিকতা, চাটুকারিতা নয়।

লেখক পরিচিতি:
রাহমান চৌধুরী, লেখক, শিল্প সমালোচক
Raahman Chowdhury

*প্রকাশিত লেখার মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই এখানে প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট