।। সাগর লোহানী ।।
একটি দেশের প্রাথমিক পরিচয় তার পতাকায়। আর দেশের প্রাথমিক প্রচার তার ডাকটিকিটে। ১৯৭১ সালে যখন গোটা জাতি তার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে জীবন বিসর্জনের প্রতিযোগিতায় রত যখন বিশ্বের জনগণের কাছে দেশের নাম প্রচার ছিল সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তখনই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের বিচক্ষণ সিদ্ধান্তে ব্রিটিশ লেবার পার্টির পার্লামেন্ট সদস্য এবং মন্ত্রী জন স্টোনহাউসের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত আগ্রহে ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই ৮টি ডাকটিকিট প্রকাশ পায়।

বাংলাদেশের প্রথম প্রকাশিত আটটি ডাকটিকিট
২৪ এপ্রিল, ১৯৭১ ভারতে আশ্রয় নেয়া পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের দেখতে যান ব্রিটিশ লেবার পার্টির এমপি জন স্টোনহাউস ও ব্রুস ডগলাসম্যান । সে সফরেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সাথে দেখা করে স্বাধীন বাংলার অস্থিত্ব প্রচারে ডাক টিকেট প্রকাশের প্রস্তাব করেন স্টোনহাউস। মন্ত্রী পরিষদের সাথে আলোচনার পর জন স্টোনহাউসকে ডাকটিকেট প্রকাশের দায়িত্ব ও মুজিবনগর সরকারের সিলমোহর সম্বলিত অনুমতিপত্র দেন তাজউদ্দিন। তাজউদ্দিন আহমদের সম্মতিতে জন স্টোনহাউস তাঁর পূর্ব পরিচিত লন্ডন প্রবাসী ভারতীয় বাঙালী গ্রাফিক্স শিল্পী বিমান মল্লিকের শরণাপন্ন হন ২৯ এপ্রিল। বিমান মল্লিক সানন্দে এই ডাকটিকিটের নকশা করে দিতে সম্মত হন। এরপর ৩ মে হাউস অফ কমন্সে বিমান মিলিত হন স্টোনহাউসের সঙ্গে, এই সভায় উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।
দেড় মাসের চেষ্টায় বিমান মল্লিক তৈরী করলেন বাংলাদেশের প্রথম ৮টি ডাকটিকিটের নকশা। কাজটা খুব সহজ ছিল না কারণ বাংলাদেশ সরকারের কোন নির্দেশনা বা concept না থাকায় গবেষণার কাজটিও করতে হয় বিমান মল্লিককেই। যাই হোক নকশা তো হল এবারে বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন পেতে হবে। দায়িত্ব নিয়ে ব্রিটিশ সাহায্য সংস্থা ‘War on Want’ এর প্রধান ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ কলকাতায় এলেন। একটিতে বাংলাদেশের পতাকা, দুটিতে মানচিত্র, একটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ত ঝরার প্রতীক, একটিতে ব্যালট বাক্স, একটিতে ছেড়া শেকল, একটিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি এবং একটিতে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর প্রতীক সম্বলিত ৮টি ডাকটিকিটের মূল নকশার অনুমোদন দিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। লন্ডনের ফরম্যাট ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রেস থেকে টিকিট ছাপা হল স্টোনহাউসের সহায়তায়।

২৬ জুলাই হাউস অফ কমন্সের এর হারকোর্ট রুমে
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ২৬ জুলাই House of Commons এর হারকোর্ট রুমে সাংবাদিকদের সামনে উন্মোচন করলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ৮টি ডাকটিকিট আর ফার্স্ট ডে কভার। ২৯ জুলাই একই সঙ্গে লন্ডন ছাড়াও কলকাতা, বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইসরায়েল, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ দূরপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ পেল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট।

১ আগষ্ট ট্রাফালগার স্কোয়ারে
আটটি ডাকটিকিটের সেটটির মূল্য ছিল এক পাউন্ড নয় পেন্স। ডাক টিকিটগুলো ১০ পয়সা, ২০ পয়সা, ৫০ পয়সা, ১ রুপি, ২ রুপি, ৩ রুপি, ৫ রুপি ও ১০ রুপি অনুসারে মূল্যমান নির্ধারণ করা হয়। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট ব্রিটেনের ট্রাফালগার স্কয়ারে বিমান মল্লিক জন স্টোনহাউসসহ অসংখ্য গণ্যমান্য অতিথি, প্রবাসী বাঙালি ও ব্রিটিশ নাগরিকের উপস্থিততে হাত উঁচিয়ে বাংলাদেশের আটটি ডাকটিকিট তুলে ধরলেন।
কে এই বিমান মল্লিক? বাংলাদেশের জনগণ কি চেনেন তাঁকে? জানেন তাঁর পরিচয়? কলকাতার হাওড়াতে বিমান চাঁদ মল্লিক পিতা অজিত কুমার মল্লিক এবং মাতা সারদা দেবীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৩ খৃষ্টাব্দের ১৭ ডিসেম্বর। এগারো ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দশম। লন্ডনের সেন্ট মার্টিন স্কুল অব আর্টে চার বছর মেয়াদি ডিজাইনের কোর্স সম্পন্ন করেন মল্লিক। ১৯৬৫ সালে কাজ শুরু করে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসে। প্রথম ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড হার নেইবারস ‘ বইটির ডিজাইনের জন্য সে সময়ের বিপুল অংকের সম্মানী পেলেন।

বিমান মল্লিক
১৯৬৯ সালে মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে ব্রিটিশ সরকার স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। আর এই ডাকটিকিটের নকশা করে আলোচনায় আসেন বিমান মল্লিক। তিনিই প্রথম এবং একমাত্র ভিনদেশি, যিনি ব্রিটিশ ডাকটিকিটের নকশা করেছেন। বিমান মল্লিক একাধারে গ্রাফিক্স ডিজাইনার, চিত্রকর, সমাজসচেতন মানুষ ও একজন ম্যারাথন দৌড়বিদ। ২৭ মার্চ ২০১২ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখায় বিমান মল্লিককে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করে। তিনি ১৯৬০ থেকে ইংল্যান্ডেই থাকছেন স্ত্রী অপরাজিতা ও একমাত্র মেয়ে সান্দ্রাসহ।
আর জন স্টোনহাউস, ১৯২৫ সালের ২৮ জুলাই ব্রিটেনের সাউদাম্পটনে জন্মগ্রহণ করেন জন থমসন স্টোনহাউস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রয়্যাল এয়ারফোর্স-এর বিমানযোদ্ধা মাত্র ৩২ বছর বয়সে লেবার পার্টির এমপি হন। জন স্টোনহাউস এভিয়েশন মিনিস্ট্রার, পোস্টমাস্টার জেনারেল এবং সবশেষে ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী।

জন স্টোনহাউস
১৯৭৪ সালে নিজের মৃত্যু নিয়ে প্রতারণা ও আর্থিক জালিয়াতির মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। শোনা যায় তিনি ১৯৬২ সাল থেকে চেকস্লোভাকিয়া মিলিটারীর চর হিসেবে ব্রিটিশ তথ্য পাচারে জড়িত ছিলেন। প্রমাণের অভাবে বেশীদিন জেল খাটেননি তিনি। ১৯৮৮ র ১৪ এপ্রিল ব্রিটেনে নিজ বাসায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান ৪টি নভেলের রচয়িতা, বিতর্কিত রাজনীতিক জন স্টোনহাউস।

বাংলাদেশের প্রথম প্রকাশিত আটটি ডাকটিকিট
ইন্টারন্যাশনাল পোস্টাল ইউনিয়নের সদর দপ্তরে পাকিস্তান অভিযোগপত্র দিল যে এই টিকিটগুলো বেআইনি, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অযোগ্য। কিন্তু অভিযোগ ধোপে টিকলো না। এক্ষেত্রেও পাকিস্তানী ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিঁড়ে দুই বিদেশী জন স্টোনহাউস ও বিমান মল্লিকের আন্তরিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ পেলো তার প্রথম ফিলাটেলিক পরিচয়, ৮টি ডাকটিকিট।